ঢাকা ০৩:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
নবাবগঞ্জের প্রয়াত সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের সুযোগ্য কন্যা মেহেনাজ মান্নান ইলিশ ধরায় খরচ ৮৩০ টাকা, ভোক্তার গুনতে হয় অন্তত ২ হাজার নির্বাচন কে সামনে রেখে উত্তাল ঢাকা-১ দোহার-নবাবগঞ্জ আসন আটপাড়ায় কালী মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর কেন্দুয়ায় মানবপাচার মামলার আসামীরা রিমান্ডে মাস্টারমাইন্ডের নাম প্রকাশ করেছে ‎ ‎কেন্দুয়ায় মানবপাচারের মামলায় চীনা নাগরিকসহ দুই আসামীকে কারাগারে প্রেরণ কেন্দুয়া থেকে তিন নারীকে চীনে পাচারের চেষ্টা; চীনা নাগরিকসহ আটক দুইজন কেন্দুয়ায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার ৫ ‎কেন্দুয়ায় প্রকল্পের অনিয়ম তদন্তের সময় হাতাহাতি: ইউএনও আহত কেন্দুয়ায় প্রশাসনের অভিযানে অবৈধ জাল ধ্বংস ওসমান হাদী দাবিতে ঘনিষ্ঠ ভিডিও প্রচার, সামনে এলো আসল সত্য ব্লাড মুন দেখা যাবে রোববার, চাঁদ লাল হওয়ার কারণ কী? তিন দলই প্রধান উপদেষ্টার অধীনে নির্বাচন চায়: প্রেস সচিব টিউলিপ বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্টধারী, রয়েছে টিআইএনও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়াই হোক নববর্ষের অঙ্গীকার: প্রধান উপদেষ্টা নরেন্দ্র মোদিকে উপহার দেওয়া ছবিটি সম্পর্কে যা জানা গেল বিমসটেকের পরবর্তী চেয়ারম্যান ড. ইউনূস বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে মোদির ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন: প্রেসসচিব চীন সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে ভারতে তোলপাড়

সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ কি সর্বরোগের মহৌষধ?

আমীন আল রশীদ
  • আপডেট সময় : ০৯:২৯:৩৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / 103
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটি ‘অ্যাবসোলিউট’ নয়। অর্থাৎ আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে সরকার বা রাষ্ট্র যা খুশি করতে পারে না।

যে সংবিধানের আলোকে দেশ চলছে বা যে সংবিধানকে মুজিববাদ, ফ্যাসিবাদী বা আওয়ামী লীগের সংবিধান বলে গালি দেওয়া হয়, সেটি বাহাত্তরের সংবিধান নয়; বরং সেটি জিয়ারও সংবিধান, এরশাদেরও।

 

 

 

বাহাত্তরের সংবিধানকে ‘মরহুম সংবিধান’ আখ্যা দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। সোমবার রাজধানীতে জাতীয় যুবশক্তির এক অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেন। অবশ্য তার দলের শীর্ষ নেতারা শুরু থেকেই বাহাত্তরের সংবিধানকে মুজিববাদী ও ফ্যাসিবাদী সংবিধান আখ্যা দিয়ে এর কবর রচনার কথাও বলছেন।

বাস্তবতা হলো, বাহাত্তরের সংবিধান বলে এ মুহূর্তে দেশে কিছু নেই। কেননা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে যে সংবিধান গৃহীত হয়, ওই সংবিধানে এখন পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন আনা হয়েছে। এর মধ্যে জিয়াউর রহমানের আমলে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মূলনীতি বদলে দেয়া হয়। সংবিধানের শুরুতে যুক্ত করা হয় বিসমিল্লাহ। এরশাদের সময় অষ্টম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে যুক্ত করা হয় রাষ্ট্রধর্ম। এরপর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনা হয় ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ওই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হলেও বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্মসহ অন্য আরও অনেক পরিবর্তন অক্ষুণ্ন রাখা হয়। তার মানে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যে সংবিধানটি বিদ্যমান এবং যে সংবিধানের আলোকে দেশ চলছে বা যে সংবিধানকে মুজিববাদ, ফ্যাসিবাদী বা আওয়ামী লীগের সংবিধান বলে গালি দেয়া হয়, সেটি বাহাত্তরের সংবিধান নয়; বরং সেটি জিয়ারও সংবিধান। সেটি এরশাদেরও সংবিধান!

