ঢাকা ০৬:২৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৫ মার্চ ২০২৫, ২১ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে সব প্রমাণ সরকারের কাছে আছে জেলায় জেলায় সরকারি অর্থে ‘আওয়ামী পল্লি’ উপদেষ্টা পরিষদে যুক্ত হচ্ছেন সি আর আবরার উপদেষ্টা হচ্ছেন ড. আমিনুল ইসলাম পদত্যাগ করলেন নাহিদ ইসলাম বাবরের জীবন থেকে ১৭ বছর কেড়ে নেয় ‘প্রথম আলো’ সোমবার থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হবে : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা চাপমুক্ত প্রশাসন এবং ড. ইউনূসের দর্শন ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ পালনের ঘোষণা আনিসুল হকের মুক্তি চেয়ে পোস্টার দিল্লিতে গৃহবন্দী শেখ হাসিনা? গ্যাস-বিদ্যুতে ভয়াবহ ভোগান্তির আশঙ্কা ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেন প্রধান উপদেষ্টা হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত ২০ এপ্রিলের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ মোদি-হাসিনা মাইনাস: ট্রাম্পের আস্থায় এখন ড. ইউনূস! মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসি গ্যাবার্ডের বাংলাদেশ নিয়ে ভাইরাল ভিডিওর আসল ঘটনা আমি ফিরব, আমাদের শহিদদের প্রতিশোধ নেব’: শেখ হাসিনা অপরাধী হাসিনাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপে ভারত ইন্টারপোলের জালে বেনজীর হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর দাবি জোরদার হচ্ছে ভারতে!

চাপমুক্ত প্রশাসন এবং ড. ইউনূসের দর্শন

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ০৯:৪৯:০৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • / 9
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় জেলা প্রশাসক সম্মেলন। তিন দিনের ওই সম্মেলন শেষে জেলা প্রশাসকরা তাঁদের কর্মস্থল নিজ নিজ জেলায় ফিরে গেছেন। জেলায় ফিরে যাওয়ার পর তাঁদের মধ্যে এক ধরনের নির্ভার উদ্দীপ্ত মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ঢাকা থেকে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার পর তাঁরা আগের চেয়ে অনেক বেশি উদ্দীপনা নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

জেলা প্রশাসক সম্মেলনের ফল দ্রুত পেতে শুরু করেছে মানুষ। একটি সম্মেলনের পর দ্রুত মাঠ প্রশাসনে এ ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন অতীতে কখনো দেখা যায়নি। সম্মেলনের পর এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে জেলা প্রশাসনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কাজের ক্ষেত্রে তাঁরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে অনেক জায়গায় তাঁরা সমন্বয় সভা করছেন।
প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা বিরাজ করছিল তা দূর করতে তাঁরা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন। একটি সম্মেলন কিভাবে টনিকের মতো কাজ করে তার বড় প্রমাণ এই জেলা প্রশাসক সম্মেলন। জেলা প্রশাসকরা এই সম্মেলনের সবচেয়ে বড় উদ্দীপনা হিসেবে দেখছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নীতিনির্ধারণী বক্তব্যকে। জেলা প্রশাসকরা নিজেরাই বলছেন, এই প্রথম সরকারের প্রধান নির্বাহী এমনভাবে বক্তব্য দিলেন, যাতে মনে হচ্ছে যে তাঁরা সত্যিকারের একটি দিকনির্দেশনা পেয়েছেন।

জেলা প্রশাসকদের এই সম্মেলনে প্রথমেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বক্তব্যে নিজেকে প্রধান অতিথি হিসেবে অভিহিত করায় অভিমানের কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রধান অতিথি বলে আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়া হলো। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূস মূল যে বক্তব্য দেন, ওই বক্তব্যে তিনি পুরো প্রশাসনকে (মাঠ প্রশাসন থেকে প্রধান উপদেষ্টা পদ পর্যন্ত) একটি টিম হিসেবে চিহ্নিত করেন। খেলার সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেছিলেন, একটি টিমে সবাই যদি ঠিকঠাক মতো কাজ না করতে পারে, তাহলে যেমন দল ভালো করতে পারে না, তেমনি প্রশাসন যদি সমন্বিতভাবে খেলতে না পারে, প্রত্যেকের মধ্যে যদি সমন্বয় না থাকে, তাহলে প্রশাসন ঠিকমতো কাজ করে না।’
গত ৫৩ বছর প্রশাসনকে ব্যবহার করা হয়েছে দলীয় স্বার্থে।

ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রশাসনকে ব্যবহার করেছেন। প্রশাসন হয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার। আর এ কারণেই প্রশাসনের মধ্যে একটি বড় অংশ তাদের ক্যারিয়ারের জন্য এবং নানা রকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণের জন্য সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি করেছে। ফলে নৈতিকতাহীন মোসাহেবী প্রশাসন কায়েম হয়েছিল গোটা দেশে। কারণ প্রশাসনের কাছে সুস্পষ্ট একটা বার্তা শুরুতেই ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দেওয়া হতো যে, তারা যত সরকারের অনুগত হবে, তাতে তাদের পদোন্নতি হবে, ভালো পোস্টিং হবে। দলীয় আনুগত্য নির্ভর প্রশাসন যে দেশসেবা করতে পারে না, তার প্রমাণ নিকট অতীতেই রয়েছে। যে কারণে প্রশাসনে একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যে মেধা, দক্ষতা ও সৃজনশীল শক্তি রয়েছে, সেটি তারা কাজে লাগাতে পারছিলেন না। উল্টো রাজনৈতিক অভিপ্রায় বাস্তবায়নে তাদের সব সময় কাজ করতে হয়েছে। সেসব কাজ না করলে তাদের শাস্তি পেতে হয়েছে। তবে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনে যাঁরা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সেসব রিটার্নিং অফিসারদের প্রথমে ওএসডি এবং বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। দায়িত্ব পালনে অযোগ্য ও অক্ষম কর্মকর্তাদের যাঁদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পার হয়েছে, তাঁদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
অনেকের মনে প্রশ্ন, এতে প্রশাসনের দোষ কি? তারা তো সরকারের অনুগত এবং আজ্ঞাবহ হবেই! সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশনা মানার বিকল্প তো তাদের নেই! নির্বাচন পরিচালনার জন্য সরকার তাঁদের যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে, সেভাবেই তো তাঁরা কাজ করবেন। কিন্তু বাস্তবতা যে এমনটি নয়, সেটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাষ্ট্রচিন্তা ও দর্শন থেকে সুস্পষ্ট বোঝা গেল। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁদের ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কারো রক্তচক্ষুকে ভয় না পাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রশাসনের দায়িত্ব সম্পর্কে এই প্রথমবারের মতো একজন সরকারপ্রধান একটি সুবিন্যস্ত রূপরেখা উপস্থাপন করলেন।

প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী রাষ্ট্রের কর্মচারী। তিনি কোনো সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দলের না। এটি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রথমে বুঝতে হবে। জনগণের জন্য আইন অনুযায়ী যেটি করণীয় সেটাই তাঁদের করতে হবে। ‘রাতের ভোট’ করার আদেশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এটি সুস্পষ্টভাবে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীর চাকরির শর্ত ভঙ্গ। কারণ সরকারি কর্মকর্তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাঁদের বেতন-ভাতা হয়। আর এ কারণে সে সময় যেসব জেলা প্রশাসক রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁদের উচিত ছিল এ ধরনের আদেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ করা। সেটি না পারলে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার আবেদন করা। কিন্তু তাঁরা কেউ সেটি করেননি। এটি না করার কারণ, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে দেখা গেছে, প্রশাসন যেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একটি শাখায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল যেভাবে প্রশাসনকে পরিচালনা করতে চেয়েছে, প্রশাসন ঠিক সেভাবেই কাজ করেছে। পুরো প্রশাসন যেন ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়েছিল। প্রশাসনের ভেতর যাঁরা চাটুকার, তেলবাজ, দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য, তাঁরাই তাঁদের আনুগত্যের জন্য বিভিন্ন জায়গায় পদোন্নতি পেয়েছিলেন। এই অবস্থার অবসানে বাংলাদেশের জন্য দরকার হয়ে পড়ে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও দর্শন। আর সেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও দর্শনই উপস্থাপন করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এটি দেশের প্রশাসনের জন্য একটি মাইলফলক ঘটনা।

