জরায়ু ক্যান্সার : কারণ, লক্ষণ এবং চিকিৎসা
- আপডেট সময় : ১১:০০:৩১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৯ নভেম্বর ২০২৪
- / 59
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৫ লাখ ৭০ হাজার নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ৩ লাখ ১০ হাজার নারী এই রোগে মারা যান। জরায়ুমুখ রোগের মধ্যে ৯০ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনাই ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার বা আইএআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর নতুন করে ৮ হাজার ২৬৮ জন নারীর শরীরে শনাক্ত হচ্ছে জরায়ুর ক্যান্সার। আর বছরে ৪ হাজার ৯৭১ জন নারী জরায়ুমুখের ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেন।
যে ভাইরাসটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে
জরায়ু ক্যান্সারে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসকে (এইচপিভি) অন্যতম কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। ১০০ এরও বেশি প্রজাতির এইচপিভি রয়েছে। এর মধ্যে দুই ধরনের হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের কারণে এই ক্যান্সার হয়ে থাকে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে, ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশের পরপরই ক্যান্সার হয় না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিউম্যান প্যাপিলোমা জীবাণু প্রবেশের পর ১৫ থেকে ২০ বছরও সময় লাগে জরায়ুমুখের ক্যান্সার হতে। এক্ষেত্রে এটি নির্ণয়ে অনেকটা সময় পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, অন্য ধরনের ক্যান্সারের তুলনায় জরায়ুমুখের ক্যান্সার খুব সহজে নির্ণয় করা যায়। তবে, জরায়ুমুখের ক্যান্সারের মুল সমস্যা হলো- এটি শেষ পর্যায়ে গেলেই শুধু ব্যথা দেখা দেয়। যা মেয়েলী সমস্যা বলে ভুল করে থাকেন বেশিরভাগ সময়ই। এমন ভুল যেন না হয়, সেজন্য লক্ষণগুলো মনে রাখা জরুরি।
জরায়ুমুখের ক্যান্সারের লক্ষণ-
জরায়ুমুখে ক্যান্সারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এই রোগ অ্যাডভান্সড স্টেজে ধরা পড়ে। প্রথমদিকে এই রোগের কোনো লক্ষণ থাকে না। এরপর যখন লক্ষণ প্রকাশ পায় তখন সেটা অ্যাডভান্সড হয়ে যায়। এ কারণে জরায়ু ক্যান্সারকে নীরব ঘাতক বলা হয়ে থাকে।
# তলপেটে ব্যথা, ব্যাক পেইন ভাপা ফুলে যাওয়া ও পায়ে পানি আসা জরায়ু ক্যান্সারের অ্যাডভান্সড স্টেজের লক্ষণ।
# নিম্ন অঙ্গের চারপাশে চাপ লাগা কিংবা ঘন ঘন মূত্র ত্যাগ করা।
# গ্যাস, বদ হজম, কোষ্ঠকাঠিন্য। হালকা খাবারের পর পেট ভর্তি লাগা, পেটে অস্বস্তি লাগা ইত্যাদি পেটের কোনো সমস্যা খুব বেশি হলে তা জরায়ু ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।
# পেটে অতিরিক্ত ব্যথা কিংবা পেট ফুলে থাকা, সঙ্গে বমি বমি ভাব কিংবা বারবার বমি হওয়া। এর ফলে খিদে কমে যায়।
# মেনোপজ হওয়ার পরও যদি কোনো নারীর রক্তক্ষরণ দেখা যায় তাহলে সেটিও জরায়ু ক্যান্সারের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ। সেক্ষেত্রে দ্রুত তাকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে।
# অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পাওয়া বা হঠাৎ করে ওজন কমে যাওয়া।
# প্রথমদিকে রোগীর সাদা স্রাব হয়। অনেক সময় গন্ধযুক্ত বা রক্ত মিশ্রিত সাদা স্রাব হয়।
# যৌন সম্পর্কের পর রক্ত বের হওয়া জরায়ু ক্যান্সারের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি লক্ষণ। এজন্য সহবাসে কারো রক্ত গেলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
# মাসিক অনিয়মিত হওয়া। দুই মাসিকের মাঝে অনিয়মিত রক্তচাপ অথবা মাসিক এত বেশি অনিয়মিত হচ্ছে যে মাসিকের তারিখ শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকিপূর্ণ বয়স ও অন্যান্য
বিশেষ করে ৫০ বছর বয়স্ক বা এর চেয়েও বেশি বয়সের নারীরা জরায়ু ক্যান্সারে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। রোগটি নীরব ঘাতক হওয়ায় অনেকেই প্রাথমিক লক্ষণগুলো বুঝতে পারেন না।
এ ছাড়া যারা কম বয়সে বাচ্চা নেয়, অনিরাপদ যৌন সঙ্গম চর্চা করে, শারীরিক সম্পর্কের জন্য যাদের একাধিক সঙ্গী থাকে, শারীরিক সম্পর্কের সময় যারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না ও যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম; এমন নারীদের ক্ষেত্রে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত বেশি হন।
সম্প্রতি সুইডেনের ক্যারোলিনক্সা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষকরা জানিয়েছেন, মানসিক সমস্যা বা স্নায়ুর সঙ্গে যুক্ত মনের রোগে আক্রান্ত নারীদেরও জরায়ুমুখে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি দ্বিগুণ। নারীদের জরায়ুমুখে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে।
১৯৪০-৯৫ সালের মধ্যে জন্মেছে এমন চল্লিশ লাখ নারীর ওপর পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এমন বহু নারীর শরীরে এই ক্যান্সারের লক্ষণ দেখা গেছে। এই রোগে আক্রান্ত নারী নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কথা মনেই রাখতে পারেন না। ব্যক্তিগত ভালো-মন্দের খেয়াল তাদের থাকে না।
জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধ
দশ বছর বয়স থেকেই জরায়ুমুখের ক্যান্সার প্রতিরোধক ভ্যাক্সিন নেওয়া যায়। একবার ক্যান্সার হয়ে গেলে ভ্যাক্সিন কোনো কাজে আসে না। তিনটি ডোজ আছে। প্রথমটির এক মাস পরে দ্বিতীয় টিকা এবং তারও পাঁচ অর্থাৎ প্রথমটির ছয় মাস পরে তৃতীয় ডোজের টিকাটি নিতে হয়। তবে, ভ্যাক্সিন এই ক্যান্সারকে শতভাগ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না।
কিন্তু রেগুলার ‘চেকআপ’ ও ‘প্যাপ স্মেয়ার’ নামে একটি টেস্ট আছে, যা জরায়ুমুখে ক্যান্সার জনিত কোনো পরিবর্তন হলে ডিটেক্ট করা সম্ভব। ‘প্যাপ স্মেয়ার’ একটি স্ক্রিনিং টেস্ট। প্রতি ৩-৫ বছরে একবার করানো ভালো। ২১ বছরের পর থেকেই করা যায়। ৪০ বছরের পর থেকে নিয়মিত করা উচিত, ৫০ এর পর থেকে বছরে একবার করালে আরও ভালো।
জরায়ুমুখের ক্যান্সারের চিকিৎসা
ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণত রোগটির স্টেজের ওপর ভিত্তি করে একেক স্টেজে একেক চিকিৎসা দেয়া হয়। সার্জারি, রেডিও এবং কেমোথেরাপি- এই তিন ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়। সাধারণ কিছু চিকিৎসা মূল চিকিৎসার পাশাপাশি দেয়া হয়। লক্ষণের ওপর নির্ভর করে ব্যথানাশক, এন্টিবায়োটিক, ব্লাড ট্রান্সফিউশন ইত্যাদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সার্জারির মধ্যে ওর্থিমস রেডিক্যাল হেইসটোরিকওমি, পিলভিক এক্সটারেশন উল্লেখযোগ্য। প্রথম এবং দ্বিতীয় স্টেজে এ সার্জারি করা হয়।
এডভান্স স্টেজ হয়ে গেলে সার্জারি করে লাভ হয় না, কারণ ক্যান্সারের বীজ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সব স্টেজেই রেডিও থেরাপি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সার্জারি করার অনেক আগেই রেডিওথেরাপি দিয়ে এর সাইজ কমিয়ে আনা হয়। কেমোথেরাপি ডাক্তার প্রয়োজন বুঝে দিয়ে থাকেন। অপারেশনের পরে নিয়মিত ফলোআপ জরুরি। তিন মাস অন্তর প্রথম এক বছর, ছয় মাস অন্তর পরের এক বছর ও এরপর এক বছর অন্তর অন্তর ফলোআপ করাতে হবে।