ঢাকা ০৩:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
নবাবগঞ্জের প্রয়াত সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের সুযোগ্য কন্যা মেহেনাজ মান্নান ইলিশ ধরায় খরচ ৮৩০ টাকা, ভোক্তার গুনতে হয় অন্তত ২ হাজার নির্বাচন কে সামনে রেখে উত্তাল ঢাকা-১ দোহার-নবাবগঞ্জ আসন আটপাড়ায় কালী মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর কেন্দুয়ায় মানবপাচার মামলার আসামীরা রিমান্ডে মাস্টারমাইন্ডের নাম প্রকাশ করেছে ‎ ‎কেন্দুয়ায় মানবপাচারের মামলায় চীনা নাগরিকসহ দুই আসামীকে কারাগারে প্রেরণ কেন্দুয়া থেকে তিন নারীকে চীনে পাচারের চেষ্টা; চীনা নাগরিকসহ আটক দুইজন কেন্দুয়ায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার ৫ ‎কেন্দুয়ায় প্রকল্পের অনিয়ম তদন্তের সময় হাতাহাতি: ইউএনও আহত কেন্দুয়ায় প্রশাসনের অভিযানে অবৈধ জাল ধ্বংস ওসমান হাদী দাবিতে ঘনিষ্ঠ ভিডিও প্রচার, সামনে এলো আসল সত্য ব্লাড মুন দেখা যাবে রোববার, চাঁদ লাল হওয়ার কারণ কী? তিন দলই প্রধান উপদেষ্টার অধীনে নির্বাচন চায়: প্রেস সচিব টিউলিপ বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্টধারী, রয়েছে টিআইএনও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়াই হোক নববর্ষের অঙ্গীকার: প্রধান উপদেষ্টা নরেন্দ্র মোদিকে উপহার দেওয়া ছবিটি সম্পর্কে যা জানা গেল বিমসটেকের পরবর্তী চেয়ারম্যান ড. ইউনূস বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে মোদির ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন: প্রেসসচিব চীন সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে ভারতে তোলপাড়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু’র খুঁটিনাটি তথ্য

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ০১:২২:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • / 173
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (সংক্ষেপে: ডাকসু হিসেবে পরিচিত)[ক] হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। এটি ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।[১][২] পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বনাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ গ্রহণ করা হয়। ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ বলা হয়।[৩][৪] বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার হল এই ছাত্র সংসদ। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসে গৌরবময় ভূমিকা রাখে এই ছাত্র সংসদ।[৫] ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ।[৫][৬]

প্রতিষ্ঠা ও ইতিহাস
প্রতিষ্ঠা থেকে ১৯৯০
১৯২২ সালের ১লা ডিসেম্বর কার্জন হলে অনুষ্ঠিত শিক্ষকদের একটি সভায় ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’ নামে একটি ছাত্র সংসদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।[১] ১৯২৩ সালের ১৯শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী পরিষদ পূর্বোল্লিখিত শিক্ষক সভার সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেয়।[১] ১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদের সাধারণ সভায় খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ অনুমোদন করলে তা কার্যকর হয়। প্রথমবার ১৯২৪-২৫ সালে সম্পাদক ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, পরের বছর অবনীভূষণ রুদ্র। ১৯২৯-৩০ সালে সম্পাদক নির্বাচিত হন আতাউর রহমান খান।[৭]

পরবর্তীতে ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বনাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ গ্রহণ করা হয়।[৭] বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাহবুবুর জামান।[৮] সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন।[৯] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ১৯৯০ পর্যন্ত ৩৬ বার নির্বাচন হয়েছে।

১৯৯০ থেকে বর্তমান
ডাকসুতে ক্ষমতাসীন দল বিরোধী ছাত্রসংগঠন জয়ী হতে পারে—এই আশঙ্কা থেকে ৯০ পরবর্তী সরকারগুলো এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনীহ ছিল।[১০] উপাচার্য একে আজাদ চৌধুরী ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেও নানা মহলের চাপ ও বাধায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচন আর হয়নি।[৬] নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স ও সুযোগ না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর বড় নেতাদেরও অনাগ্রহ ছিল।[১০] ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অর্থবহ কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার–ঘনিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোয় ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্য।[১০] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘ছাত্র সংসদ না থাকায় মাস্তানতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।[১১]

গঠনতন্ত্র
উপাচার্যকে সভাপতি এবং ১৬ জন ছাত্র প্রতিনিধি থেকে ১০ জন কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়, কোষাধাক্ষের দায়িত্ব পালন করেন একজন শিক্ষক। ২০১৯ সালে সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, পদাধিকারবলে ডাকসুর সভাপতি উপাচার্যসহ এর নির্বাহী কমিটি হবে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট।[১২] ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে ডাকসুর কথা বলা হয়েছে৷[১৩] আর ডাকসুর গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ডাকসু নির্বাচন হবে৷[১৩] কীভাবে হবে, কাদেরকে নিয়ে হবে, সেগুলো বিস্তারিত বলা আছে গঠনতন্ত্রে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্র সংসদ আছে৷ সেখানেও সরাসরি ভোটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার বিধান রয়েছে৷[১৩]

জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা
৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ।[৫][৬][১৪] ডাকসুর নেতৃবৃন্দের সাহসী ও বলিষ্ঠ উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।[১৫]

