ঢাকা ১০:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে নির্বাচন সংস্কার কমিশন গঠন আমি স্যামসাং ব্যবহার করি, স্ক্রিনশট গেছে আইফোনের : জনপ্রশাসন সচিব উন্নয়নের ভ্রান্ত ধারণা: ঋণে ডুবে থাকা দেশ টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় নাহিদ ইসলাম আমার টাকা-পয়সার প্রতি লোভ নেই, ৫ কোটি হলেই চলবে এক দিনেই হাওয়া ৮ হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন অবশেষে দেখা মিলল আসাদুজ্জামান কামালের ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ কারাগারে কেমন আছেন ‘ভিআইপি’ বন্দীরা একটি ফোনকল যেভাবে বদলে দিয়েছে ড. ইউনূসের জীবনের গতিপথ ড. ইউনুসের Three Zeros থিয়োরি বর্তমান উপদেষ্টাদের সঙ্গে নতুন চার-পাঁচজন মুখ যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কয়েকটি জাতীয় দিবস বাতিল করতে পারে সরকার সমবায় ব্যাংকের ১২ হাজার ভরি স্বর্ণ গায়েব: উপদেষ্টা “প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস: বাংলার গর্ব, বৈশ্বিক সম্প্রীতির প্রতীক” খেলোয়াড় সাকিবের নিরাপত্তা আছে, ফ্যাসিস্ট সাকিবের ক্ষেত্রে অবান্তর: ক্রীড়া উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সম্মেলন থেকে কী অর্জন করলেন? জাতিসংঘে তিন-শুন্যের ধারণা দিলেন ড. ইউনুস যন্ত্রণার নাম ব্যাটারি রিকশা তরুণ সমাজের অফুরান শক্তি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে— ড. ইউনূস

ইবনে সিনা: ইতিহাসের এক উজ্জ্বল পারস্য প্রতিভা

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ০৩:১৬:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ মে ২০২২ ২৪ বার পড়া হয়েছে
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ইবনে সিনা নামটি শোনেননি, এমন কাউকে বুঝি পাওয়াই যাবে না। ছোটবেলা থেকেই আমরা এই সব্যসাচী ব্যক্তির নাম জেনে এসেছি একজন খ্যাতিমান মুসলিম বিজ্ঞানী হিসেবে। ইতিহাসের অত্যন্ত গুণী ব্যক্তিদের মাঝে একজন হলেন এই ইবনে সিনা। আমরা এ লেখায় জানতে পারব ইবনে সিনার জীবন নিয়ে- কী ছিল তাঁর কীর্তি, কীভাবেই বা তিনি হলেন এত বিখ্যাত?

ইবনে সিনার একটি পেইন্টিং; source: hmyhero.com

‘ইবনে সিনা’ শব্দের অর্থ হলো ‘সিনার পুত্র’। কিন্তু আসলে কিন্তু তাঁর পিতার নাম ‘সিনা’ ছিল না! তাঁর পুরো নাম ছিল আবু আলী আল-হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা। অর্থাৎ তাঁর অনেক ঊর্ধ্বতন পুরুষ ছিলেন সিনা নামের একজন। কিন্তু এই বিশাল নামকে মানুষ ছোট করতে করতে কেবল শেষের ‘ইবনে সিনা’ (ابن سینا) নামেই ডাকা শুরু করে। আর লাতিনে সেই নামের আরো বিকৃতি সাধিত হয়, নামটা হয়ে যায় Avicenna! তবে ইতিহাসের পাতায় তিনি ইবনে সিনা নামেই পরিচিত হয়ে আছেন অনন্তকালের জন্য।

