অটোরিকশার অর্থনীতি: কেন এই বাহনের এত বিপুল চাহিদা?
- আপডেট সময় : ০৫:২৭:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২৯ বার পড়া হয়েছে
বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) আরেকবার স্থবির হয়ে পড়ে ঢাকা শহর। এবার স্থবির হওয়ার কারণ, রাজধানীজুড়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগরী এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল বন্ধে হাইকোর্টের আদেশের পর এই বিক্ষোভ শুরু হয়। গত ১৯ নভেম্বর এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
অটোরিকশার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবারই প্রথম নয়। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এর আগেও একাধিকবার অটোরিকশা বন্ধের উদ্যোগ নিলেও অবৈধ এ তিন চাকার বাহনগুলো সড়কে চলছে।
গত কয়েক বছরে অটোরিকশার সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছে। শুধু ঢাকাই নয়, দেশের অন্যান্য এলাকাও এই বাহনে সয়লাব হয়ে গেছে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ৪০ লাখ অটোরিকশা চলাচল করছে।
এই বাহনের এমন ব্যাপক চাহিদার কারণ কী? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে বুঝতে হলে অটোরিকশার অন্তর্নিহিত অর্থনীতি বোঝা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত যানবাহনের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ হচ্ছে বাস বা মিনিবাসের গণপরিবহন। গণপরিবহনের চাহিদা অনুপাতে জোগানের এই ঘাটতিই অটোরিকশার বাড়বাড়ন্তের মূল কারণ।
অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্যাডেল রিকশার ভাড়াও ক্রমাগত বাড়ছে। তাই তুলনামূলক কম খরচে যাতায়াত করতে মানুষ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দিকে ঝুঁকছে।
অর্থনীতিতে একে বলা হয় ‘সাবস্টিটিউশন ইফেক্ট’—যেখানে ভোক্তা কম খরচের বিকল্প সেবা বা পণ্য গ্রহণ করে।
ফলে প্যাডেল রিকশাচালকদের জন্য প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে উঠেছে। তাদের অনেকেই নিজের রিকশায় ব্যাটারি লাগিয়ে সেটিকে অটোরিকশায় রূপান্তর করেছেন।
২০০৪ সালে চীন থেকে প্রথম সম্পূর্ণ সংযোজন করা অটোরিকশা আমদানি শুরু হলেও এখন এগুলো স্থানীয়ভাবেই সংযোজন হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ প্যাডেল রিকশায় আমদানি করা ব্যাটারি লাগিয়ে সেগুলোকে অটোরিকশায় রূপান্তর করা হয়।
ঢাকায় একটি নতুন অটোরিকশা তৈরি করতে খরচ পড়ে ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকার বেশি।
একটি অটোরিকশায় চারটি ১২ ভোল্টের ব্যাটারি, একটি মোটর, সুইচ, লাইট ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ থাকে। ব্যাটারির খরচ প্রায় ৩০ হাজার টাকা, আয়ুষ্কাল ৬ মাস থেকে ১ বছর। তবে ছয় মাস পর ব্যাটারি ফেরত দিলে প্রায় অর্ধেক টাকা ফেরত পাওয়া যায়।
ঢাকার শাহবাগ এলাকার ৫২ বছর বয়সি অটোরিকশা চালক মো. ওয়াহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা মালিককে দৈনিক ৩৫০ টাকা দিই। চার্জ করার জন্য দৈনিক ৫০ টাকার মতো লাগে। এতে মাসে চার্জ খরচ যায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ টাকা।’
অন্যদিকে একটি প্রথাগত প্যাডেল রিকশা তৈরিতে খরচ হয় ৩৫ হাজার টাকারও কম। এছাড়া প্যাডেল রিকশার দৈনিক গ্যারেজ ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা—এর কোনো চার্জিং খরচও নেই।
তারপরও রিকশাচালকরা কেন প্রথাগত প্যাডেল রিকশা রেখে অটোরিকশার দিকে ঝুঁকছেন?
উত্তরটা সহজ। কারণ, প্যাডেল রিকশায় আয় যেমন বেশি, তেমনি এখান থেকে বিনিয়োগও উঠে আসে অনেক দ্রুত।
প্রায় ৪০ বছর ধরে রিকশা উৎপাদনের পেশায় যুক্ত আলী হোসেন। এই ব্যবসায় লাগা পরিবর্তনের ঢেউ সম্পর্কে নিজের মতামত জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি আর প্যাডেল রিকশা তৈরি করি না। কারণ, এখন এটা থেকে লাভ আসে না। আজকাল মানুষের সবসমই তাড়া থাকে; তারা প্যাডেল রিকশার চেয়ে অটোরিকশাই বেশি পছন্দ করে।’
অটোরিকশা চালাতে শারীরিক পরিশ্রম হয় না, দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানো যায় এবং চালকরা ভাড়াও কম রাখতে পারেন। এতে তারা সারা দিনে তুলনামূলক কম ভাড়ায় প্যাডেল রিকশার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী পরিবহন করতে পারেন।
অটোরিকশা চালক ওয়াহিদ ইসলাম জানান, ‘মাসে আমরা প্রায় ৩৫ হাজার টাকা বা তারচেয়েও বেশি আয় করতে পারি।’
অন্যদিকে প্যাডেল রিকশাচালকরা মাসে মাত্র ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। এছাড়া মাঝেমধ্যেই শারীরিক পরিশ্রমের কারণে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে অনেকদিন তাদের কোনো আয়ই হয় না।
লাখ লাখ রিকশাচালক জীবিকার জন্য অটোরিকশার ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক বলেন, অটোরিকশার ক্ষেত্রেও অর্থনীতির মুনাফা সর্বোচ্চ করার তত্ত্ব প্রযোজ্য। অর্থনীতিতে বলা হয়, একজন ব্যবসায়ীর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মুনাফা সর্বোচ্চ করা।
তিনি বলেন, ‘অটোরিকশা থেকে বেশি ভাড়া ও মুনাফা আসায় রিকশাচালকদের মূলত উৎসাহ দিচ্ছেন গ্যারেজ ও রিকশা মালিকেরা।’
তবে এসব অটোরিকশার বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক সমস্যা হলো নিরাপত্তা। অটোরিকশার কারিগরি ত্রুটি ও সড়কে অনিয়ন্ত্রিত চলাচলের কারণে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান ও এ ধরনের তিন চাকার বাহনগুলো ঢাকা শহরের সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতিত অবনতি ঘটাচ্ছে।
কয়েকদিন আগেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অটোরিকশা দুর্ঘটনায় আফসানা করিম নামক এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে।
এআরআইয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে সারা দেশে ৯০০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৫৮২টি দুর্ঘটনা গুরুতর।
অধ্যাপক শামসুল হক টিবিএসকে বলেন, ‘ছোট যানবাহনগুলো সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ। গণপরিবহনের পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং ছোট যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, সড়ক অবকাঠামোর জন্য যদি দুর্বল পরিকল্পনা করা হয়, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটবেই। নগর সড়ক পরিকল্পনার মৌলিক বিজ্ঞান রয়েছে।
তার মতে, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে পথচারীদের ওপর। ফুটপাত প্রশস্ত ও ব্যবহারযোগ্য করতে হবে। এরপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত গণপরিবহনকে। সবশেষে অটোরিকশা ও সিএনজির মতো ছোট যানবাহনের জন্য আলাদা লেন তৈরি করতে হবে।
নিরাপত্তা উদ্বেগের পাশাপাশি অটোরিকশা জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের ওপরও চাপ সৃষ্টি করছে। কেননা এসব যানবাহন চার্জ করার জন্য বিদ্যুৎ খরচ হয়।
৪৮ থেকে ৬০ অ্যাম্পিয়ারের চার্জার দিয়ে একটি অটোরিকশা সম্পূর্ণ চার্জ করতে ৭-৮ ঘণ্টা সময় লাগে। এছাড়া পুরনো ব্যাটারি সঠিকভাবে না ফেলার কারণে পরিবেশ দূষণের ঝুঁকিও রয়েছে।
তবে অধ্যাপক শামসুল হক মনে করেন, হুট করেই অটোরিকশা নিষিদ্ধ করে দেওয়াটা কোনো সমাধান নয়। বিদ্যমান চালকদের বিকল্প কর্মসংস্থান খুঁজে নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে তারা এভাবে বারবার বিক্ষোভে নামবেন।
তিনি বলেন, ‘বন্যার পানি সামলাতে আমার প্রথমে ফ্লাডগেট বন্ধ করি। একইভাবে অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রথমে অটোরিকশা ও এর ব্যাটারির আমদানি বন্ধ করতে হবে।’