ডাকসু ভিপি ও জিএস তালিকা

ক্রম সেশন সহ সভাপতি (ভিপি) ছাত্র সংগঠন জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) ছাত্র সংগঠন
০১ ১৯২৪-২৫ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত
০২ ১৯২৫-২৬ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এ কে মুখার্জি (ভারপ্রাপ্ত এ বি রুদ্র)
০৩ ১৯২৭-২৮ বি কে অধিকারী
০৪ ১৯২৮-২৯ এএম আজহারুল ইসলাম এস চক্রবর্তী
০৫ ১৯২৯-৩০ রমণী কান্ত ভট্টাচার্য কাজী রহমত আলী ও আতাউর রহমান
০৬ ১৯৩২-৩৩ ভবেশ চক্রবর্তী
০৭ ১৯৩৩-৩৪ ভবেশ চক্রবর্তী
০৮ ১৯৩৫-৩৬ এ এইচ এম এ কাদের
০৯ ১৯৩৬-৩৭ এ এইচ এম এ কাদের
১০ ১৯৩৮-৩৯ আব্দুল আওয়াল খান
১১ ১৯৪১-৪২ আব্দুর রহিম
১২ ১৯৪৫-৪৬ আহমদুল কবির (ভারপ্রাপ্ত ফরিদ আহমেদ) সুধীর দত্ত
১৩ ১৯৪৬-৪৭ ফরিদ আহমেদ সুধীর দত্ত
১৪ ১৯৪৭-৪৮ অরবিন্দ বোস গোলাম আযম
১৫ ১৯৫৩-৫৪ এস. এ. বারী জুলমত আলী খান (ভারপ্রাপ্ত ফরিদ আহমেদ)
১৬ ১৯৫৪-৫৫ নিরোদ বিহারী নাগ আব্দুর রব চৌধুরী
১৭ ১৯৫৫-৫৬ নিরোদ বিহারী নাগ আব্দুর রব চৌধুরী
১৮ ১৯৫৬-৫৭ একরামুল হক শাহ আলী হোসেন
১৯ ১৯৫৭-৫৮ বদরুল আলম ফজলী হোসেন
২০ ১৯৫৮-৫৯ আবুল হোসেন এ টি এম মেহেদী
২১ ১৯৫৯-৬০ আমিনুল ইসলাম তুলা আশরাফ উদ্দিন মকবুল ছাত্র ইউনিয়ন
২২ ১৯৬০-৬১ বেগম জাহানারা আক্তার অমূল্য কুমার
২৩ ১৯৬১-৬২ এস এম রফিকুল হক এনায়েতুর রহমান
২৪ ১৯৬২-৬৩ শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ কে এম ওবায়েদুর রহমান ছাত্রলীগ
২৫ ১৯৬৩-৬৪ রাশেদ খান মেনন ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়ন
২৬ ১৯৬৪-৬৫ বোরহানউদ্দিন ছাত্র ইউনিয়ন আসাফউদ্দৌলা
২৭ ১৯৬৬-৬৭ ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ছাত্রলীগ শফি আহমেদ
২৮ ১৯৬৭-৬৮ মাহফুজা খানম ছাত্র ইউনিয়ন মোরশেদ আলী ছাত্র ইউনিয়ন
২৯ ১৯৬৮-৬৯ তোফায়েল আহমেদ ছাত্রলীগ নাজিম কামরান চৌধুরী
৩০ ১৯৭০-৭১ আ স ম আবদুর রব ছাত্রলীগ আব্দুল কুদ্দুস মাখন ছাত্রলীগ
৩১ ১৯৭২-৭৩ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ছাত্র ইউনিয়ন মাহবুব জামান ছাত্র ইউনিয়ন
৩২ ১৯৭৯-৮০ মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ ছাত্রলীগ আখতারুজ্জামান বাসদ ছাত্রলীগ
৩৩ ১৯৮০-৮১ মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ ছাত্রলীগ আখতারুজ্জামান বাসদ ছাত্রলীগ
৩৪ ১৯৮২-৮৩ আখতারুজ্জামান বাসদ ছাত্রলীগ জিয়া উদ্দীন আহমেদ বাবলু বাসদ ছাত্রলীগ
৩৫ ১৯৮৯-৯০ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ছাত্রলীগ মুশতাক হোসেন
৩৬ ১৯৯০-৯১ আমানউল্লাহ আমানশহীদ উদ্দিন চৌধূরী এ্যানি (ভারপ্রাপ্ত-১৯৯২) ছাত্রদল খায়রুল কবির খোকন ছাত্রদল
৩৭ ২০১৯-২০ নুরুল হক নুর সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ গোলাম রব্বানী ছাত্রলীগ

ডাকসু সংগ্রহশালার প্রদর্শনী কক্ষ ও দর্শনার্থী
ডাকসুর একটি সংগ্রহশালা রয়েছে। ডাকসুর সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন এবং এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষিত রয়েছে ডাকসু সংগ্রহশালায়। ১৮৮৩ সাল থেকে এ দেশের মুদ্রা, দুর্লভ আলোকচিত্র, পুস্তক, কোলাজ পদ্ধতির পোস্টার, পত্রিকা কাটিং, ভাষা শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইত্যাদি ইতিহাসের উপাদান সংরক্ষিত আছে এখানে। এটিকে অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মিনি জাদুঘর’ হিসেবে অভিহিত করে। ১৯৯২ সালের ৭ জানুয়ারি ডাকসু ভবনের নিচতলায় একটি কক্ষে যাত্রা শুরু করে এটি। এখানে প্রবেশের আগে চোখে পড়ে ভবনের দেয়ালে অাঁকা ভাষা শহীদদের ম্যুরাল ‘চেতনায় একুশ’। ভেতরে আছে বিভিন্ন সময়ের ছাত্র নেতা, রাজনীতিবিদ, শহীদ, শিক্ষাবিদ, দার্শনিকদের ছবি। সংগ্রহশালার এক কোনায় রয়েছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক আমতলার আমগাছের ধ্বংসাবশেষ। কক্ষের ভেতরে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। এখানে রয়েছে ৩৫ জন ভাষাসৈনিকের মুদ্রিত সাক্ষাৎকার, ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক ২৯টি পোস্টার, ভাষাসৈনিকদের ১৫টি আলোকচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসংবলিত ছবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্তের আলোকচিত্র, প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, প্রচারপত্র, স্মারকলিপি ইত্যাদি।[১৬]

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সংক্ষেপে ডাকসু নামে পরিচিত৷ ডাকসু গঠনতন্ত্রে প্রতি বছর নির্বাচন হওয়ার বিধান থাকলেও দীর্ঘ ২৮ বছর কোনো নির্বাচন হয়নি৷ ফলে এক সময়ের দ্বিতীয় সংসদ হিসেবে পরিচিত ডাকসু তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে৷দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে অকার্যকর হয়ে আছে৷

১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাসু) সৃষ্টি করা হয়। এটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক কার্যকলাপের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি পায়। ঐ সময় প্রতিটি ছাত্র ১ টাকা দিয়ে সদস্য হতে পারত। সেই সময়ের তিনটি হল- ঢাকা হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও জগন্নাথ হল- প্রতিটি হল থেকে একজন করে শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধি এবং উপাচার্য মনোনীত একজন শিক্ষক নিয়ে সংসদ গঠন করা হত। তখন থেকেই সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাত্র প্রতিনিধিদের মধ্য থেকেই নির্বাচন করা হত। এ সময় ছাত্র সংসদের কার্যক্রম শুধুমাত্র সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখন ছাত্র সংসদ সাধারণ মিলনায়তন পরিচালনা, বিতর্ক সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত।

ডাসু থেকে ডাকসু:

১৯৫৩ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)।

ডাকসু গঠনতন্ত্র ও সংশোধন:

১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদের সাধারণ সভায় খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ অনুমোদন করলে তা কার্যকর হয়। এতে ছাত্র প্রতিনিধি ও মনোনীত শিক্ষক প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ কর্তৃক কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৩৯ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে বলা হয় মুসলমান হল থেকে সহ-সভাপতি হলে হিন্দু হল থেকে সাধারণ সম্পাদক কিংবা হিন্দু হল থেকে সহ-সভাপতি হলে মুসলমান হল থেকে সাধারণ সম্পাদক হবে। সাম্প্রদায়িক প্রভাবের কারণে এই সংশোধন করা হয়। আর গঠনতন্ত্রে এই সংশোধনের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের উপশম হয়।

১৯৪৪-৪৫ সালে বিশ্ব নির্বাহী পরিষদ আরেকটি সংশোধন অনুমোদন করে। চারটি হলের প্রতিটি থেকে চারজন করে ষোল জন এবং মেয়েদের মধ্য থেকে একজন ছাত্রী প্রতিনিধি ছাত্র-ছাত্রীরা সংসদের জন্য নির্বাচন করতে পারত। এ ১৭ জনের পরিষদ থেকে একজন ভিপি ও একজন জিএস নির্বাচিত হত।

১৯৫৩ সালে পুনরায় গঠনতন্ত্রে সংশোধন করা হয়। নাম পরিবর্তন তরে রাখা হয় ডাকসু। উপাচাযর্কে সভাপতি এবং ১৬ জন ছাত্র প্রতিনিধি থেকে ১০ জন কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়। কোষাধ্যক্ষ থাকতেন একজন শিক্ষক।

১৯৯১ সালের ১৭ জুন সিন্ডিকেটের সভায় একটি সংশোধনী আনা হয়। এতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা প্রিলিমিনারি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টসের ডিগ্রি পাস কোর্স, বিএফএ, বিবিএ, ডিপ্লোমা, পরিসংখ্যান ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সার্টিফিকেট কোর্সের শিক্ষার্থীরা ভোটার হতে পারবেন। কিন্তু এদের মধ্যে যারা কোনো কোর্সে শিক্ষাবিরতি দিয়ে পুনর্ভর্তি হয়েছেন বা ফি দেওয়ার সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, তারা সে সুযোগ পাবেন না।

১৯৯৮ সালে সর্বশেষ ডাকসু গঠনতন্ত্রের সংশোধন করা হয়েছিল৷

ডাকসু গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে ডাকসু নির্বচনের পর মাত্র এক বছর তার কার্যকারিতা থাকবে। এই সময়ের পর যদি ডাকসু নির্বাচন না হয় তবে ৩ মাস পর্যন্ত কার্যকারিতা থাকবে। এরপর ডাকসু বাতিল হয়ে যাবে। আর কেবল নিয়মিত ছাত্ররাই ডাকসুর কর্মকর্তা কিংবা সদস্য হতে পারবে। যদি ডাকসুর কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়ার পর কারও ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যায় সাথে সাথে ডাকসু হতে তার পদও বাতিল হয়ে যাবে।

সর্বশেষ চলতি বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন করার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি গঠন করা হয়৷গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি গত বৃহস্পতিবার(১০ জানুয়ারি) ১৩ টি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সাথে বৈঠক করে সোমবারের (১৪জানুয়ারি) মধ্যে লিখিত প্রস্তাব দেয়ার নির্দেশ দেয়৷

ডাকসু নির্বাচন :

১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাসু) সৃষ্টি হয়। মোট ৩৬ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমদিকে ডাকসুর ভিপি মনোনীত করা হত, ১৯২৪-২৫ সালে প্রথম ডাকসুর ভিপি মনোনীত করা হয়। ডাকসুর প্রথম ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন যথাক্রমে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।

১৯২৮-২৯ সেশনে ভিপি ও জিএস হিসেবে মনোনীত হন এ এম আজহারুল ইসলাম ও এস চক্রবর্তী, ১৯২৯-৩২ সময়কালে রমণী কান্ত ভট্টাচার্য ও কাজী রহমত আলী ও আতাউর রহমান, ১৯৪৭-৪৮ সেশনে অরবিন্দ বোস ও গোলাম আযম।

১৯৫৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ডাকসুর প্রথম নিবার্চন অনুষ্ঠিত হয়। এর পূর্বে ভিপি মনোনীত ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটে প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৫৩ সালে। ডাকসুর প্রথম ভিপি (ভাইস প্রেসিডেন্ট) হিসেবে নির্বাচিত হন এস এ বারী এটি এবং জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি) হিসেবে নির্বাচিত হন জুলমত আলী খান।

এরপর ভিপি ও জিএস নির্বাচিতদের মধ্যে যথাক্রমে রয়েছেন নিরোদ বিহারী নাগ ও আব্দুর রব চৌধুরী, একরামুল হক ও শাহ আলী হোসেন, বদরুল আলম ও মো. ফজলী হোসেন, আবুল হোসেন ও এটিএম মেহেদী, আমিনুল ইসলাম তুলা ও আশরাফ উদ্দিন মকবুল, বেগম জাহানারা আখতার ও অমূল্য কুমার, এস এম রফিকুল হক ও এনায়েতুর রহমান, শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ও কে এম ওবায়েদুর রহমান, রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন ও আসাফুদ্দৌলা, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও শফি আহমেদ, মাহফুজা খানম ও মোরশেদ আলী, তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী, আসম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোট ৭ বার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৯৭২ সালে ডাকসুর ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস নির্বাচিত হন মাহবুবুর জামান। সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন ৷

১৯৯০ থেকে ২০১৯:

১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসু নির্বাচনের পর ১৯৯১ সালের ১২ জুন তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করেছিলেন। ওই সময় কিছু সংখ্যক ছাত্রনেতা তাদের ছাত্রত্ব বজায় রাখার জন্য বিশেষ ভর্তির দাবি জানান। এ নিয়ে উদ্ভূত সহিংসতায় ডাকসু নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে যায়।

এরপর ১৯৯৪ সালে ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করেছিলেন। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার অভিযোগ আনে ছাত্রলীগ। ফলে ডাকসু নির্বাচন স্থগিত হয়। ১৯৯৫ সালে আবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলেও নির্বাচন হয় নি। তারপর ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসির দায়িত্ব নেয়ার পর অন্তত ছয়বার ডাকসু নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমা গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু ওপর মহলের এবং বিরোধী ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের বাধায় তিনি ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করতে ব্যর্থ হন।

১৯৯৭ এর ২৭ মে সিন্ডিকেটের সভায় ডাকসু ভেঙে দেয়া হয়৷ ১৯৯৮ সালে ডাকসুর জন্য গঠিত নতুন (সংশোধিত) গঠনতন্ত্রে ডাকসু ভাঙার চার সাসের মধ্যে আবার নির্বাচন দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের আগেই ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত তা হয়নি। তারপর ২০০৫ সালের মে মাস ভিসি হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক ড এস এম এ ফয়েজ। ওই বছর ডিসেম্বরেই ডাকসু নির্বাচন দেয়ার কথা বলেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে সে নির্বাচন হয় নি ।

এরপর ২০১২ সালে বিক্ষোভ, ধর্মঘট, কালো পতাকা মিছিল এবং ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানান সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’ তৈরি করে লাগাতার কর্মসূচিও চলে বেশ কিছুদিন।

২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ শিক্ষার্থীর করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৭ জানুয়ারি এক রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। আদালতের নির্দেশনার পর ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ ডাকসু নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

আদালতের নির্দেশনার সাত মাসেও নির্বাচনের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উকিল নোটিশ দেন রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ অক্টোবর চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। সেই শুনানি শেষে গত রোববার হাইকোর্ট জানান, মার্চে ডাকসু নির্বাচনের কোনো বাধা নেই।

উপাচার্যের ভাষ্যমতে চলতি বছরের ৩১ বছরের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বদ্ধপরিকর৷লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রশাসন এগিয়ে যাচ্ছে৷

ডাকসু ভবন:

ডাকসু প্রতিষ্ঠার শুরুতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন পুরাতন কলা ভবনে ডাকসু অফিসের কার্যক্রম চালানো হত। ১৯৬২ সালে নীলক্ষেত সংলগ্ন কলাভবনের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলে ডাকসু অফিস কলা ভবনের পূর্বদিকের নিচতলায় স্থানান্তর করা হয়।

১৯৮০ সালে কলাভবনের পূর্ব-দক্ষিনের কোনে (জাপান স্টাডিজ যেখানে ঠিক সেখানে) ডাকসুর অফিস কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮২ সালে আলাদা ডাকসু ভবন নির্মান করা হয় ৷তখন থেকে বর্তমান মধুর ক্যান্টিনের সামনে ডাকসুর নিজস্ব ভবনে ডাকসুর দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ডাকসু গঠিত হয়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬২- এর শিক্ষানীতি আন্দোলন, ’৬৬ – এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণ-অভুত্থান, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, এবং ’৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছে ডাকসু। শুধু আন্দোলন সংগ্রামে নয়, অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের প্রধান কেন্দ্র হিসেবেও ডাকসু সুদীর্ঘ সময় নানা ভূমিকা রেখেছে, তৈরি করেছে নতুন নেতৃত্ব ও চেতনা। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় কোন যোগ্য প্রতিনিধিত্ব গড়ে উঠতে পারছে না। ডাকসুর মতো শক্তিশালী প্লাটফর্ম অকার্যকর থাকায় আবাসিক হলগুলোতে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম বিরাজ করলেও সাধারণ ছাত্রদের প্রতিবাদের কোন উপায় নেই। প্রতিনিয়ত ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু’র খুঁটিনাটি তথ্য

আপডেট সময় : ০১:২২:০২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (সংক্ষেপে: ডাকসু হিসেবে পরিচিত)[ক] হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। এটি ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়।[১][২] পরবর্তীতে ১৯৫৩ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বনাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ গ্রহণ করা হয়। ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদ বলা হয়।[৩][৪] বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার হল এই ছাত্র সংসদ। প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসে গৌরবময় ভূমিকা রাখে এই ছাত্র সংসদ।[৫] ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও সামরিকতন্ত্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ।[৫][৬]

প্রতিষ্ঠা ও ইতিহাস
প্রতিষ্ঠা থেকে ১৯৯০
১৯২২ সালের ১লা ডিসেম্বর কার্জন হলে অনুষ্ঠিত শিক্ষকদের একটি সভায় ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’ নামে একটি ছাত্র সংসদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।[১] ১৯২৩ সালের ১৯শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নির্বাহী পরিষদ পূর্বোল্লিখিত শিক্ষক সভার সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেয়।[১] ১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদের সাধারণ সভায় খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ অনুমোদন করলে তা কার্যকর হয়। প্রথমবার ১৯২৪-২৫ সালে সম্পাদক ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, পরের বছর অবনীভূষণ রুদ্র। ১৯২৯-৩০ সালে সম্পাদক নির্বাচিত হন আতাউর রহমান খান।[৭]

পরবর্তীতে ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে পূর্বনাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ গ্রহণ করা হয়।[৭] বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ডাকসুর সহসভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাহবুবুর জামান।[৮] সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন।[৯] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ১৯৯০ পর্যন্ত ৩৬ বার নির্বাচন হয়েছে।

১৯৯০ থেকে বর্তমান
ডাকসুতে ক্ষমতাসীন দল বিরোধী ছাত্রসংগঠন জয়ী হতে পারে—এই আশঙ্কা থেকে ৯০ পরবর্তী সরকারগুলো এ নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনীহ ছিল।[১০] উপাচার্য একে আজাদ চৌধুরী ডাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেও নানা মহলের চাপ ও বাধায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচন আর হয়নি।[৬] নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বয়স ও সুযোগ না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলোর বড় নেতাদেরও অনাগ্রহ ছিল।[১০] ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের অর্থবহ কোনো উদ্যোগ নেয়নি সরকার–ঘনিষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোয় ক্রমে ক্রমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্য।[১০] ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বলেন, ‘ছাত্র সংসদ না থাকায় মাস্তানতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।[১১]

গঠনতন্ত্র
উপাচার্যকে সভাপতি এবং ১৬ জন ছাত্র প্রতিনিধি থেকে ১০ জন কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়, কোষাধাক্ষের দায়িত্ব পালন করেন একজন শিক্ষক। ২০১৯ সালে সংশোধিত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, পদাধিকারবলে ডাকসুর সভাপতি উপাচার্যসহ এর নির্বাহী কমিটি হবে ২৫ সদস্যবিশিষ্ট।[১২] ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশে ডাকসুর কথা বলা হয়েছে৷[১৩] আর ডাকসুর গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে, প্রতি বছর ডাকসু নির্বাচন হবে৷[১৩] কীভাবে হবে, কাদেরকে নিয়ে হবে, সেগুলো বিস্তারিত বলা আছে গঠনতন্ত্রে৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্র সংসদ আছে৷ সেখানেও সরাসরি ভোটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার বিধান রয়েছে৷[১৩]

জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা
৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান, ৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ।[৫][৬][১৪] ডাকসুর নেতৃবৃন্দের সাহসী ও বলিষ্ঠ উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়।[১৫]

ডাকসু ভিপি ও জিএস তালিকা

ক্রম সেশন সহ সভাপতি (ভিপি) ছাত্র সংগঠন জেনারেল সেক্রেটারি (জিএস) ছাত্র সংগঠন
০১ ১৯২৪-২৫ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত
০২ ১৯২৫-২৬ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এ কে মুখার্জি (ভারপ্রাপ্ত এ বি রুদ্র)
০৩ ১৯২৭-২৮ বি কে অধিকারী
০৪ ১৯২৮-২৯ এএম আজহারুল ইসলাম এস চক্রবর্তী
০৫ ১৯২৯-৩০ রমণী কান্ত ভট্টাচার্য কাজী রহমত আলী ও আতাউর রহমান
০৬ ১৯৩২-৩৩ ভবেশ চক্রবর্তী
০৭ ১৯৩৩-৩৪ ভবেশ চক্রবর্তী
০৮ ১৯৩৫-৩৬ এ এইচ এম এ কাদের
০৯ ১৯৩৬-৩৭ এ এইচ এম এ কাদের
১০ ১৯৩৮-৩৯ আব্দুল আওয়াল খান
১১ ১৯৪১-৪২ আব্দুর রহিম
১২ ১৯৪৫-৪৬ আহমদুল কবির (ভারপ্রাপ্ত ফরিদ আহমেদ) সুধীর দত্ত
১৩ ১৯৪৬-৪৭ ফরিদ আহমেদ সুধীর দত্ত
১৪ ১৯৪৭-৪৮ অরবিন্দ বোস গোলাম আযম
১৫ ১৯৫৩-৫৪ এস. এ. বারী জুলমত আলী খান (ভারপ্রাপ্ত ফরিদ আহমেদ)
১৬ ১৯৫৪-৫৫ নিরোদ বিহারী নাগ আব্দুর রব চৌধুরী
১৭ ১৯৫৫-৫৬ নিরোদ বিহারী নাগ আব্দুর রব চৌধুরী
১৮ ১৯৫৬-৫৭ একরামুল হক শাহ আলী হোসেন
১৯ ১৯৫৭-৫৮ বদরুল আলম ফজলী হোসেন
২০ ১৯৫৮-৫৯ আবুল হোসেন এ টি এম মেহেদী
২১ ১৯৫৯-৬০ আমিনুল ইসলাম তুলা আশরাফ উদ্দিন মকবুল ছাত্র ইউনিয়ন
২২ ১৯৬০-৬১ বেগম জাহানারা আক্তার অমূল্য কুমার
২৩ ১৯৬১-৬২ এস এম রফিকুল হক এনায়েতুর রহমান
২৪ ১৯৬২-৬৩ শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ কে এম ওবায়েদুর রহমান ছাত্রলীগ
২৫ ১৯৬৩-৬৪ রাশেদ খান মেনন ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়ন
২৬ ১৯৬৪-৬৫ বোরহানউদ্দিন ছাত্র ইউনিয়ন আসাফউদ্দৌলা
২৭ ১৯৬৬-৬৭ ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ছাত্রলীগ শফি আহমেদ
২৮ ১৯৬৭-৬৮ মাহফুজা খানম ছাত্র ইউনিয়ন মোরশেদ আলী ছাত্র ইউনিয়ন
২৯ ১৯৬৮-৬৯ তোফায়েল আহমেদ ছাত্রলীগ নাজিম কামরান চৌধুরী
৩০ ১৯৭০-৭১ আ স ম আবদুর রব ছাত্রলীগ আব্দুল কুদ্দুস মাখন ছাত্রলীগ
৩১ ১৯৭২-৭৩ মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ছাত্র ইউনিয়ন মাহবুব জামান ছাত্র ইউনিয়ন
৩২ ১৯৭৯-৮০ মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ ছাত্রলীগ আখতারুজ্জামান বাসদ ছাত্রলীগ
৩৩ ১৯৮০-৮১ মাহমুদুর রহমান মান্না জাসদ ছাত্রলীগ আখতারুজ্জামান বাসদ ছাত্রলীগ
৩৪ ১৯৮২-৮৩ আখতারুজ্জামান বাসদ ছাত্রলীগ জিয়া উদ্দীন আহমেদ বাবলু বাসদ ছাত্রলীগ
৩৫ ১৯৮৯-৯০ সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ ছাত্রলীগ মুশতাক হোসেন
৩৬ ১৯৯০-৯১ আমানউল্লাহ আমানশহীদ উদ্দিন চৌধূরী এ্যানি (ভারপ্রাপ্ত-১৯৯২) ছাত্রদল খায়রুল কবির খোকন ছাত্রদল
৩৭ ২০১৯-২০ নুরুল হক নুর সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ গোলাম রব্বানী ছাত্রলীগ

ডাকসু সংগ্রহশালার প্রদর্শনী কক্ষ ও দর্শনার্থী
ডাকসুর একটি সংগ্রহশালা রয়েছে। ডাকসুর সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন এবং এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষিত রয়েছে ডাকসু সংগ্রহশালায়। ১৮৮৩ সাল থেকে এ দেশের মুদ্রা, দুর্লভ আলোকচিত্র, পুস্তক, কোলাজ পদ্ধতির পোস্টার, পত্রিকা কাটিং, ভাষা শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ইত্যাদি ইতিহাসের উপাদান সংরক্ষিত আছে এখানে। এটিকে অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মিনি জাদুঘর’ হিসেবে অভিহিত করে। ১৯৯২ সালের ৭ জানুয়ারি ডাকসু ভবনের নিচতলায় একটি কক্ষে যাত্রা শুরু করে এটি। এখানে প্রবেশের আগে চোখে পড়ে ভবনের দেয়ালে অাঁকা ভাষা শহীদদের ম্যুরাল ‘চেতনায় একুশ’। ভেতরে আছে বিভিন্ন সময়ের ছাত্র নেতা, রাজনীতিবিদ, শহীদ, শিক্ষাবিদ, দার্শনিকদের ছবি। সংগ্রহশালার এক কোনায় রয়েছে ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক আমতলার আমগাছের ধ্বংসাবশেষ। কক্ষের ভেতরে আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি। এখানে রয়েছে ৩৫ জন ভাষাসৈনিকের মুদ্রিত সাক্ষাৎকার, ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক ২৯টি পোস্টার, ভাষাসৈনিকদের ১৫টি আলোকচিত্র, মুক্তিযুদ্ধের তথ্যসংবলিত ছবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্তের আলোকচিত্র, প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, প্রচারপত্র, স্মারকলিপি ইত্যাদি।[১৬]

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ সংক্ষেপে ডাকসু নামে পরিচিত৷ ডাকসু গঠনতন্ত্রে প্রতি বছর নির্বাচন হওয়ার বিধান থাকলেও দীর্ঘ ২৮ বছর কোনো নির্বাচন হয়নি৷ ফলে এক সময়ের দ্বিতীয় সংসদ হিসেবে পরিচিত ডাকসু তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে৷দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে অকার্যকর হয়ে আছে৷

১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাসু) সৃষ্টি করা হয়। এটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক কার্যকলাপের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি পায়। ঐ সময় প্রতিটি ছাত্র ১ টাকা দিয়ে সদস্য হতে পারত। সেই সময়ের তিনটি হল- ঢাকা হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও জগন্নাথ হল- প্রতিটি হল থেকে একজন করে শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধি এবং উপাচার্য মনোনীত একজন শিক্ষক নিয়ে সংসদ গঠন করা হত। তখন থেকেই সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাত্র প্রতিনিধিদের মধ্য থেকেই নির্বাচন করা হত। এ সময় ছাত্র সংসদের কার্যক্রম শুধুমাত্র সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তখন ছাত্র সংসদ সাধারণ মিলনায়তন পরিচালনা, বিতর্ক সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত।

