এবারে বিএনপি’র জোট গঠনের মালমসলা আগের চেয়ে আলাদা বলেই মনে হচ্ছে। আপাতত গণসংহতি আন্দোলন ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নামে দুটি মধ্যবাম দলের সঙ্গে তাঁদের ইস্যুভিত্তিক সমঝোতা হয়েছে। অর্থাৎ মধ্যডান বিএনপি আরও ডানপন্থীদের সঙ্গে জোট গড়ার চেয়ে মধ্যবামদের প্রতিই আগ্রহী। এই মধ্যবামদের সঙ্গে আবার রেজা-নুরুদের মধ্যডান গণ অধিকার পরিষদসহ নাগরিক ঐক্য ও গণফোরামের মতো মধ্যপন্থীদেরও মেলামেশা আছে। কিন্তু এই জোটের পরিণতিও যতটা গর্জায় ততটা বর্ষায় কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকছে। সন্দেহের জন্য দুটি কারণই যথেষ্ট।
প্রথমত, এটা কি নির্বাচনী জোট, নাকি আন্দোলনের জোট? বাংলাদেশের ইতিহাস দেখায়, গণ-আন্দোলনে জয়ী না হয়ে কেউ সুষ্ঠু নির্বাচনেও জয়ী হয় না। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে বিজয়ীরাই ৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। ৯০-এর গণ-আন্দোলনে সবচেয়ে আপসহীনেরাই ’৯১ সালে সরকার গঠন করেছে। এখন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের যে লক্ষ্য বিএনপি নিয়েছে, সে জন্য তাদের আগে মাঠের আন্দোলনে জয়ী হতে হবে। সেই লক্ষ্য হাসিলে ছোট বাম দলগুলো তেমন ভরসা হবে না। হওয়ার কথাও না। বিএনপি নেতৃত্ব নিশ্চয় সেটা বোঝেন। দ্বিতীয়ত, বিএনপি কোনো কারণে নির্বাচন বর্জন করলে কি জোটের বন্ধুরাও চূড়ান্ত পথ নিতে রাজি থাকবেন? নাকি তখন বিএনপিকে আবারও একাই লড়াই করে মার খেতে হবে? এ দুটি বিষয়ে উত্তরটা ভবিষ্যতের খাতাতেই তোলা থাকুক।
রাজপথের আন্দোলনে বিএনপির দরকার জামায়াত বা জাতীয় পার্টির মতো সঙ্গীদের। এদের কিছু ভোট রয়েছে, কিছু কিছু এলাকায় তারা দাপটও দেখাতে সক্ষম। বড় দলকে এদের বাদ দিয়ে তবে কেন ছোটদের দুয়ারে ধরনা দিতে হচ্ছে? প্রথমত, জামায়াত নিয়ে দেশের ভেতরের ও বাইরের অনেকের আপত্তি রয়েছে। আপত্তি রয়েছে বিএনপির ভেতরেও। অতীতে ‘মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষকতার’ যে বদনাম বিএনপি কামিয়েছে, তা ঘোচানোর খাতিরেও তাদের বাম ও সেক্যুলারদের সঙ্গে ওঠ-বস দেখাতে হবে। ক্ষমতাসীন সরকার হেফাজতে ইসলামের মতো করে জামায়াতকে যুগপৎ লাঠির ভয় আর মুলার লোভ দিয়ে খেলাতে না পারলে অস্তিত্ব বাঁচাতে জামায়াতকে বিএনপির কাতারেই দাঁড়াতে হবে। প্রকাশ্য বা গোপনে। আর জাতীয় পার্টি তো সরকারেরই ঘরের লোক; মুরব্বিরা বাধ্য না করলে আওয়ামী লীগকে ছাড়ার কোনো কারণ তাদের নেই। সুতরাং বামদের সঙ্গে বোঝাপড়া করাই থাকছে বিএনপির পয়লা কাজ।
বাংলাদেশের বাম দলগুলো নির্বাচনে জয়ী না হলেও রাজপথে লড়াইয়ের ইতিহাস তাদের কম না। ফুলবাড়ী কয়লাখনির বিরুদ্ধের আন্দোলন কিংবা সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে তারা সেই প্রমাণ রেখেছে। কিন্তু রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রশ্নে তাদের বড় অংশটাই (সিপিবি-বাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টি) আওয়ামী লীগের বৃত্তেই থাকতে ভালোবাসে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এটাই তাদের ইতিহাস। সময়ে সময়ে যে অভিমান দেখা যায়, তা আদতে ‘আমরা আর আমাগো মামুদের’ পারিবারিক গোস্সার বেশি কিছু না। পড়লে তারা আওয়ামী দিকেই পড়ে। এটাই তাদের ঐতিহ্য। তা ছাড়া কোনো কোনো বাম তাত্ত্বিক যখন উন্নয়ন ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকেও অপরিহার্য মনে করছেন না, তখন তো তাঁদের সরকার পরিবর্তন কিংবা নির্বাচনী ব্যবস্থার রদবদলের গরজ বেশি হওয়ার কথা না। এ এমন এক চেতনা যে বর্তমান সরকারের সঙ্গে রক্ষণশীলদের মাখামাখি তাঁরা দেখেও দেখবেন না বলে ঠিক করে রেখেছেন। সুতরাং সিপিবি-বাসদ-ওয়ার্কার্স পার্টির বাম জোটের দিক থেকে বিএনপির কোনো আশা নেই। আবার ছোট বাম দলগুলোর কাছে কী পাবে বিএনপি, যা তার নিজের ঘরে নেই?