গ্যাস-বিদ্যুতে ভয়াবহ ভোগান্তির আশঙ্কা

- আপডেট সময় : ০৮:৩৭:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / 20
শীত শেষে ফাল্গুনের শুরুতেই পড়ছে হালকা গরম। রাতে চালাতে হচ্ছে ফ্যান। এতেই শুরু হয়েছে লোডশেডিং। মার্চে রমজান, সঙ্গে বাড়বে গরমও। একই সঙ্গে শুরু হয়েছে সেচ মৌসুম। সব মিলিয়ে মার্চ-এপ্রিল থেকে বিদ্যুতের চাহিদা দেড় গুণ হবে। খাত-সংশ্লিষ্টদের মতে, এই বাড়তি চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হবে বিদ্যুৎ বিভাগকে। অর্থ সংকটে চাহিদা অনুসারে জ্বালানি সরবরাহ সম্ভব হবে না। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবার গরমে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি থাকবে বিদ্যুতের। যদিও বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, লোডশেডিং হবে দেড় হাজার মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে এবার ভয়াবহ লোডশেডিং ও ভোগান্তির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে রমজানে ও সেচ মৌসুমে সংকট ঠেকিয়ে রাখা যাবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ বছর গ্রীষ্মকালে ১৮ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে।
কিন্তু এখন খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া বিদ্যুতের বকেয়া বিলের পরিমাণ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে খুব বেশি কমেনি। বিল না পাওয়ায় বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা প্রাথমিক জ্বালানি ফার্নেস অয়েল ও কয়লা আমদানিতে হোঁচট খাচ্ছে। অর্থ সংকটে রয়েছে গ্যাস খাতও। বকেয়া ও ডলার সংকটে এলএনজি আমদানি ব্যাহত হতে পারে। দেশীয় উৎস থেকেও গ্যাসের জোগান কমছে। ফলে এবার গরমে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
শুরু হয়েছে লোডশেডিং
গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, গত সোমবার রাত ৯টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ১৭০ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয়েছে ১০২ মেগাওয়াট। এখন দিন দিন তা বাড়ছেই।
বিদ্যুৎ সরবরাহ সক্ষমতা
বর্তমানে দেশে বিদ্যুতের প্রকৃত উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াটের মতো। এর মধ্যে ৫৮টি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা উৎপাদনের ৪৪ শতাংশ তথা ১২ হাজার মেগাওয়াট। সাতটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ২৬ শতাংশ তথা সাত হাজার মেগাওয়াট সরবরাহ করে। ফার্নেস অয়েল থেকে পাওয়া যাবে সাড়ে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। ভারত থেকে আমদানি করা হয় ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। এ ছাড়া সৌর-জলবায়ু থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে।
গরমে চাহিদা
পিডিবি জানিয়েছে, গরমে বিদ্যুতের চাহিদা হবে ১৮ হাজার ২৩২ মেগাওয়াট। এই চাহিদা মেটাতে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৬ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, কয়লা থেকে ৫ হাজার ৫৫৮ মেগাওয়াট, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্র থেকে ৪ হাজার ১৪৯ মেগাওয়াট এবং বিদ্যুৎ আমদানি করে ২ হাজার ১২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, যদি চাহিদা অনুসারে জ্বালানি মেলে। কিন্তু বাস্তবে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদনের সম্ভাবনা কম।
জ্বালানি চাহিদা
রমজান ও গরমে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন দেড় লাখ টন ফার্নেস অয়েল ও ১৫-১৬ হাজার টন ডিজেল। দৈনিক কয়লার চাহিদা ৪০ হাজার টন। বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে দিনে ১৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে সরবরাহ পাচ্ছে ৯০ থেকে ৯২ কোটি ঘনফুট। রমজানে মার্চে এটি ১৩০ কোটি ঘনফুটে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে পেট্রোবাংলা। এপ্রিল থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে দেওয়া হবে। এ জন্য স্পট মার্কেট থেকে বাড়তি এলএনজি আনতে চায় সরকার। গত বছর বিদ্যুৎ খাতে গড়ে ১১০-১১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস দিয়েছিল পেট্রোবাংলা। মার্চের জন্য ২ দশমিক ৫ থেকে ৩ লাখ টন কয়লা আমদানির নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।
বকেয়ায় আটকা জ্বালানি
অর্থ সংকটে কয়লা, ফার্নেস অয়েল ও গ্যাস আমদানি ব্যাহত হওয়ায় গত বছর গরম মৌসুমে বিভিন্ন সময় পায়রা, রামপাল, এস আলমসহ অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ ছিল। এ কারণে লোডশেডিং বেড়ে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে দেশজুড়ে তালিকা করে লোডশেডিং দিয়েছিল সরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বকেয়া বিল ফের বাড়ছে। কোম্পানিগুলোর পাওনা ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কোম্পানিগুলো দ্রুত পাওনা পরিশোধে সরকারকে তাগাদা দিচ্ছে। সময়মতো পাওনা অর্থ না পেলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ বিঘ্নিত হতে পারে বলে সতর্ক করে তারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগে চিঠি দিয়েছে। এতে রমজান ও গ্রীষ্মে গ্যাস-বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
বিদ্যুৎ কেনা বাবদ ৩১ হাজার কোটি টাকার বেশি পাওনা জমেছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান রেজাউল করিম। এই বকেয়া ভারতের আদানির বিল ৯ হাজার থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়াই।
ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া ১০ হাজার কোটি টাকা। এসব কেন্দ্রের মালিকরা জানুয়ারিতেই অন্তত পাঁচ হাজার কোটি টাকা চেয়েছিলেন। তা তাদের দেওয়া হয়নি। ফলে রমজান ও গরমে চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের একজন মালিক। নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, এখন তিন হাজার মেগাওয়াটের মতো ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে হচ্ছে। গরমে তা আরও বাড়াতে হবে। কিন্তু সরকার টাকা দিচ্ছে না। তারা চাইলে দেশীয় মালিকদের বন্ড ইস্যু করতে পারত, সেটিও করছে না। টাকা না পাওয়ায় সময়মতো এলসি খোলা যাচ্ছে না। ফার্নেস অয়েল আমদানি ব্যাহত হলে গরমে তেলচালিত কেন্দ্রের কমপক্ষে আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বিঘ্নিত হবে।
ওই মালিক আরও বলেন, আমাদের ফার্নেস অয়েল আমদানির সার্ভিস চার্জ ছিল ৯ শতাংশ। এলসি খুলে তেল এনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে বিল জমা দেওয়া পর্যন্ত ১২২ দিন সময় লাগে। এতে চার্জ বেড়ে ৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ হয়। কিন্তু পিডিবি বিল দিতে ২২০ দিন পর্যন্ত সময় নেয়। ফলে সার্ভিস চার্জ ১২-১৩ শতাংশে পৌঁছায়। বাড়তি এই চার্জ না দিয়ে সরকার বরং চার্জ ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছে। ফলে অনেকেই নিজে তেল আনতে চাইবে না; বিপিসির দিকে তাকিয়ে থাকবে। এত বিপুল ফার্নেস অয়েল আমদানির সক্ষমতা বিপিসির নেই। ফলে এবার গরমে তীব্র লোডশেডিং হবে বলে আশঙ্কা হচ্ছে।
শহরে ও গ্রামে সমান লোডশেডিং
বিগত দিনগুলোতে গ্রামে ভয়াবহ লোডশেডিং হলেও শহরবাসী বেশি সুবিধা ভোগ করত। নগরে খুব বেশি লোডশেডিং দেওয়া হতো না। কিন্তু এবার তেমনটি হবে না। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা এ বিষয়ে বলেছেন, এবার গরমে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হতে পারে। শহর ও গ্রামে সমান হারে এই লোডশেডিং বণ্টন করে দেওয়া হবে। বৈষম্য করা হবে না।
সংকট থাকবে গ্যাসেও
রমজান ও গরমে বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাসও ভোগাবে গ্রাহককে, বিশেষ করে আবাসিকে। সূত্র জানিয়েছে, দিনে গ্যাসের চাহিদা ৪২০ কোটি ঘনফুট। ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে মোটামুটি চাহিদা মেটানো যায়। এখন সরবরাহ হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৬৫ কোটি ঘনফুট। রমজান মাসে ও গরমে এটি বেড়ে ২৮০ থেকে ২৮৫ কোটি ঘনফুট হতে পারে। কারণ, এলএনজি আমদানি বাড়ানো হবে। তার পরও দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমে যাওয়ায় রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে সংকট থাকবে। গত ১৫ দিনে চার কোটি ঘনফুট উৎপাদন কমেছে। রমজান ও গরমে বাড়তি গ্যাসের পুরোটাই চলে যাবে বিদ্যুৎ খাতে। শিল্প ও আবাসিকে সংকট বাড়বে।
সাশ্রয়ে জোর দিতে চায় সরকার
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছেন, দেশের কুলিং লোড (এসি) প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট। এসির তাপমাত্রা ২৫-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নির্ধারণ করলে কমপক্ষে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব। তাই এসি ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ বিভিন্ন খাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্দেশনা দেবে। বাণিজ্য উপদেষ্টা বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে জানাবেন, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা মসজিদের ইমামদের অনুরোধ করবেন এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব সচিবালয়সহ অন্য সরকারি দপ্তরগুলোতে এ নীতি কার্যকর করবেন।
যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা
বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপ্পা) সভাপতি কে এম রেজাউল হাসনাত সমকালকে বলেন, সরকারে অর্থ সংকট চলছে, সেটি সবাই জানে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের হাত-পা বাঁধা। অর্থ না পেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব নয়, যা গরমে প্রভাব ফেলবে।
বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন ও এলএনজি সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর বকেয়া প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি তেল কোম্পানিগুলো বিপিসির কাছে পাবে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। এলএনজি সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো বকেয়া না পেলে এলএনজি সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, বকেয়ার কারণে গত বছর বিপাকে পড়েছিল জ্বালানি খাত। কয়লা, এলএনজি, তেলসহ দেশের জ্বালানি খাত আমদানিনির্ভর। সময়মতো অর্থছাড় না হলে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি মিলবে না। এতে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সংকট হবে। কারণ, এলসি খোলা সাপেক্ষে দেশে জ্বালানি পৌঁছাতে ১৫ থেকে ৪৫ দিন লাগে। এলসি খুলতে যত দেরি হবে, জ্বালানি পৌঁছাতে তত বেশি সময় লাগবে। সময়মতো জ্বালানি আমদানি করা না গেলে সেচ ও গরমের ভরা মৌসুমে দেশে লোডশেডিং ব্যাপক হারে বেড়ে যেতে পারে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, সরকার আর্থিক সংকটে রয়েছে। ফলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি আমদানির অর্থ পরিশোধে সমস্যা হচ্ছে। এ জন্য সরকার বৈদেশিক মুদ্রা প্রদানের মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সহযোগিতা নিচ্ছে। এ বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টার নেতৃত্বে একটি কমিটি কাজ করছে।