অনিয়মই ছিল চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর নিয়ম। পদে পদে ছিল গাফিলতি। ডিপো পরিচালনায় অব্যবস্থাপনার পথেই হেঁটেছিল প্রতিষ্ঠানটি। রাসায়নিক জাতীয় পদার্থের কনটেইনার রাখার জন্য সেখানে ছিল না আলাদা ইয়ার্ড। ঝুঁকিপূর্ণভাবে ডিপোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড এবং অন্য রপ্তানিযোগ্য পণ্য পাশাপাশি রাখা হয় খোলা জায়গায়। সেখানে মাত্র ২০টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকলেও আগুন নেভাতে ছিল না পর্যাপ্ত ওয়াটার হোস পাইপ। আইন অনুযায়ী কোনো কারখানার জনবল ৫০ জনের বেশি হলে তার ১৮ শতাংশ কর্মীকে অগ্নিনির্বাপণে প্রশিক্ষিত হতে হবে। তবে বিএম ডিপোর ৫১১ কর্মীর একজনেরও প্রশিক্ষণ ছিল না। আগুন লাগার পর বিএম ডিপো ঘিরে অনুসন্ধান চালায় পুলিশের একটি বিশেষ গোয়েন্দা ইউনিট। তাদের প্রতিবেদনে ডিপো ঘিরে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতির নানামুখী ছবি উঠে আসে। তবে ওই অনুসন্ধানে নাশকতার কোনো তথ্য পায়নি তারা।

প্রতিবেদনে আগুন লাগার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ডিপোতে রাখা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড দীর্ঘদিন খোলা আকাশের নিচে থাকার কারণে অতিরিক্ত তাপদাহে কনটেইনারের ভেতরের জারিকেন লিকেজ হয়ে আগুনের সূত্রপাত হয়। হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড একটি দাহ্য পদার্থ। এটি কাঠ, প্লাস্টিক, রাবার, পেপারের সংস্পর্শে এলে আগুনে প্রজ্বলিত হতে পারে। খোলা জায়গায় পড়ে থাকলে ডিকম্পোজ হয়ে এর দুই যৌগ অক্সিজেন ও পানি আলাদা হয়ে যেতে পারে। প্রতিবেদনে এও বলা হয়, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রাখার জন্য শীতল জায়গা প্রয়োজন। ডিপোর অপারেশনাল বিভাগ রাসায়নিকের ৩৭ কনটেইনার উন্মুক্ত জায়গায় রেখে গাফিলতি ও উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএম ডিপোর কনটেইনার সার্ভিস বিভাগের সুপারভাইজার আহমেদুর রহমান সমকালকে বলেন, রাসায়নিক জাতীয় পণ্যের কনটেইনার আলাদা কোনো জায়গায় রাখার নির্দেশনা কখনও ডিপার্টমেন্ট থেকে দেওয়া হয়নি। হয়তো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। এটা তেমন কোনো রাসায়নিক নয়। আমদানি-রপ্তানির জন্য যেসব কনটেইনার ছিল, তা ডিপো থেকে সরানো হচ্ছে। তবে নতুন কোনো কনটেইনার এখনও ঢোকেনি।
ফায়ার ইনভেস্টিগেটর ও বুয়েটের প্রকৌশলী আল ইমরান হোসেন বলেন, বিএম ডিপোর অনিয়ম-অবহেলার পাশাপাশি সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান তা দেখভালের দায়িত্বে ছিল, তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। যারা কেমিক্যাল প্যাকেজিং করে ডিপোতে পাঠিয়েছিল, তারা কোনো নিয়মকানুন মানেনি।

৪ জুন স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ৪৯ জন মারা যান। এর মধ্যে ছিল ১০ জন ফায়ারম্যান ও ৩৯ জন শ্রমিক। নিহতদের মধ্যে ১৬ জন ডিপোর কর্মী। আহত হয়েছেন আড়াই শতাধিক। এ ঘটনায় সীতাকুণ্ড থানায় মামলা হয়।
ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের প্রাথমিক কারণ ফায়ার সার্ভিসকে জানাতে ব্যর্থ হয় তারা। এ ছাড়া আগুনের ধরন সম্পর্কেও প্রাথমিক তথ্য দিতে পারেনি। এমনকি যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের ডিপো ব্যবস্থাপনা তদারকি করার কথা ছিল, তা যথাযথভাবে করতে ব্যর্থ হয় তারা। এ ছাড়া বিএম ডিপোর মতো বিস্ম্ফোরক ও রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণের অন্য যেসব স্থান রয়েছে, তা এখনই পরিদর্শন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিপোতে থাকা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডের ৩৭টি কনটেইনার ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানে রপ্তানির উদ্দেশ্যে ডিপোতে রাখা হয়েছিল। আল-রাজি কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠানে এসব তৈরি হয়। ২০১৯ সালে আল-রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। ২০২১ সালের মে মাস থেকে রাসায়নিক উৎপাদন শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রাকৃতিক গ্যাস, পানি, ইথানল এন্টাকুইন, পেট্রাবিউটাইল ইউরিয়া দিয়ে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড তৈরি হয়। গার্মেন্টস শিল্প, ওয়াশিং মেশিন ও বিভিন্ন সংক্রমণনাশক হিসেবে এটি ব্যবহূত হয়। ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরও কিছু দেশে বাংলাদেশ থেকে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রপ্তানি হয়ে থাকে।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৭টির মধ্যে ২৪টি কনটেইনার আগুনে পুড়ে গেছে। প্রথমে ঘটনার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে একটি কনটেইনার বিকট শব্দে বিস্ম্ফোরিত হয়। ১২টি কনটেইনার অক্ষত ছিল। প্রাণ গ্রুপের খাদ্যসামগ্রী ভর্তি ১৭ কনটেইনারসহ বিভিন্ন গার্মেন্টস এবং অন্য পণ্যের মোট ১৯৪ কনটেইনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিএম ডিপোর অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি মিলিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এ ছাড়া অন্য কোম্পানির ৬০০-৭০০ কোটি টাকার পণ্যসহ সর্বমোট ৯০০-১০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। ঘটনার রাত ৯টা ১০ মিনিটে রাতের ডিউটি চলাকালে এক শ্রমিক ডিপোর একটি কনটেইনারের নিচ থেকে ধোঁয়া বের হওয়ার তথ্য প্রতিষ্ঠানটির সহকারী ব্যবস্থাপক জসীম উদ্দিনকে জানান। এরপর শ্রমিকদের অনেকে তড়িঘড়ি করে দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে বালু ও পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। খুব দ্রুত আগুন ছড়াতে থাকলে কনটেইনার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের সুপারভাইজার আহমেদুর রহমান ৯টা ২১ মিনিটে জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এ ফোন করে আগুন লাগার বিষয়টি জানান। চার মিনিটের মধ্যে ৮টা ২৫ মিনিটে কুমিরা ফায়ার স্টেশনের ম্যানেজার সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি টিম ডিপো এলাকায় যায়। একই সময় সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ, ফৌজদারহাট পুলিশ ফাঁড়ি ও শিল্প পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিএম ডিপো একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। কাছাকাছি অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ভালো। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির আশপাশে কোনো অপরাধে জড়িত এমন সংগঠনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া বিএম ডিপো এলাকায় কোনো রাজনৈতিক দলের একক আধিপত্য বা রাজনৈতিক বিরোধ নেই।

এ প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দোষী ও অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা এবং দেশের সব কনটেইনার ডিপোর পরিদর্শন করে নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়ানো ও সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত অগ্নিনির্বাপণ মহড়া দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।