এ ব্যাপারে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগে লোডশেডিংয়ের সময়সূচি জানালেও এখন দিনদুপুরে যে কোনো সময় আমাদের কারখানাগুলোতে লোডশেডিং হচ্ছে। আমরা এতদিন শুনে এসেছি যে বিদ্যুতে বাংলাদেশ সারপ্লাসে আছে। আমরা শুনেছি যে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানিকে হাজার হাজার কোটি টাকা আওয়ামী লীগ সরকার দিয়েছে। যদি এত টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে দেওয়াই হয় তাহলে এখন কেন বিদ্যুৎ নেই। আর বিদ্যুতে সারপ্লাস যদি থাকেই তাহলে লোডশেডিং কেন হচ্ছে। অর্থাৎ বিগত সরকার আমাদের মিথ্যা বলেছে। তিনি বলেন, আমরা পরিষ্কার বলেছি যে, আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ। এই দুটোর সমাধান যদি না হয় তাহলে বাংলাদেশের পুরো উৎপাদনশীল শিল্প ও রপ্তানিখাত ব্যাহত হবে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। রপ্তানিতে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট সমাধান করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। লোডশেডিংয়ের কারণে পোশাক কারখানার মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান না করলে আমাদের রপ্তানিখাত মুখ থুবড়ে পড়বে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কোথাও কোথাও ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। আর ঢাকায় এলাকাভেদে এখন ১৫০ থেকে ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশে গতকাল ২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়। গত কদিন গড়ে দেড় থেকে ২ হাজার মেগাওয়াটের ওপর লোডশেডিং হচ্ছে। তীব্র গরমের মধ্যে ঘন ঘন লোডশেডিং হওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে শিশু ও বয়স্কদের। যদিও গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, দেশে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগবে। সরকার বিদ্যুতের ঘাটতি মেটাতে চেষ্টা করছে। এ জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জ্বালানি, কয়লা আমদানি করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি নিশ্চিত না করেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে। সে সময় চাহিদা বিবেচনা না করে অপ্রয়োজনীয় এত বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করায় এগুলো অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়। এত বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে কোনো লাভ হয়নি। কারণ গরম বাড়লেই দেশে গত কয়েক বছর ধরে মানুষকে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় ভুগতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট। আর এখন বিদ্যুতের চাহিদা মাত্র ১৬ হাজার মেগাওয়াট। পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির তথ্যমতে, গতকাল দুপুর ১২টায় সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৫৫০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে উৎপাদন ছিল ১২ হাজার ৭২৮ মেগাওয়াট বিদ্যুতের। অর্থাৎ এ সময় বিদ্যুতের ঘাটতি বা লোডশেডিং ছিল ১ হাজার ৭২০ মেগাওয়াট। মঙ্গলবার রাত ১টায় ২ হাজার ৯৩ মেগাওয়াট লোডশেডিং দেওয়া হয়। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা যায়, গত ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৫ হাজার ৫০৪ মেগাওয়াট। আর এদিন বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল ৫২০ মেগাওয়াট। খুলনায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮১৪ মেগাওয়াট আর ঘাটতি ছিল ২১৩ মেগাওয়াট। রাজশাহীতে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট, ঘাটতি ছিল ৩৩০ মেগাওয়াট। কুমিল্লায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৪৭১ মেগাওয়াট আর ঘাটতি ছিল ২৪০ মেগাওয়াট। ময়মনসিংহে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১ হাজার ৩১৩ মেগাওয়াট, ঘাটতি ছিল ৩১০ মেগাওয়াট। সিলেটে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৮০ মেগাওয়াট আর ঘাটতি ছিল ১২০ মেগাওয়াট। রংপুরে চাহিদা ছিল ১ হাজার ৮০ মেগাওয়াট, ঘাটতি ছিল ২৪০ মেগাওয়াট। পিডিবি বলছে, ভারতের আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিল বকেয়া থাকায় আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরবরাহ কমেছে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। বেসরকারি খাতের তেলচালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেও সর্বোচ্চ চাহিদায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কারণ তারাও অনেক টাকা পাবে। এ ছাড়া কারিগরি ত্রুটির কারণে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রর উৎপাদনও বর্তমানে বন্ধ আছে। আবার সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের একটি টার্মিনাল