চতুর্থ প্রজন্মের ৬ ব্যাংকে ৬ হাজার কোটি টাকা উদ্ধৃত্ত তারল্য
- আপডেট সময় : ০৭:৫৬:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর ২০২৪ ১৩৭ বার পড়া হয়েছে
চতুর্থ প্রজন্মের দুই-তৃতীয়াংশ ব্যাংকের হাতেই বর্তমানে উদ্বৃত্ত তারল্য বা ব্যয়যোগ্য অতিরিক্ত অর্থ রয়েছে। দেশের আর্থিক খাতে নগদ অর্থের তীব্র সংকটের মাঝে এই ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্য থাকার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ৬টি ব্যাংকের এখন উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, নিজেদের প্রয়োজনের বেশি নগদ অর্থ হাতে থাকায় এই পরিমাণ বাড়তি অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রেখেছে আলোচ্য ছয়টি ব্যাংক। যে কারণে আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকিমুক্ত অবস্থানে থাকার পাশাপাশি দৈনন্দিন লেনদেনও সাবলিলভাবে করতে পারছে ব্যাংক ছয়টি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ৪৫০ কোটি অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে এনআরবিসি ব্যাংকে।
২০১৩ সালে অনুমোদন পাওয়া ৯টি ব্যাংকই মূলত দেশের চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত। এগুলোর মধ্যে পদ্মা ব্যাংকে (সাবেক ফার্মার্স) চরম লুটপাট চালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দীন খান আলমগীর। পাশাপাশি ইউনিয়ন ব্যাংক ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলেছে এস আলম গ্রুপ। এই ব্যাংক তিনটি থেকে আমানতকারীরা টাকা তুলতে পারছেন না। এগুলোর বাইরে বাকি ছয়টি ব্যাংক এখনও বড় কোনও সংকটে পড়েনি। কেবল এনআরবিসি ব্যাংক উদ্যোক্তা পরিচালকদের লুটপাটে কার্যক্রম শুরুর পরপরই বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিল। তবে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিয়ে পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেওয়ার পর ঘুরে দাঁড়িয়েছে এনআরবিসি।
চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর আগস্ট ভিত্তিক তারল্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এনআরবিসি, মেঘনা, মিডল্যান্ড, এনআরবি, মধুমতি ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল এন্ড কমার্স ব্যাংকে (এসবিএসি) উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সর্বোচ্চ ৯৫০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে মিডল্যান্ড ব্যাংকের। ৮৫০ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে মেঘনা ব্যাংকের। এনআরবি ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য ২০০ কোটি টাকা। এছাড়া মধুমতি ব্যাংকের ৮৩০ কোটি টাকা এবং এসবিএসি ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমান ৫০০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ছয় ব্যাংকে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা।
এনআরবিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল বলেন, কয়েকটি ব্যাংকে তারল্য সংকট থাকলেও বেশিরভাগেই অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। নতুন ৯ ব্যাংকের মধ্যে ৬টিতেই অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। এর মধ্যে এনআরবিসি ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, এনআরবিসি ব্যাংক ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ ব্যাংক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে ব্যতিক্রমী সেবামূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে। একক গ্রাহককে অতিরিক্ত ঋণ না দিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ছোট ছোট উদ্যোক্তার এসএমই ঋণ বিতরণে বেশি ভূমিকা রাখছে ব্যাংকটি। ফলে গ্রাহকের আমানতও সুরক্ষিত থাকছে।
তিনি আরও বলেন, ব্যাংক পরিচালনার মূলনীতি-কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিবিধান সঠিকভাবে পরিচালন করা। আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সিআরআর এসএলআর যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে। ভবিষ্যতের ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে সব ব্যাংকই তার নীতি অনুযায়ী অতিরিক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করে। যেসব ব্যাংক আমানতের সুরক্ষা দেয়, সেসব ব্যাংকে আমানত বাড়ছে। হাতে গোনা কয়েকটি ব্যাংক সমস্যায় আছে, তারা তারল্য সহায়তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে এমন ১০টি ব্যাংক তাদের অর্থ সহযোগিতা করছে। যার গ্যারান্টি দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আশা করছি সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর সমস্যা কিছুদিনের মধ্যেই সমাধান হয়ে যাবে।
নির্বিঘ্ন দৈনিন্দিন লেনদেন :
নগদ টাকার সংকট না থাকায় নির্বিঘেœ দৈনন্দিন লেনদেন করতে পারছেন এই ছয় ব্যাংকের গ্রাহকরা।
রবিবার এসবিএসি ব্যাংকের বনানী শাখা ঘুরে দেখা গেছে, শাখায় টাকার জন্য আসা প্রত্যেক গ্রাহকই প্রয়োজন অনুযায়ী টাকা তুলতে পারছেন। শাখার ব্যবস্থাপক এসইভিপি মোহাম্মদ আসাদুল হক বলেন, আমাদের কোনও গ্রাহককে টাকা দিতে সমস্যা হচ্ছে না। বড় অংকের চেকও আমরা নিষ্পত্তি করতে পারছি। বৈদেশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রমও স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
মতিঝিলে অবস্থিত এনআরবিসি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা ঘুরেও একই চিত্র মিলেছে। গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় অংকের টাকা তুলতেও কোনও সমস্যা হচ্ছে না।
