ঢাকা ০৫:০৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
তিন দলই প্রধান উপদেষ্টার অধীনে নির্বাচন চায়: প্রেস সচিব টিউলিপ বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্টধারী, রয়েছে টিআইএনও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়াই হোক নববর্ষের অঙ্গীকার: প্রধান উপদেষ্টা নরেন্দ্র মোদিকে উপহার দেওয়া ছবিটি সম্পর্কে যা জানা গেল বিমসটেকের পরবর্তী চেয়ারম্যান ড. ইউনূস বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে মোদির ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন: প্রেসসচিব চীন সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে ভারতে তোলপাড় ড. ইউনূসকে ঈদগাহের মুসল্লিরাঃ আপনি ৫ বছর দায়িত্বে থাকুন, এটাই দেশের মানুষের চাওয়া বাংলাদেশে বিশ্বমানের হাসপাতালের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লবের সূচনা! খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ঈদের দাওয়াত দিলেন প্রধান উপদেষ্টা যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন সেনাপ্রধান পররাষ্ট্র নীতিতে ড. ইউনূসের কাছে হেরে গেছেন নরেন্দ্র মোদী! ৩ এপ্রিলও ছুটির প্রস্তাব, মিলতে পারে ৯ দিনের ছুটি বউয়ের টিকটকেই ধরা সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ, ‘ক্লু’ ছিল গাড়িতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মঈনুদ্দিনের পরিচয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের পরিচয় শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে সব প্রমাণ সরকারের কাছে আছে জেলায় জেলায় সরকারি অর্থে ‘আওয়ামী পল্লি’

শেখ মুজিবের পরিকল্পনা হতাশ করেছিল মুক্তিযোদ্ধা

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ০২:৪৪:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪
  • / 114
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়রি।  ঢাকায় ফিরে আসার পর সরকার প্রধান হলেন। অনেক সমালোচকদের মতে, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য শেখ মুজিবের পরিকল্পনা হতাশ করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। যারা নিছক চাকরিপ্রত্যাশী ছিলেন না, বরং উৎসাহী ছিলেন জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে দায়িত্বসহ অংশ নিতে। তবে এ ধরনের সমালোচনা ভাসা ভাসা এবং অযৌক্তিক। বরং বলা যেতে পারে ক্ষমতায় যেতে না পারার মনোবেদনার প্রতিচ্ছায়া। তার মধ্যেও শেখ মুজিবের সবচেয়ে বড় একটি কৃতিত্ব ছিল স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে দেশকে একটি শাসনতন্ত্র উপহার দেয়া।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানি না রক্তাক্ত বিপ্লবের পর পৃথিবীর আর  কোনো দেশে সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক শাসন চালু হয়েছে কি না। সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে। ভোট দেয়ার বয়স একুশের বদলে আঠারো বৎসর করে ভোটাধিকারের সীমা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্ব বিমান উড়ছে দেশ-বিদেশের আকাশে,  তৈরি হয়েছে নিজস্ব বাণিজ্য জাহাজ বহর। বিডিআর সীমান্ত পাহারায় নিযুক্ত, স্থলবাহিনী মাতৃভূমির ওপর যেকোনো হামলা প্রতিরোধে প্রস্তুত। গড়ে উঠেছে আমাদের নিজস্ব নৌ ও বিমানবাহিনী। থানা ও পুলিশ সংগঠনের যে ৭০ ভাগ পাকিস্তানিরা নষ্ট করেছিল, এখন আবার তা গড়ে উঠেছে। জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছে।…কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৮০ ভাগ মালিক আপনারা।…পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা তুলে নেয়া হয়েছে।…আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই। তাই মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা করে যারা দালাল আইনে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয়েছিলেন, তাদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে।’ এসব কথাই ভালো এবং সঠিক। কিন্তু  দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য মানুষ শাসনতন্ত্রের নীতিমালা বা শেখ মুজিব উল্লিখিত সফলতাসমূহকে বুঝতে চায়নি।  স্বাধীন একটি দেশে মানুষ পরাধীন অবস্থা থেকে ভালো থকেবে এই আশাইতো করে। সেখানেই ঘটলো বিপত্তি। জনমনে শান্তি ছিল। যে কারণে সাধারণ মানুষের ভেতরে একধরনের ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল। কারণ একই সময়ে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদের অর্থনৈতিক অবস্থায় মানুষ আরও বিরক্ত ও হতাশ হচ্ছিল। অন্যদিকে একাধিপত্য বজায় রাখার জন্য শ্রমিক ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা অন্তিমে সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এর মূল বিষয় ছিল রাষ্ট্র ও শাসক দলকে এক করে ফেলা এবং এই বোধটি সিভিল সমাজকে তছনছ করে দেয়ার উপক্রম করেছিল, ওই সময় আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগেও অন্তর্দ্বন্দ্ব চরমে। সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্ব দলকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে ফেলছিল।

