ইতিহাসের কাঠগড়ায়:জিন্নাহ,কংগ্রেস ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ
- আপডেট সময় : ০৯:১৮:০৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৫ মার্চ ২০২৪ ২৯ বার পড়া হয়েছে
মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ,জন্মনাম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহভাই; ২৫ ডিসেম্বর ১৮৭৬ – ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮) ছিলেন একজন গুজরাটি বংশদ্ভুত আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯১৩ সাল থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা পর্যন্ত জিন্নাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হন এবং আমৃত্যু এই পদে বহাল থাকেন। পাকিস্তানে তাকে কায়েদে আজম (মহান নেতা) ও বাবায়ে কওম (জাতির পিতা) হিসেবে সম্মান করা হয়।
নির্বাচন ও বিভাগ নিয়ে গণভোটে অংশ নেবে। একটি সীমানা কমিশন বিভক্ত প্রদেশের সীমানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বাংলার পার্শ্ববর্তী আসামের মুসলিম অধ্যুষিত সিলেট জেলাও গণভোট অংশ নেবে। ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন, নেহেরু, জিন্নাহ ও শিখ নেতা বলদেব সিং রেডিওতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। জিন্নাহ পাকিস্তান জিন্দাবাদ (পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক) বলে তার ভাষণ শেষ করেন। পরে পাঞ্জাব ও বাংলায় গণভোট অনুষ্ঠিত হয় এবং শেষপর্যন্ত দুটি প্রদেশ বিভক্ত হয়। সিলেট ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পাকিস্তানে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়
গভর্নর জেনারেল
পাকিস্তান সৃষ্টির পর জিন্নাহ পাকিস্তান ডমিনিয়নের গভর্নর জেনারেল হন। অন্যদিকে মাউন্টব্যাটেন ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে থেকে যান। জিন্নাহ আমৃত্যু এই পদে ছিলেন।
মৃত্যু
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর করাচিতে তার বাসভবনে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর মৃত্যু হয়। তিনি দীর্ঘদিন ধরে যক্ষ্মা রোগে ভুগছিলেন। ১২ সেপ্টেম্বর তাকে দাফন করা হয়। এই দিন পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশেই শোকপ্রকাশ করে। ভারতের গভর্নর জেনারেল রাজাগোপালাচারী এদিন জিন্নাহর সম্মানে নিজের সরকারি অভ্যর্থনা বাতিল করেন। জিন্নাহর দাফনস্থল বর্তমানে মাজারে কায়েদ বলে পরিচিত।
প্রথম কিস্তিঃ
ইতিহাস একটি পথনির্দেশক জ্ঞান বটে, তবে পথ নয়।আর এর পথ নির্দেশনা তখনই সঠিক হবে যখন ইতিহাসকে সঠিকভাবে পর্যালোচনা ও অনুধাবন করা হবে। আর এই পর্যালোচনা তখনই সঠিক হবে যখন ইতিহাসে যার অবদান যেমন, তেমন ভাবে মূল্যায়ন করা হবে।১৯৪৭ সাল ছিল এই উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট।১৯৪৭ সালকে আমরা অনেকে ভুলে গেলেও ভুলে নাই ভারত।তারই প্রতিশোধ পাকিস্তানের সাথে একের পর এক যুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়,বাংলাদেশের সীমান্তে মানুষ হত্যা, ভারতে একের পর এক মুসলিম নিধন দাঙ্গা।এখনও ভারতের মুসলিমদের পাকিস্তান অথবা বাংলাদেশকে গালি দিয়ে প্রমাণ করতে হয় তারা দেশপ্রেমিক ।আসলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলতে কোন কিছু কি ছিল? থাকলে তার ভিত্তি কি ছিল? আর এর ভাঙ্গনের জন্য কে দায়ী ছিল? বিশ শতকের গোড়ার দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতের স্বাধীনতার জাতীয় মঞ্চে তখন কংগ্রেস, আর কংগ্রেসের প্রাণ সঞ্চারণকারি ছিলেন গাঁধী,কংগ্রেসকে প্রকৃত জাতীয়তাবাদী হিসাবে তুলে ধরতে জিন্নার প্রানান্তকর প্রচেষ্টা-যার কারণে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের দূত হিসাবে খ্যাতিলাভ,এরপরে জিন্না বনাম কংগ্রেস এবং সর্বশেষ এসে কংগ্রেস বনাম জিন্নাহ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ;এই ছিল ১৯০০সাল থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত উপমহাদেশে রাজনৈতিক শিরোনাম।বিভিন্ন বিভক্তি সত্ত্বেও সকল পক্ষই ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। তারপরও ভারত ভাঙ্গল।কাঠগড়ায় যেহেতু দাঁড় করেছি,চুলচেরা বিশ্লেষণ চাই সকল পক্ষকে ,বিশেষ করে জিন্নাহ,কংগ্রেস ও মুসলিম জাতীয়তাবাদকে।
ভারতের গুজরাট প্রদেশের কাথিয়াবাড়ের অবস্থান।এই কাথিয়াবাড়ের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বাবা জেনাভাই।মুসলিম শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত খোজা সম্প্রদায়ের লোক তারা । তাঁতই ছিল তাদের পারিবারিক ব্যবসা। উল্লেখ্য যে, গুজরাটের এই কাথিয়াবাড়ে ভারত মহাদেশের আরেক মহাপুরুষ মহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর পিতৃভূমি। নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য জেনাভাই একদিন করাচিতে আগমন করেন।করাচিতে ২৫ শে ডিসেম্বর ১৮৭৬ সালে জেনা ভাই ও মিঠিবাইয়ের একটি পুত্র সন্তান জম্মগ্রহণ করেন। নাম রাখা হয় মোহম্মদ আলী জেনাভাই।ব্যপক আর্থিক দুর্যোগের কারণে পিতার বন্ধু ফ্রেডরিক ল-ক্রফটের সহযোগিত ইংল্যান্ডে যাওয়ার সুযোগ পায়।লন্ডনে তিনি দেখা পান দাদাভাই নওরোজীর। দাদাভাই নওরোজী সম্বন্ধে বলতে হয় তিনি ছিলেন সকল ধর্মের মানুষের কাছে পূজনীয় ব্যক্তি।দাদাভাই ব্রিটিশ হাউস অব কমনসের সদস্য হওয়া জিন্না নিয়মিত অতিথি হিসাবে সেখানে শুনতে যেতেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দাদাভাইয়ের ভারতের জন্য কাজ করা দেখে তিনিও ইংল্যান্ডে রাজনীতি করার বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেন।তবে সেখানকার সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে দাতস্থ হলেও ব্রিটিশদের প্রতি তার ব্যপক ঘৃণার জম্ম নেয়। ব্রিটিশরা নিজেদের দেশের জন্য অনেক পজেটিভ রাজনীতি করলে তাদের সাম্রাজ্যভুক্ত অন্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য ভিন্ননীতি অবলম্বন করত।তাদের এই দ্বিমুখী রাজনৈতিক কর্মকান্ড তাকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্দ করে তোলে।এতো প্রতিকূল পরিবেশে দাদাভাই এর জয় এবং মানুষের জন্য কাজ করায় দাদাভাইয়ের প্রতি জিন্নার শ্রদ্ধতা ও ভালবাসা ছিল অগাধ।পরে দাদাভাইও জিন্নার রাজনৈতিক পরিচয়ের উপর অনেকটাই প্রভাব ফেলেছেন।জিন্না বুড়ো মানুষটি একান্ত বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন, যদিও দুজনের মধ্যে বয়সের তফাৎ অনেকটাই।কংগ্রেসের প্রথম দিকের বছরগুলিতে দুজনই ব্যপক স্বেচ্ছা-শ্রম দিয়েছেন ।১৮৯৩ সালের ২৫ মে পরীক্ষার দিয়ে ব্যারিস্টারি পাশ করলেন ভারতীয় উপমহাদেশে আইনের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রটি।এই সময়ে তিনি তার নাম থেকে ভাই কথাটি ছেঁটে বাদ দেন।তিনি হলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।এটা খুব তুচ্ছ কথা নয়। যেকোন মনোবিজ্ঞানী নি:সন্দেহ এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে অনেক কিছু খুঁজে পাবেন।
ইংল্যান্ডে পড়াশুনা শেষ করে জিন্না ১৮৯৬ সালে ভারতে ফিরে এলেন।করাচিতে যাওয়ার কোন কারণ ছিল না কারণ সেখানে তার বাবা এর মধ্যেই দেউলিয়া হয়ে গেছেন।বাহিরে থাকা সময়ে তাঁর স্ত্রী এমি বাই এবং তার মায়েরও মৃত্যু ঘটেছে।পরবর্তী জীবনের বেশিভাগ সময় তিনি বম্বেতেই কাটিয়েছেন। তবে শুরুতে তার কর্ম জীবন ছিল খুবই কঠিন।সৈয়দ পিরজাদা একটি ছবিতে বলেছেন জিন্নার জীবনে সে সব দিনের কথা জিন্না বলত, ”আমি যখন শুরু করেছিলাম তখন আমার কাছে ট্রাম বাসে চড়ার মতো পয়সাও ছিল না। বেশির ভাগ সময় হেটে যাওয়া আসা করতাম।” ”সর্বোচ্চ স্তরে সব সময়ে জায়গা আছে, কিন্তু সেখানে যাওয়ার কোনও লিফট নেই, তোমাকে লড়াই করতে হবে।”তিনি সত্যিই লড়াই করেছেন,খুবই কঠিন লড়াই।বম্বের হাইকোর্ট অব জুডিকেচার এ তিনি নাম লেখালেন ২৪ আগষ্ট ১৮৯৬,আর তার পরেই এডভোকেট হিসাবে শপথ নিলেন। গাঁধী ফিরে নাম লিখিয়েছেন ১৮৯১ সালে।মোহম্মদ আলী জিন্না তখন মাত্র কুড়ি বছরের তরুণ।আইন ও রাজনীতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তার সামনে প্রসারিত।প্রথম দিনগুলোর কঠোরতা সত্ত্বেও,তার ফিরে আসার সময়টা ছিল খুবই ভাল।কারন সেই সময়ে তার বাবা করাচির আদালতে বেশ কিছু কঠিন মামলা জড়িয়ে রয়েছেন।জিন্না নিজে সেসব মামলা লড়লেন এবং জিতলেন।জিন্নার পেশাদারি জীবন শুরু হয়ে গেল এবং খুব শীঘ্রই তিনি বম্বে বার এ সেরাদের একজন হয়ে উঠলেন।তৎকালীন এডভোকেট জেনোরেল জন মোলসওয়ার্থ ম্যাকফার্সনের চেম্বারে জায়গা পেলেন।তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি এই স্বীকৃতি পেলেন।১৯০০ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে নিয়োগ পান,একজন তরুণ আইনজীবীর জন্য যা খুবই সম্মানজনক। আইনের প্রতি জিন্নার আগ্রহ এবং অনুরাগের আর একটি দিক ছিল তাঁর অসাধারণ সততা। জিন্না যখন ওকালতি শুরু করেন তখন আইনজীবী মহলে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে বর্ণবিদ্বেষ যথেষ্ট ছিল।কিন্তু খুবই দ্রুততার সাথে তিনি সেখানে ভারতীয়দের জায়গা করে নিলেন।এমনকি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েও তিনি সরকারের এমনকি বিচারপ্রতিদেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন।অন্য অনেক আইনজীবীর মতো তিনি আর্থিক লাভের জন্য কিছু করতেন না, তাঁর প্রকৃতি ছিল আত্মপ্রত্যয়ী এবং লড়াকু । জাতীয়তাবাদে তার উৎসাহ স্বার্থসিদ্ধির ইচ্ছা থেকে জম্মায়নি,তার উৎস ছিল জিন্নার মুক্ত ও উদার প্রকৃতি,ইংল্যান্ডে তার অভিজ্ঞতা । সমাজ সংস্কারের জন্য তাঁর অত্যন্ত আগ্রহ ছিল।কিন্তু সেই সঙ্গে সাংবিধানিক নিয়মকানুনের প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল পুরোমাত্রায়।যে বৈশিষ্ট্য এসেছিল তাঁর আইনি পেশার থেকেই।তিনি ছিলেন সেই মানুষদের মতোই, যাঁরা নিজের চেষ্টায় প্রভাবশালী হয়ে উঠেন, নিজের ক্ষমতার দ্বারা এবং নিজের নীতির প্রতি দায়বদ্ধ থেকে। আর কোনও অস্ত্র না থাকায় তিনি এগুলোই ব্যবহার করেন।ভারতের সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের মোকাবেলার আইনজীবী হিসাবে তাঁর জীবনের গোড়াতেই তাঁর প্রশিক্ষণ মুসলিম সঙ্গে সরকারের সর্ম্পক বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করে দেয়।ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অসুবিধা সত্ত্বেও তিনি নিজে উচ্চস্থানে পৌছেছিলেন বলে তিনি আশা করতেন,অন্যরাও বিশেষ সাহায্য ছাড়াই শিক্ষা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে সফল হতে পারবে।যখন মার্চ ১১,১৯১৩ সালে পাবলিক সার্ভিসেস কমিশনের কাছে তিনি সাক্ষ্য দিয়েছেন।লর্ড ইসলিংটন তাকে জিজ্ঞাসা করেন,এক সঙ্গে পরীক্ষা হলে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠিগুলো অসুবিধা হবে না।জিন্না অবিচলভাবে বলেন,”আমি যদি দক্ষ লোক পাই ,তা হলে যদি কোনও গোষ্টির আধিপত্যও থাকে (যদিও এই মুহর্তে সেই সম্ভাবনায় আমার ঘোর সন্দেহ) তা হলে আপত্তি করব না।”ইসলিংটন আরও বলেন ,”আমার কাছে বলা হয়েছে, কোনও হিন্দুকে যদি মুসলিমদের বিচারের দায়িত্ব বসিয়ে দেওয়া হয় তা হলে সমস্যা হবে।আপনি কি মনে করেন যে একজন শিক্ষিত প্রভাবশালী মুসলিমের থেকে কয়েক নম্বর বেশি পাওয়ার জন্য কোন হিন্দু একটি মুসলিম প্রধান জেলার একজন দক্ষ প্রশাসক হিসাবে বেশি ভাল কাজ করতে পারবেন?” উত্তরে জিন্না বলেন,”সে ক্ষেত্রে আপনি হিন্দুদের প্রতি অত্যান্ত অন্যায় করবেন।কেন একজন হিন্দু একটি মুসলিম প্রধান জেলার দায়িত্বে থাকতে পারবে না,আমি তার কোন কারন দেখিনা”,এই ধরনের মতবাদ জিন্নার জীবনে প্রথম দিকে তাঁকে কংগ্রেসের সদস্য করে তোলে, মুসলিম লিগের নয়। পাকিস্তান সরকার জিন্নার সরকারি জীবনীকার হিসাবে নিযুক্ত করে হেক্টর বোলিথেকে। পার্সিভাল স্পিয়ার ”জিন্না দ্য ত্রিুয়েটর অব পাকিস্তান”বইটি থেকে উদ্ধৃত করে লিখেন,”ব্যক্তিগত সততা,নীতির প্রতি দায়বদ্ধতা সঙ্গে যোগ করতে হয় তার সাহস,তাঁর মনে কোনও ক্ষুদ্রচিন্তা বা ক্ষুদ্র উদ্দেশ্যের অনুপুস্থিতি । বিশের দশকে মাঝামাঝি স্বরাজ এবং সরকারি শক্তি মধ্যস্ততা কিংবা সর্বদলীয় বৈঠকের আলোচনায় প্রতিরোধ, কিংবা গাঁধীর সম্মান এবং কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে একক লড়াই,বিশ্বযুদ্ধে নিরত সাম্রাজ্যবাদী সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধীতা, যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দরদস্তরে চাপের মুখে নতিস্বীকার না করা,এর কোনও বিষয়েই জিন্নার মধ্যে কখনও সাহসের অভাব দেখা যায়নি”।তার এসব শক্তি তিনি পুরোমাত্রায় ঢেলে দিয়েছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি।ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগো যাঁকে বলেছিলেন,”কংগ্রেসের চেয়ে বেশি কংগ্রেস ”। কংগ্রেসের তৎকালীন দুই প্রভাবশালী নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলে এবং পরে সরোজিনী নাইডু যাঁকে ভারতের হিন্দু মুসলিম ঐক্যের প্রতীক বা দূত বলেছিলেন। উদার,বহুসংস্কৃতিমান এবং ধর্মনিরপেক্ষ যিনি ভারতীয় ঐক্যের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সে জিন্না কিভাবে পাকিস্তানে প্রথম এবং আয়েশা জালালের কথায়’একমাত্র মুখপাত্র ’হয়ে উঠলেন ইতিহাসের ধারাবাহিক পর্যলোচনায় আমরা তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
জিন্নার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ইংল্যান্ডে থেকে ফেরার পর থেকে তার আইন প্র্যাকটিসের সাথে সাথে।১৮৯৭ সালে তিনি যোগ দেন মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বমূলক একটি সংগঠন’আনজ্ঞুমান-ই-ইসলামে’।বম্বে হাইকোর্টের বিচারপ্রতি বদরুদ্দিন তায়েবজি ছিলেন এই সংগঠনের নেতৃত্বে।তাই স্বাভাবিকভাবে তিনি হয়ে উঠলেন জিন্নার মুসলিম পরামর্শদাতা।বিশেষত কংগ্রেসে মুসলিমদের ভূমিকা কি, সে বিষয়ে তিনি পথ নির্দেশনা পেয়েছিলেন।কংগ্রেসে জিন্নার রাজনীতি বরাবরই খুবই স্বচ্ছ।কংগ্রেসে বিভিন্ন স্বার্থন্বেসী মহল তাদের মনে অভিপ্রায় বাস্তবায়নের পথ ধরে কংগ্রেসে যোগ দিলেও জিন্নার চিন্তা ছিল কংগ্রেসই ভারতীয় মুক্তির পথ।সে সময় তার যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল,অভিজ্ঞতার,নাগরিক জীবনে স্বতন্ত্র ভাবধারায় চিন্তাশীল ভারতীয় হিসাবে তার যে বিবর্তন, প্রথম জীবনে লড়াইয়ের পর তার সাফল্য,সংস্কারক হিসাবে ইসলামের প্রতি দৃষ্টি,এ সব কিছুই প্রথম জীবনে রাজনৈতিক অন্য কোন পথে যেতে দেয়নি।বিভিন্ন চিন্তাধারার লোক থাকা সত্ত্বেও তিনি সবসময় চেষ্টা করছেন ঐক্য ধরে রাখতে।তাইতো কট্রর হিন্দুবাদী স্বরাজ দাবীদার তিলকের প্রতি তিনি ছিলেন সৎ ভাবাপন্ন।অথচ এই স্বরাজ মূলত হিন্দুয়ানী রাষ্ট্রের রুপরেখা।যার প্রবতর্ক মারাঠা সেনাপতি শিবাজী।যাক পরে এর সম্বন্ধে আলোচনা করব।জিন্নার একমাত্র চিন্তা ছিল ব্রিটিশ ঔদ্ধত্য থেকে ভারতের মুক্তি,তাই তার রাজনৈতিক কার্যক্ষেত্রে জাতীয় না হয়ে উপায় ছিল না।তাঁর চিন্তা খুব কমই রাজ্য রাজনীতিতে খাপ খাওয়াতে পেরেছে।কিন্তু এখানে তিনি সবচেয়ে বড় বাধার সম্মুখীন হন;একটি রাজ্যের পূর্ণ সমর্থন না পেয়ে কী করে জাতীয় রাজনীতি কাজ করা যায়।সেই সঙ্গে তাঁর এক দ্বন্ধ ছিল,কি করে কংগ্রেসের সদস্য পদে থেকে সদ্য প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করা যায়? লিগকে উপেক্ষা করার উপায় ছিল না,অথচ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এই সময়ে (তখন তার বয়স তিরিশের কোটায়) লিগকে তাঁর রাজনৈতিক দল নির্বাচন করলে খুব সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিতে নিজেকে বেঁধে ফেলা হত।একমাত্র উপায় ছিল কংগ্রেস সদস্য হিসাবে মুসলিম লিগের বৈঠকে যোগদান।এই সিদ্ধান্তে জিন্না একটি শর্ত যোগ করলেন”মুসলিমের প্রতি বা মুসলিম স্বার্থের প্রতি আনুগত্য কখনওই জাতীয় স্বার্থের প্রতি আনুগত্যহীনতার ছায়ামাত্রও বোঝাবে না,যার প্রতি জিন্না ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।”
অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল,রাজনৈতিক নির্বাচন।এখানেও জিন্নার সামনে এক জটিল দ্বন্ধ উপস্থিত হল।তিনি উত্তেজক,জ্বালাময়ী বত্তৃতার মানুষ ছিলেন না।তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল আত্মস্থ, সংযত এক মানুষের, যিনি মুক্ত চিন্তার স্বচ্ছতা এবং তীক্ষ্ম প্রকাশ ক্ষমতা দিয়ে কাজ করেন।যতক্ষন রাজনীতি হল আলোচনার ব্যাপার,তাঁর অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠত না।কিন্তু সমাজে রাজনীতি,গণতন্ত্রের প্রসার এবং মানুষের অংশগ্রহনের হার বাড়তে থাকায় জাতীয় নেতাদের রাজা এবং স্থানীয় রাজনৈতিক ধারার সাথে যোগ রাখা ক্রমশ গুরত্বপূর্ন হয়ে উঠল।এবং এইখানে জিন্না সর্বভারতীয় মঞ্চ হারিয়ে ফেললেন।তাকে আরো যেসব সমস্যা সম্মুখীন হতে হয় তার মধ্যে অন্যতম ভারতীয় জনতার মধ্যে গাঁধীর প্রভাব।জিন্নার সাথে গাঁধীর তুলনা করা কঠিন।কিন্তু ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই প্রধান মহীরু নিয়ে আলোচনা না করলে ইতিহাস পথ হারাবে।কাথিবাড়ের এই দু’ সন্তানের মধ্যে যে মিলটি সবচেয়ে বেশি ছিল তা হল দুইজনই লন্ডন ফেরত ব্যারিষ্টার।পারিবারিকভাবে দুইজনের তফাৎ ছিল বিস্তর।একজন খুবই সাধারণ পরিবার থেকে জাতীয় স্তরে উঠে আসে।আরেকজন ছিল জম্ম থেকে সম্ভ্রান্ত পরিবারের।গাঁধীর বাবা ছিলেন একটি ভারতীয় রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী,যা তাকে অনেক সাহায্য করে।প্রতিবাদের রাজনীতিতে অসাধারন দক্ষ গাঁধী ভারতের রাজনীতির প্রকৃতিকে বদলে দিয়েছেন।তিনি বদলে দিয়েছেন মানুষকে যারা দীর্ঘদিন বিদেশি শাসনের অধীনে থেকে অধীনতার একটি শৈলী রপ্ত করেছেন।গাঁধী তাদের এই দীর্ঘ নৈতিক অধীনতা থেকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিয়েছিলেন।তিনি রাজনীতিকে উচ্চভিত্তদের বসার ঘর,বিতর্ক সভা এবং নানা সংগঠন থেকে বের করে গ্রামের সমাজে,মাটির কাছে নিয়ে এলেন,তাঁর শিকড় ছিল সেই মাটিতে।গ্রামের মানুষের ভাষা,প্রাত্যহিক বাদানুবাবাদ এবং তত্ত্বের মধ্যেই তাঁর জীবন ছিল।সেই জীবনে ঘাস,গন্ধ আর তার অসাধারণ সৌন্দর্য এবং সুগন্ধ তিনি জানতেন।হেক্টর বোলিথো তাঁর ’ইন কয়েস্ট অব জিন্না’বইয়ে এই দুই মহান ভারতীয়ের কিছু চমকপ্রদ পার্থক্য দেখিয়েছেন।লিখেছেন, জিন্না ছিল ক্ষমতার উৎস, গাঁধী ছিলেন ক্ষমতার অস্ত্র।জিন্না ছিলেন রাজনীতিতে শীতল যুক্তিবাদী,তার মন ছিল একমুখী,যার পিছনে ছিল প্রচন্ড শক্তি।জিন্নার মধ্যে সহানুভূতি শক্তি নিহিত ছিল,কিন্তু তার ব্যবহার ছিল খুবই শীতল,আন্তরিকতাহীন।গাঁধী ছিলেন করুণার প্রতিমূর্তি।জিন্না দারিদ্রের স্পর্শ করতে চাইতেন না,গাঁধী সারা জীবনই দরিদ্রকে সাহায্য নিজের হাত কুলষিত করেছেন।
জিন্না শৈশবে বারবার স্থান পরিবর্তনের পর,তিনি কোথাও সহজে শিকড় গড়তে পারতেন না,অন্যের সঙ্গে সহজে সম্পর্ক তৈরী করতে পারতেন না।তাঁর নির্যাস ছিল সংবিধানবাদীর।সেই জন্য ১৯২০ সাল নাগাদ গাঁধীর আর্বিভাব এবং দ্রুত উথানের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় স্তরে নিজের অবস্থান বজায় রাখা তাঁর জন্য কঠিন হয়ে উঠে।এমন কোনও রাজ্য ছিল না,তখন বা তাঁর পরেও যাকে জিন্না একেবারে নিজের বলে দাবি করতে পারতেন।গণ-রাজনীতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তার অক্ষমতা বরাবর ছিল এক বড় সমস্যা।তারপর জাতীয় স্তরে তাঁর অবস্থানকে আরও দুবর্ল করে দিয়েছিল তাঁর মুসলিম পরিচিতি,কারণ জাতীয়বাদী রাজনীতি তখন অনেক নেতা,যার বেশিরভাগই ছিল হিন্দু।ফলে নেতা হিসাবে তিনি দ্বিতীয় সারিতে পড়ে যান।গাঁধীর প্রতি তার বিদ্বেষ ছিল ব্যাপক যা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে।জাতীয় রাজনীতিতে গাঁধীর প্রবেশের গোড়া থেকেই জিন্না ভাবতেন গাধীঁ ’ভন্ড,ধাপ্পাবাজ,হুজুগে’।একই পরিবেশে পড়াশুনা করা,একই চলনে অভ্যস্থ হওয়া গাঁধী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে তার আগা গোড়া পরিবর্তন করে ফেলেন।ইংরেজ ’জেন্টলম্যান’ রীতিনীতি বাদ দিয়ে তিনি হয়ে পড়লেন পুরো হিন্দু পুরোহিত।জিন্না তাঁর থ্রি পিস, সু,তাঁর সিগারেট হোল্ডার এবং সাহেবি ইংরেজি প্রতি অনুরক্ত থাকলেন বরাবর।গুজরাতি তো নয়ই,কোন ভাষাতেই ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে কথা বলা তাঁর ধরণ ছিল না।জিন্না বরাবরই নিয়মতান্ত্রিক সংসদীয় রাজনীতির ধারক ছিলেন।আর গাধীঁর অহিংস,সত্যাগ্রহ উদার রাজনীতির সাথে ধর্মীয় এবং চরমপন্ত্রী রাজনীতির সম্মেলন ঘটিয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে গেলেন।জনপ্রিয়তার কারণে প্রতিদ্বন্দি পরে ব্যক্তি চরিত্রের কারণে বিদ্বেষ পরায়ন হয়ে উঠেন।তবে এও ঠিক,শেষ অবধি ১৯৪৬ এর ১৬ আগষ্টে ’ডিরেক্ট অ্যাকশনের’এর ডাক দিয়ে তিনি নিজেই সেই হুজুগে,লোক খ্যাপানো নেতাই হয়ে উঠলেন,ঠিক যা তিনি গাঁধীর মধ্যে বিশেষ অপছন্দ করতেন।তারপরও ভারত ভাগ হওয়ার আগ পযর্ন্ত তিনি তার উপর বেশি ভরসা করতেন এবং গাঁধীরও তার প্রতি আগ্রহের কারণে তিনি গাঁধীর প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করতেন।শেষের দিকে অবশ্যই তিনি গাঁধীকে অনুসরন করতে শুরু করেন যা তাকে মুসলিম লীগের একমাত্র মুখপাত্র হয়ে উঠতে সহযোগিতা করেছে।প্রথমে কংগ্রেসে গাঁধীকে জিন্না নিজের প্রতিদ্বন্দী বলে দেখতে থাকেন।আর কংগ্রেস তাদের কার্যক্রমে সমস্ত মুসলিমকে তাদের প্রতিপক্ষ ভাবা শুরু করে।একটু দেখে নিই কংগ্রেসের জম্ম,তার কার্যক্রম,মুসলিমলীগ গড়ে উঠা এবং শেষ অবধি জিন্নার মুসলিম লীগের দায়িত্বগ্রহণে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা।
দ্বিতীয় কিস্তিঃ
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা অ্যালান অক্টভিয়ান হিউম
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে মূলত প্রতিষ্ঠাতা অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ সরকারী কর্মচারী অ্যালান অক্টভিয়ান হিউম,সময়টা ছিল ১৮৮৫ সাল।ইংরেজ পৃষ্টপোষকতা এই দল গড়ে তোলার মূল লক্ষ্য ছিল এই দেশের মানুষের দাবীদাবা তুলে ধরার মাধ্যমে ইংরেজদের রাষ্ট্রপরিচালনা সহজতর করা,এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন কলকাতার উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী।১৮৮৬ সালে কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে শ্রী ব্যানার্জীর ভাষণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়।তিনি বলেন …ইংল্যান্ডের মহারানী এবং জনগনের শাসনে সুসভ্য হইয়া অদ্য আমরা এই স্থানে সম্মিলিত হইয়াছি এবং কোন প্রকার বাধা ব্যাতিরেকেই আপনার চিন্তার অর্গল উম্মুক্ত করিতে সক্ষম হইয়াছি।ব্রিটিশ শাসন,একমাত্র ব্রিটিশ শাসনেই ইত্যকার ঘটনা সম্ভব(উচ্চ রোল হর্ষধ্বনি)।এই কংগ্রেস কি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ অথবা বিদ্রোহ লালনের প্রতিষ্টান(চিৎকার না’না’);নাকি উক্ত সরকারের স্থিতিশীলতার ভিত্তিভূমিতে আরো একটি প্রস্তর খন্ড যোজন।(চিৎকার ’হ্যাঁ’হ্যাঁ)মুসলিমদের দীর্ঘদিনের শোষন বঞ্চনার প্রেক্ষিতে বর্ণহিন্দুদের যে শক্তিশালী বিরাট শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছিল।যাদেরকে তৎকালে বিদ্যুৎসমাজ বলে আখ্যায়িত করা হত তারাই হল কংগ্রেসের সদস্য।কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার সময় সেটাই সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি।গভেষক বিনয় ঘোষের ভাষায়”কিসের ট্র্যাজেডি”?প্রথম ও প্রধান ট্রাজেডি হল একে ভারতীয় বিদ্যুৎসমাজ না বলে বলা উচিৎ মুসলমান বর্জিত ”হিন্দু বিদ্যুৎ”সমাজ।এই সময়ে পুরো ভারতের মধ্যে বাংলাভাষাভাষী অঞ্চল নিয়ে বিশেষ আলোচনার প্রয়োজন আছে।কারণ ইংরেজরা সর্বপ্রথম যে অঞ্চলটি তাদের অধীনে নেয় তা এই বাংলা।এছাড়া কিছু সময় ছাড়া বেশিরভাগ সময়ই এই অঞ্চলের মানুষজন ছিল পরাধীন।স্বাধীন হিসাবে যারা ছিল তারা কেউ এই অঞ্চলের মানুষ ছিল না।তারপরও তাদের নিজেদের বলে দাবী করা যায় কারণ তারা এখানে এসে উপনিবেশ গড়েনি বরং এই অঞ্চলের মানুষের সাথে মিশে গেছে এবং এখানে তাদের মৃত্যু হয়েছে।মোঘল আমল পুরোটাকেই বলা যায় উপনিবেশ আমল।কারণ তারা কেউ অঞ্চলে থাকতে আসেনি বরং শাসন আর শোষন করার জন্য এসেছে।যার ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলের মুসলিমরা কখনও মধ্যভিত্ত শ্রেণি হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি।দিল্লি,বম্বে,করাচিতে সরকারি চাকরি করার বদৌলতা যা কিছুটা সম্ভব হয়েছে।আর এই অঞ্চলের জমিদারদের বেশিভাগ হিন্দু।ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তনে তা আরো সচনীয় হয়ে উঠে।মুসলমানদের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া,এই অঞ্চলের হিন্দুদের ইংরেজকে পৃষ্টপোষকতা দান,ব্রিটিশদের প্রতি ঘৃণা, সর্বোপরি ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থাকে পরিত্যাগ করার ফলে যে কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ধনী মুসলিম বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেছিল,তাদের অবস্থাও ধীরে ধীরে লুপ্ত প্রায় আর বাকীদের অবস্থাকে চরম অসহনীয় বলা যায়।ইংরেজদের প্রথমদিকে কলকাতাকে রাজধানী করা,হিন্দুদের ইংরেজদের সহযোগিতা প্রদান,তাদের শিক্ষা দীক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সরকারী বিভিন্ন চাকরি,ব্যবসা বাণিজ্য এবং পেশাভিওিক বিভিন্ন শ্রেনীতে ভালভাবে এগিয়ে যায়।আলী গড় আন্দোলনের কর্ণধার,নওয়াব আব্দুল লতিফ,সৈয়দ আমীর আলী এদের প্রচেষ্টায় বিংশ শতাব্দীর দার গোড়ায় দিকে এসে ইংরেজ শাসক গোষ্টা স্বীয় নীতি সংশোধনে লিপ্ত হয়।এর আগে বেশ কয়েকবার এ অঞ্চলে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়।এর মধ্যে অন্যতম ৭৬ এর মনন্তর।ঐতিহাসিকদের মতে এই অঞ্চলে ঐ দুর্ভিক্ষে কমপক্ষে এককোটি মানুষ মারা যায়।যার নব্বই ভাগই এ অঞ্চলের হতদরিদ্র মুসলিম জনগোষ্টি।দারিদ্রতা এবং প্রশাসনিক কেন্দ্রের বাহিরে পড়ে যাওয়া দুর্ভিক্ষে এত ক্ষয়ক্ষতি হয়।এরই জের হিসাবে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ।গাঙ্গেয় বদ্বীপ এলাকার পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে সৃষ্ট হলো পৃথক প্রদেশ।কিন্তু কলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু শিক্ষিত সমাজ এবং হিন্দু জমিদারদের বিষয়টি মনঃপুত হল না।কবি গুরু থেকে শুরু করে কংগ্রেসের সকল হিন্দু নেতা প্রথমে বাঙালী হিন্দু নেতা পরে কংগ্রেসের পুরো হিন্দু লবি শুরু করলেন ভয়াবহ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন; সারাভারতব্যাপী শুরু হয় সন্ত্রাসী স্বদেশী আন্দোলন।রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন এই আন্দোলনের সমর্থনে,’ আমার সোনার বাংলা’।তবে ভয়াবহ সন্ত্রাসী আন্দোলন শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ এই আন্দোলন থেকে সরে পড়লেন।এই প্রথম মুসলমানরা বুঝতে পারলেন কংগ্রেস পুরোদমে হিন্দুদের সংগঠন।যদিও কংগ্রেসের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রিয় নেতা ছিলেন মুসলিম।তবে বাংলার মুসলমান সবচেয়ে অনুধাবন করলেন তাদের দাবীদাবা আদায়ের জন্য তাদের নিজস্ব একটি সংগঠন দরকার।ফলশ্রুতিতে নওয়াব সুলিমুল্লাহর পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিমলীগ।
মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রধান পৃষ্ঠপোষক নওয়াব সুলিমুল্লাহ
সময়টা ১৯০৬ সাল।কংগ্রেসের একপেশে নীতি,জাতীয় রাজনীতিতে যে কয়েকজন মুসলিম ছিলেন তাদের বাংলা সম্বন্ধে উদাসিনতা ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর এক ঘোষণায় বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেল।এটা ছিল এই অঞ্চলের মুসলিম মনে চরম আঘাত; যার পরিণতিতে মুসলিম লীগের রাজনীতির রুপধারণ এবং সর্বশেষ ভারত বিভাগ।তখন পযর্ন্ত জিন্না কংগ্রেসের লোক।১৯০৬ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে জিন্না দুইটি বিষয়ে কথা বলেন,দুইটি মুসলিম সম্পর্কিত।তিনিতো মুসলিমই ছিলেন,তাই কি করে আর মুসলিমদের উপেক্ষা করা যায়।প্রথম বক্তব্য ছিল ’ওয়াকফ-ই-ঔলাদ’এর মান্যতা বিষয়ে।তাঁর প্রস্তাবটি কিছুটা সংশোধনের মাধ্যমে কংগ্রেস বৈঠকে গ্রহীত হয়।ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সে সময় তার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।তারা হয়তো ক্লান্ত হয়ে গেছে নয়তো ভবিষ্যৎ প্রত্যক্ষ করছিলেন।রাজনৈতিক ক্ষমতায় স্থানীয়দের অংশগ্রহণ করানোর বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন।ফলে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে কার কি ধরণের অংশগ্রহণ থাকবে সে ব্যাপারে ধর্মীয় গোষ্টী থেকে শুরু করে জাতি গোষ্টীগুলোর মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। এরই মধ্যে আগা খাঁ কিছু ডেলিগেশন নিয়ে ভাইসরয় কাছে গিয়ে মুসলিমদের জন্য পৃথক নির্বাচক মন্ডলির জন্য আবেদন করেন।জিন্না এসে ব্যাপক ক্ষিপ্ত হয় এবং আগা খাঁ এর প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন এবং তিনি পৃথক নির্বাচক মন্ডলির ব্যাপারে মুসলিমদের এই দাবির ব্যাপক সমালোচনা করে।তিনি মনে করতেন কংগ্রেস হিন্দু মুসলিম উভয়েরই প্রতিনিধিত্ব করেন।বাস্তব অবস্থা হলো তিনি জাতীয় স্থরের নেতা উপরেই রয়ে গেলেন।কিন্তু স্বাধীন ভারতে মুসলমানরা নিজেদের মোটেই নিরাপদ ভাবতে পারছিলেন না, না জাতীয় ভাবে না স্থানীয়ভাবে।আগাঁ খাঁ তার স্মৃতি কথা লিখেন ”জিন্না একমাত্র সুপরিচিত মুসলিম যিনি এই অবস্থান নিলেন,কিন্তু তাঁর বিরোধিতার মধ্যে কোন মিনমিনে ভাব ছিল না।তিনি বলেন যে, আমাদের পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর নীতি দেশকে নিজের বিরুদ্ধে ভাগ করে দিচ্ছে।”
তারপর এল পরিবর্তন,দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া কাগজে ২০ ফেব্রুয়ারী,১৯০৯ একটি চিঠিতে জিন্না স্পষ্টতই ভিন্ন অবস্থান নিলেন,এবং (প্রথম বার?)স্বীকার করলেন যে মুসলিম ”নতুন সংস্কারে বাস্তবিক এবং যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব পাওয়ার অধিকারী।”বম্বেতে মুসলিমদের একটি বৈঠকে,১৩ আগষ্ট ১৯০৯ সালে জিন্না বলেন যে,বম্বে আইনসভার মুসলিম প্রতিনিধি পাঠানোর পথ যদি দুইটি হয়।একঃ পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর দ্বারা নির্বাচন,দুইঃ মনোনয়নের ভিওিতে প্রার্থী নির্ণয়,সে ক্ষেত্রে প্রথম পথটিই গ্রহণ করা উচিত।সময়ের সাথে সাথে তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে চলল।যা মুসলিমদের দাবীর সাথে অনেক সামঞ্জস্যপূর্ণ।তার এই পরিবর্তন কংগ্রেসে তাকে কিছুটা দ্বিধা দ্বন্ধের মধ্যে ফেলে দেয় ১৯১১ এবং ১৯১২ সালে জিন্না কংগ্রেসে অধিবেশনে অংশগ্রহণ নেননি।যদিও তিনি খাতা কলমে মুসলিম লীগের সদস্য নয়,কিন্তু ১৯১০ এবং ১৯১২ সালের অধিবেশনে যোগ দেন।এর ফলে ১৯১৩ সালে তাঁর লীগে যোগ দেওয়ার পথটা সহজ হয়।১৯১২ সালে ৩১ ডিসেম্বর বাঁকিপুর মুসলিম লীগ কাউন্সিলের বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য তাঁকে প্রথাগতভাবে আমন্ত্রন জানানো হয়।তখনও তিনি কংগ্রেসের সদস্য।এখানে মুসলিম লীগের উদ্দেশ্য বিষয়ক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়,যার চার নম্বর অধ্যায় ছিল,লীগের অন্যতম উদ্দেশ্য”ভারতের উপযোগী স্বশাসন ব্যবস্থা পাওয়া।”এর স্বপক্ষে কথা বলেন জিন্না এবং ঠিক আর্দশের জন্য তিনি লীগের প্রশংসা করেন এবং দৃড়ভাবে বলেন এ ব্যাপারে কংগ্রেস ভুল পথে চলছে।মুসলিমদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং কংগ্রেসের সাথে চলন এই পর্যায়ে তাকে আবার সর্বভারতীয় স্তরের নেতায় পরিণত করে।১৯১৩ সালে এপ্রিলে গোখলের সঙ্গে জিন্না পাড়ি দেন ব্রিটেনে,ছমাস থাকেন ভারতের বাহিরে।এই সময় ঘটে কানপুর মসজিদের দুর্ঘটনা।যা আবারও সমস্ত ভারতের মুসলিমদের আতংকগ্রস্থ এবং সর্তক করে তোলে।এত কিছুর পরও জিন্না চেষ্টা চালিয়ে যান কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে ঐক্য আনার,মধ্যমপন্ত্রী ও চরমপন্ত্রীদের মধ্যে সমঝোতার।রাজনীতিতে এই সময় সব দলই তাঁকে মান্যতা দিয়েছে।চরমপন্ত্রী,মধ্যপন্ত্রী,মুসলিম,হিন্দু,পার্সি, এবং অন্যান্যরা।১৯১৪ সালে জিন্নাহ খাতায় কলমে অল ইন্ডিয়া মুসলিমে যোগ দিলেন।ওই সংগঠনে তাঁর বন্ধুদের অনুরোধে তিনি যোগ দিতে রাজি হলেন।এই বিরল যৌথ প্রতিনিধিত্বের জন্য প্রশ্ন উঠলে ,তার পৃষ্টপোষকরা বিবৃতি দিলেন”মুসলিম লিগ এবং মুসলিম স্বার্থের প্রতি আনুগত্য কোনও ভাবে,কোনও সময়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের প্রতি আনুগত্যের ছায়াও ফেলবে না,যার জন্য তাঁর (জিন্নার)জীবন নিবেদিত।”
তৃতীয় কিস্তিঃ
১৯১৪ সালের মধ্যে জাতীয় স্তরের রাজনৈতিক নেতা হিসাবে জিন্নার সুনাম প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।এর মধ্যে নির্বাচন কেন্দ্রিক স্থানীয় পর্যায়ে স্বার্থান্বেসী মহল সক্রিয় হয়ে উঠল।আর তাতে জাতিগত বিভেদ,ধর্মীয় বিভেদ বেড়ে চলল।তাই জিন্না চরম বা মধ্যপন্ত্রী নয় বরং হিন্দু মুসলিম ঐক্য তৈরী করার কাজে হাত দিলেন।জিন্না, গোপাল কঞ্চ গোখলের সাথে পরামর্শ করে একটি সাংবিধানিক সূত্র বের করার চেষ্টা করলেন,যা ভারতের নানা রাজনৈতিক স্বার্থকে যুক্ত করবে।এ সময় ১৯১৫ সালে গোখলের মৃত্যু জিন্নার জন্য তার চিন্তাধারা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে।তারপর ১৯১৬ বলা যায় তার একক চেষ্টায় ‘লখনই চুক্তি’ সাক্ষরিত হয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সাথে।এ সময় সর্বভারতীয় স্তরে নেতা হিসাব জিন্নার অবস্থান দৃড় হল তবে এবার আর হিন্দু মুসলিম ঐক্যের দূত হিসাবে নয় বরং মুসলিম হিসাবে।এসময় তিনি মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।চুক্তি সাক্ষরিত হলেও কার্যত কংগ্রেসের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক চিন্তা ঢুকে পড়ছে।তারপরও ১৯১৮ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করে চলছিল।কিন্তু আঞ্চলিক স্তরে সংঘাত বেড়েই চলছিল। মূলত কংগ্রেসে এসময় চলছিল গাঁধীর একক আধিপত্য। যিনি সংঘাত না চাইলেও তার স্বরাজ, রামরাজত্ব স্বপ্নে বিভোর ছিলেন।এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষপ্রান্তে এসে অটোম্যান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ল এবং তুর্কি সেনাপতি কামাল আতাতুর্ক নিজেই খেলাফত ভেঙ্গে দেন।আর এই সময় বিখ্যাত আলী ভাইদ্বয় তাদের খেলাফত আন্দোলন শুরু করেন।খেলাফত আন্দোলনের শুরুতে গাঁধী এই আন্দোলনের সমর্থন ব্যক্ত করেন। গাঁধী বলতেন,হিন্দু এবং মুসলমান একই মায়ের সন্তান এবং একই মাটির সন্তান।অতএব তারা একে অপরের সুখ দুঃখের ভাগীদার হবেন।এই হিন্দু মুসলিম মাখামাখি এমন পর্যায়ে পৌছে যে তারা আল্লাহ আকবর এবং ওম একই বলে প্রচার শুরু করেন।মুসলমানরা এতে এতো আহলাদিত হয়ে পড়ল মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে গাঁধীকে বক্তব্য দেওয়ার অনুরোধ করলেন।জিন্না এমনিতে কংগ্রেসে আগ থেকে কোনঠাসা হয়ে ছিল আর খেলাফত আন্দোলন মুসলিম লীগেও তার অবস্থান নড়বড়ে করে দেয়।খেলাফত আন্দোলন ছিল নিছকই একটি বাস্তবতা বর্জিত ধর্মীয় আবেগী আন্দোলন।কারণ তুর্কিরা নিজেরাই খেলাফত ভেঙ্গে দিয়েছে।এসব জানা সত্ত্বে গাঁধীর এ আন্দোলনে সমর্থন নিছকই রাজনৈতিক সুবিধা।এ সময় অনেক জায়গায় মুসলিমরা হিন্দুদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে গোহত্যা বন্ধ রাখে।গাঁধীজি মুসলিমদের এই গোহত্যা বন্ধ রাখাকে তার বিশাল কৃতিত্ব বললেন।এমনকি তিনি এমন ভবিষ্যৎ বাণী করে ছাড়লেন ”একদিন ভারতীয় হিন্দুরা তরবারী হাতে গোহত্যা বন্ধ করবে।” হয়তো তার সে স্বপ্ন পূরণে ভারতে শিব সেনারা এত তৎপর।হিন্দুদের গোহত্যা সহ বিভিন্ন অযোক্তিক রসমরেওয়াজ সম্পর্কে গাঁধীকে একবার প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন ,”আপাত দৃষ্টিতে এগুলো অযোক্তিক মনে হলেও এগুলো ভারতের চিরায়ত ধর্ম।” জিন্না গাঁধীর জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা উত্তরণের ব্যাপারটা বুঝতে পারলেও তার করার কিছুই ছিলনা।১৯১৭ সালে জিন্না মেস্টনকে বলেছিলেন, ”চরমপন্ত্রীদের একটি নির্দিষ্ট কর্মসূচি রয়েছে,যা হয়তো অবাস্তব,কিন্তু তা মানুষের মর্যাদাবোধের কাছে আবেদন রাখে।নরমপন্ত্রীদের তেমন কোনও মতবাদ নেই,সরকারকে বিশ্বাস করা ছাড়া।” আসলে গাঁধীর নেতৃত্ব ছিল প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে ধর্মীয় এবং আঞ্চলিক চরিত্রের,যেখানে জিন্না ছিলেন আসাম্প্রদায়িক,জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত এক নেতা।একজন ধর্মকে তাঁর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছিলেন,অন্যজন নৈতিক কারণে সেই ব্যবহার থেকে দূরে থাকতেন।১৯২০ সাল অবধি জিন্না ভারতীয় রাজনীতির নানা শক্তিকে ধরে রেখেছেন এবং একই সঙ্গে সরকারের উপর চাপ বজায় রেখেছেন ।জিন্না চেয়েছিলেন একটা ফেডারেশন ব্যবস্থা,যেখানে অবশিষ্ট ক্ষমতাগুলি থাকবে রাজ্যের হাতে।সেক্রেটারি অব স্টেট ফর ইন্ডিয়ার দফতরটি তখন যে আকার ছিল,তার পক্ষে তিনি ছিলেন না।তিনি মনে করতেন,ভাইসরয় এবং গভর্নরদের হাতে একতান্ত্রিক ক্ষমতা থাকা উচিত নয়।কেবলমাত্র জননিরাপত্তা এবং পুলিশি প্রশাসনের বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে,কিন্তু তাঁদের আইন সভার কাছে দায়বদ্ধ করতে হবে।আইনসভা আর্থিক ক্ষমতা সহ সব ক্ষমতার অধিকারী থাকবে।আঞ্চলিক এবং কেন্দ্রীয় আইনসভায় সদস্য মনোয়ন প্রথা বন্ধ করতে হবে।সব আসনই নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ণ করতে হবে।তার নানা প্রস্তাবের মধ্যে এও বলা হয়েছিল যে ইংল্যান্ডের জনজীবনে যারা উজ্জ্বল,তেমন মানুষদের মধ্যে থেকে গভর্নর বাছা হোক,যাতে তারা ভারতের সমাজে নতুন চিন্তা আনতে পারেন।আঞ্চলিক ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে দেওয়া হোক,যারা আঞ্চলিক আইনসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকতে পারেন,গর্ভনরের কাছে নয়।অথচ ইংল্যান্ড সরকার ভাইসরয় এবং গর্ভনরদের হাতে সকল ক্ষমতা রেখে আঞ্চলিক পর্যায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিলেন। এর প্রতিবাদে ১৯২০ সালে জিন্না ব্যাপক ক্ষোভের সাথে বলেন,”ইংল্যান্ডের অভিজাত সমাজ আসলে বুদ্ধিহীন রক্ত দিয়ে তৈরী।” ভারতীয়রা অসহযোগিতা করলে তার ফল কি হবে।সে সতর্কবানীও তিনি ছুঁড়ে দেন।
পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু
ঐ বছর কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে গাঁধীজী অসহযোগিতা আন্দোলনের প্রস্তাব দেন।যা জিন্নার বলা অসহযোগিতা থেকে ভিন্ন।একমাত্র মতিলাল নেহেরু গাঁধীজীর অসহযোগিতা আন্দোলনকে সমর্থন করেন।তারপরও গাঁধীজীর প্রস্তাবই ১৮৮৬ ভোটে পাশ হয়ে যায়।এ অবস্থা হোম রুল লিগের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অ্যানি বেসান্ত পদত্যাগ করেন,গাঁধীজী হন নতুন প্রেসিডেন্ট।জিন্না বারবার সতর্ক করেন তার এই সহযোগিতা আন্দোলন নিশ্চিত সংঘাতে রুপ নিবে।গাঁধীজী হোম রুল পরিবর্তন করে এক বছরের মধ্যে স্বরাজ লাভের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করেন।এই স্বরাজ বলতে কি? জিন্না প্রশ্ন তুললেন।প্রায় একই সময় মুসলিম লীগের একটি অধিবেশনে গাঁধীর অসহযোগিতা আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়।জিন্না বুঝলেন,এ সময়টা তার নয়,সবাই গাঁধীকেই অনুসরণ করছে।কার্যত গাঁধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের আহমাদাবাদ অধিবেশন(১৯২১)পৌঁছল তাঁর শেষ পরিণামে।এই অধিবেশনে আগতদের জন্য কোনও চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা রাখা হয়নি।সকলে মাটিতে বসলেন,খাদি পরলেন এবং বসে বসে চরকায় সুতো কাটতেছিলেন।ঐ অধিবেশনই ছিল জিন্নার কংগ্রেসের শেষ অধিবেশন।তিনি একমাত্র প্রতিনিধি ছিল যাতে তিনি তার সহজাত পোশাক পরে এলেন এবং চরকায় সুতো কাটেননি।ততদিনে জিন্নার নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন পুরোই বেস্তে যায়।অসহযোগ আন্দোলনের ফলে কংগ্রেসেরও আইনসভা প্রবেশের পথও বন্ধ হয়ে যায়।গাঁধীর আন্দোলনের ধর্মীয় রুপ প্রথম দিকে সহযোগিতার সেতুবন্ধন রচনা করলেও তার স্থায়িত্ব অল্প রইল।প্রথম শুরু হয় মালাবার বিদ্রোহের মাধ্যমে এর জন্য ইংরেজরা খেলাফত আন্দোলনকে দায়ী করে।দ্রুত তা পুরো ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।মুলতানের দাঙ্গায় জন্যও মুসলিমদের দায়ী করা হয়।গাঁধীর সমকালীন নেতা বি আর আম্বেকর তাঁর বই ‘পাকিস্থান অথবা দেশবিভাগ’ বইটিতে লিখেছেন, “কলঙ্কজনক সত্য এই যে, বেশ কিছু উজ্জ্বল হিন্দু যারা মুসলিম ধর্মীয় আবেগে আঘাত দিয়েছিলেন।” মালাবার ও মুলতান এর জিগির তুলে ১৯২২ এর ডিসেম্বরে গয়ায় হিন্দু মহাসভার বার্ষিক অধিবেশনে পন্ডিত মদন মোহন মালব্য প্রচারের সুরটি বেঁধে দিলেন।তিনি প্রস্তাব করলেন,প্রত্যেকটি গ্রামে হিন্দুসভা গড়ে তোলা হোক।এই অধিবেশনে পন্ডিত মালব্যের প্রস্তাব কেবল সমর্থনই পায়নি,অধিবেশন শেষ হল আরও অনেক বেশি জঙ্গি মানসিকতায়।হিন্দুরে এই সংগঠিত প্রচারের মোকাবেলায় মুসলমানরা ছিল একেবারেই অসংগঠিত। মূলত গাঁধীর ধর্মীয় ধারায় অসহযোগিতা আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা অনেকদূর পিছিয়ে দিল।নামে মাত্র যে নির্বাচনগুলো ১৯২৩, ১৯২৬ এসব নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি পুরো মাত্রায় নষ্ট হয়ে গেল। অবস্থা এতদূর গড়ালো গাঁধীজী শত চেষ্টা করেও সে অবস্থার আর উত্তরণ ঘটাতে পারেননি।সম্ভবত এই কারণে ১৯২৬ সালে নির্বাচনে কংগ্রেসের পক্ষে শোচনীয় হয়ে উঠল।জিন্না এই সময় মুসলিমলীগকে বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করেন।ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম নেতৃবৃন্দকে ঐক্যে আনার চেষ্টা করলেন।পরিবর্তিত পরিস্থিতি জিন্না আবার দূঢ়ভাবে বলতে পারলেন দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে,সংবিধানের অামূল পরিবর্তন দরকার।এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি আরেকটি ’লখনউ প্যাক্ট’ প্রণয়নের চেষ্টা চালিয়েছেন।কিন্তু হিন্দু মহাসভা পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর দাবী কোন ভাবে মানতে রাজী নয়।এহেন পরিস্থিতি কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে হিন্দু মহাসভা অনেকটা হিন্দুদের মুখপাত্র হয়ে উঠল।শেষ পযর্ন্ত কংগ্রেসও মুসলমানদের পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর দাবীটা বাতিল করলেন।যদিও গাঁধী পৃথক নিবার্চক মন্ডলীর পরিবর্তে আনুপাতিক সুবিধা দিতে রাজি ছিলেন কিন্তু হিন্দু মহাসভার আপত্তিতে তাও হলোনা।১৯২৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হল,ক্ষমতায় এল কনজারভেটিবরা।তারা সোজা সাপ্টা জানিয়ে দিল সহযোগিতা না করলে কোন সাংবিধানিক সংস্কার না।এর বিরুদ্ধে জিন্না কড়া প্রতিবাদ জানালেন এবং বললেন ভারতের সব বড় নেতাই গাঁধী ,মতিলাল নেহেরু যখন তাদের সহযোগিতা করছে,তখন এধরনের বক্তব্য উদ্দেশ্য প্রণোধিত।কিন্তু তিনি হেরে গেলেন।তার সর্বভারতীয় জাতীয়বাদী লড়াই থমকে গেল।এই অচলাবস্থায় জন্য মোতিলাল নেহরু ডিসেম্বরে ১৯২৮ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে আক্ষেপ করে বললেন, “ঐক্যবদ্ধ না হলে বিদেশীদের সামনে দাঁড়ানো মুশকিল।কিন্তু আমাদের মধ্যে বিদেশী আধিপত্য থাকলে ঐক্যবদ্ধ হওয়াও মুশকিল।” ফিরে যাওয়া যাক পাঞ্জাবে।১৯২৭ সালে জিন্নার উদ্যোগের ফলে পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ তাঁর প্রতি স্বন্দিগ্ধ হয়ে উঠে।বস্তুত পাঞ্জাবের মুসলিমরা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় সেখানকার নেতৃবৃন্দ পাঞ্জাবের পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর দাবী প্রত্যাক্ষান করে।এর ফলশ্রুতিতে মুসলীম লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। এতে জিন্না হারান ফিরোজ খান নূন, স্যার মহম্মদ ইকবাল, হযরত মোহানির মত নেতৃবৃন্দকে।মুসলীম লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হলেও বাস্তবতা হচ্ছে ঐখানে শতদা ভাগে বিভক্ত গোষ্ঠি ছিল।এ রকম পরিস্থিতিতে জিন্না হতাশ হলেন।এর মধ্যে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী রাত্রি মৃত্যুবরণ করেন।১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডে চলে যান।এই বছর গুলি ছিল, একাকিত্ব, মানসিক এবং নৈতিক সংযমের সংমিশ্রণ এবং সততা যা এতই তীব্র যে প্রায় আত্মনির্যাতনের পর্যায়ে পৌঁছে যায়।তাঁর গুণগুলি ছিল তীব্র,তুলনায় দোষগুলো ছিল খুবই নগণ্য।
১৯২৭ সালে কলকাতা অধিবেশনে (সর্বদলীয় জাতীয় কনভেনশন,ডিসেম্বর ১৯২৮)দিল্লি থেকে জিন্না একটি টেলিগ্রাম করে,এই বলে যে তিনি এবং তাঁর ছয় সহকর্মী কংগ্রেস কমিটির সঙ্গে দেখা করে কিছু বিষয় আলোচনা করতে চান-এগুলি ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁদের সমঝোতার শর্ত।জওহরলাল নেহেরু ছিলেন তখন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট।যিনি পুরো ওষ্টেমিনিষ্টার স্টাইলে গণতন্ত্রের পক্ষে ছিলেন।সংখ্যাগরিষ্ঠতা সর্বশেষ কথা।জিন্না দাবীগুলো একটি বিশেষ কমিটির কাছে রাখলেন কিন্তু কমিটি সেগুলো খারিজ করল।বিপক্ষে ছিল ১৮ জন,পক্ষে মাত্র ২ জন।তাঁরা হলেন গাঁধী ও জামশেদ নাসের ওয়ালিন।জিন্না চোখে জল নিয়ে ফিরে গেলেন।সকালে জামশেদ স্টেশনে জিন্নাকে বিদায় জানাতে গেলেন।তিনি তার সাথে করমর্দন করলে এবং এই কথাগুলি বললেন, “জামশেদ,আমাদের রাস্তা আলাদা হয়ে গেল।” যবনিকা ঘটল তার ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের।জিন্না সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল আঞ্চলিক পর্যায়ে রাজনীতি না করা এবং জাতীয় পর্যায়ে মজবুত কোন মঞ্চ না থাকা।ফলে বিশাল হৃদয় সম্পন্ন এবং ধর্মীয় সংকীর্ণতা মুক্ত হয়েও তিনি পাননি তার উপযুক্ত রাজনৈতিক অবস্থান।কারণ তিনি যতই যোগ্যই হন না কেন তার সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল যা তিনি অনুধাবন করেছেন অনেক পরে তা হচ্ছে তিনি ছিলেন একজন মুসলিম।ক্রমান্বায়ে সে আত্মপরিচয়ে তিনি রাজনৈতিক অভিষ্ট নির্ধারন করলেন।আঞ্চলিক পর্যায়ে মুসলিম নেতাদের সাথে সমন্বয় শুরু করলেন।আর তাতে ১৯২৭ সালে তার চারদফা ,১৯২৮ সালে দাঁড়াল ছয়ে এবং ১৯২৯ সালে চদ্দোয়।আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দের নিষ্ঠুর যুক্তি এবং তাদের নিরন্তর দাবির চাবুক শেষ অবধি জিন্নাকে পাকিস্থানের ‘কায়েদে-ই আজম’করে তুলল।
