ঘোষণা দিয়ে হামলা, ঠেকান গেল না কেন?
- আপডেট সময় : ১২:৫৫:৩১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪ ৩৬ বার পড়া হয়েছে
আগের দিন প্রচারণা চলল ‘সুপার সানডে’ এর; পরদিন এর পাল্টায় এল ‘মেগা মানডে’। অনেক দূর থেকে দল দলে গিয়ে শিক্ষার্থীরা একে অপরের কলেজে হামলা চালিয়ে একে অপরকে রক্তাক্ত করেছে, আতঙ্ক ছড়িয়েছে চারপাশে।
আগের দিনের ঘোষণা ছিল ‘সুপার সানডে’; পরদিন এর পাল্টায় এল ‘মেগা মানডে’। শত শত শিক্ষার্থী এমন ‘ট্যাগ লাইনের’ কর্মসূচি নিয়েই হাজির হল প্রতিপক্ষের কলেজ প্রাঙ্গণে, যা এক পর্যায়ে রূপ নেয় তীব্র সংঘর্ষে।
অথচ সংঘাতে জড়ানো শিক্ষার্থীদের কলেজগুলোর একটি রাজধানীর এক প্রান্ত ডেমরায় অবস্থিত। অন্য দুটি নগরীর কেন্দ্রস্থল পুরান ঢাকার। মাঝের দূরত্ব প্রায় সাত কিলোমিটার। আগের রাতে ঘোষণা দিয়ে এত দূর থেকে দল দলে গিয়ে শিক্ষার্থীরা একে অপরের কলেজে হামলা চালিয়ে একে অপরকে রক্তাক্ত করেছে, আতঙ্ক ছড়িয়েছে চারপাশে।
সড়কে সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ থাকায় দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। যানবাহনসহ ভাঙচুর করা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সরঞ্জাম। কিশোর-তরুণদের মারামারির রক্ত ঝরানো ছবি আর ভিডিও উদ্বেগ ছড়িয়েছে।
এসব কারণে প্রশ্ন উঠেছে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে তথ্য জানা থাকার পরও কেন থামনো গেল না এমন অপ্রীকিতর এমন ঘটনা। এজন্য পুলিশের কার্যকর পদক্ষেপ না থাকাসহ বেশ কিছু বিষয় সামনে এনেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সবকিছু জানার পরও সেটি ঠেকাতে না পারায় পুলিশের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ‘গাফিলতি’ দেখছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা।
এ ধরনের ঘটনায় জনমনে আস্থা কমে যায় মন্তব্য করে পুলিশের এই সাবেকপ্রধান বলেন, “পুলিশের কাছে গোয়েন্দা তথ্য থাকার কথা। তারপরও ঘোষণা দিয়েই যদি হামলা করা হয় তাহলে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ ছিল, সে সুযোগটা ছিল। কিন্তু মনে হয়েছে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।”
পুলিশ প্রশাসনের পাশাপাশি ঘোষণা দেওয়া কলেজগুলোর কর্তৃপক্ষ কেন ব্যবস্থা নেয়নি এমন সমালোচনার মধ্যে “এ ধরনের ঘটনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকদের অসহায়ত্বের’’ বিষয়টিকে সামনে এনেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন ও রিসার্চের অধ্যাপক মো. ফজলুর রহমান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আসলে এমন একটা পর্যায়ে যখন শিক্ষার্থীরা আবেগপ্রবণ হয়ে যায় তখন শিক্ষকদের করার কিছু থাকে না। আমরা অনাকাঙ্খিত কোনো ঘটনার সম্মুখীন হলে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাই। বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো ফোর্স নেই এ ধরনের পরিস্থিতি সামলানোর।”
আর কলেজে হামলার ঘটনায় পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়’ ভূমিকা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া পুলিশের সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরেন।
সন্ধ্যায় ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ বলেন, “পুলিশ শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারত।
”পুলিশের দিক থেকে দুর্বলতা থাকলে সেটাও আমরা চিহ্নিত করার চেষ্টা করছি।”
আসিফের বক্তব্যও ছিল প্রায় একই ধরনের। তিনি বলেন, “পুলিশ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চায়নি।”
ঘটনার শুরু কোথায়
মাহবুবুর রহমান কলেজের অভিজিৎ হালদার নামে এক শিক্ষার্থীর ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ ছিল কলেজটি শিক্ষার্থীরা। ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে রোববার হাসপাতালটি ঘেরাওয়ে আসে তারা। খবরে এসেছে ছাত্রদের এ জোটে ৩৫ কলেজের শিক্ষার্থীরা যোগ দিয়েছিলেন।
এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পাশের সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ‘ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার’ ঘটনা ঘটে। এরমধ্যেই সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় মাহবুবুর রহমান কলেজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
তারা কলেজের অফিসকক্ষ থেকে কম্পিউটার লুটপাট ও ভাঙচুর করে। অনেককে হাতে করে ল্যাপটপসহ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে যেতে দেখা গেছে ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে।
শ্রেণিকক্ষে ঢুকে চেয়ারটেবিল, ফ্যান সবকিছু ভাংচুর, একটি মাইক্রোবাস, একটি প্রাইভেট কার ও দুটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে হামলাকারী শিক্ষার্থীদের উল্লাস করতেও দেখা গেছে।
‘অতর্কিত’ এ হামলার ‘প্রতিশোধ নিতে’ রাতেই ফেইসবুকে ‘মেগা মানডে’ ঘোষণা দিয়ে সোমবার ডেমরার মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলার প্রচারণা চালাতে থাকেন সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুলসহ তাদের ‘জোটভুক্ত’ সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা।
জোটবদ্ধ হয়ে তারা নগর থেকে দূরে ডেমরায় অবস্থিত মোল্লা কলেজের দিকে যান। পুলিশের বাধা টপকে সোমবার বেলা ১২টার দিকে ঢুকে পড়েন কলেজের ভবনে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে হামলা, ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়।
এসময় দুই পক্ষের সংঘর্ষে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
পরপর দুই দিনের এ ঘটনার বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বলছে, ৩৫টি বিভিন্ন কলেজ শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ (ইউসিবি) নামে ফেইসবুকে একটি ফোরাম সক্রিয় রয়েছে। অপরদিকে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ ও সরকারি কবি নজরুল কলেজ মিলে সাত কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের একটি জোট রয়েছে।
পরপর দুইদিনের হামলাতেই সংশ্লিষ্ট কলেজ ছাড়াও তাদের জোটভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছে, বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এমনটিই দাবি করেছে পুলিশ।
মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ সামীর বলেন, “আমাদের এক থেকে ১২ তলা পর্যন্ত সব ধ্বংস করে দিয়েছে, আগুন লাগানো হয়েছে। আমাদের কোটি টাকার উপরে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।”
“এমন হামলার আশঙ্কায় গতকাল রাত থেকে আমাদের চেয়ারম্যান প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে, প্রশাসন সহযোগিতা করলে আজ এমন হত না।“
হামলার ঘটনায় তাদের কলেজেরই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
কলেজটির অধ্যক্ষ ওবায়দুল্লাহ নয়ন বলেন, “গতরাতেই (রোববার) আমরা জানতে পারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্ররা আমাদের কলেজটি গুড়িয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তারা কলেজের ইট পর্যন্ত খুলে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। বাস্তবিক অর্থেই আজ তারা সেটা ঘটিয়েছে। আমরা পুলিশকে জানিয়েছিলাম, কিন্তু তাতে কী হল?”
