বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলোর দূরত্ব
অভ্যুত্থানের ৪ মাস পেরোতেই ঐক্যে ফাটল

- আপডেট সময় : ০২:৫০:২৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪
- / 88
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে দলমত নির্বিশেষে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শিক্ষার্থীরা। রাজনৈতিক মতাদর্শ ভিন্ন থাকলেও একমঞ্চ থেকেই আন্দোলন করে গেছেন তারা। তবে অভ্যুত্থানের চার মাস পেরোতেই ফাটল ধরেছে সেই ঐক্যে। গত আগস্ট মাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও আজও সেটি আলোর মুখ দেখেনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনগুলোর দূরত্ব বাড়ছে। শুধু তাই নয়, নিজেদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে বিভেদ, উঠেছে বৈষম্যের অভিযোগ। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেতরে-বাইরে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে।
গত ৩ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ছাত্রদের সাক্ষাৎকে কেন্দ্র করে ভেতরে-বাইরে অনৈক্যের বিষয়টি আবারও সামনে আসে। সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি। তাদের আমন্ত্রণও জানানো হয়নি। শুধু তাই নয়, আন্দোলনে প্রথম সারিতে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্রনেতাকে বাইরে রাখার বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এ ছাড়া আন্দোলনে সম্মুখসারিতে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রদেরও গুরুত্ব না দেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, একটি পক্ষ নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে অন্যদের সামনে আসার সুযোগ দিচ্ছে না।
৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে কাঁপল ক্যালিফোর্নিয়া৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে কাঁপল ক্যালিফোর্নিয়া
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা শুরু থেকে সামনে থেকে আন্দোলন করেছি, গুলি লেগেছে আমাদের গায়ে। অথচ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পায় সিলেকটিভ কিছু মানুষ। একটি পক্ষকে শুধু নিজেরা সামনে থাকার নেশা পেয়ে বসেছে। আমাদের কোথাও সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। আন্দোলন-পরবর্তী আমরা আর কথা বলার মতো পরিস্থিতিও পাচ্ছি না। ইচ্ছেকৃতভাবে আমাদের আড়ালে রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে ঐক্য নষ্ট হচ্ছে এবং কিছু মানুষের মুখোশ উন্মোচন হচ্ছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ ইমরান বলেন, ‘শুধু নিজেদের দলের লোককে ফ্রন্টলাইনে রেখে সুযোগ-সুবিধা দেবেন আর বাকি স্টেকহোল্ডারের প্রতি কোনো ধরনের তোয়াক্কা করবেন না, এ বেইনসাফের সমালোচনা আমরা করবই। ক্রাইসিস মোমেন্টে একদিকে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে বিভিন্ন ঘরানার ছাত্রদের একত্রিত করবেন আর অন্যদিকে ক্ষমতার বলয়ে শুধু নিজেদের লোকজনকে বসিয়ে ইনসাফের মিথ্যা আশ্বাস দেবেন, সেটা কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। ৫ আগস্টের পর থেকে আপনারা অনেক সত্য লুকিয়েছেন, শুধু ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেদের বলয়কে শক্তিশালী করার জন্য। মনে রাখবেন, বেইনসাফ আর বিভাজনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ঐক্য কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয় না।’
দেশ রূপান্তরের সোনাগাজী প্রতিনিধি গ্রেপ্তারদেশ রূপান্তরের সোনাগাজী প্রতিনিধি গ্রেপ্তার
এদিকে বেশ কিছুদিন ধরে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দূরত্ব বাড়ার বিষয়টি সামনে আসছে। গত সপ্তাহে ঐক্য ধরে রাখতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে ছাত্র সংহতি সপ্তাহ পালনের সিদ্ধান্ত হলেও তা সেভাবে পালিত হয়নি। এজন্য ছাত্র আন্দোলনের নেতারা রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন নেতাদের গুরুত্ব না দেওয়াকে দায়ী করছেন।
সর্বশেষ গত বুধবার রাজধানীর বাংলা মোটরে রূপায়ণ ট্রেড সেন্টারে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতবিনিময় সভা হয়। এতে শিবিরসহ অন্যান্য সংগঠন অংশ নিয়েছে। তবে ওই সভায় যায়নি ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র ফেডারেশনসহ বামপন্থী আট ছাত্র সংগঠনের মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট। এসব সংগঠনের নেতারা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ছাত্র সংগঠনগুলোকে না নেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় তারা মতবিনিময়ে যাননি।
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে ছাত্র সংগঠনের মিটিং ছিল না। কিন্তু অনেক গণমাধ্যম সেটিকে প্রচার করেছে ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে ড. ইউনূসের মিটিং। এতে করে সমস্যাটি হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যাদের ডিবিতে নিয়ে গিয়েছিল এবং যারা বর্তমানে নেতৃত্বে রয়েছেন, নতুন অর্গানোগ্রামে আমরা সাম্প্রতিক কনসার্নগুলো জানাতে গিয়েছিলাম।’
জাতীয় ঐক্যে এক জাতীয় সরকারে নয়জাতীয় ঐক্যে এক জাতীয় সরকারে নয়
মতবিনিময় সভায় অংশ না নেওয়ার ব্যাপারে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ছাত্রপ্রতিনিধি বলতে শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে বোঝায় না। তারা নিজেরাই বৈষম্য তৈরি করছে। সবাইকে নিয়ে ঐক্য ধরে রাখতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে। তারা আমাদের ডাকার প্রয়োজনবোধ করেনি। আমরা দেখছি সুনির্দিষ্ট একটা পক্ষকেই সামনে থাকতে এবং আন্দোলনের সব ক্রেডিট নিতে। তবে আমরা এখনো চাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমাদের পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকুক এবং ঐক্য টিকে থাকুক।’
বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক সালমান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা দলমত নির্বিশেষে একটি ব্যানারে আন্দোলন করেছি। সে ব্যানারে সিদ্ধান্ত হয়েছিল সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি তার উল্টোটা। ছাত্র সংগঠনগুলোর জাতীয় ঐক্য ভাঙার জন্য তারা দায়ী। তাদের অগণতান্ত্রিক আচরণের কারণে মতবিনিময় সভা মূলধারার প্রায় সব ছাত্র সংগঠন বয়কট করেছে।’
ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি নূরুল বশর আজিজী বলেন, ‘তারা (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন) প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রোগ্রামে ছাত্র সংগঠনগুলোকে ডাকেনি। বিপ্লবের অংশীদারদের মাইনাস করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। বিষয়টা আমরা ভালোভাবে নিইনি।’
মন্ত্রীর হাজার কোটি স্ত্রী ‘ক্যাসিনো সম্রাজ্ঞী’মন্ত্রীর হাজার কোটি স্ত্রী ‘ক্যাসিনো সম্রাজ্ঞী’
এ বিষয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামীন মোল্লা বলেন, ‘সভায় না যাওয়া আমাদের একটি প্রতিক্রিয়া। গত মিটিংয়ে আমরা আহ্বান করেছি ছাত্র সংগঠনগুলো প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বসতে চাই। আমাদের ওভারলুক করে ওনারা নিজেরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে চলে গেছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘কাউকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া, দূরে রাখা এটি জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। এটা দূর করতে হবে।’
তবে নিজেদের কিংবা ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে দূরত্ব কিংবা ঐক্যে ফাটল ধরছে বলে মনে করছেন না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নির্বাহী সদস্য ও দপ্তর সেল সম্পাদক জাহিদ আহসান। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বুধবারের সভায় রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন কিংবা অভ্যুত্থানকারী সংগঠন হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বরং গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি এবং গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট বজায় রাখতে সরকারের ভূমিকার ব্যাপারে পরামর্শ নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। জাতীয় ঐকমত্য গঠনের যে ডাক প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন, গতকালের (বুধবার) মতবিনিময় সভায় তার কোনো প্রয়াস ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ছাত্রদের মধ্যে যদি কোনো জাতীয় ঐক্যের ডাক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দেয়, সেখানে অবশ্যই সব ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের রাখা হবে। এ ছাড়া আমাদের সব সিদ্ধান্ত নির্বাহী কমিটি নেয়। এর বাইরে কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করলে সেটি তাদের ব্যক্তিগত। আমরা সবাইকে নিয়ে ঐক্য ধরে রেখে নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য কাজ করছি।’