এবার আসা যাক সংবিধান পরিবর্তনের প্রসঙ্গে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানকে বলা হয় রক্তে লেখা সংবিধান। রাষ্ট্রের প্রয়োজনের কথা বলে এই সংবিধানে এ পর্যন্ত যে ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে, তার কতগুলো সত্যিই রাষ্ট্র ও জনগণের প্রয়োজনে হয়েছে আর কতটি সংশোধনী ক্ষমতাসীন দলের প্রয়োজনে—ওই তর্ক এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এই সংবিধান যে গণতন্ত্রের বিকাশ ও নাগরিকের অধিকার সুরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে বা পুরোপুরি সফল হয়নি, তার পেছনে সংবিধানের ভাষার চেয়ে বেশি দায়ী সংবিধান প্রয়োগকারীদের অভিপ্রায়।

যখনই যারা সরকার পরিচালনা করেছে, সংবিধানকে তারা মূলত নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য নেই বলে কিংবা ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদে এমপিরা প্রাণ খুলে কথা বলতে পারেন না বলে এই সংবিধানের কবর রচনা করা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লিখিত সংবিধানকে মরহুম বলে টিপ্পনি কাটা কোনো সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির লক্ষণ নয়।

সংবিধান চিরকালই সংশোধনযোগ্য। সময়ের প্রয়োজনে সংবিধানে পরিবর্তন আসে। ওই পরির্তনের সুযোগ সংবিধানেই রাখা হয়। আবার কখন কোন প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশোধন করা যাবে, সেটিও সংবিধানেই বলা থাকে।

সংবিধান, সংসদ, নির্বাচনের পদ্ধতি ইত্যাদির সুরাহা হবে কোন প্রক্রিয়ায়? যে জুলাই সনদ নিয়ে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে—সেটিরই বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? এই সনদে উল্লিখিত সুপারিশগুলো কি অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেই বাস্তবায়ন করতে পারবে?

সংবিধান সংস্কার কমিশন বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের যেসব সুপারিশ করেছে, তা আগামী সংসদ গঠিত হওয়া তথা নির্বাচনের আগে কী করে বাস্তবায়ন সম্ভব? জুলাই সনদে সংবিধানের যেসব অনুচ্ছেদে পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে, ওগুলোই বা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে? জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নতুন সংবিধান লেখার জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চায়। কিন্তু এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি এবং বাংলাদেশে গণপরিষদ গঠন বাস্তবসম্মত কি না—ওই তর্কেরও সুরাহা হয়নি।

কোনো কোনো দল, বিশেষ করে জামায়াত ও এনসিপি জুলাই সনদের আলোকে জাতীয় নির্বাচন চায়। কিন্তু এই সনদে রাষ্ট্রের কাঠামো, বিশেষ করে সংসদের কাঠামো পরিবর্তনের যে সুপারিশ রয়েছে, সেটি নির্বাচনের আগে কী করে গঠন করা যাবে ওই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। যেমন জুলাই সনদের ২১ নম্বরে বলা হয়েছে: “সংবিধানে যুক্ত করা হবে যে, (ক) বাংলাদেশে একটি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা থাকিবে, যাহার নিম্নকক্ষ (জাতীয় সংসদ) এবং উচ্চকক্ষ (সিনেট) ১০০ (একশত) সদস্য নিয়ে নিয়ে গঠিত হইবে।”

প্রশ্ন হলো, সনদের এই ধারা বাস্তবায়ন করে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব কি না? কারণ বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনসভা এক কক্ষবিশিষ্ট। এটিকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। এটি রাষ্ট্রের একটি মৌলিক পরিবর্তন। শুধু রাষ্ট্রপতির একটি অধ্যাদেশ দিয়ে এত বড় একটি পরিবর্তন করা সম্ভব কি না—ওই প্রশ্নটি এরইমধ্যে উঠেছে। সুতরাং, জুলাই সনদের আলোকে নির্বাচন হতে হবে—এই দাবিতে যারা অবিচল, তারা এই সমস্যার কী সমাধান দিচ্ছেন? সংবিধানের এত বড় একটি পরিবর্তন এবং সংসদের কাঠামোতে পরিবর্তন হয়ে যাবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে?

নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদ গঠনের আগেই সাংবিধানিক ও সংসদীয় কাঠামোর সংস্কারের জন্য সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে মতামত চাওয়া যেতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

১০৬ অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে, সেটিকে সহজ করে এভাবে বলা যায়: যদি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মাণ হয় যে, আইনের এমন কোনো প্রশ্ন উঠেছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা এতটাই জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারবেন এবং আপিল বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে তার মতামত জানাতে পারবেন।

এর ব্যাখ্যা হলো, ক) ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো একটি বিষয়ে আপিল বিভাগের মতামত নেয়া হবে কি না, সেটি রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। খ) রাষ্ট্রপতির কাছে বিষয়টা জনগুরুত্বপূর্ণ মনে হতে হবে। তার মানে সকল রাজনৈতিক দলের কাছে বা বিজ্ঞজনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ার পরে যদি বিষয়টা রাষ্ট্রপতির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে না হয়, তখন কী হবে? তিনি কি আপিল বিভাগের মতামত নেবেন না? গ) সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া সকল কাজ রাষ্ট্রতিকে করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে। কিন্তু বাংলাদেশে এ মুহূর্তে কোনো প্রধানমন্ত্রী নেই। তাহলে ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে রাষ্ট্রপতি যদি কোনো বিষয়ে আপিল বিভাগের মতামত শুনতে চান তাহলে তিনি কার পরামর্শ নেবেন, প্রধান উপদেষ্টার? বিদ্যমান সংবিধান সেটি অনুমোদন করে? ঘ) আপিল বিভাগ উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে মতামত জানাবেন।

অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে সংবিধানের এই বিধানের আলোকে, অর্থাৎ ১০৬ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। জুলাই সনদের ভূমিকায়ও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে: “বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রেরিত প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন।”

বাস্তবতা হলো, গত বছরের ৫ থেকে ৮ অগাস্ট দেশে কোনো সরকার ছিল না। তাছাড়া, ১০৬ অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেটি ‘অ্যাবসোলিউট’ নয়। অর্থাৎ আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে সরকার বা রাষ্ট্র যা খুশি করতে পারে না। ধরা যাক, রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের কাছে দেশের নাম, জাতীয় সংগীত, সংবিধানের মূলনীতি বা সংসদের কাঠামো পরিবর্তনের বিষয়ে মতামত চাইলেন। এ বিষয়ে মতামত বা সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার কি আপিল বিভাগের আছে? সংবিধান রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানকেই চূড়ান্ত ক্ষমতা দেয়নি। বরং প্রত্যেককে তার সীমানার ভেতরে স্বাধীন করেছে এবং পরস্পরকে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল করে দিয়েছে—যাতে একটা ভারসাম্য থাকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় এই ভারসাম্যটি কম বলেই এত আলোচনা, এত বিতর্ক। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে যা খুশি করা যাবে।

দ্বিতীয়ত, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে জুলাই সনদের বিষয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের সুরাহা করার আগে এই সনদের একটি বিরাট ত্রুটি নিয়েও কথা বলা প্রয়োজন। সেটি হলো, জুলাই সনদের ২ নম্বর অঙ্গীকারে বলা হয়েছে: “এই সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করবো এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।” তার মানে যে জুলাই সনদকে সংবিধানের উপরে স্থান দেয়া হচ্ছে, ওই সনদের বাস্তবায়নের বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে আপিল বিভাগের মতামত চাওয়াও যে একটা পরিহাস, সেটিও হয়তো অনেকে খেয়াল করছেন না অথবা দেখেও না দেখার ভান করছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ কি সর্বরোগের মহৌষধ?

আপডেট সময় : ০৯:২৯:৩৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেটি ‘অ্যাবসোলিউট’ নয়। অর্থাৎ আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে সরকার বা রাষ্ট্র যা খুশি করতে পারে না।

যে সংবিধানের আলোকে দেশ চলছে বা যে সংবিধানকে মুজিববাদ, ফ্যাসিবাদী বা আওয়ামী লীগের সংবিধান বলে গালি দেওয়া হয়, সেটি বাহাত্তরের সংবিধান নয়; বরং সেটি জিয়ারও সংবিধান, এরশাদেরও।

 

 

 

বাহাত্তরের সংবিধানকে ‘মরহুম সংবিধান’ আখ্যা দিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। সোমবার রাজধানীতে জাতীয় যুবশক্তির এক অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেন। অবশ্য তার দলের শীর্ষ নেতারা শুরু থেকেই বাহাত্তরের সংবিধানকে মুজিববাদী ও ফ্যাসিবাদী সংবিধান আখ্যা দিয়ে এর কবর রচনার কথাও বলছেন।

