মাজারে হামলায় আতঙ্কে স্থানীয়রা, প্রশ্নের মুখে সরকার
- আপডেট সময় : ০১:১০:৫০ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
- / 125
মাজারের বন্ধ গেটের সামনে পুলিশের পাহারা। মাঝেমধ্যে টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনীর ভ্রাম্যমাণ দল। কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত মাজারটি দেখতে ভিড় করছেন আশপাশের অনেকেই। সব মিলিয়ে থমথমে পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত এলাকার বাসিন্দারাও।
শুক্রবার হামলা-ভাঙচুরের পর শনিবার সকাল থেকে এমনটাই দেখা গেছে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ এলাকার নুরুল হকের যেখানে কবর ছিল, সেই এলাকায়। স্থানীয়ভাবে এটি ‘নুরাল পাগলার মাজার’ নামে পরিচিত।
এলাকার বাসিন্দাদের অনেকে বলছেন, শুক্রবার হাজার হাজার মানুষ হামলা করেছিল মাজারটিতে। আবার এমন হামলা হয় কি না এমন আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।
এদিকে, এ ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা ও গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে অজ্ঞাতনামা সাড়ে তিন হাজার আসামি করে শনিবার একটি মামলা করেছে পুলিশ।
নুরুল হকের মাজারের মতো শুক্রবার হামলা হয়েছে রাজশাহীর পবা উপজেলার একটি খানকা শরিফে। সেখানেও দলবদ্ধ মব তৈরি করে পুলিশের সামনেই ভাঙচুর চালানো হয়।
কেবল মাজারে নয়, ধর্ম অবমাননা কিংবা রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে ঢাকা, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রতি দলবদ্ধ হামলার বা বিশৃঙ্খলার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনার পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আবারও। মবের বিরুদ্ধে সরকারের ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা করছেন কেউ কেউ।
অনেকেই অভিযোগ করছেন, ‘মব সন্ত্রাস’-এর বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিলেও বাস্তবে এ নিয়ে কঠোর ভূমিকা রাখতে পারেনি সেনাবাহিনীও।
অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পুলিশ এবং সরকার উভয়কেই সংকটে ফেলছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের অনেকে। তারা বলছেন, ব্যবস্থা নিলে যদি কিছু হয়, এমন চিন্তা কাজ করছে সবার মধ্যেই।
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে একদল উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি। সরকারের ভূমিকাও এ ক্ষেত্রে শক্তিশালী নয় বলেই মনে করেন তারা।
‘রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক যে উদ্দেশ্যেই হোক, মব সন্ত্রাস করে একবার ছাড় পেলে সেই সুযোগ বারবারই নেওয়ার শঙ্কা থাকে, আর বাংলাদেশে এখন সেটিই হচ্ছে’, বলে মনে করেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক।
‘ছোঁয়াচে রোগের মতো সমাজে মব কালচার ছড়িয়ে পড়ছে’, বলেও মনে করেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ অবশ্য মনে করেন, আইন-শৃঙ্খলা ঠিক করতে চাইলে পুলিশকে দিয়েই শুরু করা প্রয়োজন। তিনি বলছেন, ‘কাজ করলে চাকরি হারানোর বা জেলে যাওয়ার শঙ্কা থাকবে না— এই নিশ্চয়তা না পেলে তারা কাজ করবে কিভাবে?”
‘অন্যায় করলে পুলিশেরও আইন অনুযায়ী বিচার করেন, কিন্তু তাদের সঙ্গে অন্যায়ের বিচারও তো করতে হবে’, বলেন মনজিল মোরসেদ।
আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে
মাজারে হামলা-ভাঙচুর, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে হামলা, রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে হেনস্তা— একের পর এক এমন সব ঘটনায় নিজেদের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে পুলিশ ও প্রশাসন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে এমন সব ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
রাজবাড়ী ও রাজশাহীতে মাজার ও খানকাহ শরিফে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় আগে থেকে তথ্য থাকার পরও তা থামাতে বা বন্ধ করতে পারেনি পুলিশ।
গোয়ালন্দে নুরাল পাগলার মাজার ঘিরে দীর্ঘদিনের সমস্যা কেন জিইয়ে রাখা হয়েছিল, এমন প্রশ্নও তুলেছেন স্থানীয়দের কেউ কেউ।
‘গত ২৩ আগস্ট নুরাল পাগলার মৃত্যুর পর থেকেই মাজারটি ঘিরে একটি উত্তেজনা ছিল। সময়মতো ব্যবস্থা না নেওয়াই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলেই মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জুড়ান মোল্লাপাড়া এলাকার একজন বাসিন্দা।
স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, একসময় নিজেকে ইমাম মাহাদি বলে দাবি করেছিলেন নুরুল হক নামে ওই ব্যক্তি। এমনকি মৃত্যুর পর তার মরদেহ ওই মাজারের ভেতরে মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে বিশেষ কায়দায় দাফন করা হয়। যা নিয়ে তখন থেকেই ক্ষোভ জানিয়ে আসছিলেন স্থানীয় আলেমসমাজ। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছিল।
এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার উপজেলা ঈমান-আকিদা রক্ষা কমিটির ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে ওই মাজারে অনৈতিক কার্যকলাপের অভিযোগ তোলা হয়।
এ ছাড়া বৃহস্পতিবারের মধ্যে কবর সমতল করাসহ বিভিন্ন দাবি না মানলে শুক্রবার জুমার নামাজের পর ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয় ঈমান-আকিদা রক্ষা কমিটি।
মাজারটির সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছিল বিবদমান দুই পক্ষের। শুক্রবার জুমার নামাজের পর অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে পারে এমন শঙ্কা থেকে সতর্ক অবস্থানও নিয়েছিল পুলিশ, কিন্তু কাজ হয়নি।
গোয়ালন্দ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলছেন, ‘হামলার দিন মাজারের মূল পয়েন্টে দুইজন এডিশনাল এসপি ও আমিসহ অন্তত ২০ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন ছিলাম। সোনালী ব্যাংক মোড়, বড় মসজিদ মোড়, ওয়ালটন মোড়সহ বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের উপস্থিতি ছিল।”
পরিস্থিতি সকাল থেকে শান্ত ছিল। তবে নামাজের পর শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশের কথা বলে হঠাৎই দেশীয় অস্ত্র ও ইটপাটকেল নিয়ে মাজারে হামলা করা হয় বলে জানান রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইসলাম।
সংঘাত থামাতে প্রশাসন তৎপর ছিল বলে দাবি করেছেন রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক সুলতানা আক্তারও। তিনি বলছেন, নুরুল হকের মৃত্যুর পর উপজেলার ঈমান-আকিদা রক্ষা কমিটি ও মাজার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনা করেও কোনো সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
‘ওনারা বারবার সময় নিয়েছেন, পরিবারের লোকজন সময় নিয়ে কালক্ষেপণ করেছেন, উল্টো তাদের বারবার সময় দেওয়ায় আমরাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছিলাম’, বলেন সুলতানা আক্তার।
সেখানে মাজারের কর্মকাণ্ড বন্ধ করা এবং কবর সমতল করার জন্য দাবি তুলেছিল ঈমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। এ নিয়ে মাজার কমিটির সাথে তাদের আলোচনা চলছিল বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে।
এদিকে, রাজশাহীর পবায় খানকা শরিফে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। তাদের দাবি, হামলার সময় পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
জানা গেছে, ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে ওই খানকায় তিন দিনের আয়োজন ছিল। বৃহস্পতিবার থেকে অনেকেই সেখানে অংশ নিতে এসেছিলেন। তবে কয়েক দিন যাবৎ কিছু মানুষ এই আয়োজনে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
রাজশাহীর গণমাধ্যমকর্মী মতিউর মর্তুজা বলেন, ‘জুমার নামাজের পর হামলা হতে পারে এমন তথ্য শোনা যাচ্ছিল। এই শঙ্কা থেকে বাড়তি পুলিশও মোতায়েন করা হয়েছিল ওই এলাকায়।’
যারাই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র গাজিউর রহমান।
পুলিশের ভূমিকা নিয়ে করা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাদের কাছে লিখিতভাবে জানালে আমরা এর বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’
শুধু মাজারে হামলা নয়, সম্প্রতি মব সন্ত্রাসের আরো কয়েকটি ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত ২৮শে অগাস্ট ‘মঞ্চ ৭১’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মে আলোচনা অনুষ্ঠানে ‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে মব সৃষ্টি করে আলোচকদের হেনস্তা করে অনুষ্ঠান পণ্ড করে একদল ব্যক্তি। কিন্তু হেনস্তাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং হামলার শিকার ব্যক্তিদের ১৬ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এর আগে গত নয়ই আগস্ট রংপুরের তারাগঞ্জে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লাল নামে দুই ব্যক্তিকে মব তৈরি করে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।
একই জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার একটি গ্রামে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে বহিরাগত হামলাকারীরা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় গত ২৬ ও ২৭ জুলাই। সেখানে উপস্থিত থাকলেও বিশৃঙ্খল জনতাকে ঠেকাতে ব্যর্থ হয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
সরকারের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন বিশ্লেষকদের
‘মব সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নানা আশ্বাস দেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রে বারবারই প্রশ্নের মুখে পড়ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এমনকি সেনাবাহিনীর হুঁশিয়ারির পরও থামছে না দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, মব সন্ত্রাস ও শ্রমিক হত্যা নিয়ে গত বৃহস্পতিবার একটি বিবৃতি দেয় গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। যেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে ওই বিৃবতিতে, অন্তর্বর্তী সরকারের নির্লিপ্ততায় বা সমর্থনে দেশে মবোক্রেসি চলছে বলে অভিযোগ করা হয়।
তারা বলছে, ‘প্রশাসনিক ও বিচারিক ব্যবস্থার গোষ্ঠীগত স্বার্থরক্ষা ও ফ্যাসিস্ট কাঠামোর বদৌলতে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরের এক বছরে হাসিনার সরকারকে ফিরিয়ে এনেছে অন্তর্বর্তী সরকার।’
মাজারে হামলার ঘটনায় শুক্রবার রাতেই নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। যেখানে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
বিশৃঙ্খল জনতার বিরুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকদের অনেকে। মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে পুলিশ নিজে ভয়ে থাকছে বলে মনে করেন সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক।
তিনি বলেন, ‘মবকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সে নিজেই আক্রমণের শিকার হয় কি না এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ বা ধর্মীয় মতাদর্শের কোনো মব নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে পুলিশের আরো ভয়।’
তবে এই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ না করলে ভবিষ্যতে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা আরো বাড়তে পারে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারের নিরবতা অপরাধীদের সুযোগ করে দেয়। এমনকি এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ব্যক্তিগত ক্ষোভও কেউ কেউ মিটিয়ে নিতে পারে বলেও মনে করেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
তৌহিদুল হক বলছেন, ‘পুলিশের আচরণ বা কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেক বিতর্ক বা প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু দিনশেষে আমাদের দেশের বাস্তবতায় পুলিশের মাধ্যমেই নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ করতে হয়।’
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিশেষ করে ‘মব সন্ত্রাস’ এখন যেভাবে চলছে, এটি অব্যাহত থাকলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা প্রচলিত ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা আর থাকবে না বলেই মনে করেন এই বিশ্লেষক।
পুলিশের সাবেক প্রধান নুরুল হুদা বলছেন, ‘কিছু ঘটনা ঘটবে, কিন্তু সরকারের উচিত আরো কঠোর হওয়া। তা না হলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা প্রশ্ন তৈরি হবে।’
নির্বাচনের আগে এ ধরনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আন্তর্জাতিক মহলেও সরকার প্রশ্নের মুখে পড়বে বলেই মনে করেন পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা।





