মোল্লা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাতুল সরকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফেইসবুকে ঘোষণা দিয়েছিল তারা, এটা সবাই জানে। তারা হামলা করলে আমরা পুলিশকে আসতে বলি ৯৯৯-এ কল দিয়ে। পুলিশ এসেছে অনেক পরে।”
সেনাবাহিনীও আড়াইটার পর ঘটনাস্থলে গিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “অল্প কয়েকজন পুলিশ ছিল প্রথমে। তারা হামলার শুরুতে দূরে সরে যায়। সেনাবাহিনী ও পুলিশ আগে আসলে কোনো ক্ষতি হত না।”
আরেক শিক্ষার্থী আব্দুল হাই শিকদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হামলা করতে আসারা তো অনেক বড়। কারও কারও আইডি কার্ড ছিল গলায়। বাকিদের ছিল না। তারা হামলা করে আমাদের কলেজ ভাঙছে। কিছু রাখে নাই। উপর থেকে ফেলে দিয়েছে সব।”
অনেকটা পাল্টা বক্তব্যে সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী তুহিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকালকে (রোববার) মোল্লা কলেজের নেতৃত্বে ঢাকার বেশ কয়েকটি কলেজ একত্রিত হয়ে কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনায় সোহরাওয়ার্দী কলেজের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেছে।
“আমরা গতকাল রাত থেকে আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত প্রশাসনকে সময় দিয়েছিলাম এ ঘটনার সুষ্ঠু একটা সমাধান করার জন্য। কিন্তু আমাদের দেওয়া সময়ের ভেতর তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তারা। তাই আজ সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে আমরা দুইটি কলেজের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে সেখানে গেলে তারা আমাদের ওপর হামলা চালায়।”
তার দাবি, “আমাদের কিছু শিক্ষার্থী তাদের ধাওয়া করে মোল্লা কলেজের দ্বিতীয় তলায় উঠলে তারা আমাদের অনেক শিক্ষার্থীদের অবরুদ্ধ করে রাখে। রুমের ভেতর তাদের ওপর নারকীয় তাণ্ডব চালায়।”
সোহরাওয়ার্দী কলেজের আরেক শিক্ষার্থী ফাহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সুষ্ঠু বিচারের দাবি নিয়ে সেখানে গেলে- তাদের পোলাপান প্রস্তুত ছিল আমাদের ওপর হামলা করার জন্য। আমদের বেশ কিছু শিক্ষার্থী সেখানে অবরুদ্ধ হলে আহতদের নিয়ে আমরা ক্যাম্পাসে চলে আসি।”
ঠেকাতে পারল না কেন পুলিশ?
কেন এই ব্যর্থতা জানতে চাইলে পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার সালেহ উদ্দিন বলেন, “পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী কয়েকটি কলেজের কয়েক হাজার শিক্ষার্থীরা লাঠিসোটা নিয়ে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের দিকে আসছিল। আমরা যাত্রাবাড়ী মোড়ে সীমিত ফোর্স নিয়ে তাদের ইন্টারসেপ্ট করতে ব্যর্থ হই। তারা আমাদের ওভারকাম করে কলেজের দিকে চলে আসে।
“আমাদের কাছে যে গোয়েন্দা তথ্য আছে তাতে আমাদের মনে হয়েছে, একটা স্বার্থান্বেষী মহল ছাত্রদের সঙ্গে মিশে বিশেষ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই কলেজটিতে এভাবে ভাঙচুর ও হামলা চালিয়েছে।”
আগে তথ্য থাকার পরেও পুলিশ কেন তাদের আটকাতে পারল না জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের পুলিশ ফোর্স ছিল সীমিত, আর তারা ছিল সংখ্যায় ১৫ থেকে ২০ হাজার। যারা ছাত্র এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষের বেশে আসছে।”
‘পুলিশ ডেকেও পাওয়া যায়নি’ শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “৫ অগাস্টের ঘটনায় পুলিশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বিশেষ করে ওয়ারী বিভাগ ও যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায়। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আর এখন ঢাকা শহরে নানা ঘটনা ঘটছে। এক জায়গায় সব ফোর্স ডেপ্লয় করলে অন্য জায়গা গুলোতে সমস্যা দেখা যায়।”
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা পুলিশের বর্তমান সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে বলেন, ”বর্তমানে পুলিশ যে পরিস্থিতিতে আছে হার্ড অ্যাকশনে যাওয়াও ঠিক না। আবার যেহেতু ছাত্রদের ব্যাপার সেখানে অন্যান্য শ্রেণির তুলনায় পুলিশকে হার্ড অ্যাকশনের যেতেও চিন্তা করতে হয়।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন ও রিসার্চের অধ্যাপক মো. ফজলুর রহমান বলেন, “বর্তমানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অস্থির। সরকারের উচিত এ বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখা। তা না হলে শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। কারণ একটি শিক্ষার্থী আহত হলে তার শিক্ষা জীবনে তার প্রভাব পরে। আর কোন শিক্ষার্থীর প্রাণহানী কোনো শিক্ষক চান না।”
‘মেগা মানডের’ জমায়েত
সোমবার বেলা ১১টার দিকে সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও নজরুল কলেজের প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষার্থী সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও বাহাদুর শাহ পার্কে জড়ো হয়ে ডেমরার মোল্লা কলেজের দিকে এগোতে থাকে।
আগে থেকে পুলিশ ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনে অবস্থান করলেও ‘পুলিশি বাধা’ প্রতিহত করে লাঠিসোঠাসহ তারা সাত কিলোমিটার দূরে তাদের লক্ষ্যের দিকে রওনা দেয়।
যাত্রাবাড়ী মোড়ে আরেক দফা পুলিশ বাধা দিলেও তারা ঠেকাতে পারেনি। সেই বাধা পেরিয়ে মূল সড়ক ধরে তারা বেলা ১২টার দিকে মোল্লা কলেজে পৌঁছে যায়। পরে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়।
এমন ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, “গতকাল (রোববার) সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুলে ভাঙচুরের পর থেকেই তারা ফেইসবুকে নিজেদের ক্লোজ গ্রুপে আজকে হামলার বিষয়ে আলোচনা করে প্রস্তুতি নেয়। সে অনুযায়ী আজকে একটা হামলা হতে পারে বলে আমাদের কাছে অগ্রিম ইন্টেলিজেন্স ছিল।”
আগাম তথ্য ও আশঙ্কা অনুযায়ী পুলিশের লালবাগ বিভাগের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনে ও যাত্রাবাড়ী মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এত বেশি পরিমাণে ছিল যে তাদেরকে আটকানোর মত পুলিশের যথেষ্ট জনবল ছিল না।
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, “যাত্রাবাড়ী মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে প্রায় হাজারখানেক ফোর্স অবস্থান করছিল। আমরা ভেবেছিলাম, শিক্ষার্থীরা আসলে হয়ত তাদেরকে বুঝিয়ে আটকে দেওয়া সম্ভব হবে। তাতে কাজ না হওয়ায় তারা জোর করলে আর আটকে রাখা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়নি।”
তাৎক্ষনিকভাবে ডিএমপির কন্ট্রোল রুমে এমন পরিস্থিতি জানালে ডিএমপি ও ঢাকা জেলা পুলিশ থেকে আরও ফোর্স পাঠানো হয়। সবমিলে পুলিশের প্রায় চার হাজার ফোর্স ও সেনাবাহিনী মিলে ঘটনাস্থলের দিকে যেতে অনেকটা সময় লেগে যায়, ততক্ষণে ঘটনা ঘটে যায়।
ছাত্রদের সঙ্গে বহিরাগত কেউ ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তারা এত বেশি সংখ্যায় ছিল, এরমধ্যে ছাত্র নাকি বহিরাগত স্ক্যানিং করা সম্ভব ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গতকালের হামলার প্রতিশোধ নেওয়া। যে কারণেই আজকের ঘটনাটি ঘটল।”
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
গত ১৬ নভেম্বর ডেমরার মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদার ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ নভেম্বর তার মৃত্যু হয়।
সেদিন রাতে তার পরিবার ও কলেজের কিছু শিক্ষার্থী ‘ভুল চিকিৎসার’ অভিযোগ এনে হাসপাতালে ভাঙচুর চালায়। ২০ নভেম্বর আবারও মোল্লা কলেজের পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী হাসপাতালটিতে এসে ভাঙচুর চালায়।
এক পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেদিন হাসপাতালের পরিচালক চারজন চিকিৎসক ও দুইজন শিক্ষার্থীসহ অভিজিতের চিকিৎসা সংক্রান্তে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখান করে।
এমন ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ‘ভুল চিকিৎসার’ অভিযোগ ও এর জেরে ভাঙচুরের বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করবে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।
ওই মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে ২০ নভেম্বর সন্ধ্যার পর স্থানীয় সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে আসে। এ সময় মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা তা না মানায় উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে সোহরাওয়ার্দী কলেজের দুই ছাত্র আহত হয়। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
এর জেরে চার দিন পর মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের ‘সুপার সানডে’ ঘোষণা আসে।
পুলিশ যা বলছে
অভিজিতের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ৩৫ কলেজের ফোরাম এবং সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘উত্তেজনা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও পরস্পরের প্রতি ঘৃণার মনোভাব’ থেকেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলে সোমবার পুলিশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলো হয়েছে।
ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমানের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পুলিশ যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য অতিরিক্ত বল প্রয়োগ থেকে বিরত থাকে। পরিস্থিতি ভিন্নখাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় পুলিশ শান্তিপূর্ণভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তারপরেও ‘উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা’ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং হামলা ও লুটতরাজে জড়ায়।
রোববারের ঘটনায় মামলা
হাসপাতাল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলার ঘটনায় মোল্লা কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের আট হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে সূত্রাপুর থানার এসআই এ কে এম হাসান মাহমুদুল কবীর।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, হঠাৎ দেশি অস্ত্রশস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা, পুলিশের কাজে বাধা সৃষ্টি এবং আর্মার্ড পুলিশ কার ভাঙচুর করে ক্ষতিসাধণ করা হয়েছে।
এসময় ঢাকার লালবাগ ডিসি অফিসের কনস্টেবল মো. আশরাফুল ইসলামের নামে থাকা পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগও করা হয়েছে।
নিহত নিয়ে ‘ভুল তথ্য’ মোল্লা কলেজের
সংঘাতে মোল্লা কলেজের তিন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে বলে দাবি করেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ সামীর।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “এ হামলায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ এবং ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্র নামধারী ব্যক্তি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের মদদে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। হামলাকারীদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী নয়, বরং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত ব্যক্তিবর্গ।”
তবে প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে ভুলবসত মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে রাতে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা পরে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হতে না পেরে সংশোধিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। এখনও কারও মৃত্যু না হলেও শতাধিক শিক্ষার্থী বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।”
পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সোমবারের সংঘর্ষে প্রায় ২৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উল্লিখিত ঘটনায় নিহত হয়েছেন মর্মে অপপ্রচার চালনো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সকলকে এরূপ অপপ্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ।
যা বলছে সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজ কর্তৃপক্ষ
সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক কাকলী মুখোপাধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির খবর জানতে পেরে আমরা সোমবার কলেজ বন্ধ ঘোষণা করেছিলাম। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কর্মসূচির বিষয়ে জানতে পেরে কলেজে এসেছে।”
শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচির খবর ছড়িয়ে পড়লে সোমবার সব ক্লাস স্থগিত করে ঢাকা কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী কলেজ। তবে খোলা ছিল কবি নজরুল সরকারি কলেজ।
কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রোববার আমাদের কলেজে হামলা হওয়ার পর আমরা দফায় দফায় আমাদের ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা আশ্বস্ত করেছিল যে তারা কোনো হামলা ভাঙচুর করবে না।”
“আমাদের বিশ্বাস আমাদের ছাত্ররা যায়নি। স্থানীয় কেউ কেউ হয়তো গিয়েছে। আমাদের বহু শিক্ষার্থী আহত। আমরা তাদের চিকিৎসার নিয়ে চিন্তিত।”
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলমান উত্তেজনা প্রশমনে তিন কলেজের অধ্যক্ষকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বৈঠকে বসার আমন্ত্রণে রাজি হননি সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজের দুই অধ্যক্ষ।
কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহম্মদ হাবিবুর রহমান বলেছেন, এমন তাণ্ডবের পর বিচার না হওয়া পর্যন্ত বৈঠকে বসতে রাজি নন তিনি।
আর শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে’ কোনো আলোচনায় যেতে তিনিও রাজি নন।
এগুলোর সমাধান কী করে হবে: শিক্ষা উপদেষ্টা
রাজধানী ঢাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘিরে একের পর এক আন্দোলন, সংঘাত ও নৈরাজ্যের ঘটনার সমাধান নিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও এক ধরনের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন।
সোমবার পরিকল্পনা কমিশনে একনেক সভা শেষে ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এগুলোর সমাধান কী করে হবে…আমি তো একলা এগুলোর সমাধান করতে পারছি না। তবে নীতিগতভাবে যেগুলো ন্যায্য দাবি সেগুলো আমার পক্ষ থেকে ছাত্রদের কাছে আহ্বান করেছি, তোমরা তোমাদের দাবি নিয়ে আসো। যেগুলো ন্যায্য দাবি সেগুলো পূরণ করা হবে, রাস্তায় নামতে হবে না।
“কিছু কিছু আছে ন্যায্য দাবি না, এগুলো আমরা কিছুতেই মানব না। এবং সেখানে রাস্তায় বিশৃঙ্খলা করলে তাদের, রেললাইন অবরোধ করলে, রেল যাত্রীদের আক্রমণ করলে সেগুলোতে জনগণই তাদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। কাজেই সেদিক থেকে আমরা সুবিধায়ই আছি, কারণ কিছুদিন পর মানুষজনই তাদেরকে প্রতিরোধ করবেন এবং করা শুরু করেছেন।”