বাস্তবতা হলো, বাহাত্তরের সংবিধান বলে এ মুহূর্তে দেশে কিছু নেই। কেননা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে যে সংবিধান গৃহীত হয়, ওই সংবিধানে এখন পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন আনা হয়েছে। এর মধ্যে জিয়াউর রহমানের আমলে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মূলনীতি বদলে দেয়া হয়। সংবিধানের শুরুতে যুক্ত করা হয় বিসমিল্লাহ। এরশাদের সময় অষ্টম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে যুক্ত করা হয় রাষ্ট্রধর্ম। এরপর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনা হয় ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ওই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাহাত্তরের মূল সংবিধানের মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হলেও বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্মসহ অন্য আরও অনেক পরিবর্তন অক্ষুণ্ন রাখা হয়। তার মানে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যে সংবিধানটি বিদ্যমান এবং যে সংবিধানের আলোকে দেশ চলছে বা যে সংবিধানকে মুজিববাদ, ফ্যাসিবাদী বা আওয়ামী লীগের সংবিধান বলে গালি দেয়া হয়, সেটি বাহাত্তরের সংবিধান নয়; বরং সেটি জিয়ারও সংবিধান। সেটি এরশাদেরও সংবিধান!

এবার আসা যাক সংবিধান পরিবর্তনের প্রসঙ্গে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানকে বলা হয় রক্তে লেখা সংবিধান। রাষ্ট্রের প্রয়োজনের কথা বলে এই সংবিধানে এ পর্যন্ত যে ১৭ বার সংশোধনী আনা হয়েছে, তার কতগুলো সত্যিই রাষ্ট্র ও জনগণের প্রয়োজনে হয়েছে আর কতটি সংশোধনী ক্ষমতাসীন দলের প্রয়োজনে—ওই তর্ক এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু এই সংবিধান যে গণতন্ত্রের বিকাশ ও নাগরিকের অধিকার সুরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে বা পুরোপুরি সফল হয়নি, তার পেছনে সংবিধানের ভাষার চেয়ে বেশি দায়ী সংবিধান প্রয়োগকারীদের অভিপ্রায়।

যখনই যারা সরকার পরিচালনা করেছে, সংবিধানকে তারা মূলত নিজেদের ক্ষমতায় টিকে থাকার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় ভারসাম্য নেই বলে কিংবা ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদে এমপিরা প্রাণ খুলে কথা বলতে পারেন না বলে এই সংবিধানের কবর রচনা করা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লিখিত সংবিধানকে মরহুম বলে টিপ্পনি কাটা কোনো সুস্থ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির লক্ষণ নয়।

সংবিধান চিরকালই সংশোধনযোগ্য। সময়ের প্রয়োজনে সংবিধানে পরিবর্তন আসে। ওই পরির্তনের সুযোগ সংবিধানেই রাখা হয়। আবার কখন কোন প্রক্রিয়ায় সংবিধান সংশোধন করা যাবে, সেটিও সংবিধানেই বলা থাকে।

সংবিধান, সংসদ, নির্বাচনের পদ্ধতি ইত্যাদির সুরাহা হবে কোন প্রক্রিয়ায়? যে জুলাই সনদ নিয়ে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে—সেটিরই বাস্তবায়ন হবে কীভাবে? এই সনদে উল্লিখিত সুপারিশগুলো কি অন্তর্বর্তী সরকার চাইলেই বাস্তবায়ন করতে পারবে?

সংবিধান সংস্কার কমিশন বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের যেসব সুপারিশ করেছে, তা আগামী সংসদ গঠিত হওয়া তথা নির্বাচনের আগে কী করে বাস্তবায়ন সম্ভব? জুলাই সনদে সংবিধানের যেসব অনুচ্ছেদে পরিবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে, ওগুলোই বা কীভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে? জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নতুন সংবিধান লেখার জন্য জাতীয় নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন চায়। কিন্তু এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি এবং বাংলাদেশে গণপরিষদ গঠন বাস্তবসম্মত কি না—ওই তর্কেরও সুরাহা হয়নি।

কোনো কোনো দল, বিশেষ করে জামায়াত ও এনসিপি জুলাই সনদের আলোকে জাতীয় নির্বাচন চায়। কিন্তু এই সনদে রাষ্ট্রের কাঠামো, বিশেষ করে সংসদের কাঠামো পরিবর্তনের যে সুপারিশ রয়েছে, সেটি নির্বাচনের আগে কী করে গঠন করা যাবে ওই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। যেমন জুলাই সনদের ২১ নম্বরে বলা হয়েছে: “সংবিধানে যুক্ত করা হবে যে, (ক) বাংলাদেশে একটি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা থাকিবে, যাহার নিম্নকক্ষ (জাতীয় সংসদ) এবং উচ্চকক্ষ (সিনেট) ১০০ (একশত) সদস্য নিয়ে নিয়ে গঠিত হইবে।”

