ঢাকা ০২:১৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
নবাবগঞ্জের প্রয়াত সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নানের সুযোগ্য কন্যা মেহেনাজ মান্নান ইলিশ ধরায় খরচ ৮৩০ টাকা, ভোক্তার গুনতে হয় অন্তত ২ হাজার নির্বাচন কে সামনে রেখে উত্তাল ঢাকা-১ দোহার-নবাবগঞ্জ আসন আটপাড়ায় কালী মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর কেন্দুয়ায় মানবপাচার মামলার আসামীরা রিমান্ডে মাস্টারমাইন্ডের নাম প্রকাশ করেছে ‎ ‎কেন্দুয়ায় মানবপাচারের মামলায় চীনা নাগরিকসহ দুই আসামীকে কারাগারে প্রেরণ কেন্দুয়া থেকে তিন নারীকে চীনে পাচারের চেষ্টা; চীনা নাগরিকসহ আটক দুইজন কেন্দুয়ায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার ৫ ‎কেন্দুয়ায় প্রকল্পের অনিয়ম তদন্তের সময় হাতাহাতি: ইউএনও আহত কেন্দুয়ায় প্রশাসনের অভিযানে অবৈধ জাল ধ্বংস ওসমান হাদী দাবিতে ঘনিষ্ঠ ভিডিও প্রচার, সামনে এলো আসল সত্য ব্লাড মুন দেখা যাবে রোববার, চাঁদ লাল হওয়ার কারণ কী? তিন দলই প্রধান উপদেষ্টার অধীনে নির্বাচন চায়: প্রেস সচিব টিউলিপ বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্টধারী, রয়েছে টিআইএনও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়াই হোক নববর্ষের অঙ্গীকার: প্রধান উপদেষ্টা নরেন্দ্র মোদিকে উপহার দেওয়া ছবিটি সম্পর্কে যা জানা গেল বিমসটেকের পরবর্তী চেয়ারম্যান ড. ইউনূস বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে মোদির ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন: প্রেসসচিব চীন সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে ভারতে তোলপাড়

সোনার সিন্ডিকেটে বাজার জিম্মি

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ০৯:৪১:১৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০২৫
  • / 263
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে স্বর্ণের মূল্য বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষ ভাবতে পারে, হয়তো বৈশ্বিক বাজার না কমার কারণে এমন হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি অনেক জটিল। বাংলাদেশে শুধু আন্তর্জাতিক দামের বৃদ্ধি নয়, বরং স্থানীয় সিন্ডিকেট, অবৈধ আমদানি, নিয়ন্ত্রণহীন বেচাকেনা এবং মুদ্রাস্ফীতি— সব মিলিয়ে স্বর্ণের বাজারে এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে, সাধারণ ক্রেতা ও গয়নার ব্যবসায়ী উভয়েই বিপর্যয়ে পড়েছেন।

আন্তর্জাতিক কারণ ও মুদ্রাস্ফীতি

স্বর্ণ মূলত একটি বিশ্ববাজারে লেনদেনযোগ্য ধাতু। ইউরোপীয়, আমেরিকান, এশীয়— বহু দেশের বিনিয়োগকারীরা যখন মুদ্রাস্ফীতি, বিনিয়োগের ঝুঁকি, ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখে সিকিউরিটি হিসেবে স্বর্ণে ঝোঁকে, তখন বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে টাকার প্রায় ক্রমহ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার দরবৃদ্ধি এবং আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়াও বড় কারণ। যেমন- একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দ্রুত বাড়ছে। কারণ টাকার মূল্য কমছে ও আমদানি খরচ বেড়েছে। এই কারণগুলো যুক্ত থাকলেও শুধু এরা যথেষ্ট ব্যাখ্যা দেয় না যে, কেন বাজারে দুর্লভতার অনুভূতি তৈরি হচ্ছে, কেন দাম নিম্নগামী হচ্ছে না, কেন ক্রেতারা ক্রমাগত শোষণের মধ্যে পড়ছেন। এর পেছনে রয়েছে স্থানীয় সিন্ডিকেটের ভূমিকা, যাকে আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

সিন্ডিকেট ও কালোবাজারি : বাজার নিয়ন্ত্রণের নেপথ্য

স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ও সংশ্লিষ্ট সংবাদ প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে একটি প্রভাবশালী ‘স্বর্ণ সিন্ডিকেট’ আছে, যারা দর নির্ধারণ, আমদানি, বিক্রয় ও পুনঃবিক্রয়ের চক্রে নিয়ন্ত্রণ রাখে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রভাবশালী স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট স্বর্ণের মূল্য নিজের মতো করে বাড়াচ্ছে, সরকারের নিয়মকে এড়িয়ে। তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণ, আমদানি খরচ, দামে টানাপোড়েন- সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।’

উপরে উল্লিখিত তথ্য অনুসারে, তারা কার্যত সাধারণ ক্রেতা ও সরকারকে ‘বন্দি’ করে রেখেছে। তারা চাইলে দাম কমায়, অথবা কমানোর ক্ষেত্রে তা স্বল্প স্থায়ী হয়। উদাহরণস্বরূপ- তারা এক সময় স্বর্ণের দাম হঠাৎ বড় পরিমাণে বাড়িয়ে দেয়। পরে দাম কমলেও কমিয়ে দেয় না তেমনভাবে, বা কমিয়ে দিলেও দ্রুত আবার বাড়িয়ে দেয়। এমনকি কেউ স্বর্ণ বিক্রি করতে চাইলে তাকে কম দামে বিক্রয় করতে হয়। উল্লেখ রয়েছে, ২০-২২ শতাংশ কম দামে বিক্রির ঘটনা। এসব ঘটনাই ইঙ্গিত করে স্বর্ণের বাজারে শুধু স্বাভাবিক চাহিদা-সরবরাহের তত্ত্ব কাজ করছে না, বরং কিছু গোষ্ঠীর বাজার-সংযোগ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর রয়েছে।

আমদানি ও অবৈধ প্রবাহ : বাজারে চাপের কারণ

বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানির আইনি সুযোগ রয়েছে; তবুও অবৈধ আমদানি ও ভুল পথে প্রবেশকৃত স্বর্ণ দেখা গেছে। এটি আবার বাজারে ‘দুষ্প্রাপ্যতা’ এবং দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে।

একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অবৈধভাবে স্বর্ণ আনার জন্য সিন্ডিকেট কাজ করছে এবং এটি ২৫,০০০-৩০,০০০ টাকা প্রতি ভরি আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের ওপর প্রিমিয়াম যুক্ত করে বিক্রি করছে। এভাবে ক্লিয়ার রেকর্ড না থাকলে আমদানির সংখ্যা বা অপপ্রবাহের পরিমাণ সঠিকভাবে জানা যায় না। ফলে সরকার-নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর হয় না।

নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার ঘাটতি ও প্রতিরোধহীনতা

স্বর্ণের বাজার এমন এক ক্ষেত্র যেখানে নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক। দামের স্বচ্ছতা, আমদানি রেকর্ড, শোধ-প্রক্রিয়া, ভ্যাট/শুল্ক সংক্রান্ত নিয়মাবলি ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দায়িত্বশীল নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান স্বর্ণ দামের স্থিরতা বা নির্ধারণে কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছেন না বলে জানা গেছে। বাজার প্রতিযোগিতার প্রতিষ্ঠান (উচ্চতর নিয়ন্ত্রক সংস্থা) সিন্ডিকেট বা একাধিক ব্যবসায়ীর গোষ্ঠী তৈরি হওয়া প্রতিরোধে অক্ষম।

স্বর্ণ বিক্রেতাদের মধ্যে তথ্য-প্রকাশ বা নিয়ন্ত্রণ কম দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সোনার জুয়েলারি দোকান বা মার্কেট অংশের মধ্যে মূল্যের হেরফের প্রচুর। যেমন- একদিন হঠাৎ দাম বাড়ে, পরদিন কিছুটা কমে যায় এবং ক্রেতারা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কম পায়। এই ঘাটতিগুলো বাজারে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা বাধাগ্রস্ত করেছে, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ ক্রেতা ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে।

ক্রেতার দৃষ্টিকোণ থেকে : অর্ধ-ভর্তি স্বর্ণ কেন গোপনে হয়?

আপনি প্রশ্ন করেছেন, স্বর্ণা কি পাচার হচ্ছে না? অর্থাৎ স্বর্ণ কেন অর্ধভর্তি বা ভগ্নাংশে এভাবে বিক্রিতে প্রবৃত্ত বা কেন ক্রেতার হাতে আসে কম পরিমাণে স্বর্ণ। এখানে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে—

বড় পার্সেল বা বড় ভরির স্বর্ণ আমদানি, রূপান্তর ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট বা বড় প্রতিষ্ঠান সক্রিয়। এসব প্রতিষ্ঠান ছোট ছোট পরিমাণে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে গোপনে কাজ করতে পারে, যাতে নিয়ন্ত্রণ কম হয়। অর্ধভর্তি বা ছোট পরিমাণ বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট, দামের হেরফের ও খরচ বাড়ে, এই খাত সিন্ডিকেট বা অনিয়মপ্রবণ হয়ে থাকে।

সাধারণ ক্রেতা হয়তো সুদ্ধ স্বর্ণ কিনতে পারছেন না, অবৈধ বা কম মানের স্বর্ণ বিক্রয়ে বা স্বর্ণ গলিয়ে মেশানোর প্রবণতা থাকতে পারে যা ক্রেতার জন্য কম পরিমাণেই পৌঁছায়। উদাহরণস্বরূপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্রেতারা বিক্রয় ও পুনঃবিক্রয়ের চক্রই লাভ করছে এবং ক্রেতা বিক্রির সময় কম দামে পড়ছেন। এসব কারণে দেখা যাচ্ছে, বাজারে যথেষ্ট পরিমাণে সচ্ছলতা নেই, স্বর্ণের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণহীন এবং সাধারণ ক্রেতার অবস্থান এভাবে কঠিন হয়ে পড়েছে।

অধিক দাম?ঊর্ধ্বগতি : কি কারণ

নিচে সংক্ষেপে কারণগুলো—

আন্তর্জাতিক স্বর্ণমূল্যের দ্রুত বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিবর্তন।

টাকার মান হ্রাস ও আমদানি খরচ বৃদ্ধি।

সিন্ডিকেট ও কালোবাজারি ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম, দাম নিয়ন্ত্রণ ও বিক্রয় বাড়ানোর কৌশল।

অবৈধ আমদানি ও দুষ্প্রাপ্যতাবোধ বাড়িয়ে দেয়া।

নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম-বিধির ঘাটতি, দামের স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়েছে।

বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের জন্য বিকল্প কম থাকা, যার কারণে তারা পর্যাপ্ত তথ্য বা বিকল্প ব্যতিরেকে অনুপ্রবেশমূল্য স্বীকার করছেন।

কি করণীয়, সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ

স্বর্ণের বাজারে ক্রেতাদের অধিকার রক্ষা ও বাজার স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:

নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি : সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বর্ণ ব্যবসায়ী সংস্থাগুলো) একত্রে কাজ করে স্বর্ণ আমদানি, রিফাইনিং, বিক্রয় চেইন ও মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কার্যকর মনিটরিং চালানো জরুরি।

সিন্ডিকেট চক্র ভঙ্গ করা : কালোবাজারি বা একাধিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ধারণক্ষমতা হ্রাস করতে সুনির্দিষ্ট তদন্ত ও শাস্তিমান নিয়ম প্রয়োজন। অভিযানের পাশাপাশি রিয়েল টাইম তথ্য প্রকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ।

দামের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি : স্বর্ণের আসল আমদানি খরচ, রিফাইনিং খরচ, বিক্রয় খরচসহ তথ্য ক্রেতার জন্য উন্মুক্ত করা উচিত। এতে ‘আপেক্ষিক বাড়তি মূল্য’ কম হবে।