প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা প্রথম থেকে যদি মনে করেন, তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং রাষ্ট্র তাঁকে নিয়োগ দিয়েছে আইন অনুযায়ী কাজ করার জন্য, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যদি কোনো কাজ হয়, সেই কাজটি তিনি করতে বাধ্য নন। তাহলেই প্রশাসনে সুস্পষ্ট শৃঙ্খলা ফিরে আসে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বক্তব্যে চারটি দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন। যেটি আগামী সরকারগুলো এবং বাংলাদেশের প্রশাসনের জন্য একটি গাইডলাইন। বাংলাদেশের প্রশাসন যদি পরবর্তী সময়ে এই নির্দেশনা বা দর্শনটি মেনে চলে, তাহলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল্টে যাবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই চার নির্দেশনায় কী আছে? প্রথমত, প্রশাসনকে নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোনোভাবেই বলেননি, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার যা বলবে সে কাজটিই করতে হবে। তিনি বলেননি অন্তর্বর্তী সরকারের স্তুতি করতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকারের চাটুকারিতা করতে হবে। বরং তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, প্রশাসনকে নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। অর্থাৎ প্রশাসন যদি মনে করে, সরকার ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বা ভুল নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেটি সরকারের গোচরে আনা এবং ভুলটা শুধরে দেওয়ার জন্য তাঁর জায়গা থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন তিনি।

দ্বিতীয়ত, তিনি প্রশাসনকে জনবান্ধব হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের একটা দুস্তর দূরত্ব রয়েছে। জনগণ প্রশাসনের কাছে অনেক সময় সঠিক সেবা পান না। তাদের নানা রকম হয়রানি পোহাতে হয়। বিশেষ করে ভূমি, জন্ম নিবন্ধন ইত্যাদি ক্ষেত্রে জনভোগান্তির কথা সর্বজনবিদিত। এ কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থভাবে চিহ্নিত করে প্রশাসনকে জনবান্ধব হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একজন প্রশাসক বা সরকারি কর্মকর্তা যদি জনবান্ধব হন, তাহলে তিনি নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে বাধ্য। একজন কর্মকর্তা যখন জনবান্ধব হবেন তখন তিনি জনগণের মনের কথাগুলো বুঝতে পারবেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে ধারণ করতে পারবেন। জনগণ কী চাচ্ছে সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন। এই উপলব্ধি তাঁকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নির্মোহভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করবে। অর্থাৎ একজন প্রশাসক যদি জনবান্ধব হন এবং জনগণের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানে জনগণের কাছাকাছি থাকেন, তাহলে তিনি কোনো অন্যায় করতে পারেন না—এই বার্তাটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসই প্রথম জাতির সামনে উপস্থাপন করলেন।

তৃতীয়ত, ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রশাসনকে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশে যাঁরা প্রশাসন ক্যাডারে কাজ করেন, তাঁরা সবাই সৃজনশীল ও মেধাবী। বাংলাদেশে যে পরীক্ষা কাঠামোয় সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ হয়, তাতে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। অথচ সরকারি চাকরিতে গিয়ে নানা বাস্তবতায় তাঁরা তাঁদের ‘সৃজনশীলতা’ ব্যবহার করেন না। একটি ‘কেরানি কর্মের’ মধ্যে তাঁরা নিজেদের যুক্ত করেন। কিন্তু তাঁরা যদি তাঁদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করেন, তাঁরা যদি তাঁদের মেধাকে প্রশাসনিক কাজে লাগান, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। লাল ফিতার আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য থেকেও মানুষ মুক্তি পাবে। বিশেষ করে বর্তমানে উদ্ভাবনীর যুগ। আইটিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সৃজনশীলতার মাধ্যমে একদিকে যেমন জনসেবা দ্রুত দেওয়া যায়, তেমনি সমস্যা সমাধানেও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। আর এই কাজটি করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের খোলা যে বার্তা, সেই বার্তাটি টনিক হিসেবে কাজ করেছে প্রশাসন কর্মকর্তাদের মধ্যে।

চতুর্থত, ড. ইউনূস সব সিদ্ধান্তের জন্য ওপরের দিকে না তাকিয়ে সক্রিয় এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন মাঠ প্রশাসনের হাতে। অর্থাৎ ৫৩ বছর ধরে যে প্রশাসন ছিল তা ছিল খুবই কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থা। কেন্দ্র থেকে আরো নির্দিষ্ট করে বললে সচিবালয় থেকেই সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সচিবালয় থেকে যেভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, সেভাবেই একজন জেলা প্রশাসক কাজ করেন। সিদ্ধান্তের জন্য জেলা প্রশাসককে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু সেই রীতি ভেঙে দেওয়ার ডাক দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, স্থানীয় যে সমস্যা সেটি স্থানীয়ভাবেই সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে। সেটি যদি তাঁরা করতে পারেন, তাহলে একদিকে যেমন দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব হবে, অন্যদিকে মাঠ প্রশাসনের দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে।

এই চারটি নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি শুধু জেলা প্রশাসকদের নয়, পুরো প্রশাসনের জন্যই একটি নতুন কর্মকৌশল দিয়েছেন। একজন প্রশাসক যিনি জনগণের কর্মচারী, তিনি জনসেবার জন্য এই দায়িত্ব পালন করছেন। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে জনগণের বিপক্ষে কোনো রাজনৈতিক দলকে তুষ্ট করার জন্য কোনো কাজ কখনো সরকারি কর্মকর্তারা করবেন না, যদি তিনি এই পরামর্শগুলো মেনে চলেন। প্রশাসন যদি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সৃজনশীলভাবে কাজ করতে পারে, তাহলেই একটি জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে উঠতে পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই দর্শন আগামী দিনে প্রশাসনের জন্য একটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে বলে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করেন। আর এ দর্শন সত্যি সত্যি যখন বাস্তবায়িত হবে তখন একটি কার্যকর, নিরপেক্ষ ও জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে উঠবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

চাপমুক্ত প্রশাসন এবং ড. ইউনূসের দর্শন

আপডেট সময় : ০৯:৪৯:০৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় জেলা প্রশাসক সম্মেলন। তিন দিনের ওই সম্মেলন শেষে জেলা প্রশাসকরা তাঁদের কর্মস্থল নিজ নিজ জেলায় ফিরে গেছেন। জেলায় ফিরে যাওয়ার পর তাঁদের মধ্যে এক ধরনের নির্ভার উদ্দীপ্ত মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ঢাকা থেকে নিজ নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার পর তাঁরা আগের চেয়ে অনেক বেশি উদ্দীপনা নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

জেলা প্রশাসক সম্মেলনের ফল দ্রুত পেতে শুরু করেছে মানুষ। একটি সম্মেলনের পর দ্রুত মাঠ প্রশাসনে এ ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন অতীতে কখনো দেখা যায়নি। সম্মেলনের পর এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে জেলা প্রশাসনের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কাজের ক্ষেত্রে তাঁরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে অনেক জায়গায় তাঁরা সমন্বয় সভা করছেন।
প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা বিরাজ করছিল তা দূর করতে তাঁরা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন। একটি সম্মেলন কিভাবে টনিকের মতো কাজ করে তার বড় প্রমাণ এই জেলা প্রশাসক সম্মেলন। জেলা প্রশাসকরা এই সম্মেলনের সবচেয়ে বড় উদ্দীপনা হিসেবে দেখছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নীতিনির্ধারণী বক্তব্যকে। জেলা প্রশাসকরা নিজেরাই বলছেন, এই প্রথম সরকারের প্রধান নির্বাহী এমনভাবে বক্তব্য দিলেন, যাতে মনে হচ্ছে যে তাঁরা সত্যিকারের একটি দিকনির্দেশনা পেয়েছেন।