টাকা তুলতে আসা বর্ণ শিখা অফসেট প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্ত্বাধিকারী মোহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, আমি গত ২০২১ সাল থেকে এনআরবিসি ব্যাংক থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছি । আমি এখন পর্যন্ত এই ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। বর্তমানেও চাহিদা অনুযায়ী টাকা উত্তোলন করতে পারছি।
এনআরবিসি ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখার ব্যবস্থাপক এসভিপি আব্দুল আউয়াল মিয়া বলেন, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে তারল্য ব্যবস্থাপনা করছে এনআরবিসি ব্যাংক। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ প্রদানে কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমাদের ব্যাংক থেকে গ্রাহক যেকোন পরিমান অর্থ তাৎক্ষনিকভাবে উত্তোলন ও স্থানান্তর করতে পারছেন।
যে কারণে সাফল্য :
আলোচ্য ছয়টি ব্যাংকের চলতি বছরের আগস্টের আর্থিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলো ভালো আমানত সংগ্রহ করলেও আগ্রাসী ব্যাংকিং করেনি। যে কারণে এগুলোর ঋণ-আমানতের অনুপাত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেধে দেওয়া সীমার নিচে রয়েছে। এতে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে ব্যাংকগুলোতে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণের হারও তুলনামূলক কম এই ছয় ব্যাংকে।
বর্তমানে এনআরবিসি ব্যাংকের সংগৃহীত আমানতের পরিমাণ ১৭ হাজার ১১৬টি কোটি টাকা। এর বিপরীতে ঋণ বিতরণ করেছে ১৪ হাজার ১৬০ কোটি টাকা। ব্যাংকটি ঋণ-আমানতের অনুপাত ৮২ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
এসবিএসি ব্যাংক ১০ হাজার ২শ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিরতণ করেছে। ব্যাংকটির আমানতের বিপরীতে বিতরণকৃত ঋণের অনুপাত ৮৪ শতাংশ।
মোঘনা ব্যাংকে বর্তমানে ৭ হাজার ৯শ কোটি টাকা আমানত রয়েছে। এর মধ্যে ঋণ বিতরণ করেছে ৬ হাজার ৩শ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ঋণ-আমানত অনুপাত বেশ কম, ৮০ শতাংশ।
প্রায় ৭ হাজার ৮শ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে মধুমতি ব্যাংক। ব্যাংকটির ঋণ-আমানতের অনুপাত ৮৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এনআরবি ব্যাংক প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে। বিপরীতে ঋণ বিরতণ করেছে ৫ হাজার ৯শ কোটি টাকা। ঋণ-আমানতের অনুপাত ৮৫ শতাংশ।
মিডল্যান্ড ব্যাংকে গ্রাহক আমানত রেখেছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ঋণ বিতরণ করেছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। প্রায় ৮৫ শতাংশ ঋণ-আমানতের অনুপাত।
এই ছয়টি ব্যাংকের সংগৃহীত মোট আমানতের পরিমাণ ৫৬ হাজার ৫শ কোটি টাকার বেশি। বিপরীতে বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ৪৬ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। ছয় ব্যাংকের গড় ঋণ-আমানত অনুপাত বা এডি রেশিও ৮৩ শতাংশের কম।
উদ্বৃত্ত তারল্য কী :
আমানতকারীদের জমাকৃত অর্থ দিয়েই ব্যাংকগুলোর দৈনিন্দিন অর্থিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের জারিকৃত বিধিমালা অনুসারে, সংগৃহীত আমানতের পুরোটা ঋণ হিসেবে বিতরণ করা যায় না। আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তার স্বার্থে একটি নির্দিষ্ট অংশ বিধিবন্ধ সঞ্চিতি হিসেবে (সিআরআর ও এসএলআর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক। ২০২০ সালের এপ্রিলে জারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার মোতাবেক, প্রচলিত ধারা ব্যাংকের জন্য এই হার ১৩ শতাংশ এবং ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য এই হার ৮ শতাংশ। সিআরআরের অর্থ নগদ টাকায় এবং এসএলআরের অর্থ দিয়ে সরকারি ট্রেজারি বিলবন্ড কিনে রাখতে হয়। আর্থিকভাবে শাক্তিশালী ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই বেধে দেওয়া হারের অতিরিক্ত অর্থ জমা রাখে। অতিরিক্ত জমার পরিমাণকে উদ্বৃত্ত তারল্য বলে। যে ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য যতবেশি, ওই ব্যাংকে আমানতকারীদের অর্থ ততটা নিরাপদ।
ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো মূলত চলে জনগণের জমানো আমানতের অর্থ দিয়ে। সংগৃহীত আমানত আবার উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়। ঋণের বিপরীতের আদায়কৃত সুদ এবং কমিশন ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস। এই আয় থেকে আমানতের বিপরীতে সুদ বা মুনাফা প্রদান, ব্যাংকের দৈনন্দিন খরচ মেটানো সহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদান করে বছরশেষে মুনাফা করে থাকে ব্যাংক। মুনাফার অর্থই শেয়ারধারীদের মাঝে ডিভিডেন্ট হিসেবে বণ্টন করা হয়। আমানতকারীদের অর্থ দিয়েই যেহেতু সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয় তাই এই অর্থের সুরক্ষা দিতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি রাখতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী দেশের অধিকাংশ ব্যাংকের উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। ৬২টি ব্যাংকের মধ্যে চলতি বছরের আগস্ট শেষে দেশের সরকারি-বেসরকারি ৪৬ ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে, যার পরিমাণ এক লাখ ৯০ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আলী রেজা ইফতেখার বলেন, দেশের বেশিরভাগ ব্যাংকেই তারল্য সমস্যা নেই। বেসরকারি প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ ব্যাংকেই অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে।