কে এই মাওলানা সাদ?যে কারণে বিতর্কিত?
- আপডেট সময় : ০৭:০৭:২৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৬ নভেম্বর ২০২৪
- / 131
দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়া থেকে বুঝা যায় যে তাবলিগ জামাতের বিতর্ক এখনও কাটেনি। মূলত অভ্যন্তরীণ কিছু দ্বন্দ্বের কারণে সংগঠনটি দুটি দলে বিভক্ত হয়ে আছে। মূল দ্বন্দ্ব যাকে নিয়ে তিনি হলেন মাওলানা সাদ। পুরো নাম সাদ কান্ধলভী। তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াছ (রহ.)-এর ছেলে মাওলানা হারুন (রাহ.)। তারই ছেলে হলেন মাওলানা সাদ কান্ধলভী। তাকে নিয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে উপমহাদেশে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
মাওলানা সাদ কান্ধলভী ভারতীয় আলেম। তাবলিগ জামাতের বিশ্ব-মারকাজ বা কেন্দ্র হলো দিল্লির ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ। এই কেন্দ্রের দায়িত্বে যিনি থাকেন তাকেই বিশ্ব-তাবলিগের আমির বলা হয়। সে হিসেবে বর্তমানে তাবলিগের আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন মাওলানা সাদ।
ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ মাওলানা সাদের বেশ কিছু বক্তব্যকে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে অগ্রহণযোগ্য বলে রায় দিয়েছে। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে জারি করা এক ফতোয়ায় মাওলানা সাদের কড়া সমালোচনা করেছে দেওবন্দের ফতোয়া বোর্ড।
দেওবন্দের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে পোস্ট করা ফতোয়ায় বলা হয়, ‘তাবলিগ জামায়াতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীর সংসর্গে আছেন তাদেরকে সাবধান করা আমাদের ঈমানি দায়িত্ব। জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে মাওলানা কান্ধলভী কোরআন ও হাদিসের কিছু বিষয়ে এমন সব ব্যাখ্যা দিচ্ছেন যা সত্য থেকে বিচ্যুত এবং আলেম উলামাদের সর্বসম্মত মতামতের বিরোধী।’
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে বিতর্কিত বক্তব্যের একাধিক অভিযোগ পেয়ে তা যাচাই বাছাইয়ের পর দেওবন্দ এই সিদ্ধান্তে আসে বলে জানানো হয়। ফতোয়ায় আরও বলা হয়, ‘যদি দ্রুত সাদ কান্ধলভীর ব্যাপারে সতর্ক না হোন, তাহলে মুসলমানদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিভ্রান্তিতে পতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ দেওবন্দের এই অবস্থানকে তাবলিগের একাংশ সঠিক মনে করেন। এই দলের দায়িত্বে আছে শূরা কমিটি। এই কমিটিতে রয়েছেন বাংলাদেশের মাওলানা ক্বারি যুবায়ের আহমদসহ অনেকে।। সম্প্রতি এই অংশ পরিচালিত বিশ্ব ইজতেমা টঙ্গীর তুরাগ তীরে সম্পন্ন হয়েছে। ২০ জানুয়ারি মাওলানা সাদ নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা টঙ্গীতে শুরু হবে। যদিও মাওলানা সাদের ইজতেমায় অংশগ্রহণ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
মাওলানা সাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে তার কিছু নিচে উল্লেখ করা হলো—
১) প্রধান অভিযোগ হলো তিনি ঐতিহ্যবাহী শুরা ভেঙে আমিরতন্ত্র কায়েম করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের আমির। যে আমাকে আমির মানবে না সে জাহান্নামে যাবে।’ তাঁর এ বক্তব্য রয়েছে ইউটিউবে : https://www.youtube.com/watch?v=x19atoW-v24
এরপর কয়েকবার নিজামুদ্দিন মারকাজে মারধরের ঘটনা ঘটে। পরে ২০১৫ সালের নভেম্বরে রায়বেন্ড ইজতেমায় একত্রিত হয়ে নিজামুদ্দিনের মুরব্বিরা মারকাজের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং ১৩ জনের শুরা গঠন করা হয়। কিন্তু মাওলানা সাদ শুরা মানতে অস্বীকৃতি জানান। অতঃপর বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে তিনি নিজামুদ্দিন দখল করেন। তাঁর ওস্তাদসহ সব আলেমকে সেখান থেকে বের করে দেন, বের করতে গিয়ে আলেমদের শরীর থেকে রক্ত ঝরাতেও কসুর করেননি। (সূত্র: দাওয়াত ও তাবলিগ, ড. মুহাম্মদ আবদুল হাননান, বিশ্বসাহিত্য ভবন, নভেম্বর, ২০১৮ ভূমিকা দ্রষ্টব্য, পৃষ্ঠা-১৩)
২) মাওলানা সাদ বলেছেন, ‘মসজিদে ঈমানের আসর কায়েম করা ফরজ। মসজিদের বাইরে অন্য কোথাও হেদায়েত পাওয়া যাবে না।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৫)
৩) সাদ সাহেব বলেন, ‘হজরত মুসা (আ.) নিজের জাতির মধ্যে দাওয়াতের কাজ ছেড়ে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে নির্জনবাসে চলে গিয়েছিলেন। যার ফলে পাঁচ লাখ ৮৮ হাজার বনি ইসরাইল গোমরাহ হয়ে যায় (মুরতাদ হয়ে যায়)।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৮)
৪) মাওলানা সাদের মতে তাবলিগের ৬ নম্বরই প্রকৃত ইসলাম। সাদ সাহেব বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই ৬ নম্বরকে পূর্ণ দীন মনে করে না, সে হলো ওই ব্যবসায়ীর মতো, যে নিজেই নিজের দধিকে টক বলে বেড়ায়। এমন ব্যবসায়ী কখনো সফল হতে পারে না।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৭)
৫) সাদ সাহেব মনে করেন, হেদায়েত আল্লাহর হাতে নেই। তিনি বলেন, ‘হেদায়েত যদি আল্লাহর হাতেই থেকে থাকে, তাহলে তিনি কেন নবীদের প্রেরণ করেছেন!’ তাঁর এই বক্তব্য কোরআনের সুরা কাসাসের ৫৬ নম্বর আয়াতসহ বহু আয়াতবিরোধী।
৬) ‘ক্যামেরা মোবাইল পকেটে থাকলে নামাজ হবে না। ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল থেকে দেখে দেখে কোরআন শোনা ও পড়া হারাম। এতে কোরআনের অবমাননা হয়। এর কারণে কোনো সওয়াব হবে না। যেসব আলেম তা বৈধ হওয়ার ফতোয়া দেন, তাঁরা উলামায়ে সু।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৬)
৭) না বুঝে কোরআন পড়লে লাভ নেই। তিনি বলেন, কোরআন বুঝে পড়া প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ওয়াজিব। না বুঝে কোরআন পড়ার কারণে কোনো লাভ হবে না। এমন লোকের ওয়াজিব তরকের গুনাহ হবে।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৭)
৮) কোরআন পড়িয়ে অর্থ নেওয়া হারাম। তিনি বলেন, ‘বিনিময় নিয়ে কোরআনে কারিম পড়া নোংরা নারীর বিনিময়ের মতো। নোংরা নারী তার আগে জান্নাতে যাবে।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৬)
৯) নিজামুদ্দিন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ধর্মত্যাগের গুনাহ হবে। এ বিষয়ে তার বক্তব্য হলো— ‘সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ঈমান আনয়নের পর মদিনা থেকে ফিরে নিজের এলাকায় যাওয়াকে ইরতিদাদ তথা ধর্মত্যাগ মনে করতেন। কাজেই নিজামুদ্দিন মারকাজ (তাবলিগের মূল কেন্দ্র) থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে সাধারণ বিষয় মনে করো না।’ (সূত্র: অব্যাহত বিভ্রান্তিকর বয়ান, পৃষ্ঠা-২৫)
১০) ‘আসহাবে কাহাফের সঙ্গী জন্তুটি কুকুর ছিল না; বাঘ ছিল।’ (সূত্র: অব্যাহত বিভ্রান্তিকর বয়ান, পৃষ্ঠা-৪৯) তাঁর এ বক্তব্য পবিত্র কোরআনের সুরা কাহফের ১৮ নম্বর আয়াতবিরোধী।
১১) তার মতে, নিজামুদ্দিন পৃথিবীর অন্যতম পবিত্র স্থান। তিনি বলেন, ‘এই স্থানটির (নিজামুদ্দিন) সম্মান করো। সমগ্র পৃথিবীর অবস্থা হলো এমন যে মক্কা-মদিনার পরে যদি এমন কোনো সম্মানিত জায়গা থাকে, যে জায়গাকে আদর্শ মনে করতে হয়, যে জায়গার অনুসরণ করতে হয়, যে জায়গাকে মহান মনে করতে হয়, তাহলে সেটি হলো এই নিজামুদ্দিন বাংলাওয়ালি মসজিদ।’
১২) তাবলিগের মাশওয়ারা নামাজের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘মুমিন যেভাবে গুরুত্বের সঙ্গে নামাজ আদায় করে, গুরুত্বের সঙ্গে মাশওয়ারায় (পরামর্শ) উপস্থিত থাকা এর চেয়েও অধিক জরুরি।’ (সূত্র: অব্যাহত বিভ্রান্তিকর বয়ান, পৃষ্ঠা-৯)
১৩) তাবলিগের বাইরের কিতাব পড়া যাবে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজের (তাবলিজি) সঙ্গে লেগে থাকতে হবে এবং মাওলানা ইলিয়াছ ও মাওলানা ইউসুফ সাহেবের কিতাব পড়বে, অন্য কোনো কিতাব পড়বে না।’
১৪) আল্লাহর জিকির করে কিছুই অর্জন হয় না। তিনি বলেন, ‘সকাল সকাল কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করা এবং নফল নামাজ পড়ার একটা অর্থ বুঝে আসে। কিন্তু আল্লাহ আল্লাহ জিকির করে কী অর্জন হয়? কিছুই হয় না।’
১৫) মাওলানা সাদ তাবলিগের কাঠামোতে পরিবর্তন আনেন, যা তাবলিগের আদব ও অনেকাংশে সুন্নাহবিরোধী বলে অভিযোগ রয়েছে। যেমন যুগ যুগ ধরে তাবলিগ জামাতের যে পরামর্শসভার পদ্ধতি ছিল, যা একেবারে চূড়া থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ছিল, তা তিনি বাদ দিয়ে দেন। ধীরে ধীরে তাবলিগ জামাতে ব্যাপক বিকৃতি ঘটাতে থাকেন। যেমন—দৈনন্দিনের মেহনতের মধ্যে দাওয়াত, তালিম ও ইসতিকবাল (পরবর্তী সময় নাম রাখা হয় ‘মসজিদ আবাদির মেহনত’) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে উমুমি গাশতের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে; অথচ এই উমুমি গাশতই ছিল তাবলিগের মেরুদণ্ড। এর ফলে এই মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। সমাজের বিশেষ লোকদের মধ্যে মেহনত করাকে ‘তবাকাতি মেহনত’ নাম দিয়ে এই মেহনতের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ফলে উম্মতের বিশেষ শ্রেণি এই মেহনত থেকে মাহরুম হয়ে যায়। মাসতুরাতের তালিমের মধ্যে পাঁচটি বিষয় যুক্ত করা হয়। বিদেশি দেশগুলোতে চার মাসের পরিবর্তে পাঁচ মাসের তরতিব বানিয়ে দেওয়া হয়।
১৬) মাওলানা ইজহারুল হাসান সাহেবের ইন্তিকালের পর সাদ সাহেব নিজামুদ্দিনের কোষাগারও হাতের মুঠোয় নিয়ে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আয়-ব্যয়ের নিয়মমাফিক কোনো হিসাব-নিকাশ এখন আর তৈরি হয় না। এমনকি মজলিশে আমেলার সামনেও কোনো বিবরণী উপস্থাপন করা হয় না।
১৭) ফাজায়েলের কিতাবগুলোর তালিম বাদ দিয়ে ‘মুনতাখাব হাদিস’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। অথচ কোনো শুরাই কখনো এ কিতাবকে জামাতের সিদ্ধান্তকৃত নিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেনি। উপরন্তু এ কিতাবকে মাওলানা মুহাম্মদ ইউসুফ (রহ.)-এর ‘চয়ন-নির্বাচন’ বলা হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, এ বইয়ের হস্তলিপি বা পাণ্ডুলিপি আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। কারো সঙ্গে এ নিয়ে তিনি আলাপ-আলোচনাও করেননি!
১৮) এত কিছু করেই তিনি থেমে যাননি। তিনি বদলে দেন নামাজের কাঠামোও! নিজামুদ্দিন মসজিদের এই জায়নামাজে তাঁর পরদাদা, দাদা ও পিতা; এমনকি নানাদের মতো ব্যক্তিদের যে পদ্ধতিতে নামাজ নিজে পড়েছেন, অন্যদের পড়িয়েছেন, এখানে-সেখানে বড় দাগে পরিবর্তন করেন এভাবে যে কাওমা (রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায়) ও জলসায় (দুই সিজদার মাঝখানে বসা অবস্থায়) সেই এমন সব দোয়া পাঠ করা শুরু করে দেন, যা হানাফি মাজহাব অনুসারে ফরজ নামাজে নয়; শুধু নফল নামাজে পড়া যাবে। এমন পরিবর্তনে জামাত বিস্মিত হলেও কেউ ‘উফ’ বলার সাহস পায়নি। একজন এ ব্যাপারে কারণ জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন, ‘আমি মুহাম্মাদি। আমি সুন্নাহ অনুসরণ করি।’ এভাবেই তিনি তাবলিগ ও নামাজের কাঠামো বদলে দেন। (সূত্র: চৌধুরী আমানত উল্লাহ, সদস্য, মজলিশে আমেলা, মাদরাসায়ে কাশেফুল উলুম, বাংলাওয়ালি মসজিদ, নয়াদিল্লি; অনুবাদ : আবদুল্লাহ আল ফারুক, মাকতাবাতুল আসআদ, ঢাকা, ৫ আগস্ট ২০১৭)
উল্লেখিত অভিযোগগুলোর মধ্যে অনেক অভিযোগ অস্বীকার করে থাকেন সাদপন্থীরা। বাদবাকি অভিযোগ নিয়েও তাদের বক্তব্য হলো—দেওবন্দের ঊর্ধ্বতন আলেমগণসহ মুরুব্বিদের সঙ্গে বসে সব ভুলের সংশোধন ও নিষ্পত্তি করে নিয়েছেন।
যা-ই হোক, পরিশেষে বলতে হয়, দীনি দাওয়াতের কাজে যারা মেহনত করেন তাদের মধ্যে বিভক্তি, দ্বন্দ্ব ইসলামি শিষ্টাচার পরিপন্থী। তাই এই বিরোধ যত দ্রুত মেটানো যায় ততই মঙ্গল। ইসলামে প্রত্যেক বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা রয়েছে। সে হিসেবে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনেরও পথ খোলা আছে। অপেক্ষা শুধু কার্যকর পদক্ষেপ ও বাস্তবায়নের। কারো হস্তক্ষেপ ছাড়া আলেমরা নিজেরাই এই বিরোধ মিটিয়ে ফেলবে—এই প্রত্যাশা সকল তাবলিগ সদস্যের, সকল মুসলমানের।