ডাসু থেকে ডাকসু:

১৯৫৩ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা হয়। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)।

ডাকসু গঠনতন্ত্র ও সংশোধন:

১৯২৫ সালের ৩০ অক্টোবর সংসদের সাধারণ সভায় খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী পরিষদ অনুমোদন করলে তা কার্যকর হয়। এতে ছাত্র প্রতিনিধি ও মনোনীত শিক্ষক প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত পরিষদ কর্তৃক কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়।

১৯৩৯ সালে গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে বলা হয় মুসলমান হল থেকে সহ-সভাপতি হলে হিন্দু হল থেকে সাধারণ সম্পাদক কিংবা হিন্দু হল থেকে সহ-সভাপতি হলে মুসলমান হল থেকে সাধারণ সম্পাদক হবে। সাম্প্রদায়িক প্রভাবের কারণে এই সংশোধন করা হয়। আর গঠনতন্ত্রে এই সংশোধনের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের উপশম হয়।

১৯৪৪-৪৫ সালে বিশ্ব নির্বাহী পরিষদ আরেকটি সংশোধন অনুমোদন করে। চারটি হলের প্রতিটি থেকে চারজন করে ষোল জন এবং মেয়েদের মধ্য থেকে একজন ছাত্রী প্রতিনিধি ছাত্র-ছাত্রীরা সংসদের জন্য নির্বাচন করতে পারত। এ ১৭ জনের পরিষদ থেকে একজন ভিপি ও একজন জিএস নির্বাচিত হত।

১৯৫৩ সালে পুনরায় গঠনতন্ত্রে সংশোধন করা হয়। নাম পরিবর্তন তরে রাখা হয় ডাকসু। উপাচাযর্কে সভাপতি এবং ১৬ জন ছাত্র প্রতিনিধি থেকে ১০ জন কর্মকর্তা নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়। কোষাধ্যক্ষ থাকতেন একজন শিক্ষক।

১৯৯১ সালের ১৭ জুন সিন্ডিকেটের সভায় একটি সংশোধনী আনা হয়। এতে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক, স্নাতকোত্তর বা প্রিলিমিনারি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্টসের ডিগ্রি পাস কোর্স, বিএফএ, বিবিএ, ডিপ্লোমা, পরিসংখ্যান ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সার্টিফিকেট কোর্সের শিক্ষার্থীরা ভোটার হতে পারবেন। কিন্তু এদের মধ্যে যারা কোনো কোর্সে শিক্ষাবিরতি দিয়ে পুনর্ভর্তি হয়েছেন বা ফি দেওয়ার সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, তারা সে সুযোগ পাবেন না।

১৯৯৮ সালে সর্বশেষ ডাকসু গঠনতন্ত্রের সংশোধন করা হয়েছিল৷

ডাকসু গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছে ডাকসু নির্বচনের পর মাত্র এক বছর তার কার্যকারিতা থাকবে। এই সময়ের পর যদি ডাকসু নির্বাচন না হয় তবে ৩ মাস পর্যন্ত কার্যকারিতা থাকবে। এরপর ডাকসু বাতিল হয়ে যাবে। আর কেবল নিয়মিত ছাত্ররাই ডাকসুর কর্মকর্তা কিংবা সদস্য হতে পারবে। যদি ডাকসুর কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়ার পর কারও ছাত্রত্ব শেষ হয়ে যায় সাথে সাথে ডাকসু হতে তার পদও বাতিল হয়ে যাবে।

সর্বশেষ চলতি বছরের ৩১ মার্চের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন করার লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি গঠন করা হয়৷গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি গত বৃহস্পতিবার(১০ জানুয়ারি) ১৩ টি ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সাথে বৈঠক করে সোমবারের (১৪জানুয়ারি) মধ্যে লিখিত প্রস্তাব দেয়ার নির্দেশ দেয়৷

ডাকসু নির্বাচন :

১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাসু) সৃষ্টি হয়। মোট ৩৬ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমদিকে ডাকসুর ভিপি মনোনীত করা হত, ১৯২৪-২৫ সালে প্রথম ডাকসুর ভিপি মনোনীত করা হয়। ডাকসুর প্রথম ভিপি ও সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন যথাক্রমে মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও যোগেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।

১৯২৮-২৯ সেশনে ভিপি ও জিএস হিসেবে মনোনীত হন এ এম আজহারুল ইসলাম ও এস চক্রবর্তী, ১৯২৯-৩২ সময়কালে রমণী কান্ত ভট্টাচার্য ও কাজী রহমত আলী ও আতাউর রহমান, ১৯৪৭-৪৮ সেশনে অরবিন্দ বোস ও গোলাম আযম।

১৯৫৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ডাকসুর প্রথম নিবার্চন অনুষ্ঠিত হয়। এর পূর্বে ভিপি মনোনীত ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটে প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৫৩ সালে। ডাকসুর প্রথম ভিপি (ভাইস প্রেসিডেন্ট) হিসেবে নির্বাচিত হন এস এ বারী এটি এবং জিএস (জেনারেল সেক্রেটারি) হিসেবে নির্বাচিত হন জুলমত আলী খান।