সে যা-ই হোক, ইবনে সিনার জন্ম ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে; বুখারার কাছের এক গ্রামে, এখন সেটা উজবেকিস্তানে, এক ইসমাইলি শিয়া পরিবারে। তার বাবার নাম ছিল আব্দুল্লাহ, তিনি নিজে শিয়া হলেও কাজ করতেন সুন্নি সামানিদ সরকারের শাসনাধীনে। পাঁচ বছর পর ইবনে সিনার ছোট ভাই মাহমুদের জন্ম হয়।

ইবনে সিনার একটি মূর্তি; source: Emaze

১০ বছর বয়স হবার আগেই ইবনে সিনা কুরআনে হাফেজ হয়ে গেলেন। এক ভারতীয় সবজি-ফল বিক্রেতা থেকে তিনি ভারতীয় পাটিগণিত শিখেছিলেন। এর মাঝেই তিনি দেখা পেয়ে যান এক যাযাবর বিদ্বান লোকের, তাঁর কাছ থেকে আরো জ্ঞান নিতে লাগলেন তিনি। ইসমাইল আল জাহিদ নামের একজন সুন্নি হানাফি শিক্ষকের কাছ থেকে তিনি ইসলামি ফিকহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। পড়ে ফেলেন ইউক্লিড আর টলেমির লেখাও।

একটু বড় হবার পর ইবনে সিনা পড়তে শুরু করলেন অ্যারিস্টটলের ‘মেটাফিজিক্স’; কিন্তু অনেক কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। ৪০ বার তিনি সেই বইটি পড়েন বলে কথিত আছে, মুখস্তই হয়ে যায় তাঁর, কিন্তু অর্থ তো তিনি আর বুঝতে পারছেন না! পরে তিন দিরহাম দিয়ে তিনি একদিন আল-ফারাবির লেখা ব্যাখ্যা গ্রন্থ কিনলেন, সেটা পড়বার পর বিষয়গুলো পরিস্কার হয় তাঁর কাছে। খুশিতে তিনি শুকরানা আদায়ের উদ্দেশ্যে গরিব-দুঃখীদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করলেন।

এরপর দর্শনের পোকা ঢুকে যায় তার মাথায়। পরের দেড় বছর অনেক কিছুই পড়লেন তিনি, কিন্তু অনেক বাধার সম্মুখীন হলেন বুঝতে গিয়ে। কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে তিনি উঠে পড়তেন, ওজু করে মসজিদে নামাজ পড়তেন, যতক্ষণ না মাথা খোলে। গভীর রাত পর্যন্ত পড়তেন তিনি, অনেক সময় রাতে ঘুমের মাঝে স্বপ্নে তাঁকে হানা দিত নানা কঠিন সমস্যা। স্বপ্নেই সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করতেন তিনি।

১২৭১ সালে আঁকা ইবনে সিনার একটি ছবি; source: উইকিমিডিয়া কমন্স।

৯৯৭ সালে আমির নূহ ব্যক্তিগত ডাক্তার পদে নিয়োগ দেন ইবনে সিনাকে, কারণ তিনি নূহের মরণ রোগের চিকিৎসা করেছিলেন এবং তিনি সেরে উঠেছিলেন। তাঁর পুরস্কার হলো সামানিদদের রাজকীয় লাইব্রেরি ব্যবহারের সুযোগ। পরে সেই লাইব্রেরি আগুনে পুড়ে যায়; ইবনে সিনার শত্রুরা দাবি করে যে, আগুন ইবনে সিনাই লাগিয়েছিলেন, যেন কেউ তাঁর জ্ঞানের উৎস জানতে না পারে।

কাজের পাশাপাশি বাবাকে সাহায্য করতেন ইবনে সিনা, আর বই লিখতেন। তাঁর বাবা মারা যান অকালে, এদিকে সামানিদ সাম্রাজ্যের আয়ুও শেষ হয়ে আসে। গজনির সুলতান মাহমুদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি উত্তর দিকে রওনা দেন। খোরাসান এলাকায় যাযাবরের মতো ঘুরতে ঘুরতে তিনি তাঁর মেধা কাজে লাগাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। নানা বাধা-বিপত্তির পর কাস্পিয়ান সাগরের কাছে গোর্গান এলাকায় এক বন্ধুর কাছে আশ্রয় পেলেন তিনি। সেখানে জ্যোতির্বিদ্যা আর যুক্তিবিদ্যার উপর লেকচার দিয়েই তাঁর উপার্জন হতো। এখানেই তিনি তাঁর মাস্টারপিস ‘আল কানুন ফি আত-তিব’ (The Canon of Medicine) রচনা শুরু করেন বলে ধারণা করা হয়।

আল কানুন আল ফিত-তিব বইয়ের প্রথম পাতা; source: উইকিমিডিয়া কমন্স।

পরে বর্তমান তেহরান যে এলাকায়, সেখানে চলে আসেন ইবনে সিনা, এখানে তিনি তাঁর ৩০টির মতো ছোট ছোট বই লিখেন। এরপর তিনি হামাদানে চলে যান, সেখানে এক উচ্চবংশীয় নারীর সেবায় নিযুক্ত হন। কিন্তু সেখানকার আমির তাঁকে সেই পদ থেকে সরিয়ে উপহারসামগ্রী সহ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তিনি উজির পদও পান, কিন্তু এই পদ থেকে আমির তাঁকে বরখাস্ত করেন এবং এলাকা থেকে নির্বাসিত হবার আদেশ দেন। ইবনে সিনা ৪০ দিন লুকিয়ে ছিলেন শেখ আহমেদ ফাজলের বাড়িতে। কিন্তু আমির নিজেই অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লে ইবনে সিনা নিজের ‘উজির’ পদ ফিরে পান, তিনি ডাক্তার পদেও নিযুক্ত হন। প্রতি সন্ধ্যায় তাঁর বই ছাত্রদের পড়ানো হত। আমিরের মৃত্যুর পর ইবনে সিনা উজির পদ ছেড়ে দিয়ে আরো লেখালিখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, থাকতেন এক গোপন জায়গায়।

নতুন আমির তাঁর গোপন জায়গার খোঁজ পাবার পর তাঁকে কারাবন্দী করেন এক দুর্গে। এদিকে ইস্পাহান আর হামাদানের মাঝে যুদ্ধ লেগে যায়। ১০২৪ সালে ইস্পাহানের দখলে আসে হামাদান। ইবনে সিনে তাঁর লেখার কাজ সম্পন্ন করেন, তবে এই অশান্তির শহর থেকে তিনি পালাবেন বলে স্থির করেন। তাঁর ভাই, প্রিয় ছাত্র ও দুজন দাসের সাথে তিনি সুফি দরবেশের বেশ ধরে পালিয়ে ইস্পাহানে চলে যান। সেখানে তাঁকে রাজকীয়ভাবে বরণ করা হয়।

বাকি ১০-১২ বছরের জীবন তাঁর কাটে কাকুয়িদ শাসক মুহাম্মাদ ইবনে রুস্তমের ডাক্তার ও উপদেষ্টা হিসেবে। তিনি যুদ্ধ অভিযানেও যেতেন। হামাদানের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধের সময় তাঁকে তলপেটের ব্যথা কাবু করে ফেলে, দাঁড়াতেই পারছিলেন না তিনি। পরে আরেক অভিযানে আবারও এই একই ব্যথা তাঁকে ধরাশায়ী করে ফেলে।

এই রোগই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় তাঁকে অনুতাপ আঁকড়ে ধরে। তিনি দরিদ্রদের মাঝে সম্পদ বিলি করে দেন, তাঁর দাসদের মুক্ত করে দেন। প্রতি তিন দিন পর পর তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতে লাগলেন। ৫৮ বছর বয়সে, ১০৩৭ সালের জুন মাসে তিনি মারা যান, সময়টা ছিল রমজান। তাঁকে সমাহিত করা হয় ইরানের হামাদানেই।

ইরানের হামাদানে ইবনে সিনার সমাধি; source: উইকিমিডিয়া কমন্স

ইবনে সিনার বেশিরভাগ লেখাই আরবিতে। তবে কিছু লেখা আছে ফার্সিতে। আলবার্টাস ম্যাগনাস, থমাস অ্যাকিনাস প্রমুখ ইবনে সিনার মতবাদে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর পাঁচ খণ্ডের আল কানুন আল ফিত-তিবকে বলা হয় মেডিক্যাল শাস্ত্রের বাইবেল। বইগুলো সব লেখা শেষ হয় ১০২৫ সালে। এই বই এতই বহুমুখী ছিল যে, মধ্যযুগীয় ইউরোপে একে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং অষ্টাদশ শতকে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো। গ্যালেনের মতবাদকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে ইবনে সিনার এ বই। তাছাড়াও একশ’রও বেশি বই ইবনে সিনা লিখে গিয়েছিলেন।

ইবনে সিনার নামে চালানো একটি উক্তিই যেন সেই আগুনের জ্বালানি-

The world is divided into men who have wit and no religion and men who have religion and no wit.

অর্থাৎ “এ দুনিয়ার লোকেরা দুই দলে বিভক্ত- এক দলের ধর্ম নেই কিন্তু বুদ্ধি আছে, আরেক দলের বুদ্ধি নেই কিন্তু ধর্ম আছে।”

অথচ এ উক্তিটি তাঁর নিজের নয়, সমসাময়িক কবি ও ইসলামের সমালোচক আল মা’রি (أبو العلاء المعري) বলেছিলেন এ কথাটি। সুতরাং এ উক্তির প্রেক্ষিতে তাকে নাস্তিক খেতাব দেয়াটি যুক্তিযুক্তও নয়।

তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ইবনে সিনা ছোট বেলাতেই কুরআনে হাফিজ হন, তবে পরে গিয়ে ‘হয়তো’ দূরে সরে যান ধর্ম থেকে, হতেও পারে নাও হতে পারে। বলা হয়ে থাকে, তিনি শেষ বয়সে আবার ধর্মে ফিরে আসেন। তিনি কুরআনের সুরার ব্যাখ্যা নিয়ে ৫টি পুস্তিকা লিখেন, এর মাঝে একটি ছিল ‘নবীত্বের প্রমাণ’ শিরোনামে। তিনি যুক্তিবিদ্যা দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। ‘আল বুরহান আল সিদ্দিকিন’ নামে একটি যুক্তির সাহায্যে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন বলে জানা যায়।

তবে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, ইতিহাসের পাতায় যে তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের একজন হিসেবে চিরস্মরণীয় থাকবেন, সে বিষয়ে নেই কোনো সন্দেহ।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ইবনে সিনা: ইতিহাসের এক উজ্জ্বল পারস্য প্রতিভা

আপডেট সময় : ০৩:১৬:৩৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৪ মে ২০২২

ইবনে সিনা নামটি শোনেননি, এমন কাউকে বুঝি পাওয়াই যাবে না। ছোটবেলা থেকেই আমরা এই সব্যসাচী ব্যক্তির নাম জেনে এসেছি একজন খ্যাতিমান মুসলিম বিজ্ঞানী হিসেবে। ইতিহাসের অত্যন্ত গুণী ব্যক্তিদের মাঝে একজন হলেন এই ইবনে সিনা। আমরা এ লেখায় জানতে পারব ইবনে সিনার জীবন নিয়ে- কী ছিল তাঁর কীর্তি, কীভাবেই বা তিনি হলেন এত বিখ্যাত?

ইবনে সিনার একটি পেইন্টিং; source: hmyhero.com

‘ইবনে সিনা’ শব্দের অর্থ হলো ‘সিনার পুত্র’। কিন্তু আসলে কিন্তু তাঁর পিতার নাম ‘সিনা’ ছিল না! তাঁর পুরো নাম ছিল আবু আলী আল-হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা। অর্থাৎ তাঁর অনেক ঊর্ধ্বতন পুরুষ ছিলেন সিনা নামের একজন। কিন্তু এই বিশাল নামকে মানুষ ছোট করতে করতে কেবল শেষের ‘ইবনে সিনা’ (ابن سینا) নামেই ডাকা শুরু করে। আর লাতিনে সেই নামের আরো বিকৃতি সাধিত হয়, নামটা হয়ে যায় Avicenna! তবে ইতিহাসের পাতায় তিনি ইবনে সিনা নামেই পরিচিত হয়ে আছেন অনন্তকালের জন্য।

সে যা-ই হোক, ইবনে সিনার জন্ম ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে; বুখারার কাছের এক গ্রামে, এখন সেটা উজবেকিস্তানে, এক ইসমাইলি শিয়া পরিবারে। তার বাবার নাম ছিল আব্দুল্লাহ, তিনি নিজে শিয়া হলেও কাজ করতেন সুন্নি সামানিদ সরকারের শাসনাধীনে। পাঁচ বছর পর ইবনে সিনার ছোট ভাই মাহমুদের জন্ম হয়।

ইবনে সিনার একটি মূর্তি; source: Emaze

১০ বছর বয়স হবার আগেই ইবনে সিনা কুরআনে হাফেজ হয়ে গেলেন। এক ভারতীয় সবজি-ফল বিক্রেতা থেকে তিনি ভারতীয় পাটিগণিত শিখেছিলেন। এর মাঝেই তিনি দেখা পেয়ে যান এক যাযাবর বিদ্বান লোকের, তাঁর কাছ থেকে আরো জ্ঞান নিতে লাগলেন তিনি। ইসমাইল আল জাহিদ নামের একজন সুন্নি হানাফি শিক্ষকের কাছ থেকে তিনি ইসলামি ফিকহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। পড়ে ফেলেন ইউক্লিড আর টলেমির লেখাও।

একটু বড় হবার পর ইবনে সিনা পড়তে শুরু করলেন অ্যারিস্টটলের ‘মেটাফিজিক্স’; কিন্তু অনেক কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। ৪০ বার তিনি সেই বইটি পড়েন বলে কথিত আছে, মুখস্তই হয়ে যায় তাঁর, কিন্তু অর্থ তো তিনি আর বুঝতে পারছেন না! পরে তিন দিরহাম দিয়ে তিনি একদিন আল-ফারাবির লেখা ব্যাখ্যা গ্রন্থ কিনলেন, সেটা পড়বার পর বিষয়গুলো পরিস্কার হয় তাঁর কাছে। খুশিতে তিনি শুকরানা আদায়ের উদ্দেশ্যে গরিব-দুঃখীদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করলেন।

এরপর দর্শনের পোকা ঢুকে যায় তার মাথায়। পরের দেড় বছর অনেক কিছুই পড়লেন তিনি, কিন্তু অনেক বাধার সম্মুখীন হলেন বুঝতে গিয়ে। কোনো কিছু বুঝতে অসুবিধা হলে তিনি উঠে পড়তেন, ওজু করে মসজিদে নামাজ পড়তেন, যতক্ষণ না মাথা খোলে। গভীর রাত পর্যন্ত পড়তেন তিনি, অনেক সময় রাতে ঘুমের মাঝে স্বপ্নে তাঁকে হানা দিত নানা কঠিন সমস্যা। স্বপ্নেই সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করতেন তিনি।

১২৭১ সালে আঁকা ইবনে সিনার একটি ছবি; source: উইকিমিডিয়া কমন্স।

৯৯৭ সালে আমির নূহ ব্যক্তিগত ডাক্তার পদে নিয়োগ দেন ইবনে সিনাকে, কারণ তিনি নূহের মরণ রোগের চিকিৎসা করেছিলেন এবং তিনি সেরে উঠেছিলেন। তাঁর পুরস্কার হলো সামানিদদের রাজকীয় লাইব্রেরি ব্যবহারের সুযোগ। পরে সেই লাইব্রেরি আগুনে পুড়ে যায়; ইবনে সিনার শত্রুরা দাবি করে যে, আগুন ইবনে সিনাই লাগিয়েছিলেন, যেন কেউ তাঁর জ্ঞানের উৎস জানতে না পারে।

কাজের পাশাপাশি বাবাকে সাহায্য করতেন ইবনে সিনা, আর বই লিখতেন। তাঁর বাবা মারা যান অকালে, এদিকে সামানিদ সাম্রাজ্যের আয়ুও শেষ হয়ে আসে। গজনির সুলতান মাহমুদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি উত্তর দিকে রওনা দেন। খোরাসান এলাকায় যাযাবরের মতো ঘুরতে ঘুরতে তিনি তাঁর মেধা কাজে লাগাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। নানা বাধা-বিপত্তির পর কাস্পিয়ান সাগরের কাছে গোর্গান এলাকায় এক বন্ধুর কাছে আশ্রয় পেলেন তিনি। সেখানে জ্যোতির্বিদ্যা আর যুক্তিবিদ্যার উপর লেকচার দিয়েই তাঁর উপার্জন হতো। এখানেই তিনি তাঁর মাস্টারপিস ‘আল কানুন ফি আত-তিব’ (The Canon of Medicine) রচনা শুরু করেন বলে ধারণা করা হয়।

আল কানুন আল ফিত-তিব বইয়ের প্রথম পাতা; source: উইকিমিডিয়া কমন্স।

পরে বর্তমান তেহরান যে এলাকায়, সেখানে চলে আসেন ইবনে সিনা, এখানে তিনি তাঁর ৩০টির মতো ছোট ছোট বই লিখেন। এরপর তিনি হামাদানে চলে যান, সেখানে এক উচ্চবংশীয় নারীর সেবায় নিযুক্ত হন। কিন্তু সেখানকার আমির তাঁকে সেই পদ থেকে সরিয়ে উপহারসামগ্রী সহ বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তিনি উজির পদও পান, কিন্তু এই পদ থেকে আমির তাঁকে বরখাস্ত করেন এবং এলাকা থেকে নির্বাসিত হবার আদেশ দেন। ইবনে সিনা ৪০ দিন লুকিয়ে ছিলেন শেখ আহমেদ ফাজলের বাড়িতে। কিন্তু আমির নিজেই অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লে ইবনে সিনা নিজের ‘উজির’ পদ ফিরে পান, তিনি ডাক্তার পদেও নিযুক্ত হন। প্রতি সন্ধ্যায় তাঁর বই ছাত্রদের পড়ানো হত। আমিরের মৃত্যুর পর ইবনে সিনা উজির পদ ছেড়ে দিয়ে আরো লেখালিখিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, থাকতেন এক গোপন জায়গায়।

নতুন আমির তাঁর গোপন জায়গার খোঁজ পাবার পর তাঁকে কারাবন্দী করেন এক দুর্গে। এদিকে ইস্পাহান আর হামাদানের মাঝে যুদ্ধ লেগে যায়। ১০২৪ সালে ইস্পাহানের দখলে আসে হামাদান। ইবনে সিনে তাঁর লেখার কাজ সম্পন্ন করেন, তবে এই অশান্তির শহর থেকে তিনি পালাবেন বলে স্থির করেন। তাঁর ভাই, প্রিয় ছাত্র ও দুজন দাসের সাথে তিনি সুফি দরবেশের বেশ ধরে পালিয়ে ইস্পাহানে চলে যান। সেখানে তাঁকে রাজকীয়ভাবে বরণ করা হয়।

বাকি ১০-১২ বছরের জীবন তাঁর কাটে কাকুয়িদ শাসক মুহাম্মাদ ইবনে রুস্তমের ডাক্তার ও উপদেষ্টা হিসেবে। তিনি যুদ্ধ অভিযানেও যেতেন। হামাদানের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধের সময় তাঁকে তলপেটের ব্যথা কাবু করে ফেলে, দাঁড়াতেই পারছিলেন না তিনি। পরে আরেক অভিযানে আবারও এই একই ব্যথা তাঁকে ধরাশায়ী করে ফেলে।

এই রোগই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় তাঁকে অনুতাপ আঁকড়ে ধরে। তিনি দরিদ্রদের মাঝে সম্পদ বিলি করে দেন, তাঁর দাসদের মুক্ত করে দেন। প্রতি তিন দিন পর পর তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতে লাগলেন। ৫৮ বছর বয়সে, ১০৩৭ সালের জুন মাসে তিনি মারা যান, সময়টা ছিল রমজান। তাঁকে সমাহিত করা হয় ইরানের হামাদানেই।

ইরানের হামাদানে ইবনে সিনার সমাধি; source: উইকিমিডিয়া কমন্স

ইবনে সিনার বেশিরভাগ লেখাই আরবিতে। তবে কিছু লেখা আছে ফার্সিতে। আলবার্টাস ম্যাগনাস, থমাস অ্যাকিনাস প্রমুখ ইবনে সিনার মতবাদে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর পাঁচ খণ্ডের আল কানুন আল ফিত-তিবকে বলা হয় মেডিক্যাল শাস্ত্রের বাইবেল। বইগুলো সব লেখা শেষ হয় ১০২৫ সালে। এই বই এতই বহুমুখী ছিল যে, মধ্যযুগীয় ইউরোপে একে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হতো এবং অষ্টাদশ শতকে পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হতো। গ্যালেনের মতবাদকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে ইবনে সিনার এ বই। তাছাড়াও একশ’রও বেশি বই ইবনে সিনা লিখে গিয়েছিলেন।

ইবনে সিনার নামে চালানো একটি উক্তিই যেন সেই আগুনের জ্বালানি-

The world is divided into men who have wit and no religion and men who have religion and no wit.

অর্থাৎ “এ দুনিয়ার লোকেরা দুই দলে বিভক্ত- এক দলের ধর্ম নেই কিন্তু বুদ্ধি আছে, আরেক দলের বুদ্ধি নেই কিন্তু ধর্ম আছে।”

অথচ এ উক্তিটি তাঁর নিজের নয়, সমসাময়িক কবি ও ইসলামের সমালোচক আল মা’রি (أبو العلاء المعري) বলেছিলেন এ কথাটি। সুতরাং এ উক্তির প্রেক্ষিতে তাকে নাস্তিক খেতাব দেয়াটি যুক্তিযুক্তও নয়।

তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ইবনে সিনা ছোট বেলাতেই কুরআনে হাফিজ হন, তবে পরে গিয়ে ‘হয়তো’ দূরে সরে যান ধর্ম থেকে, হতেও পারে নাও হতে পারে। বলা হয়ে থাকে, তিনি শেষ বয়সে আবার ধর্মে ফিরে আসেন। তিনি কুরআনের সুরার ব্যাখ্যা নিয়ে ৫টি পুস্তিকা লিখেন, এর মাঝে একটি ছিল ‘নবীত্বের প্রমাণ’ শিরোনামে। তিনি যুক্তিবিদ্যা দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। ‘আল বুরহান আল সিদ্দিকিন’ নামে একটি যুক্তির সাহায্যে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন বলে জানা যায়।

তবে যত বিতর্কই থাকুক না কেন, ইতিহাসের পাতায় যে তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের একজন হিসেবে চিরস্মরণীয় থাকবেন, সে বিষয়ে নেই কোনো সন্দেহ।