সবচে আত্মঘাতী ঘটনাটি ঘটে ১৯৭২ সালের শুরুতেই। তখনও ছাত্রলীগের আন্তঃদলীয় কোন্দল চরমে। এরমধ্যে ছাত্রলীগের দুই নেতা আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের গ্রুপ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র পক্ষ নেয়। কারণ তারা মনে করতেন, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট ও সঠিক নয়। অন্য গ্রুপের নেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন ও নূরে আলম সিদ্দিকী বললেন, না, বাংলাদেশের জন্য মুজিববাদই উপযুক্ত। ১৯৭২ সালের ৬ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিতে গিয়ে শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন, ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। খাঁটি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে বাংলাদেশে, অন্য কিছু নয়।’ কিন্তু পরে তার ভাগনে শেখ মণির কারণে তিনি সমর্থন করলেন মাখন-সিদ্দিকী গ্রুপকে। এর পরিণাম এত ভয়ংকর হলো যে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে গেল। বিভক্ত মানেই দুর্বল। এই ভাঙনের প্রভাব পড়েছিল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোতেও। এই ভাঙনকে কেন্দ্র করে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠিত হলো নতুন দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ। তখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মাঠ পর্যায়ের শাসন, অস্থির বাজার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অস্থিতিশীল রাজনীতি আর এ অবস্থার বিরুদ্ধে উত্তপ্ত এবং মানুষের যে ক্ষোভ-হতাশা তাকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে যায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ। অল্প সময়েই দলটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বেশ ভালোসংখ্যক কর্মী যোগ দিয়েছিল জাসদে এবং তারাই ছিল দলের মূল শক্তি। এই জাসদ এক সময় হয়ে ওঠে শেখ মুজিববিরোধী আরেক প্লট। সরকার এদের প্রতি দমন-পীড়ন চালালেও সামরিক বাহিনীর ভেতরেও যে তার অবস্থানকে সংহত করেছিল সেটা ৭ নভেম্বরের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়।

এ ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, আওয়ামী লীগ নেতাদের একাংশের অযোগ্যতা ও দুর্নীতি এবং মিথ্যা ও অপপ্রচার, এসব প্রতিরোধে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন নেতা কঠোর কেন্দ্রীভূত শাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যেটা মোটেও কাম্য ছিল না। নির্দ্বিধায় আজ এসব কথা বলা যায় যে, তিনি ছিলেন তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তারপরও তার শাসন ব্যবস্থা নিয়ে অপপ্রচারের অন্ত ছিল না। ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকে শেখ মুজিবের শাসন ব্যবস্থাই নয় তার পরিবার-পরিজনকে নিয়েও নানা ধরনের গুজব ডাল-পালা বিস্তার করতে থাকে। তার দুই মেয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া পরিবারভুক্ত সব সদস্যের ব্যাপারেই কিছু না কিছু রটনা হয়েছিল। সব রটনা এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বোদ্ধামহল যদিও পরবর্তীকালে অপপ্রচারকে সঠিক বলেননি তারপরও ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে মানুষ এগুলোকে বিশ্বাস করেছিল, নাগরিক সমাজকে আহত করেছিল।

রটনা ছিল প্রধানত দুই ধরনের: ক্ষমতা করায়ত্তকরণ ও দুর্নীতি। অপপ্রচারের আরেকটি ছিল ভারত বিরোধীদের মুখে মুখে। সেটা হলো ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারত একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পঁচিশ বছর মেয়াদি ‘মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তিটি’ ছিল নবায়নযোগ্য। চুক্তিটিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। বিরোধীরা এই চুক্তিকে বাংলাদেশের ‘গোলামির’ জিঞ্জির হিসেবে চিহ্নিত করে এবং যে ধারা এখন অক্ষুণ্ন। ১৯৭৪ সালের জরুরি অবস্থা  ঘোষণার ব্যাপারটি শাসকগোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে বললে দেখা যাবে যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র দুই বছরের মধ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে সিভিল সোসাইটি সহজভাবে নেয়নি। যৌক্তিকতা যাই থাকুক না, এর কারণ তার মাত্র দুই বছর আগে সংবিধানে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল মৌলিক অধিকার ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর। জরুরি অবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল একদলীয় শাসন, যা আবার ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর আঘাত। উদ্ভূত পরিস্থিতির বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের প্রথম পদক্ষেপ ছিল ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং মৌলিক অধিকারসমূহ স্থগিত বলে ঘোষণা করা হয়। এরমাত্র ২৭ দিন পরে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধান সংশোধনের জন্য জারি করা হয় চতুর্থ সংশোধনী।

