চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন থাকার পরও কেন ‘সেন্সর বোর্ড’
- আপডেট সময় : ০৬:৩৩:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৪৯ বার পড়া হয়েছে
চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন থাকার পরও কেন ‘সেন্সর বোর্ড’
নতুন সেন্সর বোর্ড গঠনকে ‘অবৈধ ও বেআইনি’ বলছেন ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন।
চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন থাকার পরও কেন ‘সেন্সর বোর্ড’
পাভেল রহমান
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘদিনের দাবির পর গত বছর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন পাসের মাধ্যমে ‘সেন্সর বোর্ডের’ প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
কিন্তু আইন থাকার পরও রোববার আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গঠিত সেন্সর বোর্ড ভেঙ্গে দিয়ে নতুন বোর্ড গঠন করার পর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা উঠেছে চলচ্চিত্রাঙ্গনে।
নতুন সেন্সর বোর্ডের দুইজন সদস্য চলচ্চিত্র নিমার্তা আশফাক নিপুণ এবং অভিনয়শিল্পী কাজী নওশাবা আহমেদও সার্টিফিকেশন আইনের পক্ষে কথা বলেছেন।
এমনকি আগে থেকে সেন্সর বোর্ডবিরোধী অবস্থানের কারণে নতুন বোর্ড থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন নির্মাতা নিপুণ।
রোববার রোববার সেন্সর বোর্ড পুনর্গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। যেখানে নিপুণ ও নওশাবার সঙ্গে সদস্য হিসেবে রাখা হয় নির্মাতা জাকির হোসেন রাজু, খিজির হায়াত খান, তাসমিয়া আফরিন মৌ, লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক রফিকুল আনোয়ার রাসেলকে।
পুনর্গঠিত সেন্সর বোর্ডে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চেয়ারম্যান এবং সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যানকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
নতুন সেন্সর বোর্ডের সদস্য অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা আশফাক নিপুণের অবস্থানও সার্টিফিকেশন আইনের পক্ষে। পরে অবশ্য নিপুণ সেন্সর বোর্ডের সদস্য পদ নেননি বলে জানান।
নতুন সেন্সর বোর্ডের সদস্য অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা আশফাক নিপুণের অবস্থানও সার্টিফিকেশন আইনের পক্ষে। পরে অবশ্য নিপুণ সেন্সর বোর্ডের সদস্য পদ নেননি বলে জানান।
এছাড়া পদাধিকারবলে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব, প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (চলচ্চিত্র), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন-বিএফডিসির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালক সমিতির সভাপতি বোর্ডের সদস্য হিসেবে আছেন।
এর আগে গত ১২ মে এক বছরের জন্য চলচ্চিত্র সেন্সরবোর্ড গঠন করা হয়েছিল।
নতুন সেন্সর বোর্ড অবৈধ?
আওয়ামী সরকারের সবশেষ মেয়াদে ১৯৬৩ সালের ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস অ্যাক্ট’ রহিত করে গত নভেম্বরে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩’ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
এর আগে ২৯ অক্টোবর সংসদে ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বিল, ২০২৩’ বিল পাস হয়।
বিলে বলা হয়েছে, সার্টিফিকেশনবিহীন বা বোর্ডের দেওয়া মূল্যায়ন প্রতীক দেখা যায় না এমন কোনো চলচ্চিত্র কোনো স্থানে দেখানো হলে বা দেখানোর প্ররোচনা বা সহায়তা করলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা হবে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ড।
এতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্মিত চলচ্চিত্র, আমদানি করা বিদেশি চলচ্চিত্র, বাংলাদেশি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক দেশে বা বিদেশে নির্মিত এবং যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্র জনসাধারণের মধ্যে প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে পরীক্ষণ ও সার্টিফিকেশন দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড নামে একটি বোর্ড গঠন করবে সরকার। তথ্যসচিব হবেন ১৪ সদস্যের এই বোর্ডের চেয়ারম্যান।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘদিনের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন পাস হয়েছে, ফলে সেন্সর বোর্ড এখন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা।
এ অবস্থায় নতুন সেন্সর বোর্ড গঠনকে ‘অবৈধ ও বেআইনি’ বলছেন ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন।
ওটিটির জন্য নির্মিত হলেও ‘অমীমাংসিত’ সিনেমাকে পাঠানো হয়েছিল সেন্সর বোর্ডে, যা নিয়ে সে সমালোচনা উঠেছিল।
ওটিটির জন্য নির্মিত হলেও ‘অমীমাংসিত’ সিনেমাকে পাঠানো হয়েছিল সেন্সর বোর্ডে, যা নিয়ে সে সমালোচনা উঠেছিল।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সেন্সর বোর্ড দুটি কারণে বিভ্রান্তিকর ও বেআইনি। একটি হলো, ১৯৬৩ সালের সেন্সর আইনের প্রেক্ষিতে এই বোর্ড গঠনের বৈধতা দেয়া হয়েছে, যা এখন আর কার্যকর নেই৷ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩ প্রবর্তনের সাথে সাথে ১৯৬৩ সালের ফিল্ম সেন্সর আইন অকার্যকর হয়েছে বা সেন্সর আইনের স্থলে সার্টিফিকেশন আইন কার্যকর হয়েছে৷ তাই এই বোর্ড (নতুন) গঠন আইনগত অর্থে অবৈধ ও বেআইনি হয়েছে৷
“আর অন্যটি হল, ‘সেন্সর বোর্ড’ গঠন৷ নতুন সার্টিফিকেশন আইন অনুযায়ী গঠন করতে হবে ‘সার্টিফিকেশন বোর্ড’৷ আর এই সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠনের প্রক্রিয়া সার্টিফিকেশন আইন ২০২৩ এ উল্লেখ করা আছে৷ যা নবগঠিত ‘সেন্সর বোর্ড’ গঠন প্রক্রিয়ায় অনুসৃত হয়নি৷”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বলেন, “আইন পাস হলেও বিধিমালা তৈরি না হওয়ার কারণে সার্টিফিকেশন আইনটি এখনো বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। বিধি তৈরির কাজটি দ্রুতই শেষ হবে।
“এরপর থেকে সার্টিফিকেশন আইন অনুযায়ী বোর্ড পরিচালিত হবে। তখন ‘সেন্সর বোর্ড’ আর থাকবে না।”
‘অমীমাংসিত’ সিনেমা প্রদর্শন উপযোগী নয় কোন আইনে?
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য নির্মিত ‘আমীংসিত’ সিনেমাকে সেন্সর বোর্ডে জমা দিতে বলেছিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। পরে ২৪ এপ্রিল সিনেমাটি ‘প্রদর্শন উপযোগী নয়’ বলে সিদ্ধান্তও জানিয়েছিল সেন্সর বোর্ড।
সে সময়ই প্রশ্ন ওঠে, সার্টিফিকেশন আইন কার্যকর না হলে ওটিটি প্ল্যাটফর্মের একটি সিনেমাকে কেন সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র নিতে চিঠি দেওয়া হলো?
ওটিটির জন্য নির্মিত ‘অমীমাংসিত’ সিনেমাটি প্রদর্শনের উপযোগী নয় বলে জানিয়েছিলে সেন্সর বোর্ড।
ওটিটির জন্য নির্মিত ‘অমীমাংসিত’ সিনেমাটি প্রদর্শনের উপযোগী নয় বলে জানিয়েছিলে সেন্সর বোর্ড।
সে সময় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকটমের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, “নতুন আইন অনুযায়ী, এখন থেকে যেকোনো মাধ্যমেই সিনেমা প্রদর্শন করতে গেলে সেন্সর সনদ নিতে হবে। এ কারণেই ‘অমীমাংসিত’ সিনেমাটি সেন্সর বোর্ড সদস্যরা দেখে সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন।”
হুমায়ূন কবীর ‘নতুন আইন’ বলতে সার্টিফিকেশন আইনটির কথা বলেছিলেন। তাহলে সার্টিফিকেশন আইনটি এখনও বাস্তবায়ন শুরু হয়নি কেন? প্রশ্নে সেন্সর বোর্ডের বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মো. আবদুল জলিল বলেন, “আমি দায়িত্ব নেয়ার আগের ঘটনা এটি। এ ব্যাপারে আমার জানা নেই। আমি যেটুকু জানি, সার্টিফিকেশন আইনের বিধি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ফলে এখনো সার্টিফিকেশন আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।”
আইন অনুয়ায়ী তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে থাকেন। গত বৃহস্পতিবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকারকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করেছে সরকার। ফলে সেন্সর বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে বর্তমানে কেউ নেই।
সেন্সর বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, গত ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর থেকে সেন্সর বোর্ড থেকে কোনো সিনেমাকে সেন্সর ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।
নতুন বোর্ডের সদস্যরাও চান সার্টিফিকেশন আইন
সেন্সর বোর্ড প্রথার বিরুদ্ধে নির্মাতা আশফাক নিপুণের ফেইসবুক পোস্ট।
সেন্সর বোর্ড প্রথার বিরুদ্ধে নির্মাতা আশফাক নিপুণের ফেইসবুক পোস্ট।
রোববার পুনর্গঠিত সেন্সর বোর্ডের সদস্য করা হয় চলচ্চিত্র পরিচালক আশফাক নিপুণ ও অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদকে।
সার্টিফিকেশন আইন বাস্তবায়নের দাবিতে বিভিন্ন সময় সোচ্চার থাকা এ দুজনকে পুনর্গঠিত সেন্সর বোর্ডে দেখে অনেকে ফেইসবুকে সমালোচনা করে পোস্ট দিয়েছেন। যার প্রেক্ষিতে রোববার রাতেই নিপুণ ও নওশাবা তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেন।
অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ বলেন, “সেন্সর সার্টিফিকেশন চেয়েছি, চাইবো।”
অন্যদিকে আশফাক নিপুন ফেইসবুকে লিখেছেন, “সেন্সর বোর্ড আগামী কয়েক মাসের ভেতর সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ডে রূপান্তরিত হবে বলে আমাকে জানিয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। আমি আজীবন চলচ্চিত্রে বা শিল্পে সেন্সর বোর্ড প্রথার বিরুদ্ধে।”
সেন্সর বোর্ডের অফিশিয়াল সদস্যপদ এখনো গ্রহণ করেননি জানিয়ে আশফাক নিপুন লেখেন, “আমি খুবই সম্মানিত বোধ করেছি মন্ত্রণালয় আমাকে বোর্ডের সদস্য হওয়ার যোগ্য মনে করেছেন। কিন্তু একটা মিস-কমিউনিকেশন হয়ে গেছে। আমি এই বোর্ডের অফিশিয়াল সদস্যপদ গ্রহণ করিনি। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে এই ব্যাপারে আমার কথা হয়েছে। সেন্সর বোর্ডের বাতিলের পক্ষে আমার অবস্থান সর্বদা চলমান থাকবে।”