ক্রেতা সচেতনতা বৃদ্ধি : সাধারণ ক্রেতাদের শিক্ষা দেয়া হোক, কিভাবে খাঁটি স্বর্ণ যাচাই করবেন, কত শতাংশ লাভ সাধারণ হওয়া উচিত, বিক্রির সময় কি ধরনের হার আশা করা যায়।

অবৈধ আমদানি ও দুষ্প্রবাহ রোধ : সীমান্ত, কাস্টমস ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সক্রিয় করা হোক যাতে অবৈধ স্বর্ণ প্রবেশ ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ হয়।

বিকল্প বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়ন : যদি সাধারণ মানুষ শুধুই স্বর্ণকে নিরাপদ হিসেবে দেখেন, তাহলে দাম বাড়তেই থাকবে। তাই সোনার বিকল্প বিনিয়োগ বা সঞ্চয়ের সুযোগ তৈরি করা জরুরি।

স্বর্ণ আমাদের সমাজে শুধু একটি ধাতু নয়; সামাজিক প্রতীক, বিনিয়োগের মাধ্যম, এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কিন্তু আজকাল সেই স্বর্ণ প্রায় সবার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। কেন? কারণ দামের বৃদ্ধি শুধু বৈশ্বিক কারণেই না স্থানীয় সিন্ডিকেট, নিয়ন্ত্রণহীনতা, তথ্যের অভাব এবং অবৈধ চক্রগুলোর সক্রিয়তাই মূল কারণ।

আমাদের জন্য সময় এসেছে, স্বর্ণের মূল্য শুধুই প্রতিফলন হবে আন্তর্জাতিক দর ও মুদ্রাস্ফীতির ওপর নয়, বরং একটি স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক ও নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা সঙ্গে আনতে হবে। সাধারণ ক্রেতার অধিকার রক্ষা করতে হলে আর সময় নেই, উঠতে হবে রূপান্তরের পথে।

যদি দাঁড়াই শুধু হতাশার সঙ্গে, তাহলে স্বর্ণ আজ যেমন ক্রমাগত নামছে না, এমন অনাগত পতন আমাদের হতে পারে। তবে সচেতনতা, নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ও জনগণের অংশগ্রহণ থাকলে স্বর্ণের বাজার হয়তো আবার সে স্থানে ফিরতে পারে, যেখানে খুচরা ক্রেতাও লাভবান, ব্যবসায়ীও নিয়মে চলো এবং সিন্ডিকেট চক্র ভেঙে পড়ুক।
আমাদের মূল দাবি

স্বর্ণ শুধু দাম নয়; এটি বিশ্বাসের প্রতীক। তাই বাজারে সঠিক মূল্য, সঠিক তথ্য ও সঠিক সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

সোনার সিন্ডিকেটে বাজার জিম্মি

আপডেট সময় : ০৯:৪১:১৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৭ নভেম্বর ২০২৫

প্রায় প্রতিদিনই সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে স্বর্ণের মূল্য বেড়েই চলেছে। সাধারণ মানুষ ভাবতে পারে, হয়তো বৈশ্বিক বাজার না কমার কারণে এমন হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে পরিস্থিতি অনেক জটিল। বাংলাদেশে শুধু আন্তর্জাতিক দামের বৃদ্ধি নয়, বরং স্থানীয় সিন্ডিকেট, অবৈধ আমদানি, নিয়ন্ত্রণহীন বেচাকেনা এবং মুদ্রাস্ফীতি— সব মিলিয়ে স্বর্ণের বাজারে এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে, সাধারণ ক্রেতা ও গয়নার ব্যবসায়ী উভয়েই বিপর্যয়ে পড়েছেন।