 

১৯৭৫ সালের ৭ জুন জাতীয় দল হিসেবে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা ‘বাকশাল’ গঠন করে এর কাঠামো ঘোষণা করা হয়। বাকশালের  কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সৈনিক, আমলা বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের নেয়া হয়। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিকে ঠেকাতে বঙ্গবন্ধু ‘দ্বিতীয় বিপ্লবে’র সূচনা করেছিলেন। বাকশালের এই কর্মসূচি গ্রহণের পর পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতার লক্ষণ ফুটে ওঠে। চালের দাম আট টাকা থেকে সাড়ে পাঁচ টাকায় নেমে আসে, আলু দুই টাকা পাঁচ পয়সা থেকে দেড় টাকায় নেমে আসে।  ঢাকা শহরে মধ্যবিত্তের ব্যয় সূচক ৪৫৮.৫ (জানুয়ারি) থেকে ৪১৬.৯ (এপ্রিলে) এবং খাদ্যমূল্য সূচক একই সময়ে ৪৬৬.৩ থেকে ৪৫৯.০তে হ্রাস পায়। আগস্ট মাসে অবস্থার আরও উন্নতি হয় ভালো আবহাওয়া ও ভালো ফসল হওয়ার কারণে। দ্রব্যমূল্য নামতে থাকে।

১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেভাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে, তাতে এটি স্পষ্ট যে এটি একটি দেশি ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, যার পরিকল্পনায় দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়েছে। কিন্তু বাকশাল গঠনের যে কথা ছড়ানো হয় বাকশাল সেই এক নায়কের শাসন ছিল না, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দিকে যাত্রা ছিল সেটা আজও খোলসা হয়নি। কিন্তু সেই সময়ের অপপ্রচার এখনও আছে। আছে জনবিরোধী কাজের নিদর্শন যেটা শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থা শেষ হলে আারো বেশি গতি পেয়েছে। তবে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি পত্রিকার পাতায় নজর দিলে অনেক প্রচারকে অপপ্রচার মনে হবে। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধের কয়েকটি রাজনৈতিক দল তার মৃত্যুর পরে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। সেগুলো নিয়ে এক সময় পত্রিকা ঘাটলে নতুন অনেক বিষয় বেরিয়ে আসবে। মানুষ যতদিন ইতিহাস সন্ধানী না হবে ততদিনই জাতির ইতিহাস অজানা থাকবে। আমরা অপপ্রচার শুনে অভ্যস্ত হবো। মানুষকে ইতিহাস বিমুখ করাও একটা রাজনীতি। এই রাজনীতির খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসুক মানুষ। জয় হোক মানুষের।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

শেখ মুজিবের পরিকল্পনা হতাশ করেছিল মুক্তিযোদ্ধা

আপডেট সময় : ০২:৪৪:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়রি।  ঢাকায় ফিরে আসার পর সরকার প্রধান হলেন। অনেক সমালোচকদের মতে, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের জন্য শেখ মুজিবের পরিকল্পনা হতাশ করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের। যারা নিছক চাকরিপ্রত্যাশী ছিলেন না, বরং উৎসাহী ছিলেন জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে দায়িত্বসহ অংশ নিতে। তবে এ ধরনের সমালোচনা ভাসা ভাসা এবং অযৌক্তিক। বরং বলা যেতে পারে ক্ষমতায় যেতে না পারার মনোবেদনার প্রতিচ্ছায়া। তার মধ্যেও শেখ মুজিবের সবচেয়ে বড় একটি কৃতিত্ব ছিল স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে দেশকে একটি শাসনতন্ত্র উপহার দেয়া।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানি না রক্তাক্ত বিপ্লবের পর পৃথিবীর আর  কোনো দেশে সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক শাসন চালু হয়েছে কি না। সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে। ভোট দেয়ার বয়স একুশের বদলে আঠারো বৎসর করে ভোটাধিকারের সীমা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্ব বিমান উড়ছে দেশ-বিদেশের আকাশে,  তৈরি হয়েছে নিজস্ব বাণিজ্য জাহাজ বহর। বিডিআর সীমান্ত পাহারায় নিযুক্ত, স্থলবাহিনী মাতৃভূমির ওপর যেকোনো হামলা প্রতিরোধে প্রস্তুত। গড়ে উঠেছে আমাদের নিজস্ব নৌ ও বিমানবাহিনী। থানা ও পুলিশ সংগঠনের যে ৭০ ভাগ পাকিস্তানিরা নষ্ট করেছিল, এখন আবার তা গড়ে উঠেছে। জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছে।…কলকারখানা, শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৮০ ভাগ মালিক আপনারা।…পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা তুলে নেয়া হয়েছে।…আমরা প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিতে বিশ্বাসী নই। তাই মুক্তিযুদ্ধের শত্রুতা করে যারা দালাল আইনে অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হয়েছিলেন, তাদের সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়েছে।’ এসব কথাই ভালো এবং সঠিক। কিন্তু  দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য মানুষ শাসনতন্ত্রের নীতিমালা বা শেখ মুজিব উল্লিখিত সফলতাসমূহকে বুঝতে চায়নি।  স্বাধীন একটি দেশে মানুষ পরাধীন অবস্থা থেকে ভালো থকেবে এই আশাইতো করে। সেখানেই ঘটলো বিপত্তি। জনমনে শান্তি ছিল। যে কারণে সাধারণ মানুষের ভেতরে একধরনের ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল। কারণ একই সময়ে ক্ষমতাসীন দলের লোকজনদের অর্থনৈতিক অবস্থায় মানুষ আরও বিরক্ত ও হতাশ হচ্ছিল। অন্যদিকে একাধিপত্য বজায় রাখার জন্য শ্রমিক ইউনিয়নের ক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা অন্তিমে সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এর মূল বিষয় ছিল রাষ্ট্র ও শাসক দলকে এক করে ফেলা এবং এই বোধটি সিভিল সমাজকে তছনছ করে দেয়ার উপক্রম করেছিল, ওই সময় আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগেও অন্তর্দ্বন্দ্ব চরমে। সংগঠনের অন্তর্দ্বন্দ্ব দলকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে ফেলছিল।

সবচে আত্মঘাতী ঘটনাটি ঘটে ১৯৭২ সালের শুরুতেই। তখনও ছাত্রলীগের আন্তঃদলীয় কোন্দল চরমে। এরমধ্যে ছাত্রলীগের দুই নেতা আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের গ্রুপ ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র পক্ষ নেয়। কারণ তারা মনে করতেন, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় সরকারের পদক্ষেপ যথেষ্ট ও সঠিক নয়। অন্য গ্রুপের নেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন ও নূরে আলম সিদ্দিকী বললেন, না, বাংলাদেশের জন্য মুজিববাদই উপযুক্ত। ১৯৭২ সালের ৬ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ভাষণ দিতে গিয়ে শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন, ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। খাঁটি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে বাংলাদেশে, অন্য কিছু নয়।’ কিন্তু পরে তার ভাগনে শেখ মণির কারণে তিনি সমর্থন করলেন মাখন-সিদ্দিকী গ্রুপকে। এর পরিণাম এত ভয়ংকর হলো যে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে গেল। বিভক্ত মানেই দুর্বল। এই ভাঙনের প্রভাব পড়েছিল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোতেও। এই ভাঙনকে কেন্দ্র করে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠিত হলো নতুন দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ। তখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মাঠ পর্যায়ের শাসন, অস্থির বাজার, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অস্থিতিশীল রাজনীতি আর এ অবস্থার বিরুদ্ধে উত্তপ্ত এবং মানুষের যে ক্ষোভ-হতাশা তাকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে যায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ। অল্প সময়েই দলটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বেশ ভালোসংখ্যক কর্মী যোগ দিয়েছিল জাসদে এবং তারাই ছিল দলের মূল শক্তি। এই জাসদ এক সময় হয়ে ওঠে শেখ মুজিববিরোধী আরেক প্লট। সরকার এদের প্রতি দমন-পীড়ন চালালেও সামরিক বাহিনীর ভেতরেও যে তার অবস্থানকে সংহত করেছিল সেটা ৭ নভেম্বরের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়।

এ ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, আওয়ামী লীগ নেতাদের একাংশের অযোগ্যতা ও দুর্নীতি এবং মিথ্যা ও অপপ্রচার, এসব প্রতিরোধে শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন নেতা কঠোর কেন্দ্রীভূত শাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যেটা মোটেও কাম্য ছিল না। নির্দ্বিধায় আজ এসব কথা বলা যায় যে, তিনি ছিলেন তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তারপরও তার শাসন ব্যবস্থা নিয়ে অপপ্রচারের অন্ত ছিল না। ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকে শেখ মুজিবের শাসন ব্যবস্থাই নয় তার পরিবার-পরিজনকে নিয়েও নানা ধরনের গুজব ডাল-পালা বিস্তার করতে থাকে। তার দুই মেয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী  শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া পরিবারভুক্ত সব সদস্যের ব্যাপারেই কিছু না কিছু রটনা হয়েছিল। সব রটনা এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বোদ্ধামহল যদিও পরবর্তীকালে অপপ্রচারকে সঠিক বলেননি তারপরও ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে মানুষ এগুলোকে বিশ্বাস করেছিল, নাগরিক সমাজকে আহত করেছিল।