জেলা প্রশাসকদের এই সম্মেলনে প্রথমেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বক্তব্যে নিজেকে প্রধান অতিথি হিসেবে অভিহিত করায় অভিমানের কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রধান অতিথি বলে আমাকে দূরে ঠেলে দেওয়া হলো। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূস মূল যে বক্তব্য দেন, ওই বক্তব্যে তিনি পুরো প্রশাসনকে (মাঠ প্রশাসন থেকে প্রধান উপদেষ্টা পদ পর্যন্ত) একটি টিম হিসেবে চিহ্নিত করেন। খেলার সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেছিলেন, একটি টিমে সবাই যদি ঠিকঠাক মতো কাজ না করতে পারে, তাহলে যেমন দল ভালো করতে পারে না, তেমনি প্রশাসন যদি সমন্বিতভাবে খেলতে না পারে, প্রত্যেকের মধ্যে যদি সমন্বয় না থাকে, তাহলে প্রশাসন ঠিকমতো কাজ করে না।’
গত ৫৩ বছর প্রশাসনকে ব্যবহার করা হয়েছে দলীয় স্বার্থে।

ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রশাসনকে ব্যবহার করেছেন। প্রশাসন হয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার। আর এ কারণেই প্রশাসনের মধ্যে একটি বড় অংশ তাদের ক্যারিয়ারের জন্য এবং নানা রকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণের জন্য সরকারি দলের লেজুড়বৃত্তি করেছে। ফলে নৈতিকতাহীন মোসাহেবী প্রশাসন কায়েম হয়েছিল গোটা দেশে। কারণ প্রশাসনের কাছে সুস্পষ্ট একটা বার্তা শুরুতেই ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দেওয়া হতো যে, তারা যত সরকারের অনুগত হবে, তাতে তাদের পদোন্নতি হবে, ভালো পোস্টিং হবে। দলীয় আনুগত্য নির্ভর প্রশাসন যে দেশসেবা করতে পারে না, তার প্রমাণ নিকট অতীতেই রয়েছে। যে কারণে প্রশাসনে একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক প্রবণতা তৈরি হয়েছিল। প্রশাসনের কর্মকর্তাদের যে মেধা, দক্ষতা ও সৃজনশীল শক্তি রয়েছে, সেটি তারা কাজে লাগাতে পারছিলেন না। উল্টো রাজনৈতিক অভিপ্রায় বাস্তবায়নে তাদের সব সময় কাজ করতে হয়েছে। সেসব কাজ না করলে তাদের শাস্তি পেতে হয়েছে। তবে সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনে যাঁরা রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সেসব রিটার্নিং অফিসারদের প্রথমে ওএসডি এবং বেশ কয়েকজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। দায়িত্ব পালনে অযোগ্য ও অক্ষম কর্মকর্তাদের যাঁদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পার হয়েছে, তাঁদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।
অনেকের মনে প্রশ্ন, এতে প্রশাসনের দোষ কি? তারা তো সরকারের অনুগত এবং আজ্ঞাবহ হবেই! সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশনা মানার বিকল্প তো তাদের নেই! নির্বাচন পরিচালনার জন্য সরকার তাঁদের যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছে, সেভাবেই তো তাঁরা কাজ করবেন। কিন্তু বাস্তবতা যে এমনটি নয়, সেটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের রাষ্ট্রচিন্তা ও দর্শন থেকে সুস্পষ্ট বোঝা গেল। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তাঁদের ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কারো রক্তচক্ষুকে ভয় না পাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রশাসনের দায়িত্ব সম্পর্কে এই প্রথমবারের মতো একজন সরকারপ্রধান একটি সুবিন্যস্ত রূপরেখা উপস্থাপন করলেন।

প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী রাষ্ট্রের কর্মচারী। তিনি কোনো সরকার বা কোনো রাজনৈতিক দলের না। এটি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের প্রথমে বুঝতে হবে। জনগণের জন্য আইন অনুযায়ী যেটি করণীয় সেটাই তাঁদের করতে হবে। ‘রাতের ভোট’ করার আদেশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এটি সুস্পষ্টভাবে প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারীর চাকরির শর্ত ভঙ্গ। কারণ সরকারি কর্মকর্তারা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাঁদের বেতন-ভাতা হয়। আর এ কারণে সে সময় যেসব জেলা প্রশাসক রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তাঁদের উচিত ছিল এ ধরনের আদেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, প্রতিবাদ করা। সেটি না পারলে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার আবেদন করা। কিন্তু তাঁরা কেউ সেটি করেননি। এটি না করার কারণ, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে দেখা গেছে, প্রশাসন যেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একটি শাখায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল যেভাবে প্রশাসনকে পরিচালনা করতে চেয়েছে, প্রশাসন ঠিক সেভাবেই কাজ করেছে। পুরো প্রশাসন যেন ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়েছিল। প্রশাসনের ভেতর যাঁরা চাটুকার, তেলবাজ, দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য, তাঁরাই তাঁদের আনুগত্যের জন্য বিভিন্ন জায়গায় পদোন্নতি পেয়েছিলেন। এই অবস্থার অবসানে বাংলাদেশের জন্য দরকার হয়ে পড়ে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও দর্শন। আর সেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও দর্শনই উপস্থাপন করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এটি দেশের প্রশাসনের জন্য একটি মাইলফলক ঘটনা।

প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা প্রথম থেকে যদি মনে করেন, তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং রাষ্ট্র তাঁকে নিয়োগ দিয়েছে আইন অনুযায়ী কাজ করার জন্য, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে যদি কোনো কাজ হয়, সেই কাজটি তিনি করতে বাধ্য নন। তাহলেই প্রশাসনে সুস্পষ্ট শৃঙ্খলা ফিরে আসে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বক্তব্যে চারটি দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন। যেটি আগামী সরকারগুলো এবং বাংলাদেশের প্রশাসনের জন্য একটি গাইডলাইন। বাংলাদেশের প্রশাসন যদি পরবর্তী সময়ে এই নির্দেশনা বা দর্শনটি মেনে চলে, তাহলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল্টে যাবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই চার নির্দেশনায় কী আছে? প্রথমত, প্রশাসনকে নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস কোনোভাবেই বলেননি, বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার রয়েছে কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার যা বলবে সে কাজটিই করতে হবে। তিনি বলেননি অন্তর্বর্তী সরকারের স্তুতি করতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকারের চাটুকারিতা করতে হবে। বরং তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, প্রশাসনকে নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে হবে। অর্থাৎ প্রশাসন যদি মনে করে, সরকার ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বা ভুল নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সেটি সরকারের গোচরে আনা এবং ভুলটা শুধরে দেওয়ার জন্য তাঁর জায়গা থেকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন তিনি।

দ্বিতীয়ত, তিনি প্রশাসনকে জনবান্ধব হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও দেখা যাচ্ছে, প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের একটা দুস্তর দূরত্ব রয়েছে। জনগণ প্রশাসনের কাছে অনেক সময় সঠিক সেবা পান না। তাদের নানা রকম হয়রানি পোহাতে হয়। বিশেষ করে ভূমি, জন্ম নিবন্ধন ইত্যাদি ক্ষেত্রে জনভোগান্তির কথা সর্বজনবিদিত। এ কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যথার্থভাবে চিহ্নিত করে প্রশাসনকে জনবান্ধব হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। একজন প্রশাসক বা সরকারি কর্মকর্তা যদি জনবান্ধব হন, তাহলে তিনি নির্মোহ ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে বাধ্য। একজন কর্মকর্তা যখন জনবান্ধব হবেন তখন তিনি জনগণের মনের কথাগুলো বুঝতে পারবেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষাগুলোকে ধারণ করতে পারবেন। জনগণ কী চাচ্ছে সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন। এই উপলব্ধি তাঁকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নির্মোহভাবে কাজ করতে উৎসাহিত করবে। অর্থাৎ একজন প্রশাসক যদি জনবান্ধব হন এবং জনগণের সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধানে জনগণের কাছাকাছি থাকেন, তাহলে তিনি কোনো অন্যায় করতে পারেন না—এই বার্তাটি ড. মুহাম্মদ ইউনূসই প্রথম জাতির সামনে উপস্থাপন করলেন।

তৃতীয়ত, ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রশাসনকে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। বাংলাদেশে যাঁরা প্রশাসন ক্যাডারে কাজ করেন, তাঁরা সবাই সৃজনশীল ও মেধাবী। বাংলাদেশে যে পরীক্ষা কাঠামোয় সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ হয়, তাতে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। অথচ সরকারি চাকরিতে গিয়ে নানা বাস্তবতায় তাঁরা তাঁদের ‘সৃজনশীলতা’ ব্যবহার করেন না। একটি ‘কেরানি কর্মের’ মধ্যে তাঁরা নিজেদের যুক্ত করেন। কিন্তু তাঁরা যদি তাঁদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করেন, তাঁরা যদি তাঁদের মেধাকে প্রশাসনিক কাজে লাগান, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। লাল ফিতার আমলাতান্ত্রিক দৌরাত্ম্য থেকেও মানুষ মুক্তি পাবে। বিশেষ করে বর্তমানে উদ্ভাবনীর যুগ। আইটিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সৃজনশীলতার মাধ্যমে একদিকে যেমন জনসেবা দ্রুত দেওয়া যায়, তেমনি সমস্যা সমাধানেও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। আর এই কাজটি করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের খোলা যে বার্তা, সেই বার্তাটি টনিক হিসেবে কাজ করেছে প্রশাসন কর্মকর্তাদের মধ্যে।

চতুর্থত, ড. ইউনূস সব সিদ্ধান্তের জন্য ওপরের দিকে না তাকিয়ে সক্রিয় এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন মাঠ প্রশাসনের হাতে। অর্থাৎ ৫৩ বছর ধরে যে প্রশাসন ছিল তা ছিল খুবই কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থা। কেন্দ্র থেকে আরো নির্দিষ্ট করে বললে সচিবালয় থেকেই সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হয়। সচিবালয় থেকে যেভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, সেভাবেই একজন জেলা প্রশাসক কাজ করেন। সিদ্ধান্তের জন্য জেলা প্রশাসককে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু সেই রীতি ভেঙে দেওয়ার ডাক দিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, স্থানীয় যে সমস্যা সেটি স্থানীয়ভাবেই সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে। সেটি যদি তাঁরা করতে পারেন, তাহলে একদিকে যেমন দ্রুত সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব হবে, অন্যদিকে মাঠ প্রশাসনের দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে।

এই চারটি নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি শুধু জেলা প্রশাসকদের নয়, পুরো প্রশাসনের জন্যই একটি নতুন কর্মকৌশল দিয়েছেন। একজন প্রশাসক যিনি জনগণের কর্মচারী, তিনি জনসেবার জন্য এই দায়িত্ব পালন করছেন। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে জনগণের বিপক্ষে কোনো রাজনৈতিক দলকে তুষ্ট করার জন্য কোনো কাজ কখনো সরকারি কর্মকর্তারা করবেন না, যদি তিনি এই পরামর্শগুলো মেনে চলেন। প্রশাসন যদি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সৃজনশীলভাবে কাজ করতে পারে, তাহলেই একটি জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে উঠতে পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই দর্শন আগামী দিনে প্রশাসনের জন্য একটি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে বলে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করেন। আর এ দর্শন সত্যি সত্যি যখন বাস্তবায়িত হবে তখন একটি কার্যকর, নিরপেক্ষ ও জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে উঠবে।