কবি নজরুলের প্রেম ও পারিবারিক জীবনের কিছু কথা

- আপডেট সময় : ০৫:৩৩:২৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪
- / 84
নজরুলের প্রেম ও বিবাহ নিয়ে দু’ বাংলাতেই কিছু বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। কুমিল্লার দৌলতপু্র থেকে কলকাতায় এসে আলী আকবর খান নামের এক প্রকাশক নজরুলকে পাকড়াও করেন ১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে। তিনি ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে নজরুলকে দৌলতপুরে নিয়ে যান। তাঁর মতলব ছিল নিজের সুন্দরী ভাগ্নী নার্গিস নামের এক যুবতীর সঙ্গে নজরুওলের বিয়ে দেওয়া। আসলে আলী আকবর মনে মনে ভেবেছিলেন চালচুলোহীন নজরুলকে ভাগ্নীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ঘর জামাই করে রাখবেন এবং নজরুলকে দিয়ে স্কুলপাঠ্য বই লিখিয়ে নিয়ে নিজের প্রকাশনা ব্যবসা চালিয়ে যাবেন রমরমিয়ে।
নজরুলের মতো জনপ্রিয় লেখককে কলকাতার আরও কিছু প্রকাশক নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে ব্যবহার করেছেন বরাবরই। কিন্তু আলী আকবরের মতো এমন হীন উদ্দেশ্য নিয়ে নজরুলকে একেবারে পুরোপুরি নিজের কবজায় পুরে নেওয়ার কথা ভাবতে পারেননি। ওর খুবই বেহিসেবি ভাবাবেগে তাড়িত কবি আলী আকবরের সেই গোপন মতলব ধরতে না পেরে তাঁর ভাগ্নী নার্গিসকে বিয়ে করার জন্য সম্মতিও দিয়ে বসলেন। হয়তো সুন্দরী নার্গিসের প্রেমেও পড়ে গিয়ে থাকবেন।
আসলে ভর-যৌবনের ‘এডোলেসেন্স’ আবেগের তীব্রতাই নজরুলকে বিপথগামী করে তোলে। কিন্তু বিয়ের পিঁড়িতে বসে নজরুল যেই-না জানতে পারলেন তাঁকে ঘরজামাই করার ফন্দি হয়েছে, তিনি বিয়ের চুক্তিপত্র সই না করে বিয়ের আসর থেকে উঠে পড়েন এবং সেই নির্ধারিত বিয়ের দিন, ১৯২১ সালের ১৮ জুন ঝড়-জলের রাতেই নজরুল আলী আকবরের বাড়ি ছেড়ে কুমিল্লায় কান্দরপাড়ে, বিরজা সুন্দরীদেবীদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। সঙ্গে ছিলেন বিরজা সুন্দরীর পুত্র রবীন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত।
বিরজা সুন্দরী দেবী ঐ বিয়ের আসরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মতোন ঝুলতে লাগল মধ্যপথেই, এখন আমাদের বিদায়ের পালা।’ বিয়ের ব্যাপার নিয়ে পরের বছরই, ১৩২৯ বঙ্গাব্দের বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকায় শ্রাবণ সংখ্যায় বিরজা সুন্দরী দেবীর ‘নৌকা পথে’ নামে একখানা লেখা প্রকাশিত হয়। তাতেই তিনি ঐ বিয়ে সুসম্পন্ন না হওয়ার কথা লিখেছেন।
এমন অকাট্য সাক্ষ্য থাকা সত্বেও দু’ বাংলার কিছু মুসলমান লেখক আদাজল খেয়ে লড়ে গেলেন এই বলে যে নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে সুসম্পন্ন হয়েছিল। তাঁদের লেখায় বিয়ের চুক্তিপত্র বা অন্য কোনও সাক্ষ-প্রমান তাঁরা দাখিল করতে পারেননি। নার্গিস ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। এর মধ্যে ১৯৩৮ সালে নার্গিস বিয়ে করেন আজিজুল হাকিম নামে তখনকার পুর্ব বাংলার এক নজরুল ভক্তকে। এতগুলো বছরের মধ্যে নার্গিসকে দিয়ে কোনও লেখক বলাতে পারেননি যে ১৯২১ সালে নজরুলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে সুসম্পন্ন হয়েছিল।
আসলে কয়েক জন মুসলমান নজরুল জীবনীকার তাঁদের ধর্মীয় সংস্কার বসত বোধ হয় পরবর্তী কালে নজরুলের হিন্দু রমণিকে বিয়ে করার বিষয়টি হজম করতে পারেননি। তা-ও আবার নজরুল সেই রমণীকে মুসলমান না করে সাঁখা সিঁদুর সহ তাঁর নিজের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে থাকতে দেওয়ায় মুসলমান জীবিনীকারদের বদ হজমের মাত্রাটা আরও বেড়ে গিয়েছিল হয়তো। সেই জন্যই মনগড়া ধারণা নিয়ে তাঁরা অন্তত চাইবেনই যে হিন্দু রমণী বিবাহের আগে নজরুল অন্তত এক জন মুসলমান রমণীর পানি গ্রহন করে শুদ্ধ হয়ে ছিলেন। এই মনোভঙ্গি থেকেই নজরুলের বিয়ে নিয়ে এতো বিভ্রাট। পরবর্তী সময়ের গবেষণায় এই বিভ্রান্তির নিরসন ঘটলেও কোনও কোনও লেখক সে সবের খোঁজ রাখাটা জরুরি মনে করেন না। তারা হয়তো পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটেই আনন্দ পান।
নজরুলের অন্যতম সুহৃদ মুজাফফর আহমদ-ইয়ের লাখা ” কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতি কথা” গ্রন্থখানা দু বাংলাতেই নজরুল সম্পর্কিত আকর গ্রন্থ হিসাবে সাতের দশকেই মান্যতা পেয়েছে আধিকাংশ নজরুল গবেষকের কাছে। করাচি সেনা শিবির থেকে ১৯২০ সালের মার্চ মাসে নজরুল কলকাতা ফিরে আসেন। চিঠি-পত্র মারফত মুজাফফর আহমেদের সঙ্গে নজরুলের যোগাযোগ সেনা শিবির থেকেই। মুজাফফরের উদ্যোগে নজরুলের প্রথম কবিতা ছাপা হয় কলকাতার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির পত্রিকায় ১৯২১ সালে। করাচির সেনা শিবির থেকেই নজরুলের লেখা ডাক মারফত মুজাফফরের হাতে এসে পড়ে।
কলকাতায় ফিরে মুজাফফরের আস্তানাতেই নজরুল থিতু হন। তাঁরা একসঙ্গে ছিলেন অনেকগুলি বছর। সেই মুজাফফরই তথ্য-প্রমান দিয়ে দেখিয়েছেন নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে সুসম্পন্ন হয়নি। তিনি ষাটের দশকেই জেলখানায় বসে নজরুল নিয়ে লেখার সময় বিরজা সুন্দরীদেবীর পুত্র বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেও সুনিশ্চিত হন যে নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়েটা প্রহসন ছাড়া কিছু ছিল না। শেষ পর্যন্ত বিয়ের আসর থেকে বিবাহ সম্পন্ন হতে না দিয়েই নজরুল উঠে পড়লেন এবং তারই সঙ্গে তাঁদের কান্দিরপাতড়ে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন সেই ঝড়-জলের রাতেই। কয়েক দিন পর মুজাফফর কলকাতা থেকে কুমিল্লায় গিয়ে নজরুলকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনেন। বিয়ে সুসম্পন্ন না হওয়ার কথা নজরুওলের মুখে শুনেছিলেন মুজাফফর।
১৯৭২ সালে মুজাফফর আহমদকে ঢাকায় নিয়ে যান তাঁর কিছু অনুরাগীবৃন্দ। এই নিবন্ধের লেখকও তখন একই সঙ্গে ঢাকায় যান। মুজাফফরকে রাখা হয় তাঁর একমাত্র জামাতা বিখ্যাত কবি, ছান্দাসিক ও লেখক আব্দুল কাদিরের বাড়িতে। আব্দুল কাদির ১৯৫১ সালের শেষেও কলকাতায় ছিলেন চাকরি সূত্রে। তিনি কলকাতায় শিক্ষা দফতরের সরকারি বিদ্যালয় পরিদর্শকের কাজ করতেন।
নজরুলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেশ ভাগের পর ১৯৫২ তে তিনি ঢাকায় ফিরে যান। তিনি জন্মসূত্রে কুমিল্লার মানুষ। কিন্তু কুমিল্লার মানুষ হয়েও তিনি নার্গিস ও নজরুলের বিয়ে সংক্রান্ত কোনও প্রমান পত্র সংগ্রহ করতে পারেননি। তিনি ১৯৪১ সালে নজরুলের একখানা ছোট জীবনী পুস্তিকা রচনা করেন এবং ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত নজরুল রচনা সম্ভার সম্পাদনা করেন। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি নজরুল সংক্রান্ত এম্ন নথিপত্র সংগ্রহ করেন যা, এ বাংলা ও বাংলা মিলিয়ে কোনও গবেষকের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আব্দুল কাদের স্বরচিত কাব্যগ্রন্থের প্রশংসা করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও খুবই গুরুত্বপূর্ণ অভিমত প্রকাশ করেন লিখিত ভাবে। আব্দুল কাদির নজরুলের চেয়ে ১০ বছরের ছোট ছিলেন।
মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় ১৯২৩-৩৬ মুজাফফর আহমেদ যখন কারাগারে তখন নজরুলই আব্দুল কাদিরের সঙ্গে মুজাফফর আহমদের একমাত্র কন্যা আফিফা খাতুনের সঙ্গে বিয়ের বন্দোবস্ত করেন। এ জন্য নজরুল বঙ্গোপসাগরের দ্বিপময় ভূমি মুজাফফরের জন্মস্থান সন্দীপে যান আব্দুক কাদিরকে সঙ্গে নিয়ে।
এ রকম গভীর সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আব্দুল কাদির নজরুলের বিয়ে নিয়ে সঠিক তথ্য কেন সংগ্রহ করতে পারলেন না এটা খুবই বিস্ময়ের ব্যাপার। প্রমীলা দেবীই যে নজরুওলের একমাত্র বিয়ে করা স্ত্রী এ কথাটা কাদিরের লেখায় খোলাখুলি উচ্চারিত হল না কেন? ১৯৭২ সালে কাদিরের ঢাকার গুলসনের বাড়িতে এই নিবিন্ধকারের পক্ষ ঠেকে প্রশ্ন করা হলে কাদির দ্বিধায় পড়ে যান। শ্বশুরের সামনে তিনি অর্ধ শতাব্দী পর এ নিয়ে বিতর্কে জড়াতে চাননি নতুন করে।
১৯২১ সালের ১৮ জুন তারিখে নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে নিয়ে আলী আকবর খান বস্তুত এক তামাশাই সৃষ্টি করেন। এ ঘটনার তিন বছর পর নজরুলের সঙ্গে বিয়ে হয় কুমিল্লার কান্দির পাড়ের কন্যা আশালতা সেনগুপ্তের। আশালতা হলেন বিরজা সুন্দরীদেবীর দেওয়রের মেয়ে। নজরুল বিরজা সুন্দরীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন। বিরজা সুন্দরী দেবীর গভীর স্নেহের পাত্র হয়ে ওঠেন নজরুল। আলী আকবর খানের মাধ্যমেই কিন্তু এ বাড়ির সঙ্গে ১৯২১ সালা নজরুলের জানাশোনা।
কিন্তু আশালতার সঙ্গে নজরুলের বিয়ের ব্যাপারটা বিরজা সুন্দরী দেবীও সহজে মেনে নিতে পারেননি। তাই আশালতার বিধবা মা গিরিবালা দেবী মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতায় মেয়ের বিয়ে দেন নজরুলের সঙ্গে। বিয়ের অনুষ্ঠান হয় বেনিয়াপুকুরের ৬ নম্বর হাজি লেনে সম্পূর্ণ নতুন রীতিতে। বিয়ের আগে বা পরে স্ত্রীকে নজরুল ইসলাম ধর্মে অন্তরিত করেননি। তাই যে- ইসলামি প্রথা মেনে মুসলমানের সঙ্গে মুসলমানের বিয়ে হয় নজরুলের ক্ষেত্রে সেই প্রচলিত রীতি পালন করা হয়নি। ‘আহলে হাদিস’ মতে এক বৈবাহিক চুক্তি অনুসারে নজরুলের বিয়ে হয়। তাতে ধর্ম বদলের প্রয়োজন হয়নি। তবে বিয়ের পর নজরুল স্ত্রীর নতুন নাম দেন প্রমীলা। কে জানে মধুসূদনের মেঘনাদ বধ কাব্যে প্রমীলা নামের এক অনার্য নারির মুক্তি চেতনাকে যে ভাবে সর্ব প্রথম বাংলা সাহিত্যে মহিমান্বিত করা হয়, বিয়ের পর নজরুলের মনে সে রকম কনোও ভাবনা কাজ করেছিল কি না? ছোট বেলায় তার স্ত্রীর ডাক নাম ছিল দুলি। স্কুলে পড়ার সময় তাঁর নাম হয় আশালতা। আর বিয়ের পর হয়ে যান প্রমীলা। ‘নারীর যে স্বাতন্ত্র নাই’ এ কথা কালীদাসের লেখাতেও বলা হয়েছে। খ্রিষ্টিয় পঞ্চম শতকে, কতকাল আগে। বিয়ের আগে বাবার এবং বিয়ের পর স্বামীর পরিচয়ে চিহ্নিত হয় ভারতীয় নারী। নজরুল এ নিয়মও ভাঙার প্রয়াসী ছিলেন।
নজরুল ১৭৮৯-এর ফরাসি বিপ্লবের আদররে দিপি হন। তাঁর পর ১৯১৭ সালের রুস বিপ্লব তাঁকে করাচির সেনা নিবাসে উজ্জীবিত করে। এ ভাবেই নারীর স্বাধীন সত্ত্বাকে তিনি সম্মান করতেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মত লেখক বিশ্বাস করতেন দুটি প্রস্ফুটিত হৃদয়ের পবিত্র ও সুগভীর মিলনই বিবাহ। তিনি বলেন, দেশের বেশিরভাগ নারীও জানে না তাঁর স্বামী তারে সত্যি ভালবাসে কি না। পুরুষেরও অজানা থেকে যায় তাঁর স্ত্রী প্রকৃত অর্থে তাঁকে কতটা ভালবাসে। কিন্তু বছরের পর বছর তারা একসঙ্গে ঘকনান করে। ছেলে-মেয়েও হয়। এ ভাবেই এক সময় তাদের জীবনও শেষ হয়ে যায়।
শরৎচন্দ্রের কাছে বোধ হয় হৃদয়ানুভূতির এ প্রশ্নটা ছিল মুখ্য। বাইরের মন্ত্র-তন্ত্র, আচার-বিচার ও ছোঁয়া-ছুঁয়ির কুৎসিত সংস্কার নয়। সেই জন্যই তিনি শ্রীকান্ত উপন্যাসে বৈষ্ণবী ও সুফিবাদি মুসলমান-এর গোঁসাইকে অন্তত হৃদয়ানুভূতির দিক থেকে এক গভীর সৌন্দর্য চেতনায় পৌঁছে দিতে চেষ্টা করেন। তবু পল্লী সমাজের রমা ও রমেশ কিংবা চরিত্রহীণের কিরনময়ী ও দিবাকরকে নিয়ে তিনি অনেক দূর পোঁছেও ফিরে এসেছেন পুরোনো আচার ও প্রাচীন সামাজিক সংস্কারাচ্ছন্নতায়। এ ক্ষেত্রে শরৎচন্দ্র অনেকটাই আপনমগখী। বরং মৃতদাহের অচলা ও সুরেশকে নিয়ে অনেকটা দুঃসাহসিক হয়ে ওঠেন। যেখানে রবীন্দ্রনাথ সংশয়হীন হয়ে ওঠেন যোগাযোগ উপন্যাসে।
তবুও এ কথা বলতেই হয়, ‘মুসলমানীর গল্পে’ যে ধর্মীয় কুসংস্কার ও সামন্ততান্ত্রিক আচার সর্বস্বতাকে ভেঙেছেন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিবাহ ঘটানোর দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে বিনোদিনীর ক্ষেত্রে তা ঘটাতে পারেনি। উনিশ শতকের মধ্যভাগে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রচলন করার দঃসাহসিক প্রয়াসের পরও বিধবার বিয়ে দিতে হলে শরৎচন্দ্রকে বাংলা ছেড়ে নায়িকাকে বার্মা মুলুকে নিয়ে যেতে হবে কেন? এ কি সামাজিকতার ভয়? লোকনিন্দার আতঙ্ক? নজরুল এমন বাধা অতিক্রম করে ছিলেন।
বিরজা সুন্দরী দেবী তো হলেন সেই সমাজের মধ্যে থাকা নারী। গিরিবালা দেবিও তাই। তবু গিরিবালা দুঃসাহসিক হয়ে ওঠেন প্রাণের টানে। মুসলমান পরিবারে জন্ম নেওয়া প্রায় বাউণ্ডেলে চাকরিহীন, বাসস্থানহীন , ব্রিটিস সরকারের কুনজরে পড়ে জেলখাটা এক কবির সঙ্গে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিতে তাঁর সংস্কারে বাধেনি। নজরুলের প্রতি কতটা গভীর স্নেহ থাকলে এমন করে সংস্কারের পুরোনো শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলা যায় বিধবা গিরিবালা তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর এ ঘটনা ঘটেছে সেই বাঙালী সমাজের সেই কালে যখন ধর্ম নিয়ে, জাত-পাত নিয়ে নানা টানাপোড়ন নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে ভারতীয় রাজনীতির প্রশ্রয়েই।
বাঙালী পরিবারে বিধবারা নানান কারণেই তাচ্ছিল্ল ও করুণার শিকার হয়ে থাকে। ফলে ভেতরে ভেতরে তাঁরা দ্ন্দ্ব হয়। এই দন্দ্বতা কখনও কখনও তাদের দ্রোক্ষভ্যব করে তলে। গিরিবালা দেবীরও হয়তো তাই হয়ে থাকতে পারে।
নজরুলের বিয়ের অনেক আগেই গিরিবালা বিধবা হন। তাঁর স্বামী বসন্ত কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন ত্রিপুরার রাজাদের নায়েব। তখন কুমিল্লা ছিল ত্রিপুরার অন্তর্গত। নজরুলের চিঠিতেই এ তথ্য পাওয়া যায়। খুব সংস্কৃতি সম্পন্ন স্বদেশী মনোভাবাপন্ন পরিবার ছিল তাঁদের। প্রমীলা তাঁদের একমাত্র মেয়ে। সেই মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে গিরিবালা দেবী সংস্কারের বাঁধন ছেরে বেরিয়ে এসেছিলেন। ১৯২৪-এর দগ্ধ কালবেলায়। এ কী কম দুঃসাহসিকতার পরিচয়।
এঙ্গেল নামের এক ইতিহাস খ্যাত জার্মান দার্শনিক লিখেছিলেন, একথা বিশাল রক্তক্ষয়ী পরও অনেক কাল ধরে থেকে যায় পুরনো অভ্যাস, রীতিনীতি ও সংস্কারের অবশেষ ভাবনা। সেই অভ্যাস ভাঙা খুব সহজ ব্যাপার নয়। তাঁর জন্য নিজের সঙ্গে নিজের নড়াই চালিয়ে যেতে হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবিত দেবতা এ ভাবেই হয়ে ওঠে গণদেবতা। তখনই তিনি উচ্চারণ করেন ‘ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা আঘাতে আঘাত কর।’
রবীন্দ্রনাথ নিজেকে নতুন করে নির্মাণ করেন। সেই জন্য লেখা হয়, অচলায়তন, বির্ষজন, গরা কিংবা রক্তকরবী। বরিশালের জীবনানন্দ দাশ কলকাতায় এসে নজরুলের সামনে বলতে পেরেছিলেন ‘ পৃথিবীর গচীর, গভীর অসুখ এখন।’ জীবনানন্দ প্রথম পর্বের লেখায় নজরুলের দ্বারা প্রভাবিত হন।
এই প্রেক্ষিতে দেখলে গিরিবালা দেবীর মহানুভাবতার তুলনা মেলা ভার। নজরুলের মতো বেহিসাবি অস্বচ্ছল কবিকে নিয়ে ২২ বছর তিনি আগলে ছিলেন অন্নপূর্ণার মতো। ১৯২৪ সালেই কলকাতা থেকে হুগলীর চক বাজারে গিয়ে সংসার পাতা, সেখান থেকে ১৯২৬-এর ৩ জানুয়ারি কৃষ্ণনগরে গিয়ে প্রায় তিন বছরেরও ওপর জীবন যাপন। তাঁর পর আবার কলকাতায় ফিরে এসে কাছাকাছি আট-দশ বার বাসা বদল। এ কী কম কষ্টের জীবন গোটা পরিবারের! এর মধ্যে হুগুলীতে নজরুলের প্রথম পুত্রের জন্ম ও কয়েক মাস পরেই মৃত্যুর ঘটনা, সেখানে ম্যালেরিয়ায় নজরুলের মরমর অবস্থা, কৃষ্ণনগরে ব্বিতিয় নাতি বুলবুলের জন্ম আর ১৯২৯ সালে কলকাতায় ফিরে আসার আক বছর বয়সে বসন্ত রোগে অকাল মৃত্যু, নিজের একমাত্র সন্তান প্রমীলার ১৯৩৮ সালে কোমড় থেকে পা পর্যন্ত অসাড় হয়ে যাওয়ার মতো দুর্বিপাক সামাল দিয়েছেন গিরিবালা দেবী। পরের দুই নাতি সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধর অবুঝ আবদার ও দূরিন্তপনাও কম ছিল না সেই সংসারে। প্রমীলা দেবীর পক্ষাঘাত রোগের চার বছরের মধ্যেই নজরুল চির দিনের জন্য সম্বিতহারা হয়ে গেলেন। ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই কলকাতায় আকাশবাণীর এক অনুষ্ঠান করার সময় তাঁর কন্ঠ প্রায় রুদ্ধ হয়ে যবার উপক্রম হলো। ক্রমে একেবারেই কথা বলার ক্ষমতা হারালেন এবং স্মৃতশক্তি লোপ পেল। মস্তিষ্কের কোষগুলো স্নায়বিক রোগে শুকিয়ে যাওয়ার ফলে। এমন রোগ এক লক্ষ মানুষের মধ্যে এক জনের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। পরে এ রকম রোগে আক্রান্ত হন সাঁতারু মিহির সেন ও বিখ্যাত শিল্পী রামকিংকর বেইজ। এর পর কবি পরিবারের দারিদ্র চরমে পৌঁছায়।
শ্যামবাজারের বাড়িতে থাকার সময় এমনও হয়েছে কবির অন্নগ্রহণের প্রিয় কাঁসার বাসন দোকানে বন্ধক দিয়ে চাল কিনতে হয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুরস্কার হিসাবে কবির পাওয়া এক ভরি ওজনের সোনার তৈরি ‘জগত্তারণী’ পদক কয়েক বার যে বাঁধা দিতে হয়েছে পরিবারের ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য সে খবর এখন কত জনই বা রাখেন! শেষ পর্যন্ত কবির ছোট পুত্রবধু কল্যাণি কাজী টাকা দিয়ে সেই পদক ছাড়িয়ে আনেনে এবং তাঁর পর থেকে সে পদক কল্যাণী কাজীর ঘরেই রয়ে গেছে।
কবি যখন সুস্থ ছিলেন কত মানুষের আনাগোনা ছিল তাঁর কাছে। কবি যখন গ্রমোফোন কোম্পানির ট্রেনার ও সুরকার তখন কত শিল্পীর সমাগম ঘটে তাঁকে কেন্দ্র করে। কিন্তু কবির অসুস্থতার পর অবস্থাটা একেবারেই বদলে গেল। তখন গিরিবালা দেবীর উপরেই সংসারের সব দায়িত্ব চেপে বসে। অসুস্থ মেয়ে-জামাইকে দেখা, ঘর সংসার সামলানো, নিজের পুজো-আর্চা নিয়ে তখন হিমসিম অবস্থা। অসুস্থ জামাইয়ের মলমূত্রও সাফাইয়ের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে নিত্য পুজো করা এই বিধবাকে।
রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেনঃ” এই মহিয়সী নারী ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় স্থান লাভের যোগ্য-কিন্তু ক’জনই বা তাঁর নাম জানে। গিরিবালা দেবী বৈদ্য জাতি সম্ভূতা। আমাদের বাল্যকালে বৈদ্যরা খুব সংঘবদ্ধ সম্প্রদায় বলা চলত। কিছু না কিছু আত্মীয়তা পরস্পরকে যুক্ত রাখতো; আমার কোনো আত্মীয়া এদের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত ছিলেন, তাঁর কাছে প্রমীলা দেবীর বিবাহের রোমাঞ্চের গল্প শুনেছিলাম – শুনেছিলাম সমাজে সেই জন্য তাঁর মাতাকেও নির্যাতিত হতে হয়েছিল। কিন্তু রোমান্সের রঙীন চিত্রটিই তাঁর বক্তব্যের মধ্যে প্রাধাণ্য পাওয়া যায়।, অন্য দিকটি তেমন করে ভেবে দেখিনি। সে বয়সও তখন নয়।
“… আজ থেকে ৪০-৪৫ বৎসর পুর্বে উচ্চ বর্ণের হিন্দু বিধবার পক্ষে এ যে কতদূর বৈপ্লবিক কর্ম তা বোধ হয় আজকের যুগে বসে অনুমান করা যায়না। যদি প্রমীলা দেবী সমাজ ও আত্মীয়-স্বজনের মতামত অগ্রাহ্য করে কবিকে বিবাহ করে হিন্দু সমাজ ত্যাগ করে চলে যেতেন, তাতে বিষ্ময়ের কিছু থাকত না, যৌবনে, আবেগে প্রেমের প্রবলতা বহু মানুষকেই যুগে যুগে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করার শক্তি দিয়ে থাকে। প্রেমের আহ্বানের অনিবার্জতার মুখে ভেসে যায় মানুষের মনগড়া বাধা, যৌবনের আহ্বান সমাজের মুখে তুড়ি মেরে বলতে পারে ‘বিধির বিধান কাটবে তুমি এমন শক্তিমান, তুমি কি এমনি শক্তিমান?’
” কিন্তু গিরিবালা দেবির মাতৃ স্নেহে সে কি করে এমন সর্ববাধা বিজয়ী অজেয় শক্তি লাভ করল, চিরন্তন মানব ধর্মের কোন গভীর বিশ্বাস এই শত বাধা কন্টকিত সঙ্কীর্ণ হিন্দু সমাজের পল্লী পরিবেশের মধ্যে তাঁর চিত্তের গহনে চির জাগ্রত ছিল, যা নজরুলের কবি-মানসকে সর্ব জাতি সম্প্রদায়ের ঊর্দ্ধে তুলে দেখতে পেরেছিল?
” রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি ‘গোরা’ আনন্দময়ী কল্পিত চরিত্র, একমাত্র সেই কল্পনার সঙ্গেই যেন তুলনা মেলে, জানিনা, রবীন্দ্রনাথ এই মহিমাময়ী নারীর কোনো সংবাদ জানতেন কি না, জানলে অবশ্যই তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে যেতেন।”
চার দশক আগে মৈত্রেয়ী দেবীর লেখাতেই আছে গিরিবালা দেবী মুসলমান জামাতের সংসারে থেকেও নিজের দর্ম আচার পালন ধরে রাখতেন খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে। কন্যা ও জামাতের পরিচর্চা করেছেন নিজের হাতে। তাদের রান্না-বান্নার কাজ সামলে ‘নিজের পূজার্চনা ও স্বপাক আহার ইত্যাদি চালিয়ে গেছেন। আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে যে মানব ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। মানবতা যে এ সবের ঊর্ধ্বে, তা কোনো যুক্তিতর্ক ও দর্শনশাস্ত্র দিয়ে না বুঝলেও যে অন্তরে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করা যায় তা এমন সব জীবন না থাকলে বিশ্বাস হত না। এই জীবঙ্খানি তাই একটি অভুত-পূর্ব দৃষ্টান্ত।”
নজরুলের সংসারে থেকেও গিরিবালা দেবী কি সাত্ত্বিক জীবন যাপন করতেন নজরুলের বন্ধু খান মিনুদ্দীনের লেখা ‘যুগস্রষ্টা নজরুল’ গ্রন্থেও তাঁর বিবরণ পাওয়া যায়।
মা গিরিবালা ও মেয়ে প্রমীলাকে নিয়ে পল্লী কবি জসীমুদ্দিনের লেখা আরও অতুলনীয়। তিনি প্রমীলা সম্পর্কে লিখেছেন, ভাবির মতন সর্বংসহা মেয়ে বাংলাদেশে খুব কমই পাওয়া যায়। কবির ছন্নছাড়া/ নাঙরহীন জীবিন। এই জীবনের অন্তঃপুরে স্নেহমমতায় মধুর হইয়া চিরকাল তিনি কবির কাব্য সাধনাকে জয়যুক্ত করিয়া ছিলেন। কোনো সময় তাঁহাকে কবির সম্পর্কে কোনো অভিযোগ করিতে দেখি নাই।’
আসলে প্রমীলা দেবীরও ছিল এক সুন্দর কবি-মন। কবিতার টানেই তিনি নজরুলকে ভালবেসেছিলেন। তাঁর ভিতরেও কি গভীর কাব্যপ্রীতি জমানো ছিল তা বোঝা যায় তাঁর লেখা ‘শঙ্কিতা’ ও ‘করুণা’ নামের দুখানি কবিতা পড়ে। কবিতা দুটি ছাপা হয় তাঁর জীবদ্দশাতেই প্রকাশিত দ্বি-মাসিক ‘সাম্যবাদী’ পত্রিকায়।
মুজাফফর আহম্মদের জীবনী থেকেই জানা যায়, নজরুল কোনও নতুন গানের সুরারোপ করে প্রমিলা দেবীকে শোনাতেন। কিছু দিন পর সেই সুর ভুলে গেলে প্রমীলা দেবীর কাছে জেনে নিতেন সুরটা কেমন ছিল। প্রমীলা দেবী গান গেয়ে তাঁকে সেই সুর মনে করিয়ে দিতেন। এমনই গুনবতী মহিলা ছিলেন প্রমীলা।
“আমি আমার মা-বাবার কনিষ্ঠ সন্তান। আমাকে ‘দাদা’ ডাকার কেউ ছিল না। একমাত্র প্রমীলাই আমায় ‘দাদা’ ডাকত। তাঁর মৃতুতে আমায় ‘দাদা’ বলার কেউ রইল না। “মৃত্যুর আগে তার সেই দাদাকে প্রমীলা দেবী কিছু বলতে চান। সে সুযোগ তাঁর হয়নি।
১৯৬২ সালের ৩০ জুন প্রমীলা দেবী প্রয়াত হন টালাপার্কের গায়ে অবস্থিত ভাড়া বাড়িতে। যত দিন বেঁচে ছিলেন, শুয়ে শুয়ে নিজের হাতে নজরুলকে খাইয়ে দিতেন। পক্ষাঘাতগ্রস্থ শরীর নিয়ে কাত হয়ে স্টোভে নজরুলের পছন্দমতো কিছু তরকারিও রান্না করতেন। প্রমীলা যেমন গভীর প্রেমে আবদ্ধ ছিলেন, নজরুলও সুস্থ অবস্থায় প্রমীলার ভালবাসার বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজেকে। ১৯৬২ সালে এন্টালির ক্রিস্টেফার রোডে নতুন এক সরকারি ফ্ল্যাট পেয়ে ছিলেন কাজী সব্যসাচী। টালার বাড়ি থেকে সেই বাড়িতে নিয়ে আসা হয় কবিকে। টালার মন্নথনাথ দত্ত রোডের যে ঘরে কবি ও তাঁর পরম প্রিয় স্ত্রী প্রমীলা থাকতেন সেই ঘর ছেড়ে আসার সময় কবি কী আবেশ টানে বার বার তাকিয়ে ছিলেন প্রমীলা দেবীর বিছানার দিকে! সম্মিত হারা কবির ভিতরে তখন কি কোনও অনুচ্চারিত অনুভূতি আকুলিত হয়ে উঠছিল তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য!
প্রখ্যাত শিল্পী আঙ্গুরবালা ও ইন্দুবালা দেবীর সঙ্গে এই নিবন্ধ লেখকের নজরুল সম্পর্কে সাক্ষাৎকার ভিত্তিক কিছু কথা হয়। তাঁদের কাছ থেকেও জানা যায় তাঁদের পরম শ্রদ্ধেয় ‘কাজি’দা স্ত্রীর প্রতি কী গভীর প্রেমে আচ্ছন্ন ছিলেন।