আন্তর্জাতিক কারণ ও মুদ্রাস্ফীতি

স্বর্ণ মূলত একটি বিশ্ববাজারে লেনদেনযোগ্য ধাতু। ইউরোপীয়, আমেরিকান, এশীয়— বহু দেশের বিনিয়োগকারীরা যখন মুদ্রাস্ফীতি, বিনিয়োগের ঝুঁকি, ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দেখে সিকিউরিটি হিসেবে স্বর্ণে ঝোঁকে, তখন বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম বাড়ে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে টাকার প্রায় ক্রমহ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার দরবৃদ্ধি এবং আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়াও বড় কারণ। যেমন- একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দ্রুত বাড়ছে। কারণ টাকার মূল্য কমছে ও আমদানি খরচ বেড়েছে। এই কারণগুলো যুক্ত থাকলেও শুধু এরা যথেষ্ট ব্যাখ্যা দেয় না যে, কেন বাজারে দুর্লভতার অনুভূতি তৈরি হচ্ছে, কেন দাম নিম্নগামী হচ্ছে না, কেন ক্রেতারা ক্রমাগত শোষণের মধ্যে পড়ছেন। এর পেছনে রয়েছে স্থানীয় সিন্ডিকেটের ভূমিকা, যাকে আদৌ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

সিন্ডিকেট ও কালোবাজারি : বাজার নিয়ন্ত্রণের নেপথ্য

স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা ও সংশ্লিষ্ট সংবাদ প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে একটি প্রভাবশালী ‘স্বর্ণ সিন্ডিকেট’ আছে, যারা দর নির্ধারণ, আমদানি, বিক্রয় ও পুনঃবিক্রয়ের চক্রে নিয়ন্ত্রণ রাখে। একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রভাবশালী স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট স্বর্ণের মূল্য নিজের মতো করে বাড়াচ্ছে, সরকারের নিয়মকে এড়িয়ে। তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণ, আমদানি খরচ, দামে টানাপোড়েন- সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।’

উপরে উল্লিখিত তথ্য অনুসারে, তারা কার্যত সাধারণ ক্রেতা ও সরকারকে ‘বন্দি’ করে রেখেছে। তারা চাইলে দাম কমায়, অথবা কমানোর ক্ষেত্রে তা স্বল্প স্থায়ী হয়। উদাহরণস্বরূপ- তারা এক সময় স্বর্ণের দাম হঠাৎ বড় পরিমাণে বাড়িয়ে দেয়। পরে দাম কমলেও কমিয়ে দেয় না তেমনভাবে, বা কমিয়ে দিলেও দ্রুত আবার বাড়িয়ে দেয়। এমনকি কেউ স্বর্ণ বিক্রি করতে চাইলে তাকে কম দামে বিক্রয় করতে হয়। উল্লেখ রয়েছে, ২০-২২ শতাংশ কম দামে বিক্রির ঘটনা। এসব ঘটনাই ইঙ্গিত করে স্বর্ণের বাজারে শুধু স্বাভাবিক চাহিদা-সরবরাহের তত্ত্ব কাজ করছে না, বরং কিছু গোষ্ঠীর বাজার-সংযোগ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যকর রয়েছে।

আমদানি ও অবৈধ প্রবাহ : বাজারে চাপের কারণ

বাংলাদেশে স্বর্ণ আমদানির আইনি সুযোগ রয়েছে; তবুও অবৈধ আমদানি ও ভুল পথে প্রবেশকৃত স্বর্ণ দেখা গেছে। এটি আবার বাজারে ‘দুষ্প্রাপ্যতা’ এবং দাম বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে।

একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অবৈধভাবে স্বর্ণ আনার জন্য সিন্ডিকেট কাজ করছে এবং এটি ২৫,০০০-৩০,০০০ টাকা প্রতি ভরি আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের ওপর প্রিমিয়াম যুক্ত করে বিক্রি করছে। এভাবে ক্লিয়ার রেকর্ড না থাকলে আমদানির সংখ্যা বা অপপ্রবাহের পরিমাণ সঠিকভাবে জানা যায় না। ফলে সরকার-নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর হয় না।

নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থার ঘাটতি ও প্রতিরোধহীনতা

স্বর্ণের বাজার এমন এক ক্ষেত্র যেখানে নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক। দামের স্বচ্ছতা, আমদানি রেকর্ড, শোধ-প্রক্রিয়া, ভ্যাট/শুল্ক সংক্রান্ত নিয়মাবলি ইত্যাদি। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দায়িত্বশীল নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান স্বর্ণ দামের স্থিরতা বা নির্ধারণে কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছেন না বলে জানা গেছে। বাজার প্রতিযোগিতার প্রতিষ্ঠান (উচ্চতর নিয়ন্ত্রক সংস্থা) সিন্ডিকেট বা একাধিক ব্যবসায়ীর গোষ্ঠী তৈরি হওয়া প্রতিরোধে অক্ষম।

স্বর্ণ বিক্রেতাদের মধ্যে তথ্য-প্রকাশ বা নিয়ন্ত্রণ কম দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন সোনার জুয়েলারি দোকান বা মার্কেট অংশের মধ্যে মূল্যের হেরফের প্রচুর। যেমন- একদিন হঠাৎ দাম বাড়ে, পরদিন কিছুটা কমে যায় এবং ক্রেতারা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কম পায়। এই ঘাটতিগুলো বাজারে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা বাধাগ্রস্ত করেছে, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ ক্রেতা ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে।

ক্রেতার দৃষ্টিকোণ থেকে : অর্ধ-ভর্তি স্বর্ণ কেন গোপনে হয়?

আপনি প্রশ্ন করেছেন, স্বর্ণা কি পাচার হচ্ছে না? অর্থাৎ স্বর্ণ কেন অর্ধভর্তি বা ভগ্নাংশে এভাবে বিক্রিতে প্রবৃত্ত বা কেন ক্রেতার হাতে আসে কম পরিমাণে স্বর্ণ। এখানে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে—

বড় পার্সেল বা বড় ভরির স্বর্ণ আমদানি, রূপান্তর ও বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট বা বড় প্রতিষ্ঠান সক্রিয়। এসব প্রতিষ্ঠান ছোট ছোট পরিমাণে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে গোপনে কাজ করতে পারে, যাতে নিয়ন্ত্রণ কম হয়। অর্ধভর্তি বা ছোট পরিমাণ বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট, দামের হেরফের ও খরচ বাড়ে, এই খাত সিন্ডিকেট বা অনিয়মপ্রবণ হয়ে থাকে।

সাধারণ ক্রেতা হয়তো সুদ্ধ স্বর্ণ কিনতে পারছেন না, অবৈধ বা কম মানের স্বর্ণ বিক্রয়ে বা স্বর্ণ গলিয়ে মেশানোর প্রবণতা থাকতে পারে যা ক্রেতার জন্য কম পরিমাণেই পৌঁছায়। উদাহরণস্বরূপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্রেতারা বিক্রয় ও পুনঃবিক্রয়ের চক্রই লাভ করছে এবং ক্রেতা বিক্রির সময় কম দামে পড়ছেন। এসব কারণে দেখা যাচ্ছে, বাজারে যথেষ্ট পরিমাণে সচ্ছলতা নেই, স্বর্ণের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণহীন এবং সাধারণ ক্রেতার অবস্থান এভাবে কঠিন হয়ে পড়েছে।

অধিক দাম?ঊর্ধ্বগতি : কি কারণ

নিচে সংক্ষেপে কারণগুলো—

আন্তর্জাতিক স্বর্ণমূল্যের দ্রুত বৃদ্ধি ও বৈশ্বিক বিনিয়োগ পরিবর্তন।

টাকার মান হ্রাস ও আমদানি খরচ বৃদ্ধি।

সিন্ডিকেট ও কালোবাজারি ব্যবসায়ীদের কার্যক্রম, দাম নিয়ন্ত্রণ ও বিক্রয় বাড়ানোর কৌশল।

অবৈধ আমদানি ও দুষ্প্রাপ্যতাবোধ বাড়িয়ে দেয়া।

নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ও নিয়ম-বিধির ঘাটতি, দামের স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নষ্ট হয়েছে।

বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতাদের জন্য বিকল্প কম থাকা, যার কারণে তারা পর্যাপ্ত তথ্য বা বিকল্প ব্যতিরেকে অনুপ্রবেশমূল্য স্বীকার করছেন।

কি করণীয়, সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ

স্বর্ণের বাজারে ক্রেতাদের অধিকার রক্ষা ও বাজার স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ:

নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষমতা বৃদ্ধি : সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বর্ণ ব্যবসায়ী সংস্থাগুলো) একত্রে কাজ করে স্বর্ণ আমদানি, রিফাইনিং, বিক্রয় চেইন ও মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কার্যকর মনিটরিং চালানো জরুরি।

সিন্ডিকেট চক্র ভঙ্গ করা : কালোবাজারি বা একাধিক ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ধারণক্ষমতা হ্রাস করতে সুনির্দিষ্ট তদন্ত ও শাস্তিমান নিয়ম প্রয়োজন। অভিযানের পাশাপাশি রিয়েল টাইম তথ্য প্রকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ।

দামের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি : স্বর্ণের আসল আমদানি খরচ, রিফাইনিং খরচ, বিক্রয় খরচসহ তথ্য ক্রেতার জন্য উন্মুক্ত করা উচিত। এতে ‘আপেক্ষিক বাড়তি মূল্য’ কম হবে।

ক্রেতা সচেতনতা বৃদ্ধি : সাধারণ ক্রেতাদের শিক্ষা দেয়া হোক, কিভাবে খাঁটি স্বর্ণ যাচাই করবেন, কত শতাংশ লাভ সাধারণ হওয়া উচিত, বিক্রির সময় কি ধরনের হার আশা করা যায়।

অবৈধ আমদানি ও দুষ্প্রবাহ রোধ : সীমান্ত, কাস্টমস ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে সক্রিয় করা হোক যাতে অবৈধ স্বর্ণ প্রবেশ ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ হয়।

বিকল্প বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়ন : যদি সাধারণ মানুষ শুধুই স্বর্ণকে নিরাপদ হিসেবে দেখেন, তাহলে দাম বাড়তেই থাকবে। তাই সোনার বিকল্প বিনিয়োগ বা সঞ্চয়ের সুযোগ তৈরি করা জরুরি।

স্বর্ণ আমাদের সমাজে শুধু একটি ধাতু নয়; সামাজিক প্রতীক, বিনিয়োগের মাধ্যম, এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। কিন্তু আজকাল সেই স্বর্ণ প্রায় সবার জন্য কঠিন হয়ে উঠেছে। কেন? কারণ দামের বৃদ্ধি শুধু বৈশ্বিক কারণেই না স্থানীয় সিন্ডিকেট, নিয়ন্ত্রণহীনতা, তথ্যের অভাব এবং অবৈধ চক্রগুলোর সক্রিয়তাই মূল কারণ।

আমাদের জন্য সময় এসেছে, স্বর্ণের মূল্য শুধুই প্রতিফলন হবে আন্তর্জাতিক দর ও মুদ্রাস্ফীতির ওপর নয়, বরং একটি স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক ও নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা সঙ্গে আনতে হবে। সাধারণ ক্রেতার অধিকার রক্ষা করতে হলে আর সময় নেই, উঠতে হবে রূপান্তরের পথে।

যদি দাঁড়াই শুধু হতাশার সঙ্গে, তাহলে স্বর্ণ আজ যেমন ক্রমাগত নামছে না, এমন অনাগত পতন আমাদের হতে পারে। তবে সচেতনতা, নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ও জনগণের অংশগ্রহণ থাকলে স্বর্ণের বাজার হয়তো আবার সে স্থানে ফিরতে পারে, যেখানে খুচরা ক্রেতাও লাভবান, ব্যবসায়ীও নিয়মে চলো এবং সিন্ডিকেট চক্র ভেঙে পড়ুক।
আমাদের মূল দাবি

স্বর্ণ শুধু দাম নয়; এটি বিশ্বাসের প্রতীক। তাই বাজারে সঠিক মূল্য, সঠিক তথ্য ও সঠিক সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।