এ পর্যায়ে জাতি ও জাতীয়তাবাদ এবং মুসলিম জাতীয়তা নিয়ে আলোচনার দাবী রাখে।জাতি,জাতীয়তা ও জাতীয়তাবাদ বলতে কি বুঝায়? কোন সব মৌল উপাদানের সমন্বয়ে জাতীয়তা গড়ে উঠে? একটি রাষ্ট্রে একটি জাতিই থাকা জরুরী,না কতিপয় জাতীর সমাবেশ হতে পারে? বহুসংখ্যাক জাতি বা জাতিসত্তা যদি একই রাষ্ট্রে বসবাস করে,তাহলে সে রাষ্ট্রের ইনসাফপূর্ণ,ন্যায়নুগ ভিত্তি ও সঠিক কর্মনীতি কি হতে পারে? এ কয়টি নিতান্ত তত্ত্বমূলক প্রশ্ন।এ কয়টি প্রশ্ন সম্পর্কে গভীর ও ধীরস্থির চিত্তে এবং মননশীলতা ও দায়িত্ববোধ সহকারে আলোচনা ও পর্যালোচনা করা একান্ত আবশ্যক।
চতুর্থ কিস্তিঃ
নেহেরু চিন্তাভাবনা অনেকটা লেলিন,মুসোলিনের মতো ছিল। অথচ এই দাম্ভিক উচ্চাবিলাসী লোকটি বুঝতে ছিলনা নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে ছিলেন, দেশ তখনও স্বাধীন হয়ে যায় নি। বৃটিশরা নিজেদের উপর চাপ কমানোর জন্য ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস দিচ্ছিল। তাছাড়া হিন্দু-মুসলিম অবিশ্বাস তখন চরম পর্যায়ে। এসময় ১৯২৯ সালে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে স্বাধীনতার লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং মার্চ মাস থেকে দেশ জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলেন।জিন্না ভয় পেলেন এবং সংগত কারণেই ভয় পেলেন, আন্দোলনের এই রাস্তা স্বাধীনতার সকল পথকেই রুদ্ধ করে দিবে। জিন্না এসময় পিতা-পুত্র অর্থাৎ মতিলাল-জওহরলাল দুইজনকে একসাথ করে গান্ধীর কাছে আনলেন,দু’জনে তখন জেলে বন্দী। জিন্না চেষ্টা করতেছিলেন কংগ্রেসের সাথে সরকারের এক বোঝাপোড়া হয়ে যাক।কিন্তু বৈঠক ব্যর্থ হয়।
১৯৩০ সালে জিন্না লন্ডনে যান এবং রাজা পঞ্চম জর্জের একটায় সভায় অংশগ্রহণ করেন।সেখানে আবারো ঈঙ্গিত পাওয়া যায়, হিন্দু মুসলিম ঐক্যমত্য পৌছলে সাংবিধানিক সংস্কারের লক্ষ্যে তারা একটি প্রস্তাব দিতে পারে।পরে লন্ডনে অবস্থানরত হিন্দু মুসলিম নেতৃবৃন্দ একটি বৈঠকে বসলেন।হিন্দুদের পক্ষকে থেকে একজন আগা খাঁ কে জিজ্ঞাসা করলেন মুসলিমদের অন্যসকল বিষয় মেনে নিলে তারা কি পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর দাবী ছেড়ে দিবেন? তিনি বললেন,”যদি আপনারা আমাদের দাবীগুলো মেনে নেন,তা হলে আমাদেরও যৌথ নিবার্চকমন্ডলীতে আপত্তি নেই,তবে মুসলিমদের জন্য আসন সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করতে হবে।” আবার জিজ্ঞাসা করা হল,যদি যৌথ নিবার্চকমন্ডলী সমেত অন্য নানা বিষয়ে একটা সমঝোতায় আসা যায়,তা হলে কি মুসলিমরা বৈঠকে জাতীয়তাবাদের দাবী সমর্থন করবে? ওর জবাবটি ছিল স্বভাব সিদ্ধ এবং সংক্ষিপ্ত: ”সে ক্ষেত্রে আপনারা সামনে থাকবেন,আর আমরা আপনাদের অনুসরণ করব”।সপ্রু ও শাস্ত্রী আপত্তি করেনি কিন্তু বাধ সাধলেন জয়াকর এবং মুণ্ডে।স্যর চিমলাম লিখেছেন,’এইভাবে একটি সোনার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল।’
আমি আগেই বলেছি জাতীয়তা ভিন্ন হলেও রাজনৈতিক চুক্তির আলোকে রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে।কিন্তু কংগ্রেস প্রকৃত পস্তাবে মুসলমানদের কোন ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলনা।প্রকারান্তে তারা মুসলিমদের জাতীয়তাকে অস্বীকার করল।মুসলিমরা অনেকদিক দিয়ে সংশয়ে ছিলেন,তারপরও তারা বারবার হচট খেয়েছেন কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদীতার কাছে।মুসলিমরা চাইছিলেনলন ভারত হোক ফেডারেশন রাষ্ট্র।আবার এই ফেডারেশন রাষ্ট্রে প্রায় ষাট এর মত রাজন্যবর্গ ছিল যার অধিকাংশ ছিল হিন্দু।দেশীয় রাজারাও যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচের সরকারের ক্ষেত্রে একধরণের আংশিক সম্মতি দিয়েছে।যদিও সকল সম্ভাবনাকে শেষ পযর্ন্ত কংগ্রেসই জল ঢেলে দিয়েছিল।এভাবে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষন করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পক্ষে সংগ্রাম করতে করতে জিন্নাহ অনেকটা একা হয়ে পড়েন।ম্যাঞ্চেষ্টার গার্ডিয়ান এর পর্যবেক্ষন তা ধরাও পড়েছিল স্পষ্ট: ”গোল টেবিলে বৈঠকে মিস্টার জিন্নার অবস্থানটি ছিল বিচিত্র।হিন্দুরা ভাবতেন যে তিনি সাম্প্রদায়িক মুসলিম,মুসলিমরা তাঁকে হিন্দুপন্থী ভাবতেন,দেশীয় রাজারা ভাবতেন তিনি বড় বেশি গণতান্ত্রিক,ব্রিটিশ মতে তিনি আবার ঘোর চরমপন্থী,ফলে তিনি সর্বত্রই আছেন,আবার কোথাও নেই।কেউ তাঁকে চায় না।”
বহুকাল পরে,লাহোরে ১৯৩৬ এর ২ মার্চ একটি জনসভায় বক্ততা দিয়েছিলেন জিন্না,তাতে এই বৈঠকের কথা ফিরে দেখেছেন তিনি: ”আমি মুসলিমদের চটিয়েছিলাম।হিন্দু বন্ধুরাও ’বিখ্যাত চৌদ্দ দফার’ ফলে খুশি হয়নি।রাজন্যবর্গের লুকানো,অসৎ ক্রিয়াকলাপের প্রবল বিরোধিতা করেছিলাম,ফলে তাঁরাও খেপে গিয়েছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আমার উপর খুশি হয়নি,কারণ আমি শুরু থেকেই জানতাম ও বলেওছিলাম যে, ওরা আদ্যন্ত ধাপ্পাবাজ,ফলের এদের বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলাম। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেখলাম যে,আমার চারপাশে কোন বন্ধু নেই।”
বৈঠক যেভাবে শেষ হোক ৫ ই মার্চ ১৯৩১ সালে লর্ড আরউইন এর মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হল।যার উদ্দেশ্য ছিল সংবিধান রচনায় যাতে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করে।আর বরাবরই মুসলিমরা যখনই কোন ছাড় দিয়েছে তখনই কংগ্রেস সেটাকে ছাড় হিসাবে না নিয়ে কিভাবে তাদের অন্তরে গহীনে লুকায়িত এক অপ্রতিরোধ্য ’রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার’ (যা শুধু কল্পনামাত্র.যার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আজ পর্যন্ত কেউ পায়নি) কাজকে আরো অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার পরিকল্পনায় নেমে পড়ে।যদিও কংগ্রেস তাদের হিন্দুদের নয় বরং সমগ্র ভারতে প্রতিনিধি হিসাবে বারবার দাবি করে আসছিল।এমনকি মৌলানা আজাদ দীর্ঘদিন কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিল।ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসের এই মহান ব্যাক্তি ভারতের মধ্যে মুসলিমদের স্বার্থ দেখেছেন এবং দেখেছেন সাম্প্রদায়িকতা এড়ানোর জন্য এটাই একমাত্র পথ।তিনি তার নিজের বই ’ভারত স্বাধীন হল’ বইটিতে বারবার দেখিয়েছেন কিভাবে পরীক্ষার সময় এলেই কংগ্রেস কিভাবে সকল গোষ্ঠির প্রতিনিধি এটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হত।আর্শ্চযজনক হলেও সত্য কংগ্রেস নেতা বল্লব ভাই প্যাটেলের সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ড এবং পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতে বল্লব ভাই প্যাটেল মুসলিম জনসাধারণকে পাকিস্থানের বিরুদ্ধে হিন্দুদের জন্য বন্ধী জিম্মি হিসাবে নিয়েছিলেন,তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।।স্বাধীন ভারতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে মুসলিম হত্যাযজ্ঞে তার পরোক্ষ সহযোগিতা এবং শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাড়ানোর জন্য গাঁন্ধীকে হত্যা তার পরোক্ষ ভূমিকা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।মৌলানা যে নেহেরুকে অন্ততঃ তার চিন্তার সাথে সামঞ্জস্য ভেবেছিলে, সে নেহেরু কিভাবে মুসলিমদের জাতীয়তাকে অস্বীকার করলেন, তা তুলে ধরলেন।এতকিছুর পরেও তিনি কংগ্রেসের সাথে থেকে গেলেন এবং কংগ্রেসের কাগজে লেখা কথাগুলোকেই কংগ্রেস মনে করতেন।
যাহোক এতকিছুর পরও একমাত্র গাঁধী ছিলেন ভরসা,জিন্নাহ তাই মনে করতেন।আর যখনই গাঁধীর জায়গায় অন্য কংগ্রেস নেতারা এসে বসলেন তখন আবারও পরিস্থিতি পাল্টে গেল।আবারও সংবিধান রচনা ব্যর্থ হল এবং স্বরাজ,ডোমিয়ন স্টেট সবকিছুই আবার থমকে গেল।ইতিমধ্যে আর্ন্তজাতিক পরিস্থিতি হঠাৎই টালমাটাল হয়ে পড়ল।বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার প্রভাবে বিশ্বের বৃহত্তম দু’টি অর্থনীতি মাকির্ন এবং ব্রিটিস অর্থনীতি বেসামাল হয়ে পড়ল।বেকারত্ব ভয়াবহ আকার নিল।১৯৩১ সালে ২৪ আগষ্ট ব্রিটেনে ম্যাকডোনাল্ড এর জোটই ক্ষমতায় এল,তবে নতুন সরকারের মুখ্যভূমিকা থাকল রক্ষণশীল গোষ্ঠী এবং তাদের ভারতীয় দাবিদাওয়ার পক্ষে কোন সহানুভূতিই ছিলনা।১৯৩৫ এর জুন মাসে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সেই সরকারই বহাল থাকল।আর্থিক মন্দার গ্রাস থেকে বেরোতেই না বেরোতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামাকা বেজে উঠল।১৯৩৯ এর সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া সেই যুদ্ধ থেকেই ’এন্ডগেম’ শুরু হল বলা চলে,যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ এ দেশভাগ এবং স্বাধীনতা।
এরকম পরিস্থিতিতে হিন্দুমুসলিম অনৈক্যের কারণে দ্বিতীয় গোলটেবিলে বৈঠক শুধু সময় ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই হল না।কংগ্রেস নিজেদের পুরো জাতির প্রতিনিধি দাবি করলেও তাদের আচরণে কখনও সেটা প্রকাশ পায়নি।এজন্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ বরাবরই গাঁন্ধীজীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন।কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিষয়ে শেষ পর্যন্ত তিনিও তার অপরাগতার কথা প্রকাশ করলে মুসলমান নেতৃবৃন্দ পরোপুরি হতাশ হয়।তাই ফেডারেশন রাষ্ট্র এবং তার কর্মপরিধি নিয়ে মুসলিমরা আরও দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করলেন।এবং এই ব্যাপারে জিন্না মোটামুটি সকল মুসলিম নেতৃবৃন্দকে এক করতে সক্ষম হয়।এর বিপরীতে পন্ডিত মালব্য এবং হিন্দু মহাসভা প্রবলভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গেল এবং এমন সব বিমূর্ত রাজনৈতিক তত্ত¡ আর নীতি আউড়ে চাপ তৈরি করল-যার সঙ্গে ভারতের বাস্তবতার কোন মিল নেই-যা ১৯৪৭ এর দেশভাগ দেখিয়ে দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে ইংরেজরা অনেক কোনঠাসা হয়ে পড়ে।এমনকি এশিয়া তাদের অধিনস্ত অনেক সাম্রাজ্য তখন জাপানের অধীনে।এরকম পরিস্থিতি ভারতীয়দের সহযোগিতার আশায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডেন্ট রুজডেল্ট বারবার বৃটেনকে তাড়া দিতে থাকে ভারতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।যদিও চার্চিল মনে প্রাণে চাচ্ছিলেন না তথাপি মার্কিন চাপে তিনি ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ভারতে একটি মিশন পাঠাতে বাধ্য হন।তাদের এই এগিয়ে আসাকে কংগ্রেস আবারো তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার বানায়।যদিও এব্যাপারে জিন্না এবং মুসলিমলীগ ছিল চুপচাপ।কংগ্রেস এটাকে আবার জিন্না এবং মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে।যদিও কংগ্রেসের রাজনৈতিক গুটি তাদের জন্য বুমেরাং হয় এবং মিশন ব্যর্থ হয়ে ইংল্যান্ডে ফেরত যায়।কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের হিন্দু নেতৃবৃন্দের কার্যক্রমের ফিরিস্থি যদি তুলে ধরা হয় তবে তাদেরকে বিশ্বের বুকে অন্যতম সাম্প্রদায়িক গোষ্টি হিসাবে চিহিৃত করা যায়।
নেহেরু জিন্নাকে মোটেই সহ্য করতে পারতেন না এবং মুসলিমদের স্বার্থের ব্যাপারে তিনি মোটেই সহানুভূতিশীল ছিলেন,তা গাঁধী সাথে তার দীর্ঘ পত্রালাপে বুঝা যায়।তিনি জিন্নার দাবীসমূহকে হাস্যকর,উদ্ভট ইত্যাদি বলে সবসময় উড়িয়ে দিয়েছেন।
তাদের কর্মকান্ডে ব্যথিত জিন্না ১৯৩৮ এ আলিগড় অ্যাংলো মুসলিম কলেজ বক্ততায় বেদনা উপুড় করে দিয়ে বলেছেন,”হিন্দু আবেগ,হিন্দু মন,হিন্দুদের মনোভাব থেকে আমি সিদ্ধান্তে এলাম,ঐক্যের কোন আশাই নেই”।পার্সিভ্যাল স্পিয়ার তাঁর নিবন্ধ ’জিন্না দ্য ক্রিয়েটর অব পাকিস্থান ’এ বলেছেন যে,”বোলিথোকে তাঁর লেখা পত্রে জানিয়েছেন যে,বিশের দশকে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে জিন্না আপাতত তাঁর রাজনৈতিক ক্যরিয়ারের বিপুল ক্ষতি করেছেন।১৯৩৩ এ তাঁর দেশে ফেরার সঙ্গেও এই ঐক্যভাবনার একটা যোগসূত্র ছিল,সঙ্গে একটি ক্ষীণ আশাও থেকে গিয়েছিল।এই কারণে তিনি ইকবাল কথিত বিচ্ছিন্নতার যুক্তিকে ঠেকিয়ে রেখেছিল।শেষে কংগ্রেস যখন স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল যে লীগ এর সঙ্গে কোন সহযোগিতা চলতে পারেনা,স্রেফ একটা অধীনতার সম্পর্ক বা একধরণের অধিগ্রহণের সম্পর্কই চলতে পারে,তখন জিন্না হাল ছেড়ে দিলেন” ।শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস এর সৈ্বরতান্ত্রিক মনোভাবই কিন্তু জিন্নাকে ”সাম্প্রদায়িক”করে তুলল,”জিন্নার আহত আত্মভিমান নয় বরং কংগ্রেসের অতি দর্পের জন্যেই তাঁর মনোভাবে এমন বিপুল পরিবর্তন এল।”
ইংরেজ পর্বে মুসলমানদের জন্য প্রথম কার্যকর আন্দোলন দাঁড় করান স্যার সৈয়দ আহমদ খান।(এর আগে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত পুরো ভারতে মুসলিমরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে শতশত আন্দোলন করেন,এসব আন্দোলনে বেশিরভাগই নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন আলেমগণ।নবাব মীর কাশিম,হায়দার আলী,তার পুত্র টিপু সুলতান,সৈয়দ নিসার আলী ওরপে তীতুমীর,মাওলানা শরিয়তুল্লাহ,তার পুত্র মাওলানা আলাউদ্দিন ওরপে দুদু মিয়া,তার পুত্র গিয়াস উদ্দিন ওরপে নোয়ামিঞা,শহীদ আহমেদ ব্রেলভী,শহীদ ইসমাইল শহীদ সহ লাক্ষো বীর মুজাহিদগণ।আরো অনেক মুসলিম মুজাহিদগণ আন্দোলন করে ফাঁশির কাষ্টে ঝুলেছেন। দুর্ভাগ্য ইহিাসে তাদের নামটা পর্যন্ত মুছে ফেলা হয়েছে।এসব আন্দোলনে যদিও মুসলিমদের হাতে গোড়াপত্তন হয়েছে, তথাপি আন্দোলনগুলোকে রাখা হয়েছে ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে। যার কারণে হাজার হাজার হিন্দু দলিত সম্প্রদায় এগুলোতে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন জীবন দিয়ে।তবে হিন্দু রাজন্যবর্গ,জমিদারশ্রেণি এবং তাদের শিক্ষিত সমাজ এসব আন্দোললের কট্টর বিরোধীতা করেই ক্ষান্ত হননি বরং ইংরেজদের আর্থিক সাহায্যসহকারে বিভিন্ন সহযোগিতা দিয়েছেন। অনেকে আন্দোলনরতদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে উল্টো বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।তারা ইংরেজদের অধিনতাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ছিলেন। এদের মধ্যেও ব্যতিক্রম ছিলেন,ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাই,তাঁতিয়ার তোপী। তারাও স্বাধীরতার জন্য লড়েছেন জীবন দিয়ে। তবে এই আন্দোলনগুলো ব্যর্থ হওয়ার আরেকটা কারণ ছিল এগুলো কোনটাই সর্বভারতীয় আকার দিতে না পারা, ফলে ইংরেজেদের আধুনিক রণসজ্জার কাছে এগুলো ছিল খুবই দুর্বল।১৮৫৭ সালে আন্দোলন এই আন্দোলগুলোর ফল বলা যায়। বিশ্বাসঘাতকতা আর রণকৌশলের দুর্বলতা ঐ আন্দোলন ব্যর্থ হলে মুসলিমরা নতুন করে ভাবতে শুরু করে।তার ফলাফল আলীগড় আন্দোলন।)
তবে এই আন্দোলন ছিল মুসলমানদের শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক উন্নতির উদ্দেশ্যে পরিচালিত আন্দোলন।সে ক্ষেত্রে তিনি বহুলাংশে সফল হন।তিনি মুসলমানদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন নিজেদের উন্নয়ন নিজেদেরই ঘটাতে হবে।১৯৩৭ সাল পরবর্তীতে শুরু হয় সে ফ্ল্যাটফর্মে মুসলমানদের রাজনৈতিক আন্দোলন।১৯৩৭ সালের আগ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বস্তুত কোন ঐক্যেই ছিল।প্রাদেশিক পর্যায়ের নেতারা কেউ কাউকে মানতে রাজি ছিল না।যার ফলে ১৯৩৭ সালে নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলিম ভোটের মাত্র ৫.৮ শতাংশ পেল।তবে এই নির্বাচন মুসলিম লীগের জন্য অনেক কিছুই ইংগিত দেয়।
১৪৪ টি হিন্দু আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১৩৪ টি পায়।অন্যদিকে কংগ্রেসের টিকিট নিয়ে যেসব মুসলিমরা প্রার্থী হয় তারা সবাই পরাজিত হয়।অন্যদিকে মুসলিম টিকিটে ৩৬ জন দাঁড়িয়ে ২৯ জন জয়ী হন।নিবাচর্নে এই জয় নেহেরুকে ব্যাপক উগ্র করে তোলেন আর জিন্না দেখেছিলেন ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।নির্বাচনে পরবর্তী এক বক্ততায় নেহেরু বলেন ”ভারতে এখন কেবল দুটি শক্তি আছে; ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর ভারতীয় জাতীয়তাবাদ,কংগ্রেস যার প্রতিনিধি” ।জিন্না অবিলম্ভে এর জবাব দেন; না,একটি তৃতীয় পক্ষ আছে-মুসলমান, ”ইতিহাস প্রমাণ করেছে,তিনি ঠিক কথা বলেছেন।” ইতিহাস সাক্ষী,কংগ্রেস যা চেয়েছেন তার বাস্তবায়নের প্রজ্ঞা বা মন কোনটাই ঈশ্বর তাদের দেননি।কারণ তিনি চিন্তা করেছেন ভিন্ন কিছু।কংগ্রেস দু’বছরের ওপর ক্ষমতায় থাকল,এই দু’বছরের অভিজ্ঞতা মুসলমানদের এত তিক্ত করে তুলল যে তারা ধরে নিল ’রাম রাজত্ব’ চলে এসেছে।আর এদিকে জিন্না সক্ষম হন মুসলমান নেতৃবৃন্দকে এক করতে।দুর্ভাগ্য যে জিনিস স্যার সৈয়দ আহমেদ একশত বছর আগে বুঝেছিলেন সে জিনিস জিন্না বুঝলেন একশত বছর পর।আরো অবাক করা বিষয়-ইসলামের সংহতি একটা কঠোর বাস্তবতা,ওই দেওয়ালে মাথা ঠুকে লাভ নেই,ওটি ভাঙ্গা যাবে না,এই বিষয়টা বৃটিশরা এতো ভালভাবে অনুধাবন করেছে জিন্নাহর বুঝতে অনেক সময় লেগে গেল।ভারত মহাদেশের ইতিহাসে বারবার সেটা প্রমাণ করেছে, যেটা গাঁধীও খুব ভালভাবে বুঝেছিলেন।
১৯৪০ সালে এসে মুসলিমরা ইতিহাসের সঠিক গতিধারায় এসে উপস্থিত হল।১৯৪০ সালে ২৩ শে মার্চ মুসলিম লীগের মুক্ত অধিবেশনে ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইনে প্রস্তাবিত ফেডারেশন পরিকল্পনাটি অল ইন্ডিয়া মুসলিম প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করল।লিগ যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করল,তাতে দাবী জানানো হল পাঞ্জাব,সিন্ধু,উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বালুচিস্তানকে সম্পূর্ন স্বশাসন এবং সার্বভৌম ক্ষমতা দিতে হবে,একই ধরণের ক্ষমতা দিতে হবে পূর্বের সংশ্লিষ্ট প্রদেশগুলিকেও এবং এই প্রদেশগুলিকে নিয়ে একটি ফেডারেশন গঠন করতে হবে।ফজলুল হক প্রস্তাবটি উথাপন করলেন;জিন্না,খালেকুজ্জামানকে এই প্রস্তাব সমর্থন করতে বললেন।পরের দিন সকালে সমস্ত সংবাদপত্রের শিরোনামে বলা হল, ’পাকিস্থান’ প্রস্তাব পাশ হয়ে গেছে।অথচ কেউ বক্ততায় এই কথাটির ব্যবহার করেনি।প্রস্তাবের মূল বয়ানেও এটি ছিল না।সংবাদপত্রগুলো মুসলিম জনসাধারণকে একটি স্লোগান সরবরাহ করল,যেটির মধ্যে হাতে-গরমে একটির রাষ্ট্রের ধারণা ছিল।লাহোর প্রস্তাবটির যথার্থ ব্যাখ্যা জনসাধারণকে বুঝিয়ে বলতে হলে মুসলিম লিগের নেতাদের বিস্তর পরিশ্রম করতে হত।’পাকিস্থান প্রস্তাব’ এর ধারণাটি সেই কষ্ট বহুলাংশে বাঁচিয়ে দিল।নিয়তি আরও একটি লাইন টেনে দিল,যা ভবিষ্যতের জন্য জমা রইল।
এতদিন পযর্ন্ত যা ছিল সাম্প্রদায়িক সমস্যা,লাহোর প্রস্তাব সেটি সম্পূর্ণ বদলে দিল।এ পর্যন্ত যতগুলি প্রস্তাব বিবেচিত হয়েছিল স্বতন্ত্র নির্বাচকমন্ডলী,মিশ্র মন্ত্রিসভা,আসন সংরক্ষন,সমতা-সবই হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল।’পাকিস্থান প্রস্তাব’ উগ্র কংগ্রেসবাদীদের বুঝিয়ে দিল মুসলমান এই অঞ্চলে একটি বড় ফ্যাক্টর।
একটু আলোচনা করা দরকার মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে প্রথম পাকিস্থান শব্দটি ব্যবহার করেন ইংল্যান্ডে পাঠরত ভারতীয় মুসলিম চৌধুরী রহমত আলী।পরবর্তীতে কবি ইকবাল এই ধারণাকে আরো অনেক দূর নিয়ে যান।১৯৪০ এ এসে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সেটাকে গ্রহন করেন।
অতীতে স্পষ্টবাদী হিসাবে পরিচিত জিন্না এ পর্যায়ে এসে কিছুটা নোংরা রাজনীতি খেললেন।তিনি লাহোর প্রস্তাব অনুযারী পাকিস্থানের ধারণা না দিয়ে তিনি যে যেমন চাচ্ছিল যেমন কট্ররপন্থীদের বললেন এটি হবে ইসলামী রাষ্ট্র,ধর্মনিরপেক্ষবাদী বললেন এটি হবে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।ফলে সবাই উচ্ছাস প্রকাশ করল এবং কেউ কেউ অতীত মুসলিম শাসনের মহিমায় স্মৃতি কাতর হয়ে পড়লেন।যে জিন্না ছিলেন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের প্রচন্ড বিরুদ্ধে তিনি দেখলেন, এই এক কঠিন মক্ষম অস্ত্র।তিনি কতটুকু ইসলাম পালন করতেন তা নিয়ে না ভেবে তিনি মুসলিম নেতাদের আহবান জানালেন ,”গোষ্ঠিসস্বার্থ,ঈর্ষা,খন্ডজাতীয় মোহ এবং স্বার্থপরায়নতা বজর্ন করে ইসলাম এবং আপনাদের জাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠুন।” এভাবে তার একক চিন্তাভাবনাকে চাপিয়ে দেওয়ার ফলে পাঞ্জাবের খিজির হায়াত আলী থান এবং বাংলার ফজলুল হকের সাথে তার দুরত্ব সৃষ্টি হয় এবং তারা লীগের ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন।কিন্তু তাতে কি ততদিনে মুসলিম লীগ এক স্বপ্ন জাগানীয়া কাফেলায় পরিণত হয়।
যদিও সেখানে মূল নেতা ততদিনে স্বৈরমনোভাব সম্পন্ন হয়ে উঠেছেন।প্রস্তাব আনা হল,কিন্তু শেষ অবধি দেশভাগ মেনে নেওয়া হবে কিনা,তা নিয়ে জিন্না নিজেও তখন দোটানায়।আসলে তার এই পাকিস্থান প্রস্তাব ছিল রাজনীতির মাঠের রৌণকৌশলমাত্র।তার বেশি কিছু নয়,ছয় বছর পরে যেভাবে লাহৌর প্রস্তাবের সীমারেখা থেকে সরে এসে কাটাছেঁড়া পাকিস্থানকে মেনে নিলেন জিন্না,সেটাই প্রমাণ করে,দেশভাগ ছিল তাঁর কাছে শুধুই কংগ্রেসের সঙ্গে দরকষাকষির রাজনৈতিক খেলা।ফলে বাস্তবপক্ষে বাংলা এবং পাঞ্জাবকে হারাতে হয় তাদের অনেক ন্যায্য অংশ আর কাশ্মীরকে বন্ধী হতে হয় ভারতীয় শিকলে।অথচ লাহৌর প্রস্তাব মোতাবেক চললে এবং চলে যাওয়া মুসলিম নেতৃবৃন্দকে ধরে রাখলে হওতো অনেক মূল্যবান অংশ হারাতে হতো না।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আচ্ছন্ন জিন্না যেভাবে ভারতের জন্য করেছেন বলা যায় সেভাবে তিনি পাকিস্থানের জন্য হতে পারেননি বরং বলা যায় পাকিস্থান হয়ে পড়ে তার একমাত্র অবলম্বন এবং তিনি রাজনীতিকে নিয়ে গেছেন খেলার মাঠে।যেখান জয়টাই মুখ্য তা এক গোলের ব্যবধানে বা দুই গোলের ব্যবধানে হোক।দেশভাগের বাসনা থাকুক বা না থাকুক,পরবর্তী কয়েকবৎসর ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবে পাশা খেলা চলে,পাশার দান গড়াতে গড়াতে ছয়টি ঘটনা পেরিয়ে যায়;ক্রিপস মিশন(১৯৪২),ভারত ছাড়ো আন্দোলন(এপ্রিল-সেপ্টেম্বর১৯৪২),লর্ড ওয়াবেল ভাইসরয় হওয়া(জুন ১৯৪৩),সিমলা বৈঠক(সেপ্টেম্বর ১৯৪৪),দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি-ক্যবিনেট মিশন(জুলাই ১৯৪৬),অন্তবর্তী সরকার (জুলাই ১৯৪৬) দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষে ইংল্যান্ডের নির্বাচনী লেবার পার্টি ক্ষমতা আসে এবং মিঃ অ্যাটলি প্রধানমন্ত্রী হন।
লেবার পার্টি এবং মিঃ অ্যাটলি পূর্ব থেকে ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে খুবই ইতিবাচক ছিলেন।১৯৪৬ সালে ১৫ই মার্চ মিঃ অ্যাটলী হাউস অব কমন্স এ ভারতীয় পরিস্থিতির বিষয়ে একটি বিবৃতি দেন।ভারত-ব্রিটিশ সম্পর্কে ইতিহাসের এই বিবৃতিটি ছিল অভূতপূর্ব।মিঃ অ্যাটলি স্বীকার করেন ভারতের অর্থনৈতিক আর সামাজিক যেসব অন্তরায় আছে,একমাত্র ভারতীয়রাই তা নিরসন করতে পারে।তার পাঠানো মিশন ভারত বিভক্তির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে একটি প্রস্তাব দেয়।তাদের পরিকল্পনায় রাষ্ট্রটি হবে একটি য্ক্তুরাষ্ট্রীয় সরকার।যেখানে কেন্দ্রের হাতে থাকবে তিনটি বিষয় প্রতিরক্ষা,পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগ।তারা গোটা দেশকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে।(ক অঞ্চলে )থাকবে সংখ্যাগুরু হিন্দু অঞ্চলগুলো,বলা যায় পুরা মধ্যভারত,(খ অঞ্চলে) থাকবে পাঞ্জাব,সিন্দুপ্রদেশ,উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তান এবং( গ অংশে) থাকবে বাংলা আর আসাম।ক্যাবিনেট মিশন ভেবেছিল,এই ব্যবস্থায় মুসলিম সংখ্যাগুরুরা পুরোপুরি ভরসা লাভ করবে এবং লীগের যেসব ন্যায্য ভয়ভীতি তা দূর হবে।প্রস্তাবটি কংগ্রেস নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদের প্রস্তাবনার সাথে সামঞ্জস্য ছিল।গোড়ায় মিঃ জিন্না ঐ পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন।আসলে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে লীগ এতদূর অগ্রসর হয়েছিল যে সেখান থেকে পিছিয়ে আসা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ল। তারপরও মুসলিম লীগ কাউন্সিলের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত পৌঁছল এবং তারা বিবৃত দিল ক্যাবিনেট মিশনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন তার চেয়ে ন্যায্য সমাধান হয় না।যদিও মৌলানা সাহেব কিছুটা বাহবা নিয়েছেন,কিছু লোক মুসলিম লীগের আগের পাকিস্থান দাবীর সমালোচনা করেছে এবং কিছু মুসলিম হতাশও হয়েছে।কিন্তু মুসলীমরা প্রমাণ করেছে এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করেছে ভারতে স্বাধীনতার জন্য তারা কোনদিন অন্তরায় ছিলনা এবং এখনও নয়।মুসলিমদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের যে অভিযোগের ছিল যে তারা ইংরেজদের সাথে আতাত করে স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে তার পুরোপুরি মুন্ডোপাত করল।
একযোগে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় সম্মত হওয়া-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এ এক গৌরবময় ঘটনা।এতে সূচিত হল, ভারতীয় স্বাধীনতার মতন একটা সমস্যার সমাধান হল আপোসরফা আর বোঝাপড়ার প্রক্রিয়া, হিংসা আর লড়াইয়ের রাস্তায় নয়।এটাও মনে হল যে,শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বাধাবিঘ্নগুলো সবাই উতরে আসতে পেরেছে।সারা দেশে তখন একটা উল্লাসের ভাব জেগেছে এবং দেশের সমস্ত লোক তখন স্বাধীনতার দাবীতে এক হয়ে দাঁড়িয়েছে।সবাই আনন্দে নেচেছে কিন্তু দূর্ভাগ্য তা অচিরে মোহভঙ্গে পরিণত হয়েছে।
মুসলিম লীগ কাউন্সিল আগেই ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিও তা করেছিল।অবশ্য তখনও বাকি ছিল এ আই সি সি র অনুমোদন।সেখান থেকে অনুমোদন নিতে ব্যাপক বেগ পেতে হয়।কংগ্রেসে থাকা সোশালিষ্টরা এর পুরোবিরোধীতা করে।ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য বিশেষ করে মৌলানা সাহেবের ব্যাপক বক্ততার মাধ্যমে তা পাশ হয়।কংগ্রেস কখনও ভারত হিন্দু মহাসভা,কখনও সোশ্যালিষ্টদের মাধ্যমে তার ইচ্ছা পূরণে চেষ্টা করেছে।বেচারা মৌলানা কংগ্রেসের হয়ে এতো খাটুনি তাকে শুধু হতাশই করেছে।১০ জুলাই বোম্বাইতে কংগ্রেস তখনকার সভাপতি মিঃ নেহেরু এক সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন।তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন,কংগ্রেস আপাতত ক্যাবিনেট মিশন পাশ করলেও ভবিষ্যৎ গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্টার জোরে তা বদল ঘটাতে পারবে।
মিশনের সকল সফলতায় জল ঢেলে দিল মিঃ নেহেরু এবং বস্তুত পক্ষে এটাই ছিল তাদের নিয়ত।এই বক্তব্যের পর ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা আর কোন দাম থাকে? ২৭ শে জুলাই মিঃ জিন্না মুসলিম লীগের কাউন্সিল ডাকেন এবং কাউন্সিল যুক্তিসঙ্গত কারণে ক্যাবিনেট মিশন প্রত্যাখান করেন এবং ঘোষনা দেন পাকিস্থান অর্জনের জন্য লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রামে পথে যাবে।এরপরও যেসব ইতিহাসবিদ ভারত ভাঙ্গনের জন্য জিন্না এবং মুসলিমলীগকে দায়ী করে তারা আসলে ইতিহাস লেখেন না, উপন্যাস লেখেন।যেখানে যেভাবেই হোক মুসলিমদের ভিলেন বানানো উদ্দেশ্য থাকে।
জিন্না এসময় যে সমস্ত মুসলমানদের এক করতে সক্ষম হন তার প্রমাণ ১৯৪৫ সালের আইনসভার নির্বাচন।এসময় মুসলীম লীগ সব মুসলিম আসনে নব্বই শতাংশের ওপর ভোট পেয়ে জয়ী হয়।কংগ্রেস ভাল করলেও ৬২টি আসনের মধ্যে ৫৭টিতে জয়ী হয়।এর পর প্রাদেশিক নির্বাচনেও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বাদে প্রতিটি প্রদেশই সফল হয়।কিন্তু আবারও মুসলিমদের সাথে ঠাট্রা আর উপহাস করা হল।বাংলা আর সিন্দু প্রদেশ ছাড়া আর কোথাও মুসলমানদের কে সরকার গঠনের আহবান করা হল না।এমনকি পাঞ্জাবে বেশ কিছু মুসলিম প্রার্থীকে কংগ্রেসের সাথে নিয়ে তাদের সরকার গঠন করতে বলা হল।এ ঘটনাগুলো মুসলিমদের যেমন হতাশ করেছে তথাপি তাদের আদর্শিক মুসলমানের সংখ্যা কম থাকলে বংশীয় মুসলিম জাতীয়তাবোধ এসময় প্রবল হয়ে উঠল।কেন্দ্রে কংগ্রেসের সরকার গঠিত হল।হিন্দু আর মুসলিমরা এই সময় পুরোপুরি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত।ফলে জায়গা জায়গা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে চলল।এসব ঘটনা কংগ্রেস সরকার পুরো নির্বিকার ছিল।দাঙ্গার ঘটনায় দৃশ্যত গাঁধী মন্তব্য করলেন, ”যদিও কংগ্রেসের নিচুতলার মুসলমান,শিখ,খ্রিষ্টান বা অন্য সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ আছে এবং কংগ্রেস সেই কথাটি বড় গলায় উল্লেখও করে, তবু কায়দে আজম জিন্না কংগ্রেসকে যে হিন্দুদের দল বলে উল্লেখ করেন,এই দাঙ্গাগুলি তাঁর সেই বক্তব্যকেই যথার্থতা দিল।” এমন পরিস্থিতিতে ভারতের তখন ভাইসরয় মিঃ ওয়াবেল এবং ক্যাবিনেট মিশন অন্তবর্তী সরকারের গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন।এর আগে বার বার অন্তবর্তী সরকারের কথা জিন্না বললেও তা প্রত্যাখাত হয়।তাই জিন্না এবার অন্তবর্তী সরকারের সমতার দাবী করে বসলেন।ক্যাবিনেট মিশন জিন্নাকে সরাসরি জানিয়ে দেন আপনি যদি অখন্ড ভারত চান তাহলে সমতার নীতি বাদ দেন।আর যদি ভারত ভাগ করতে চান তাহলে ’কাঁটছাট করা’ পাকিস্থান মেনে নিতে হবে।
পঞ্চম কিস্তিঃ
নেহেরু চিন্তাভাবনা অনেকটা লেলিন,মুসোলিনের মতো ছিল। অথচ এই দাম্ভিক উচ্চাবিলাসী লোকটি বুঝতে ছিলনা নাকি বুঝেও না বুঝার ভান করে ছিলেন, দেশ তখনও স্বাধীন হয়ে যায় নি। বৃটিশরা নিজেদের উপর চাপ কমানোর জন্য ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাস দিচ্ছিল। তাছাড়া হিন্দু-মুসলিম অবিশ্বাস তখন চরম পর্যায়ে। এসময় ১৯২৯ সালে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে স্বাধীনতার লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং মার্চ মাস থেকে দেশ জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করলেন।জিন্না ভয় পেলেন এবং সংগত কারণেই ভয় পেলেন, আন্দোলনের এই রাস্তা স্বাধীনতার সকল পথকেই রুদ্ধ করে দিবে। জিন্না এসময় পিতা-পুত্র অর্থাৎ মতিলাল-জওহরলাল দুইজনকে একসাথ করে গান্ধীর কাছে আনলেন,দু’জনে তখন জেলে বন্দী। জিন্না চেষ্টা করতেছিলেন কংগ্রেসের সাথে সরকারের এক বোঝাপোড়া হয়ে যাক।কিন্তু বৈঠক ব্যর্থ হয়।
১৯৩০ সালে জিন্না লন্ডনে যান এবং রাজা পঞ্চম জর্জের একটায় সভায় অংশগ্রহণ করেন।সেখানে আবারো ঈঙ্গিত পাওয়া যায়, হিন্দু মুসলিম ঐক্যমত্য পৌছলে সাংবিধানিক সংস্কারের লক্ষ্যে তারা একটি প্রস্তাব দিতে পারে।পরে লন্ডনে অবস্থানরত হিন্দু মুসলিম নেতৃবৃন্দ একটি বৈঠকে বসলেন।হিন্দুদের পক্ষকে থেকে একজন আগা খাঁ কে জিজ্ঞাসা করলেন মুসলিমদের অন্যসকল বিষয় মেনে নিলে তারা কি পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর দাবী ছেড়ে দিবেন? তিনি বললেন,”যদি আপনারা আমাদের দাবীগুলো মেনে নেন,তা হলে আমাদেরও যৌথ নিবার্চকমন্ডলীতে আপত্তি নেই,তবে মুসলিমদের জন্য আসন সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করতে হবে।” আবার জিজ্ঞাসা করা হল,যদি যৌথ নিবার্চকমন্ডলী সমেত অন্য নানা বিষয়ে একটা সমঝোতায় আসা যায়,তা হলে কি মুসলিমরা বৈঠকে জাতীয়তাবাদের দাবী সমর্থন করবে? ওর জবাবটি ছিল স্বভাব সিদ্ধ এবং সংক্ষিপ্ত: ”সে ক্ষেত্রে আপনারা সামনে থাকবেন,আর আমরা আপনাদের অনুসরণ করব”।সপ্রু ও শাস্ত্রী আপত্তি করেনি কিন্তু বাধ সাধলেন জয়াকর এবং মুণ্ডে।স্যর চিমলাম লিখেছেন,’এইভাবে একটি সোনার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল।’
আমি আগেই বলেছি জাতীয়তা ভিন্ন হলেও রাজনৈতিক চুক্তির আলোকে রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে।কিন্তু কংগ্রেস প্রকৃত পস্তাবে মুসলমানদের কোন ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিলনা।প্রকারান্তে তারা মুসলিমদের জাতীয়তাকে অস্বীকার করল।মুসলিমরা অনেকদিক দিয়ে সংশয়ে ছিলেন,তারপরও তারা বারবার হচট খেয়েছেন কংগ্রেসের হিন্দুত্ববাদীতার কাছে।মুসলিমরা চাইছিলেনলন ভারত হোক ফেডারেশন রাষ্ট্র।আবার এই ফেডারেশন রাষ্ট্রে প্রায় ষাট এর মত রাজন্যবর্গ ছিল যার অধিকাংশ ছিল হিন্দু।দেশীয় রাজারাও যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচের সরকারের ক্ষেত্রে একধরণের আংশিক সম্মতি দিয়েছে।যদিও সকল সম্ভাবনাকে শেষ পযর্ন্ত কংগ্রেসই জল ঢেলে দিয়েছিল।এভাবে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষন করে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পক্ষে সংগ্রাম করতে করতে জিন্নাহ অনেকটা একা হয়ে পড়েন।ম্যাঞ্চেষ্টার গার্ডিয়ান এর পর্যবেক্ষন তা ধরাও পড়েছিল স্পষ্ট: ”গোল টেবিলে বৈঠকে মিস্টার জিন্নার অবস্থানটি ছিল বিচিত্র।হিন্দুরা ভাবতেন যে তিনি সাম্প্রদায়িক মুসলিম,মুসলিমরা তাঁকে হিন্দুপন্থী ভাবতেন,দেশীয় রাজারা ভাবতেন তিনি বড় বেশি গণতান্ত্রিক,ব্রিটিশ মতে তিনি আবার ঘোর চরমপন্থী,ফলে তিনি সর্বত্রই আছেন,আবার কোথাও নেই।কেউ তাঁকে চায় না।”
বহুকাল পরে,লাহোরে ১৯৩৬ এর ২ মার্চ একটি জনসভায় বক্ততা দিয়েছিলেন জিন্না,তাতে এই বৈঠকের কথা ফিরে দেখেছেন তিনি: ”আমি মুসলিমদের চটিয়েছিলাম।হিন্দু বন্ধুরাও ’বিখ্যাত চৌদ্দ দফার’ ফলে খুশি হয়নি।রাজন্যবর্গের লুকানো,অসৎ ক্রিয়াকলাপের প্রবল বিরোধিতা করেছিলাম,ফলে তাঁরাও খেপে গিয়েছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট আমার উপর খুশি হয়নি,কারণ আমি শুরু থেকেই জানতাম ও বলেওছিলাম যে, ওরা আদ্যন্ত ধাপ্পাবাজ,ফলের এদের বিরুদ্ধে আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলাম। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেখলাম যে,আমার চারপাশে কোন বন্ধু নেই।”
বৈঠক যেভাবে শেষ হোক ৫ ই মার্চ ১৯৩১ সালে লর্ড আরউইন এর মধ্যে একটি চুক্তি সম্পাদিত হল।যার উদ্দেশ্য ছিল সংবিধান রচনায় যাতে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করে।আর বরাবরই মুসলিমরা যখনই কোন ছাড় দিয়েছে তখনই কংগ্রেস সেটাকে ছাড় হিসাবে না নিয়ে কিভাবে তাদের অন্তরে গহীনে লুকায়িত এক অপ্রতিরোধ্য ’রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার’ (যা শুধু কল্পনামাত্র.যার কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি আজ পর্যন্ত কেউ পায়নি) কাজকে আরো অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তার পরিকল্পনায় নেমে পড়ে।যদিও কংগ্রেস তাদের হিন্দুদের নয় বরং সমগ্র ভারতে প্রতিনিধি হিসাবে বারবার দাবি করে আসছিল।এমনকি মৌলানা আজাদ দীর্ঘদিন কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিল।ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসের এই মহান ব্যাক্তি ভারতের মধ্যে মুসলিমদের স্বার্থ দেখেছেন এবং দেখেছেন সাম্প্রদায়িকতা এড়ানোর জন্য এটাই একমাত্র পথ।তিনি তার নিজের বই ’ভারত স্বাধীন হল’ বইটিতে বারবার দেখিয়েছেন কিভাবে পরীক্ষার সময় এলেই কংগ্রেস কিভাবে সকল গোষ্ঠির প্রতিনিধি এটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হত।আর্শ্চযজনক হলেও সত্য কংগ্রেস নেতা বল্লব ভাই প্যাটেলের সাম্প্রদায়িক কর্মকান্ড এবং পরবর্তীতে স্বাধীন ভারতে বল্লব ভাই প্যাটেল মুসলিম জনসাধারণকে পাকিস্থানের বিরুদ্ধে হিন্দুদের জন্য বন্ধী জিম্মি হিসাবে নিয়েছিলেন,তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।।স্বাধীন ভারতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে মুসলিম হত্যাযজ্ঞে তার পরোক্ষ সহযোগিতা এবং শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাড়ানোর জন্য গাঁন্ধীকে হত্যা তার পরোক্ষ ভূমিকা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।মৌলানা যে নেহেরুকে অন্ততঃ তার চিন্তার সাথে সামঞ্জস্য ভেবেছিলে, সে নেহেরু কিভাবে মুসলিমদের জাতীয়তাকে অস্বীকার করলেন, তা তুলে ধরলেন।এতকিছুর পরেও তিনি কংগ্রেসের সাথে থেকে গেলেন এবং কংগ্রেসের কাগজে লেখা কথাগুলোকেই কংগ্রেস মনে করতেন।
যাহোক এতকিছুর পরও একমাত্র গাঁধী ছিলেন ভরসা,জিন্নাহ তাই মনে করতেন।আর যখনই গাঁধীর জায়গায় অন্য কংগ্রেস নেতারা এসে বসলেন তখন আবারও পরিস্থিতি পাল্টে গেল।আবারও সংবিধান রচনা ব্যর্থ হল এবং স্বরাজ,ডোমিয়ন স্টেট সবকিছুই আবার থমকে গেল।ইতিমধ্যে আর্ন্তজাতিক পরিস্থিতি হঠাৎই টালমাটাল হয়ে পড়ল।বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার প্রভাবে বিশ্বের বৃহত্তম দু’টি অর্থনীতি মাকির্ন এবং ব্রিটিস অর্থনীতি বেসামাল হয়ে পড়ল।বেকারত্ব ভয়াবহ আকার নিল।১৯৩১ সালে ২৪ আগষ্ট ব্রিটেনে ম্যাকডোনাল্ড এর জোটই ক্ষমতায় এল,তবে নতুন সরকারের মুখ্যভূমিকা থাকল রক্ষণশীল গোষ্ঠী এবং তাদের ভারতীয় দাবিদাওয়ার পক্ষে কোন সহানুভূতিই ছিলনা।১৯৩৫ এর জুন মাসে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত সেই সরকারই বহাল থাকল।আর্থিক মন্দার গ্রাস থেকে বেরোতেই না বেরোতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামাকা বেজে উঠল।১৯৩৯ এর সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া সেই যুদ্ধ থেকেই ’এন্ডগেম’ শুরু হল বলা চলে,যার পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ এ দেশভাগ এবং স্বাধীনতা।
এরকম পরিস্থিতিতে হিন্দুমুসলিম অনৈক্যের কারণে দ্বিতীয় গোলটেবিলে বৈঠক শুধু সময় ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই হল না।কংগ্রেস নিজেদের পুরো জাতির প্রতিনিধি দাবি করলেও তাদের আচরণে কখনও সেটা প্রকাশ পায়নি।এজন্য মুসলিম নেতৃবৃন্দ বরাবরই গাঁন্ধীজীর দিকে তাকিয়ে ছিলেন।কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিষয়ে শেষ পর্যন্ত তিনিও তার অপরাগতার কথা প্রকাশ করলে মুসলমান নেতৃবৃন্দ পরোপুরি হতাশ হয়।তাই ফেডারেশন রাষ্ট্র এবং তার কর্মপরিধি নিয়ে মুসলিমরা আরও দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করলেন।এবং এই ব্যাপারে জিন্না মোটামুটি সকল মুসলিম নেতৃবৃন্দকে এক করতে সক্ষম হয়।এর বিপরীতে পন্ডিত মালব্য এবং হিন্দু মহাসভা প্রবলভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে গেল এবং এমন সব বিমূর্ত রাজনৈতিক তত্ত¡ আর নীতি আউড়ে চাপ তৈরি করল-যার সঙ্গে ভারতের বাস্তবতার কোন মিল নেই-যা ১৯৪৭ এর দেশভাগ দেখিয়ে দিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে ইংরেজরা অনেক কোনঠাসা হয়ে পড়ে।এমনকি এশিয়া তাদের অধিনস্ত অনেক সাম্রাজ্য তখন জাপানের অধীনে।এরকম পরিস্থিতি ভারতীয়দের সহযোগিতার আশায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডেন্ট রুজডেল্ট বারবার বৃটেনকে তাড়া দিতে থাকে ভারতের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।যদিও চার্চিল মনে প্রাণে চাচ্ছিলেন না তথাপি মার্কিন চাপে তিনি ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ভারতে একটি মিশন পাঠাতে বাধ্য হন।তাদের এই এগিয়ে আসাকে কংগ্রেস আবারো তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার বানায়।যদিও এব্যাপারে জিন্না এবং মুসলিমলীগ ছিল চুপচাপ।কংগ্রেস এটাকে আবার জিন্না এবং মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে।যদিও কংগ্রেসের রাজনৈতিক গুটি তাদের জন্য বুমেরাং হয় এবং মিশন ব্যর্থ হয়ে ইংল্যান্ডে ফেরত যায়।কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের হিন্দু নেতৃবৃন্দের কার্যক্রমের ফিরিস্থি যদি তুলে ধরা হয় তবে তাদেরকে বিশ্বের বুকে অন্যতম সাম্প্রদায়িক গোষ্টি হিসাবে চিহিৃত করা যায়।
নেহেরু জিন্নাকে মোটেই সহ্য করতে পারতেন না এবং মুসলিমদের স্বার্থের ব্যাপারে তিনি মোটেই সহানুভূতিশীল ছিলেন,তা গাঁধী সাথে তার দীর্ঘ পত্রালাপে বুঝা যায়।তিনি জিন্নার দাবীসমূহকে হাস্যকর,উদ্ভট ইত্যাদি বলে সবসময় উড়িয়ে দিয়েছেন।
তাদের কর্মকান্ডে ব্যথিত জিন্না ১৯৩৮ এ আলিগড় অ্যাংলো মুসলিম কলেজ বক্ততায় বেদনা উপুড় করে দিয়ে বলেছেন,”হিন্দু আবেগ,হিন্দু মন,হিন্দুদের মনোভাব থেকে আমি সিদ্ধান্তে এলাম,ঐক্যের কোন আশাই নেই”।পার্সিভ্যাল স্পিয়ার তাঁর নিবন্ধ ’জিন্না দ্য ক্রিয়েটর অব পাকিস্থান ’এ বলেছেন যে,”বোলিথোকে তাঁর লেখা পত্রে জানিয়েছেন যে,বিশের দশকে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের পক্ষে দাঁড়িয়ে জিন্না আপাতত তাঁর রাজনৈতিক ক্যরিয়ারের বিপুল ক্ষতি করেছেন।১৯৩৩ এ তাঁর দেশে ফেরার সঙ্গেও এই ঐক্যভাবনার একটা যোগসূত্র ছিল,সঙ্গে একটি ক্ষীণ আশাও থেকে গিয়েছিল।এই কারণে তিনি ইকবাল কথিত বিচ্ছিন্নতার যুক্তিকে ঠেকিয়ে রেখেছিল।শেষে কংগ্রেস যখন স্পষ্ট বুঝিয়ে দিল যে লীগ এর সঙ্গে কোন সহযোগিতা চলতে পারেনা,স্রেফ একটা অধীনতার সম্পর্ক বা একধরণের অধিগ্রহণের সম্পর্কই চলতে পারে,তখন জিন্না হাল ছেড়ে দিলেন” ।শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস এর সৈ্বরতান্ত্রিক মনোভাবই কিন্তু জিন্নাকে ”সাম্প্রদায়িক”করে তুলল,”জিন্নার আহত আত্মভিমান নয় বরং কংগ্রেসের অতি দর্পের জন্যেই তাঁর মনোভাবে এমন বিপুল পরিবর্তন এল।”
ইংরেজ পর্বে মুসলমানদের জন্য প্রথম কার্যকর আন্দোলন দাঁড় করান স্যার সৈয়দ আহমদ খান।(এর আগে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত পুরো ভারতে মুসলিমরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে শতশত আন্দোলন করেন,এসব আন্দোলনে বেশিরভাগই নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন আলেমগণ।নবাব মীর কাশিম,হায়দার আলী,তার পুত্র টিপু সুলতান,সৈয়দ নিসার আলী ওরপে তীতুমীর,মাওলানা শরিয়তুল্লাহ,তার পুত্র মাওলানা আলাউদ্দিন ওরপে দুদু মিয়া,তার পুত্র গিয়াস উদ্দিন ওরপে নোয়ামিঞা,শহীদ আহমেদ ব্রেলভী,শহীদ ইসমাইল শহীদ সহ লাক্ষো বীর মুজাহিদগণ।আরো অনেক মুসলিম মুজাহিদগণ আন্দোলন করে ফাঁশির কাষ্টে ঝুলেছেন। দুর্ভাগ্য ইহিাসে তাদের নামটা পর্যন্ত মুছে ফেলা হয়েছে।এসব আন্দোলনে যদিও মুসলিমদের হাতে গোড়াপত্তন হয়েছে, তথাপি আন্দোলনগুলোকে রাখা হয়েছে ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে। যার কারণে হাজার হাজার হিন্দু দলিত সম্প্রদায় এগুলোতে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন জীবন দিয়ে।তবে হিন্দু রাজন্যবর্গ,জমিদারশ্রেণি এবং তাদের শিক্ষিত সমাজ এসব আন্দোললের কট্টর বিরোধীতা করেই ক্ষান্ত হননি বরং ইংরেজদের আর্থিক সাহায্যসহকারে বিভিন্ন সহযোগিতা দিয়েছেন। অনেকে আন্দোলনরতদের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে উল্টো বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।তারা ইংরেজদের অধিনতাকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ছিলেন। এদের মধ্যেও ব্যতিক্রম ছিলেন,ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাই,তাঁতিয়ার তোপী। তারাও স্বাধীরতার জন্য লড়েছেন জীবন দিয়ে। তবে এই আন্দোলনগুলো ব্যর্থ হওয়ার আরেকটা কারণ ছিল এগুলো কোনটাই সর্বভারতীয় আকার দিতে না পারা, ফলে ইংরেজেদের আধুনিক রণসজ্জার কাছে এগুলো ছিল খুবই দুর্বল।১৮৫৭ সালে আন্দোলন এই আন্দোলগুলোর ফল বলা যায়। বিশ্বাসঘাতকতা আর রণকৌশলের দুর্বলতা ঐ আন্দোলন ব্যর্থ হলে মুসলিমরা নতুন করে ভাবতে শুরু করে।তার ফলাফল আলীগড় আন্দোলন।)
তবে এই আন্দোলন ছিল মুসলমানদের শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক উন্নতির উদ্দেশ্যে পরিচালিত আন্দোলন।সে ক্ষেত্রে তিনি বহুলাংশে সফল হন।তিনি মুসলমানদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন নিজেদের উন্নয়ন নিজেদেরই ঘটাতে হবে।১৯৩৭ সাল পরবর্তীতে শুরু হয় সে ফ্ল্যাটফর্মে মুসলমানদের রাজনৈতিক আন্দোলন।১৯৩৭ সালের আগ পর্যন্ত তাদের মধ্যে বস্তুত কোন ঐক্যেই ছিল।প্রাদেশিক পর্যায়ের নেতারা কেউ কাউকে মানতে রাজি ছিল না।যার ফলে ১৯৩৭ সালে নির্বাচনে মুসলিম লীগ মুসলিম ভোটের মাত্র ৫.৮ শতাংশ পেল।তবে এই নির্বাচন মুসলিম লীগের জন্য অনেক কিছুই ইংগিত দেয়।
১৪৪ টি হিন্দু আসনের মধ্যে কংগ্রেস ১৩৪ টি পায়।অন্যদিকে কংগ্রেসের টিকিট নিয়ে যেসব মুসলিমরা প্রার্থী হয় তারা সবাই পরাজিত হয়।অন্যদিকে মুসলিম টিকিটে ৩৬ জন দাঁড়িয়ে ২৯ জন জয়ী হন।নিবাচর্নে এই জয় নেহেরুকে ব্যাপক উগ্র করে তোলেন আর জিন্না দেখেছিলেন ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা।নির্বাচনে পরবর্তী এক বক্ততায় নেহেরু বলেন ”ভারতে এখন কেবল দুটি শক্তি আছে; ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর ভারতীয় জাতীয়তাবাদ,কংগ্রেস যার প্রতিনিধি” ।জিন্না অবিলম্ভে এর জবাব দেন; না,একটি তৃতীয় পক্ষ আছে-মুসলমান, ”ইতিহাস প্রমাণ করেছে,তিনি ঠিক কথা বলেছেন।” ইতিহাস সাক্ষী,কংগ্রেস যা চেয়েছেন তার বাস্তবায়নের প্রজ্ঞা বা মন কোনটাই ঈশ্বর তাদের দেননি।কারণ তিনি চিন্তা করেছেন ভিন্ন কিছু।কংগ্রেস দু’বছরের ওপর ক্ষমতায় থাকল,এই দু’বছরের অভিজ্ঞতা মুসলমানদের এত তিক্ত করে তুলল যে তারা ধরে নিল ’রাম রাজত্ব’ চলে এসেছে।আর এদিকে জিন্না সক্ষম হন মুসলমান নেতৃবৃন্দকে এক করতে।দুর্ভাগ্য যে জিনিস স্যার সৈয়দ আহমেদ একশত বছর আগে বুঝেছিলেন সে জিনিস জিন্না বুঝলেন একশত বছর পর।আরো অবাক করা বিষয়-ইসলামের সংহতি একটা কঠোর বাস্তবতা,ওই দেওয়ালে মাথা ঠুকে লাভ নেই,ওটি ভাঙ্গা যাবে না,এই বিষয়টা বৃটিশরা এতো ভালভাবে অনুধাবন করেছে জিন্নাহর বুঝতে অনেক সময় লেগে গেল।ভারত মহাদেশের ইতিহাসে বারবার সেটা প্রমাণ করেছে, যেটা গাঁধীও খুব ভালভাবে বুঝেছিলেন।
১৯৪০ সালে এসে মুসলিমরা ইতিহাসের সঠিক গতিধারায় এসে উপস্থিত হল।১৯৪০ সালে ২৩ শে মার্চ মুসলিম লীগের মুক্ত অধিবেশনে ১৯৩৫ এর ভারত শাসন আইনে প্রস্তাবিত ফেডারেশন পরিকল্পনাটি অল ইন্ডিয়া মুসলিম প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করল।লিগ যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করল,তাতে দাবী জানানো হল পাঞ্জাব,সিন্ধু,উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বালুচিস্তানকে সম্পূর্ন স্বশাসন এবং সার্বভৌম ক্ষমতা দিতে হবে,একই ধরণের ক্ষমতা দিতে হবে পূর্বের সংশ্লিষ্ট প্রদেশগুলিকেও এবং এই প্রদেশগুলিকে নিয়ে একটি ফেডারেশন গঠন করতে হবে।ফজলুল হক প্রস্তাবটি উথাপন করলেন;জিন্না,খালেকুজ্জামানকে এই প্রস্তাব সমর্থন করতে বললেন।পরের দিন সকালে সমস্ত সংবাদপত্রের শিরোনামে বলা হল, ’পাকিস্থান’ প্রস্তাব পাশ হয়ে গেছে।অথচ কেউ বক্ততায় এই কথাটির ব্যবহার করেনি।প্রস্তাবের মূল বয়ানেও এটি ছিল না।সংবাদপত্রগুলো মুসলিম জনসাধারণকে একটি স্লোগান সরবরাহ করল,যেটির মধ্যে হাতে-গরমে একটির রাষ্ট্রের ধারণা ছিল।লাহোর প্রস্তাবটির যথার্থ ব্যাখ্যা জনসাধারণকে বুঝিয়ে বলতে হলে মুসলিম লিগের নেতাদের বিস্তর পরিশ্রম করতে হত।’পাকিস্থান প্রস্তাব’ এর ধারণাটি সেই কষ্ট বহুলাংশে বাঁচিয়ে দিল।নিয়তি আরও একটি লাইন টেনে দিল,যা ভবিষ্যতের জন্য জমা রইল।
এতদিন পযর্ন্ত যা ছিল সাম্প্রদায়িক সমস্যা,লাহোর প্রস্তাব সেটি সম্পূর্ণ বদলে দিল।এ পর্যন্ত যতগুলি প্রস্তাব বিবেচিত হয়েছিল স্বতন্ত্র নির্বাচকমন্ডলী,মিশ্র মন্ত্রিসভা,আসন সংরক্ষন,সমতা-সবই হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল।’পাকিস্থান প্রস্তাব’ উগ্র কংগ্রেসবাদীদের বুঝিয়ে দিল মুসলমান এই অঞ্চলে একটি বড় ফ্যাক্টর।
একটু আলোচনা করা দরকার মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে প্রথম পাকিস্থান শব্দটি ব্যবহার করেন ইংল্যান্ডে পাঠরত ভারতীয় মুসলিম চৌধুরী রহমত আলী।পরবর্তীতে কবি ইকবাল এই ধারণাকে আরো অনেক দূর নিয়ে যান।১৯৪০ এ এসে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সেটাকে গ্রহন করেন।
অতীতে স্পষ্টবাদী হিসাবে পরিচিত জিন্না এ পর্যায়ে এসে কিছুটা নোংরা রাজনীতি খেললেন।তিনি লাহোর প্রস্তাব অনুযারী পাকিস্থানের ধারণা না দিয়ে তিনি যে যেমন চাচ্ছিল যেমন কট্ররপন্থীদের বললেন এটি হবে ইসলামী রাষ্ট্র,ধর্মনিরপেক্ষবাদী বললেন এটি হবে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।ফলে সবাই উচ্ছাস প্রকাশ করল এবং কেউ কেউ অতীত মুসলিম শাসনের মহিমায় স্মৃতি কাতর হয়ে পড়লেন।যে জিন্না ছিলেন রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের প্রচন্ড বিরুদ্ধে তিনি দেখলেন, এই এক কঠিন মক্ষম অস্ত্র।তিনি কতটুকু ইসলাম পালন করতেন তা নিয়ে না ভেবে তিনি মুসলিম নেতাদের আহবান জানালেন ,”গোষ্ঠিসস্বার্থ,ঈর্ষা,খন্ডজাতীয় মোহ এবং স্বার্থপরায়নতা বজর্ন করে ইসলাম এবং আপনাদের জাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠুন।” এভাবে তার একক চিন্তাভাবনাকে চাপিয়ে দেওয়ার ফলে পাঞ্জাবের খিজির হায়াত আলী থান এবং বাংলার ফজলুল হকের সাথে তার দুরত্ব সৃষ্টি হয় এবং তারা লীগের ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন।কিন্তু তাতে কি ততদিনে মুসলিম লীগ এক স্বপ্ন জাগানীয়া কাফেলায় পরিণত হয়।
যদিও সেখানে মূল নেতা ততদিনে স্বৈরমনোভাব সম্পন্ন হয়ে উঠেছেন।প্রস্তাব আনা হল,কিন্তু শেষ অবধি দেশভাগ মেনে নেওয়া হবে কিনা,তা নিয়ে জিন্না নিজেও তখন দোটানায়।আসলে তার এই পাকিস্থান প্রস্তাব ছিল রাজনীতির মাঠের রৌণকৌশলমাত্র।তার বেশি কিছু নয়,ছয় বছর পরে যেভাবে লাহৌর প্রস্তাবের সীমারেখা থেকে সরে এসে কাটাছেঁড়া পাকিস্থানকে মেনে নিলেন জিন্না,সেটাই প্রমাণ করে,দেশভাগ ছিল তাঁর কাছে শুধুই কংগ্রেসের সঙ্গে দরকষাকষির রাজনৈতিক খেলা।ফলে বাস্তবপক্ষে বাংলা এবং পাঞ্জাবকে হারাতে হয় তাদের অনেক ন্যায্য অংশ আর কাশ্মীরকে বন্ধী হতে হয় ভারতীয় শিকলে।অথচ লাহৌর প্রস্তাব মোতাবেক চললে এবং চলে যাওয়া মুসলিম নেতৃবৃন্দকে ধরে রাখলে হওতো অনেক মূল্যবান অংশ হারাতে হতো না।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আচ্ছন্ন জিন্না যেভাবে ভারতের জন্য করেছেন বলা যায় সেভাবে তিনি পাকিস্থানের জন্য হতে পারেননি বরং বলা যায় পাকিস্থান হয়ে পড়ে তার একমাত্র অবলম্বন এবং তিনি রাজনীতিকে নিয়ে গেছেন খেলার মাঠে।যেখান জয়টাই মুখ্য তা এক গোলের ব্যবধানে বা দুই গোলের ব্যবধানে হোক।দেশভাগের বাসনা থাকুক বা না থাকুক,পরবর্তী কয়েকবৎসর ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবে পাশা খেলা চলে,পাশার দান গড়াতে গড়াতে ছয়টি ঘটনা পেরিয়ে যায়;ক্রিপস মিশন(১৯৪২),ভারত ছাড়ো আন্দোলন(এপ্রিল-সেপ্টেম্বর১৯৪২),লর্ড ওয়াবেল ভাইসরয় হওয়া(জুন ১৯৪৩),সিমলা বৈঠক(সেপ্টেম্বর ১৯৪৪),দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তি-ক্যবিনেট মিশন(জুলাই ১৯৪৬),অন্তবর্তী সরকার (জুলাই ১৯৪৬) দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষে ইংল্যান্ডের নির্বাচনী লেবার পার্টি ক্ষমতা আসে এবং মিঃ অ্যাটলি প্রধানমন্ত্রী হন।
লেবার পার্টি এবং মিঃ অ্যাটলি পূর্ব থেকে ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে খুবই ইতিবাচক ছিলেন।১৯৪৬ সালে ১৫ই মার্চ মিঃ অ্যাটলী হাউস অব কমন্স এ ভারতীয় পরিস্থিতির বিষয়ে একটি বিবৃতি দেন।ভারত-ব্রিটিশ সম্পর্কে ইতিহাসের এই বিবৃতিটি ছিল অভূতপূর্ব।মিঃ অ্যাটলি স্বীকার করেন ভারতের অর্থনৈতিক আর সামাজিক যেসব অন্তরায় আছে,একমাত্র ভারতীয়রাই তা নিরসন করতে পারে।তার পাঠানো মিশন ভারত বিভক্তির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে একটি প্রস্তাব দেয়।তাদের পরিকল্পনায় রাষ্ট্রটি হবে একটি য্ক্তুরাষ্ট্রীয় সরকার।যেখানে কেন্দ্রের হাতে থাকবে তিনটি বিষয় প্রতিরক্ষা,পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগ।তারা গোটা দেশকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে।(ক অঞ্চলে )থাকবে সংখ্যাগুরু হিন্দু অঞ্চলগুলো,বলা যায় পুরা মধ্যভারত,(খ অঞ্চলে) থাকবে পাঞ্জাব,সিন্দুপ্রদেশ,উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তান এবং( গ অংশে) থাকবে বাংলা আর আসাম।ক্যাবিনেট মিশন ভেবেছিল,এই ব্যবস্থায় মুসলিম সংখ্যাগুরুরা পুরোপুরি ভরসা লাভ করবে এবং লীগের যেসব ন্যায্য ভয়ভীতি তা দূর হবে।প্রস্তাবটি কংগ্রেস নেতা মৌলানা আবুল কালাম আজাদের প্রস্তাবনার সাথে সামঞ্জস্য ছিল।গোড়ায় মিঃ জিন্না ঐ পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিলেন।আসলে স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি নিয়ে লীগ এতদূর অগ্রসর হয়েছিল যে সেখান থেকে পিছিয়ে আসা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ল। তারপরও মুসলিম লীগ কাউন্সিলের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত পৌঁছল এবং তারা বিবৃত দিল ক্যাবিনেট মিশনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন তার চেয়ে ন্যায্য সমাধান হয় না।যদিও মৌলানা সাহেব কিছুটা বাহবা নিয়েছেন,কিছু লোক মুসলিম লীগের আগের পাকিস্থান দাবীর সমালোচনা করেছে এবং কিছু মুসলিম হতাশও হয়েছে।কিন্তু মুসলীমরা প্রমাণ করেছে এবং দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণ করেছে ভারতে স্বাধীনতার জন্য তারা কোনদিন অন্তরায় ছিলনা এবং এখনও নয়।মুসলিমদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের যে অভিযোগের ছিল যে তারা ইংরেজদের সাথে আতাত করে স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে তার পুরোপুরি মুন্ডোপাত করল।
একযোগে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনায় সম্মত হওয়া-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এ এক গৌরবময় ঘটনা।এতে সূচিত হল, ভারতীয় স্বাধীনতার মতন একটা সমস্যার সমাধান হল আপোসরফা আর বোঝাপড়ার প্রক্রিয়া, হিংসা আর লড়াইয়ের রাস্তায় নয়।এটাও মনে হল যে,শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বাধাবিঘ্নগুলো সবাই উতরে আসতে পেরেছে।সারা দেশে তখন একটা উল্লাসের ভাব জেগেছে এবং দেশের সমস্ত লোক তখন স্বাধীনতার দাবীতে এক হয়ে দাঁড়িয়েছে।সবাই আনন্দে নেচেছে কিন্তু দূর্ভাগ্য তা অচিরে মোহভঙ্গে পরিণত হয়েছে।
মুসলিম লীগ কাউন্সিল আগেই ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল।কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিও তা করেছিল।অবশ্য তখনও বাকি ছিল এ আই সি সি র অনুমোদন।সেখান থেকে অনুমোদন নিতে ব্যাপক বেগ পেতে হয়।কংগ্রেসে থাকা সোশালিষ্টরা এর পুরোবিরোধীতা করে।ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য বিশেষ করে মৌলানা সাহেবের ব্যাপক বক্ততার মাধ্যমে তা পাশ হয়।কংগ্রেস কখনও ভারত হিন্দু মহাসভা,কখনও সোশ্যালিষ্টদের মাধ্যমে তার ইচ্ছা পূরণে চেষ্টা করেছে।বেচারা মৌলানা কংগ্রেসের হয়ে এতো খাটুনি তাকে শুধু হতাশই করেছে।১০ জুলাই বোম্বাইতে কংগ্রেস তখনকার সভাপতি মিঃ নেহেরু এক সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন।তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন,কংগ্রেস আপাতত ক্যাবিনেট মিশন পাশ করলেও ভবিষ্যৎ গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্টার জোরে তা বদল ঘটাতে পারবে।
মিশনের সকল সফলতায় জল ঢেলে দিল মিঃ নেহেরু এবং বস্তুত পক্ষে এটাই ছিল তাদের নিয়ত।এই বক্তব্যের পর ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা আর কোন দাম থাকে? ২৭ শে জুলাই মিঃ জিন্না মুসলিম লীগের কাউন্সিল ডাকেন এবং কাউন্সিল যুক্তিসঙ্গত কারণে ক্যাবিনেট মিশন প্রত্যাখান করেন এবং ঘোষনা দেন পাকিস্থান অর্জনের জন্য লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রামে পথে যাবে।এরপরও যেসব ইতিহাসবিদ ভারত ভাঙ্গনের জন্য জিন্না এবং মুসলিমলীগকে দায়ী করে তারা আসলে ইতিহাস লেখেন না, উপন্যাস লেখেন।যেখানে যেভাবেই হোক মুসলিমদের ভিলেন বানানো উদ্দেশ্য থাকে।
জিন্না এসময় যে সমস্ত মুসলমানদের এক করতে সক্ষম হন তার প্রমাণ ১৯৪৫ সালের আইনসভার নির্বাচন।এসময় মুসলীম লীগ সব মুসলিম আসনে নব্বই শতাংশের ওপর ভোট পেয়ে জয়ী হয়।কংগ্রেস ভাল করলেও ৬২টি আসনের মধ্যে ৫৭টিতে জয়ী হয়।এর পর প্রাদেশিক নির্বাচনেও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বাদে প্রতিটি প্রদেশই সফল হয়।কিন্তু আবারও মুসলিমদের সাথে ঠাট্রা আর উপহাস করা হল।বাংলা আর সিন্দু প্রদেশ ছাড়া আর কোথাও মুসলমানদের কে সরকার গঠনের আহবান করা হল না।এমনকি পাঞ্জাবে বেশ কিছু মুসলিম প্রার্থীকে কংগ্রেসের সাথে নিয়ে তাদের সরকার গঠন করতে বলা হল।এ ঘটনাগুলো মুসলিমদের যেমন হতাশ করেছে তথাপি তাদের আদর্শিক মুসলমানের সংখ্যা কম থাকলে বংশীয় মুসলিম জাতীয়তাবোধ এসময় প্রবল হয়ে উঠল।কেন্দ্রে কংগ্রেসের সরকার গঠিত হল।হিন্দু আর মুসলিমরা এই সময় পুরোপুরি ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত।ফলে জায়গা জায়গা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে চলল।এসব ঘটনা কংগ্রেস সরকার পুরো নির্বিকার ছিল।দাঙ্গার ঘটনায় দৃশ্যত গাঁধী মন্তব্য করলেন, ”যদিও কংগ্রেসের নিচুতলার মুসলমান,শিখ,খ্রিষ্টান বা অন্য সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ আছে এবং কংগ্রেস সেই কথাটি বড় গলায় উল্লেখও করে, তবু কায়দে আজম জিন্না কংগ্রেসকে যে হিন্দুদের দল বলে উল্লেখ করেন,এই দাঙ্গাগুলি তাঁর সেই বক্তব্যকেই যথার্থতা দিল।” এমন পরিস্থিতিতে ভারতের তখন ভাইসরয় মিঃ ওয়াবেল এবং ক্যাবিনেট মিশন অন্তবর্তী সরকারের গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন।এর আগে বার বার অন্তবর্তী সরকারের কথা জিন্না বললেও তা প্রত্যাখাত হয়।তাই জিন্না এবার অন্তবর্তী সরকারের সমতার দাবী করে বসলেন।ক্যাবিনেট মিশন জিন্নাকে সরাসরি জানিয়ে দেন আপনি যদি অখন্ড ভারত চান তাহলে সমতার নীতি বাদ দেন।আর যদি ভারত ভাগ করতে চান তাহলে ’কাঁটছাট করা’ পাকিস্থান মেনে নিতে হবে।
শেষ কিস্তিঃ
প্রকৃতপক্ষে ক্যাবিনেট মিশন কংগ্রেসের প্রতি একপেশে অবস্থান নেন,ফলে মি: ওয়াবেল ক্যাবিনেট মিশনের সমালোচনা করে বলেন ক্যাবিনেট মিশনের অনেক সদস্য তাদের দ্বায়িত্বের ব্যাপারে সৎ নয়।উল্লেখ করা প্রয়োজন,ক্যাবিনেট মিশনের প্রধান মি:ক্রিপস আগাগোড়া একজন দূর্তবাজ সোশ্যালিষ্ট ছিলেন এবং তারা অনেকটা কংগ্রেসের হয়ে কাজ করছিলেন বলে মনে হচ্ছিল।ফলে মি:ওয়াবেলের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।মৌলানা আজাদ ’ভারত স্বাধীন হল’ বইটি সেসময় কংগ্রেসের ভিতরকার কর্মকান্ডকে পাগলামী এবং ছেলেমানুষী হিসাবে বর্ণনা করেছেন।তিনি একজন নিবেদিত প্রাণ কংগ্রেস ছিলেন, তাই তার কাছে এসব ছেলে মানুষী হলেও বাস্তবে এসব ছিল তাদের পরিকল্পিত ভাবে করা। ত্যক্ত বিরক্ত জিন্না ২৭ জুলাই বম্বেতে মুসলিম লীগ কাউন্সিলে দৃড়ভাবে পাকিস্থান দাবি তোলেন।গণআন্দোলনে অনব্যস্থ জিন্না এবার বললেন পাকিস্থান দাবি আদায়ের পন্থা হিসাবে ’ডিরেক্ট অ্যাকশন ’ এর পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর ক্রিপস মিশন এর রহস্যময় আচরণ মুসলিমদের হিন্দুদের প্রতি মারাত্মক বিষিয়ে তুলল, ফলে ১৬ আগষ্ট ১৯৪৬ সাল ডিরেক্ট অ্যাকশনের দিন শুধু কলকাতাতে ৬০০০হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।এই ভয়ঙ্করতা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ল বিহার,ওড়িশা,উত্তর প্রদেশ,বম্বে এবং আরো অনেক জায়গা ছড়িয়ে পড়ল।হাজার হাজার হিন্দু মুসলিম প্রাণ হারাল।যদিও ’ডিরেক্ট অ্যাকশন’ডে কে জিন্না অহিংস বলেই দাবী করেছিল।কিন্তু মাঠে মনে হয়, দুই দলই তৈরী ছিল এরকম একটা দিনের জন্য।যদি কলকাতার ঘটনার জন্য বেশিরভাগ ঐতিহাসিক এবং প্রত্যক্ষকারীরা দাবী করেন এর জন্য বাংলার মুখ্য মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীই দায়ী ছিলেন।বাংলার এই ঘটনার জন্য সারা দেশে মুসলিমরা ব্যাপক চাপে পড়ে যায়।যেন এই দিনের জন্য কংগ্রেস অপেক্ষা করছিল।অহিংসবাধী গাঁধী মি:ওয়াবেলের সাথে এক জরুরী বৈঠকে এক পর্যায়ে বলেন,যদি রক্তগঙ্গা বওয়াই জরুরী হয়,তবে অহিংসা সত্ত্বেও তা ঘটবে।মিঃওয়াবেল তার এধরণের বাক্যে বিষ্মিত হন।তিনি পরবর্তীতে তার বইতে লেখেন ”তিনি বুঝতে পারেন গাঁধী এই অহিংসার বাণী তার নিজস্ব চরিত্র নয়,এটা শুধু তার একটি অস্ত্র।”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃঅ্যাটলি লন্ডনে একটি বৈঠক ডাকলেন।১৯৪৬ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাস্তবিক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীসভার দিক থেকে সমাধানের পৌছানার এটাই শেষ প্রয়াস।ভারতকে বিভাজন থেকে বাঁচানোর জন্য নয়,আসলে ভারত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অপসারণের পদ্ধতিকে শান্তিপূর্ণ করার জন্যই যে প্রশাসনিক ভাবনা চলছিল,তার জন্য এই চেষ্টা,ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় যতই এগিয়ে আসছিল,ব্রিটিশদের কাছে আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নটা ততই জরুরি হয়ে উঠছিল।প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ওই বৈটকে সভাপতিত্ব করলেন,উপস্থিত ছিলেন স্যার পেথিক লরেন্স,স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস,নেহেরু,জিন্না,লিয়াকত আলী খান আর সর্দার বলদেব সিংহ।ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে জিন্নাকে আসস্থ করার জন্য একটা সাংবিধানিক দৃড়তা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছিল।এমতাবস্থায় নেহেরু কলকাতার ঘটনাকে দাঁড় করিয়ে অসম,পশ্চিমবঙ্গ এবং পাঞ্জাবকে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে যে বর্গ তা থেকে বের করে নিয়ে আবার চেষ্টা করল।অথচ বৃটেনের পক্ষ থেকে তাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা হল একসময় ভারতে হিন্দু মুসলিম বিভাজন আমরাই সৃষ্টি করেছি কিন্তু এখন আমরা তোমাদের স্বাধীনতা সহ সে ঐক্য ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছি আর তোমরা পায়ে ঠেলে দিচ্ছ। নেহেরু তার সিদ্ধান্তে অটল রইল।বলা যায়,ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাবের আনুষ্ঠানিক মৃত্যু সেখানেই ঘটল।
নেহেরু দেশে এসে একতরফা সংবিধান রচনায় হাত দিলেন আর মুসলিম লীগ তা থেকে সম্পূর্ন দূরে থাকল।দেখতে দেখতে চলে আসে সেই ১৯৪৭ সাল।ভারতের রাজনীতিতে তখন চরম বিরোধী অবস্থানে কংগ্রেস ও মুসলিমলীগ।মুসলিমলীগ থেকে গর্ভনরকে অনুরোধ করা হয় ,তিনি যেন সরকারী ভাবে জানিয়ে দেয় ক্যাবিনেট মিশন ব্যর্থ হয়েছে,কেননা কংগ্রেস সেই পরিকল্পনা মেনে নেয়নি।প্রত্যুত্তরে,কংগ্রেস সরকার থেকে লীগকে পদত্যাগ করার জন্য বলে এবং সর্দার প্যাটেল বারবার মুসলিম লীগের প্রতি গৃহযুদ্ধের হুমকি দিতে থাকে।এমনি এক পরিস্থিতি ১৯৪৭ সালে ৪টা ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ ওয়াবেলকে গর্ভনর পদ থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় বৃটিশ সরকার।১৯৪৭ সালে ২০শে ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হাউস কমনস এ একটি শ্বেতপত্র দাখিল করেন।সেখানে তিনি জানান,ভারতে এই মুহুর্তে ঐক্যবদ্ধ কোন সংবিধান রচনার কোন আশা তিনি দেখছেন না,পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে এবং শীঘ্রই এর ইতি টানা উচিত।১৯৪৮ সালের জুন মাসের আগেই ক্ষমতা হস্তান্তরের সকল পক্রিয়া সম্পন্নের তিনি তাগিদ দেন।এবং এই দিনই তিনি লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে ভারতের পরবর্তী ভাইসরয় হিসাবে ঘোষনা দেন।এভাবে দিনক্ষন ঠিক করে তাড়াহুড়া করায় এই নিয়ে হাউস অব কমনস এ তীব্র বিতর্ক হয়।মিঃ চার্চিল এর তীব্র বিরোধীতা করে বলেন,এটা আমাদের পলায়ন ছাড়া আর কিছুই নয় এবং তিনি একে পুরো বিশৃঙ্খল ক্ষমতা হস্তান্তর হিসাবে চিহিৃত করেন,আর মিঃ মাউন্টব্যাটেন নিয়োগে তিনি বলেন,তিনি শুধু ভারতকে বিভক্তই করবেননা বরং কয়েক খন্ডে বিভক্ত করবেন।প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলির শান্ত যুক্তিনিষ্ট বক্তৃতা সবাই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন আগে হোক বা পরে হোক ক্ষমতা হস্তান্তরটা বিপদজনকই বটে,তাই দেরী করার মানে হয়না।ভারতের স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ সালে পাশ হয়ে গেল ১৯৪৮ সালের ১৮ জুলাই।
ঘটনা এতে তিক্ততার দিকে গেল ভারতের সবচেয়ে বড় সমর্থকরাও বলতে শুরু করল,দেশভাগ ছাড়া আর গতি নেই।কংগ্রেস দেশভাগের দিকে এগিয়ে গেল এবং সেই সাথে একে ঠেকানোর জন্য যুদ্ধংদেহী প্রস্তাব পাশ করলে,যা ছিল সর্দার প্যাটেলের এবং একে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে নেহেরু। প্রস্তাবটি এবং কৌশলটি ছিল এমন, ”যদি দেশভাগ মেনে নিতে হয়,তবে পাঞ্চাব ও বাংলার গোটা প্রদেশকে তারা নিতে পারবেনা বিনাযুদ্ধে।এরকম পরিস্থিতিতে ব্রিটিশরা কোনভাবে দেশভাগ মেনে নেবেনা,আর যদি মেনে নেন বাংলাও পাঞ্জাবের তারা ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে দিবে।” পরবর্তীতে বাস্তবে ঘটেছেও তাই। ফলে ব্রিটিশরাও সবচেয়ে শক্তিশালী পক্ষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হবে।কংগ্রেস প্রমাণ করেছে বারবার,তারা কি সর্বভারতীয়দের নেতৃত্ব দিচ্ছে নাকি কট্বর হিন্দুত্ববাদীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে।এমনকি নেহেরু পাঞ্জাবে তিন অংশে বিভক্ত করার প্রস্তাবও দেয়।কংগ্রেসের এসকল কার্যক্রমকে গাঁধী ও মৌলানা আজাদ পাগলামী বলে উড়িয়ে দিলেও বাস্তবিক পক্ষে এরকম পরিস্থিতিতে এগুলোকে পাগলামী বলা কোনভাবে সম্ভব নয়।তাদের চিন্তাভাবনায় ছিল, এরকম যুদ্ধংদেহী মনোভাব ও কাটাঁছেড়ার কথা বললে মুসলিম লীগ ভয় পাবে।তবে তাদের এই প্রস্তাবে মাউন্টব্যাটেন দেশভাগের পক্ষে একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পেলেন।তিনি পুরোদমে তার কাজে নেমে পড়লেন।অথচ ভারত আজও প্রতিশোধ নিতে একের পর এক হিংসাত্মক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু ইতিহাস বলে,ভারত বিভাগ বাস্তবতা হলেও একে ত্বরান্বিত করেছে কংগ্রেস,মুসলিম লীগ নয়।
মাত্র ত্রিশ বছর আগে কংগ্রেস বাংলা বিভাগের তীব্র বিরোধীতা করেছিল,সেই কংগ্রেসই এখনই বাংলাকে বিভক্তির জন্য একের পর এক বিবৃতি দিতে থাকল।ইংরেজদের হটানোর পর বিশাল দুরবসন্ধি নিয়ে কংগ্রেসের প্রদেশ বিভক্তি মোটামুটি গ্রহনযোগ্যতা পায়।এর মধ্যে নেহেরু একবার জিন্নাকে তার সাথে বসার আমন্ত্রন জানালেও জিন্না তা নাকচ করে দেয়, যা ছিল একেবারে যোক্তিক।কারন নেহেরু রাজনীতিতে মানুষ প্রাধান্য কমই পেত বরং তার থেকে প্রাধান্য পেত একটি শক্তিশালী,প্রভাব বিস্তারকারী রাষ্ট্রগঠন।
নেহেরুর কর্মতৎপরতা অর্থাৎ এই অঞ্চলে সবচেয়ে শক্তিশালী দলের প্রধানের কার্যক্রম মাউন্টব্যাটেনকে এই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে ১৯৪৮ সালে জুনে কেন তার আগে কাজ শেষ করা সম্ভব।প্রায় শেষ বারের মতো গাধীঁ এবং জিন্না ৬ মে পরস্পর বসলেন।বৈঠকে গাঁধীর ভিন্ন চিন্তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনিও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন,দেশভাগ অবশ্যসাম্ভাবী নয়,তবে এই মুহুর্তে ভারতের রাজনীতির সমস্যা একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান।তাই দুজনেই সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন,দেশবাসী যেন শান্ত থাকে এবং সদ্ভাব বজায় রাখে, এই আহবান জানানোর।
ইংরেজদের অবস্থা আর জৌলুস তখন এত নিবু নিবু অবস্থা যে,তারা আগুন দফ করে জ্বলে উঠে গায়ে লাগার আগে সরে পড়াটাই উত্তম হিসাবে বিবেচনা করল।যদিও শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে বিদায় নেওয়াটা তাদের জন্য উত্তম ছিল,তারা সেটা কিছুটা চাইলেও কোন রিস্ক নিতে প্রস্তুত ছিল না।ক্ষমতা স্তরে স্তরে হস্তান্তর হইলে এত রক্তপাত এড়ানো যেত কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটাই হল।এদিকে দেশবিভাগ থেকে প্রদেশ বিভাগ কংগ্রেস অবশ্যম্ভাবী করে তুলল।এর সমস্যাটা বেশী ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট প্রদেশ গুলোতেই।কংগ্রেস নেতা বল্লভ ভাই প্যাটেল এবং হিন্দু মহাসভা হিন্দুদের এই বলেও আস্বস্থ করল যে,ভারতের অংশে যে মুসলিমরা থাকবে,তারা হবে তাদের হাতে এক প্রকার জিম্মী, যা মুসলিমলীগ কোন নেতার কাছ থেকে শুনা যায়নি।অথচ কংগ্রেস মুখ ফাটিয়েছে নিজেদের সকলের রাজনীতিক মঞ্চ বলে।অবাক করার বিষয়,মৌলানা আজাদ সবকিছু অবলোকন করেছেন এবং এগুলোকে কখনও সমর্থন দেননি।তারপরও তিনি শেষপর্যন্ত নিষ্ঠাবান কংগ্রেস থেকে গেলেন।যদিও তিনি আফসোস করেছেন দেশভাগের কয়েকবছর আগে তিনি স্বেচ্ছায় কংগ্রেসের সভাপতি পদ ছেয়ে দিয়ে ভুল করেছেন।বাস্তবতা হচ্ছে,তিনি সভাপতি থাকলেও এগুলো এড়াতে পারতেন কিনা তা সন্দেহ।কারণ শর্র্ষেতে ভূত ছিল অনেক।যে হিংসার বীজ কংগ্রেস তখন প্রতিষ্ঠা করেছে তা এখনও ভারতীয় মূল নীতিমালা।যার কারণে প্রতিবছর এত দাঙ্গা ভারতে সংঘটিত হচ্ছে।
দেশভাগ পক্রিয়া যেন সুষ্ঠ হয়,শক্তিশালী কংগ্রেস যেন এতে বাধা দিতে না পারে;তার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেন বাচাই করেন হিন্দুদের স্বার্থের প্রতি অধিক সহানুভূতিশীল স্যার রেডক্লিপকে।তিনি ভারতকে এমনভাবে ভাগ করলেন ঐতিহাসিকরা পাকিস্তান অংশেকে ”পোঁকায় খাওয়া পাকিস্তান’’বলে উল্লেখ করেছেন।শেষপর্যন্ত ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট পাকিস্থান স্বাধীন হয়;আর ১৫আগষ্ট স্বাধীন হয় ভারত।আর স্বাধীন ভারত আর পাকিস্তানে চলতে থাকে সবচেয়ে নারকীয় তান্ডব যেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল কংগ্রেস।কংগ্রেস আশা করছিল,প্রশাসনিক ভাবে একেবারে শূন্য,রাজনৈতিকভাবে অদৃড় পাকিস্থানের উপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা জড়িয়ে দিতে পারলে তারাই লাভবান হবে।দুই দেশে শুরু হয় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।ভারতে বলা যায়,সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দাঙ্গা সূত্রপাত। লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হয়।মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তার ভারত স্বাধীন হল বইতে সেসময়ের ভারতের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের দ্বায়িত্বে থাকে প্যাটেলকেই দায়ী করেন।এমনকি দাঙ্গার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া প্রাণ হারাতে হয় গাঁধীকে।আর জিন্না আফসোস করে বললেন,এ দায় আমরা এড়িয়ে যেতে পারিনা।
ভারত এখন ১৯৪৭ সালকে ভুলেনি, তাই তারা প্রতিনিয়ত প্রতিশোধে মত্ব।তাইতো পাকিস্থান ভেঙ্গে যখন বাংলাদেশ হল, তখন নেহেরু কন্যা ইন্দিরা পালার্মেন্টে দাঁড়িয়ে বললেন,হাজার বছরের প্রতিশোধ নিলাম।তবে ভারত ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে গনতন্ত্রের মুখোশ পরে আর পাকিস্থান,বাংলাদেশ তা ঠেকাচ্ছে গণতন্ত্রকে বাদ দিয়ে।ইতিহাস প্রমাণ করছে,গণতন্ত্র জয়ী হচ্ছে।
পরিশিষ্টঃ
আলোচনার শিরোনামে দিয়েছিলাম,ইতিহাসের কাঠগড়ায়ঃ জিন্না,কংগ্রেস ওমুসলিম জাতীয়তাবাদ।তাইতো মতামত ব্যাক্ত করার আগে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা জরুরী ছিল।আলোচনা থেকে কতগুলো সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম:
(১)ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বলতে কখনও কিছু ছিলনা;সেটা না ভাষা,না সংস্কৃতি,না ধর্ম,না ভৌগলিক,না বংশ,না গোত্র কোন দিক দিয়েই না।অর্থাৎ বাহ্যিক বা আভ্যন্তরীণ কোন একত্ব অতীতে কখনও ছিল না,এখনও নেই।এখানে যেমন আছে বহুভাষাভাষী লোক,তেমনি আছে বহু ছোট ছোট গোষ্টি।ভৌগলিক একত্ব কেউ কেউ দেখাতে চাইলেও সেটা অমূলক।একমাত্র ইংরেজ শাসন ছাড়া আর কোন সময়ই তা একই রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল না।ধর্মীয় ভাবে বিভাজনতো সুস্পষ্ট।এখানে আছে হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ,খ্রিষ্টান,শিখ,পারসিক এবং প্রকৃতি পূজারি।ধর্মীয়ভাবে কিছুটা একত্ব আনার চেষ্টা করেছেন গাঁধী।সেটাও শুধুমাত্র সফল হয়েছেন মূর্তি পূজারিদের ক্ষেত্রে।এর আগে হিন্দুরা ছিল হাজার হাজার শাখায় উপশাখা বিভক্ত।উত্তরের হিন্দুদের কাছে রাম হচ্ছে ভগবান রারন শয়তানের প্রতিমূর্তি আবার দক্ষিণের হিন্দুদের কাছে রাবণ দেবতা।এবং হিন্দুরা ধর্মীয় গোষ্ঠি হিসাবে হিন্দু নামেও পরিচিত ছিলনা।ধর্মীয় গোষ্টী হিসাবে এদেরকে এনামে প্রথম ডাকেন ইংরেজরা।এর মধ্যে আছেন আবার হরিজন ও দলিত সম্প্রদায়।তারা কংগ্রেস খুব কমই বিশ্বাস করত।তারা কংগ্রেসকে উচু জাতের হিন্দুদের একটি রাজনৈতিক সংঘটন মনে করত।
(২)কংগ্রেসকে ভারতীয় জাতীয়বাদী সংঘটন হিসাবে পরিচিত করতে যার অবদান সবচেয়ে সুবিধাজনক ছিল,তিনি হলেন মি:জিন্নাহ; তার মুসলিম পরিচয় কংগ্রেসকে সকল ধর্মের মানুষের রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে পরিচয় করিয়ে দিতে সুবিধা হয়।বস্তুত পক্ষে জিন্নাহ কখনও মুসলিম আর্দশের লোক ছিলনা।তারপরও মুসলিমলীগ জন্মের পর থেকে মুসলিমলীগের প্রতি তার পজেটিভ দৃষ্টিভঙ্গি তার মুসলিম আর্দশ থেকে জম্ম নেয়নি বরং এখানে কাজ করেছে বংশীয় একত্ব।পরবর্তীতে কংগ্রেসে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে না পেরে তিনি মুসলিম লীগের দিকে ঝুকে পড়েন।মুসলিমলীগও জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিতে দক্ষ হবে এরকম লোকের অভাব থেকে সহজে তাকে লুফে নেয় এবং তিনি শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠে মুসলমানদের আশা আকাঙ্খার প্রতীক।
৩)কংগ্রেসের জন্ম হয়েছে বৃটিশ স্বার্থ রক্ষা করার জন্য তথা বৃটিশদের এরকম একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রয়োজন ছিল যার মাধ্যমে তারা প্রজাদের অভিব্যাক্তি বুঝতে পারে। আর হিন্দরাও চেয়েছে এর মাধ্যমে নিজেদের অবস্থানকে আরো উপরে নিয়ে যাওয়ার।মূলতঃ কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী চেতনা থেকে।তারা বৃটিশদেরকে নয় বরং মুসলিমদেরই তাদের শত্রু মনে করত।উপমহাদেশে বৃটিশরা আগমনের পর থেকে তারা একে অপরের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে।কোন কোন ক্ষেত্রে বৃটিশরা হিন্দু মুসলিম সংঘাতকে আরো গভীরে প্রথিত করেছে।এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল গাঁধী আর জিন্না।তবে গাঁধীর সাথে কংগ্রেসের পার্থক্য ছিল এই যে,কংগ্রেস মনে করত তোমার যদি দুটি পা যায়-এক্ষেত্রে আমার একটি পা গেলেও এটাই বেটার আর গাঁধী মনে করতেন,তোমার কিছু উপকার হলেও আমার যদি আরো বেশী হয় এটাই বেটার।
৪)ভারতে জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্টা ছিল নিছকই একটা স্বপ্ন।বরং সেখানে একটি চুক্তি ভিত্তিক আধুনিক ফেডারেল রাষ্ট কিছুটা যুৎসই হত।তবে সেটাও কতটা যুৎসই হত,তা আন্দাজ করা কঠিন। কারণ প্রধান রাজনৈতিক সংঘঠন কংগ্রেসের মানুষিকতা বর্ণ হিন্দুদের চেয়ে ভিন্ন ছিল না। তারা স্বাধীরতার আগে প্রত্যেকটি পরীক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।আর বাকি ইতিহাসতো দেখলেনই।
৫)যে মুসলিম জাতীয়তাবাদের আলোকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে তাকে কখনও মুসলিম আদর্শিক রাষ্ট্র বলা যাবে না।এখানে আদর্শিক একত্বের তুলনায় বংশীয় একত্ব কাজ করেছে বেশি। যার প্রমাণ মুসলমানদের দ্বারা সংঘঠিত দাঙ্গাগুলো এবং তাদের হাতে সংঘঠিত লুটতরাজ।মূলত যারা মুসলিমলীগের নেতৃত্বে ছিল তারা বেশির ভাগই ছিল বংশীয় মুসলিম,আদর্শিক নয়।
প্রথমতঃ আদর্শিক নয়,তার উপর গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি ভিতর থেকে পাকিস্তানকে দুর্বল করে দেয়-যার কারণে ভারতের ষড়যন্ত্র অধিক ফলফ্রসু হয়। আদর্শিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ভারত ভাগের আগে মুসলমারদের এরকম জাতীয়তাবাদ সৃষ্টির পেছনে মূল কারণ ছিল কংগ্রেস ও হিন্দুদের আচরণ।তাই ঐ সময় ভারত ভাগ ছিল যোক্তিক। তবে ইসলামী আদর্শের সাথে চলতে প্রস্তুত এরকম জনগোষ্টি ছিল একেবারে কম। তাই বিভিন্ন ইসলামী সংঘঠনের দাবী অনুযায়ী পাকিস্তান ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে হতে হবে ,এই দাবী ছিল অযোক্তিক। এ অবস্থায় সবচেয়ে ভাল হত যদি গণতন্ত্র থাকত, তাহলে সকল পক্ষের মতামত প্রতিফলিত হত।
বি.দ্রঃ কারো কোন পরামর্শ বা সংশোধনী থাকলে অবশ্যই দিবেন।সঠিক ইতিহাস তুলে ধরাই ছিল আমার মূল উদ্দেশ্য,এই কারণে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে নিজগুণে ক্ষমা করবেন।
তথ্যসূত্রঃ-
১) জিন্না.ভারত দেশভাগ স্বাধীনতা-যশোবন্ত সিংহ
২)ভারত স্বাধীন হল-মৌলানা আবুল কালাম আজাদ
৩)ইসলামের দৃষ্টিতে জাতি ও জাতীয়তাবাদ-মাওলানা আব্দুর রহীম
৪)বাঙলা ও বাঙালির হাজার বছর-ড: আনু মুহাম্মদ
৫)চেপেরাখা ইতিহাস:আল্লামা গোলাম আহমাদ মোর্তজা
৬)আরো কিছু বই ও আর্টিকেল যা আমাকে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সহযোগিতা করে।