প্রশ্ন হলো, সনদের এই ধারা বাস্তবায়ন করে জাতীয় নির্বাচন সম্ভব কি না? কারণ বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনসভা এক কক্ষবিশিষ্ট। এটিকে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। এটি রাষ্ট্রের একটি মৌলিক পরিবর্তন। শুধু রাষ্ট্রপতির একটি অধ্যাদেশ দিয়ে এত বড় একটি পরিবর্তন করা সম্ভব কি না—ওই প্রশ্নটি এরইমধ্যে উঠেছে। সুতরাং, জুলাই সনদের আলোকে নির্বাচন হতে হবে—এই দাবিতে যারা অবিচল, তারা এই সমস্যার কী সমাধান দিচ্ছেন? সংবিধানের এত বড় একটি পরিবর্তন এবং সংসদের কাঠামোতে পরিবর্তন হয়ে যাবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে?

নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদ গঠনের আগেই সাংবিধানিক ও সংসদীয় কাঠামোর সংস্কারের জন্য সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে মতামত চাওয়া যেতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।

১০৬ অনুচ্ছেদে যা বলা হয়েছে, সেটিকে সহজ করে এভাবে বলা যায়: যদি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রতীয়মাণ হয় যে, আইনের এমন কোনো প্রশ্ন উঠেছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা এতটাই জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য পাঠাতে পারবেন এবং আপিল বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে তার মতামত জানাতে পারবেন।

এর ব্যাখ্যা হলো, ক) ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো একটি বিষয়ে আপিল বিভাগের মতামত নেয়া হবে কি না, সেটি রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। খ) রাষ্ট্রপতির কাছে বিষয়টা জনগুরুত্বপূর্ণ মনে হতে হবে। তার মানে সকল রাজনৈতিক দলের কাছে বা বিজ্ঞজনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ার পরে যদি বিষয়টা রাষ্ট্রপতির কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে না হয়, তখন কী হবে? তিনি কি আপিল বিভাগের মতামত নেবেন না? গ) সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া সকল কাজ রাষ্ট্রতিকে করতে হয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে। কিন্তু বাংলাদেশে এ মুহূর্তে কোনো প্রধানমন্ত্রী নেই। তাহলে ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে রাষ্ট্রপতি যদি কোনো বিষয়ে আপিল বিভাগের মতামত শুনতে চান তাহলে তিনি কার পরামর্শ নেবেন, প্রধান উপদেষ্টার? বিদ্যমান সংবিধান সেটি অনুমোদন করে? ঘ) আপিল বিভাগ উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে মতামত জানাবেন।

অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগের পতনের পরে সংবিধানের এই বিধানের আলোকে, অর্থাৎ ১০৬ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়। জুলাই সনদের ভূমিকায়ও বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে: “বিদ্যমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রেরিত প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামতের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন।”

বাস্তবতা হলো, গত বছরের ৫ থেকে ৮ অগাস্ট দেশে কোনো সরকার ছিল না। তাছাড়া, ১০৬ অনুচ্ছেদে আপিল বিভাগের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেটি ‘অ্যাবসোলিউট’ নয়। অর্থাৎ আপিল বিভাগের মতামত নিয়ে সরকার বা রাষ্ট্র যা খুশি করতে পারে না। ধরা যাক, রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের কাছে দেশের নাম, জাতীয় সংগীত, সংবিধানের মূলনীতি বা সংসদের কাঠামো পরিবর্তনের বিষয়ে মতামত চাইলেন। এ বিষয়ে মতামত বা সিদ্ধান্ত দেয়ার এখতিয়ার কি আপিল বিভাগের আছে? সংবিধান রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানকেই চূড়ান্ত ক্ষমতা দেয়নি। বরং প্রত্যেককে তার সীমানার ভেতরে স্বাধীন করেছে এবং পরস্পরকে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল করে দিয়েছে—যাতে একটা ভারসাম্য থাকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোয় এই ভারসাম্যটি কম বলেই এত আলোচনা, এত বিতর্ক। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে যা খুশি করা যাবে।

দ্বিতীয়ত, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে জুলাই সনদের বিষয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের সুরাহা করার আগে এই সনদের একটি বিরাট ত্রুটি নিয়েও কথা বলা প্রয়োজন। সেটি হলো, জুলাই সনদের ২ নম্বর অঙ্গীকারে বলা হয়েছে: “এই সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করবো এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।” তার মানে যে জুলাই সনদকে সংবিধানের উপরে স্থান দেয়া হচ্ছে, ওই সনদের বাস্তবায়নের বিষয়ে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে আপিল বিভাগের মতামত চাওয়াও যে একটা পরিহাস, সেটিও হয়তো অনেকে খেয়াল করছেন না অথবা দেখেও না দেখার ভান করছেন।