এরপর ভিপি ও জিএস নির্বাচিতদের মধ্যে যথাক্রমে রয়েছেন নিরোদ বিহারী নাগ ও আব্দুর রব চৌধুরী, একরামুল হক ও শাহ আলী হোসেন, বদরুল আলম ও মো. ফজলী হোসেন, আবুল হোসেন ও এটিএম মেহেদী, আমিনুল ইসলাম তুলা ও আশরাফ উদ্দিন মকবুল, বেগম জাহানারা আখতার ও অমূল্য কুমার, এস এম রফিকুল হক ও এনায়েতুর রহমান, শ্যামা প্রসাদ ঘোষ ও কে এম ওবায়েদুর রহমান, রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী, বোরহান উদ্দিন ও আসাফুদ্দৌলা, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ও শফি আহমেদ, মাহফুজা খানম ও মোরশেদ আলী, তোফায়েল আহমেদ ও নাজিম কামরান চৌধুরী, আসম আব্দুর রব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মোট ৭ বার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে৷ ১৯৭২ সালে ডাকসুর ভিপি হিসেবে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন থেকে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস নির্বাচিত হন মাহবুবুর জামান। সর্বশেষ ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য ভিপি ও জিএস পদে যথাক্রমে নির্বাচিত হন ছাত্রদলের আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুল কবির খোকন ৷

১৯৯০ থেকে ২০১৯:

১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসু নির্বাচনের পর ১৯৯১ সালের ১২ জুন তৎকালীন ভিসি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করেছিলেন। ওই সময় কিছু সংখ্যক ছাত্রনেতা তাদের ছাত্রত্ব বজায় রাখার জন্য বিশেষ ভর্তির দাবি জানান। এ নিয়ে উদ্ভূত সহিংসতায় ডাকসু নির্বাচন ভন্ডুল হয়ে যায়।

এরপর ১৯৯৪ সালে ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করেছিলেন। কিন্তু ডাকসু নির্বাচনের পরিবেশ না থাকার অভিযোগ আনে ছাত্রলীগ। ফলে ডাকসু নির্বাচন স্থগিত হয়। ১৯৯৫ সালে আবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলেও নির্বাচন হয় নি। তারপর ১৯৯৬ সালের অক্টোবরে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী ভিসির দায়িত্ব নেয়ার পর অন্তত ছয়বার ডাকসু নির্বাচনের নির্দিষ্ট সময়সীমা গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু ওপর মহলের এবং বিরোধী ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের বাধায় তিনি ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষনা করতে ব্যর্থ হন।

১৯৯৭ এর ২৭ মে সিন্ডিকেটের সভায় ডাকসু ভেঙে দেয়া হয়৷ ১৯৯৮ সালে ডাকসুর জন্য গঠিত নতুন (সংশোধিত) গঠনতন্ত্রে ডাকসু ভাঙার চার সাসের মধ্যে আবার নির্বাচন দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বরের আগেই ডাকসু নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু এ পর্যন্ত তা হয়নি। তারপর ২০০৫ সালের মে মাস ভিসি হিসেবে দায়িত্ব নেন অধ্যাপক ড এস এম এ ফয়েজ। ওই বছর ডিসেম্বরেই ডাকসু নির্বাচন দেয়ার কথা বলেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন বিরোধী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে সে নির্বাচন হয় নি ।

এরপর ২০১২ সালে বিক্ষোভ, ধর্মঘট, কালো পতাকা মিছিল এবং ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ডাকসু নির্বাচনের দাবি জানান সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী অধিকার মঞ্চ’ তৈরি করে লাগাতার কর্মসূচিও চলে বেশ কিছুদিন।

২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ শিক্ষার্থীর করা একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ১৭ জানুয়ারি এক রায়ে ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত। আদালতের নির্দেশনার পর ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ ডাকসু নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

আদালতের নির্দেশনার সাত মাসেও নির্বাচনের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে উকিল নোটিশ দেন রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ অক্টোবর চেম্বার বিচারপতি হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে বিষয়টি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। সেই শুনানি শেষে গত রোববার হাইকোর্ট জানান, মার্চে ডাকসু নির্বাচনের কোনো বাধা নেই।

উপাচার্যের ভাষ্যমতে চলতি বছরের ৩১ বছরের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বদ্ধপরিকর৷লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রশাসন এগিয়ে যাচ্ছে৷

ডাকসু ভবন:

ডাকসু প্রতিষ্ঠার শুরুতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন পুরাতন কলা ভবনে ডাকসু অফিসের কার্যক্রম চালানো হত। ১৯৬২ সালে নীলক্ষেত সংলগ্ন কলাভবনের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলে ডাকসু অফিস কলা ভবনের পূর্বদিকের নিচতলায় স্থানান্তর করা হয়।

১৯৮০ সালে কলাভবনের পূর্ব-দক্ষিনের কোনে (জাপান স্টাডিজ যেখানে ঠিক সেখানে) ডাকসুর অফিস কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮২ সালে আলাদা ডাকসু ভবন নির্মান করা হয় ৷তখন থেকে বর্তমান মধুর ক্যান্টিনের সামনে ডাকসুর নিজস্ব ভবনে ডাকসুর দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হয়।

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ডাকসু গঠিত হয়। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬২- এর শিক্ষানীতি আন্দোলন, ’৬৬ – এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯ এর গণ-অভুত্থান, ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, এবং ’৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে অগ্রনী ভুমিকা পালন করেছে ডাকসু। শুধু আন্দোলন সংগ্রামে নয়, অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমের প্রধান কেন্দ্র হিসেবেও ডাকসু সুদীর্ঘ সময় নানা ভূমিকা রেখেছে, তৈরি করেছে নতুন নেতৃত্ব ও চেতনা। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় কোন যোগ্য প্রতিনিধিত্ব গড়ে উঠতে পারছে না। ডাকসুর মতো শক্তিশালী প্লাটফর্ম অকার্যকর থাকায় আবাসিক হলগুলোতে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম বিরাজ করলেও সাধারণ ছাত্রদের প্রতিবাদের কোন উপায় নেই। প্রতিনিয়ত ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।