রটনা ছিল প্রধানত দুই ধরনের: ক্ষমতা করায়ত্তকরণ ও দুর্নীতি। অপপ্রচারের আরেকটি ছিল ভারত বিরোধীদের মুখে মুখে। সেটা হলো ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ-ভারত একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। পঁচিশ বছর মেয়াদি ‘মৈত্রী, সহযোগিতা ও শান্তি চুক্তিটি’ ছিল নবায়নযোগ্য। চুক্তিটিতে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ছিল। বিরোধীরা এই চুক্তিকে বাংলাদেশের ‘গোলামির’ জিঞ্জির হিসেবে চিহ্নিত করে এবং যে ধারা এখন অক্ষুণ্ন। ১৯৭৪ সালের জরুরি অবস্থা  ঘোষণার ব্যাপারটি শাসকগোষ্ঠীর দিকে তাকিয়ে বললে দেখা যাবে যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র দুই বছরের মধ্যে জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে সিভিল সোসাইটি সহজভাবে নেয়নি। যৌক্তিকতা যাই থাকুক না, এর কারণ তার মাত্র দুই বছর আগে সংবিধানে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল মৌলিক অধিকার ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর। জরুরি অবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল একদলীয় শাসন, যা আবার ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর আঘাত। উদ্ভূত পরিস্থিতির বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের প্রথম পদক্ষেপ ছিল ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং মৌলিক অধিকারসমূহ স্থগিত বলে ঘোষণা করা হয়। এরমাত্র ২৭ দিন পরে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধান সংশোধনের জন্য জারি করা হয় চতুর্থ সংশোধনী।

 

১৯৭৫ সালের ৭ জুন জাতীয় দল হিসেবে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা ‘বাকশাল’ গঠন করে এর কাঠামো ঘোষণা করা হয়। বাকশালের  কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সৈনিক, আমলা বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের নেয়া হয়। যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিকে ঠেকাতে বঙ্গবন্ধু ‘দ্বিতীয় বিপ্লবে’র সূচনা করেছিলেন। বাকশালের এই কর্মসূচি গ্রহণের পর পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আসে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতার লক্ষণ ফুটে ওঠে। চালের দাম আট টাকা থেকে সাড়ে পাঁচ টাকায় নেমে আসে, আলু দুই টাকা পাঁচ পয়সা থেকে দেড় টাকায় নেমে আসে।  ঢাকা শহরে মধ্যবিত্তের ব্যয় সূচক ৪৫৮.৫ (জানুয়ারি) থেকে ৪১৬.৯ (এপ্রিলে) এবং খাদ্যমূল্য সূচক একই সময়ে ৪৬৬.৩ থেকে ৪৫৯.০তে হ্রাস পায়। আগস্ট মাসে অবস্থার আরও উন্নতি হয় ভালো আবহাওয়া ও ভালো ফসল হওয়ার কারণে। দ্রব্যমূল্য নামতে থাকে।

১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু তার আগেই ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেভাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে, তাতে এটি স্পষ্ট যে এটি একটি দেশি ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, যার পরিকল্পনায় দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়েছে। কিন্তু বাকশাল গঠনের যে কথা ছড়ানো হয় বাকশাল সেই এক নায়কের শাসন ছিল না, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দিকে যাত্রা ছিল সেটা আজও খোলসা হয়নি। কিন্তু সেই সময়ের অপপ্রচার এখনও আছে। আছে জনবিরোধী কাজের নিদর্শন যেটা শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থা শেষ হলে আারো বেশি গতি পেয়েছে। তবে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল অবধি পত্রিকার পাতায় নজর দিলে অনেক প্রচারকে অপপ্রচার মনে হবে। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধের কয়েকটি রাজনৈতিক দল তার মৃত্যুর পরে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। সেগুলো নিয়ে এক সময় পত্রিকা ঘাটলে নতুন অনেক বিষয় বেরিয়ে আসবে। মানুষ যতদিন ইতিহাস সন্ধানী না হবে ততদিনই জাতির ইতিহাস অজানা থাকবে। আমরা অপপ্রচার শুনে অভ্যস্ত হবো। মানুষকে ইতিহাস বিমুখ করাও একটা রাজনীতি। এই রাজনীতির খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসুক মানুষ। জয় হোক মানুষের।