প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে বন্ধ। এতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ কমেছে। বর্তমানে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল। এলএনজি থেকে আসে ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। সামিটের টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ থাকায় এলএনজি থেকে আসছে দিনে ৬০ কোটি ঘনফুট। এতে সব মিলে গ্যাস মিলছে দিনে ২৬০ কোটি ঘনফুট। ফলে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমেছে। আড়াই মাসে আগেও যেখানে গ্যাস দিয়ে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো, আর এখন হয় ৫ হাজার মেগাওয়াট। ঢাকার দুই বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো) কর্তৃপক্ষ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানায়, বিদ্যুৎ না পাওয়ায় গতকাল বিকাল ৫টার দিকে ডিপিডিসির এলাকাগুলোতে ২০০ মেগাওয়াট এবং ডেসকোর এলাকাগুলোতে ১৬০ মেগাওয়াট লোডশেডিং দেওয়া হয়। পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ না পাওয়ায় এই লোডশেডিং দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সূত্রে জানা যায়, গ্রামাঞ্চলে এখন গড়ে ২ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর মিরপুর, মগবাজার, গুলশান, মোহাম্মদপুর, বনশ্রী, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ যাচ্ছে। কোথাও এক থেকে দেড় ঘণ্টা আবার কোথাও ১৫ মিনিট থেকে আধা ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। মগবাজার টিএন্ডটি কলোনির এক বাসিন্দা ইকরামুল ইসলাম গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাতে তিন থেকে চারবার বিদ্যুৎ চলে যায়। আবার সকালেও বেশ কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে গেছে। গরমে ঘরের মধ্যে বেশিক্ষণ থাকা যাচ্ছে না।’
ঢাকার আশপাশের এলাকা- সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই ও গাজীপুরেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এতে এসব এলাকার শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সূত্র বলছে, বিদ্যুতের সরবরাহ কমে যাওয়ায় তারা দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছেন না। আমাদের রংপুর প্রতিনিধি জানান, সেখানে গত কয়েকদিন ধরে ঘণ্টায় ঘণ্টায় লোডশেডিং হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলে বর্তমানে ১৬ জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নর্দার্ন ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই (নেসকো)-এর চাহিদা ২ হাজার ৬০০ থেকে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সেখানে ঘাটতি ১ হাজার থেকে ৯০০ মেগাওয়াটের। রংপুর বিভাগের আট জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকো মিলে চাহিদা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। সেখানে পাওয়া গেছে ৮০০ মেগাওয়াটের কম। ঘটতি ৪০০ মেগাওয়াটের বেশি। বিদ্যুৎ না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছে দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েক কোটি গ্রাহক। নেসকো কর্তৃপক্ষ বলছে, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ কম পাওয়ায় এ সমস্যা হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের কারণে উত্তরের ১৭টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহকরাও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ঘনঘন বিদ্যুৎ যাওয়া-আসার কারণে গ্রাহকদের ক্ষোভ চরমে উঠেছে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, লোডশেডিংয়ের কারণে ফ্রিজসহ অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো বলছে, চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ অনেক কম পাওয়ায় লোডশেডিং দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, হঠাৎ করে গরম বাড়ার কারণে দেশে বিদ্যুতের চাহিদাও বেড়েছে। প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে আমাদের এফএসআরইউ (সাগরে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল) বন্ধ। এতদিন এটি বন্ধ থাকায় গ্যাস আমদানি করা যায়নি। বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যন্ত্রাংশে সমস্যা থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। সেই যন্ত্রাংশ নিয়ে আসা হবে। দুই-তিন দিনের মধ্যে এটি ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা করছি। আর আদানি কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা আরও বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য বলেছি। আমরা এর মধ্যে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালানোর চেষ্টা করছি। এর পাশপাশি নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে লোডশেডিং পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছি।