ঢাকা ১১:২৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৬ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা আজ ডিসির দায়িত্বে শেখ হাসিনা চাইলে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেন হাসিনাকে যেভাবে ভারত থেকে ফেরত আনা সম্ভব জ্বালানির অভাব, সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটলে তাৎক্ষণিক বিকল্প নেই বিপিডিবির ভারতের সঙ্গে চলমান কোনো প্রকল্প স্থগিত হয়নি:অর্থ উপদেষ্টা এত বিদ্যুৎকেন্দ্র, তবু কেন লোডশেডিং পোশাক কারখানার শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যে কী ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ টাকা পাচারের স্বর্গ বাংলাদেশ রাজাকার খুঁজে বার করার ভার পেলেন তাঁদেরই আইনজীবী পুলিশ সংস্কারে শিগগিরই প্রাথমিক কমিটি গঠন : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা শেখ হাসিনার বিচার সরাসরি সম্প্রচার করা হবে মেট্রোরেলের ছিদ্দিকের চুক্তি বাতিল, চলতি দায়িত্বে রউফ বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় ১৭ স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটরের নিয়োগ বাতিল রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনে জোর প্রধান উপদেষ্টার সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্রবাসী আয়ে রেকর্ড! গণঅভ্যুত্থানে নিহত ৬৩১, আহত ১৯২০০ শাহজালাল বিমানবন্দরে পরিবর্তনের হাওয়া ডিসেম্বরের মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন ডলার দেবে এডিবি: অর্থ উপদেষ্টা নিম্ন আদালতের ১৬৮ বিচারককে একযোগে বদলি

জাতীয় সংগীত: পুরোনো তর্ক, নতুন পরীক্ষা

নবনীতা তপু
  • আপডেট সময় : ১০:৫২:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ৫০২৬ বার পড়া হয়েছে
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

অন্তত তিন বার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আলাপ সরকারি পর্যায়েও হয়েছে। এখন আবার পুরোনো আলাপটিকে নতুন করে সামনে এনে আমাদের যে পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।

জাতীয় সংগীত নিয়ে একটি তর্কের শুরু হয়েছে। সুশীলদের অনেককেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটিকে ‘কুতর্ক’ আখ্যা দিয়ে এ নিয়ে কথা বলাটাই অবান্তর বলে উড়িয়ে দিতে দেখতে পাচ্ছি। ভাবখানা এই রকম কোথাকার কে কি বললেন, তা নিয়ে ভাবার কোনো দরকার নেই। এখন জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের বিদায়ের পর দেশ গঠনের কথা ভাবতে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

এ তো গেল তর্ক, বিতর্ক বা কুতর্কের একটা দিক। অন্যদিকে অনেকেই এটিকে ‘কুতর্ক’ বলে উড়িয়ে দিতে নারাজ। বরং তারা দেশ উল্টোরথে চড়ে বসেছে কিনা, এ নিয়ে বিচলিত হচ্ছেন। স্বৈরাচারবিহীন দেশে আমরা একমাস পার করে ফেলেছি। ইতিবাচক, নেতিবাচক নানামুখী কর্মকাণ্ড ঘটছে, জাতীয় সংগীতসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ‘আমরা সবাই রাজা’ স্টাইলে মতামত প্রদান চলছে। সংবাদ সম্মেলন ডেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, বাহাত্তরের সংবিধান ‘বৈধ নয়’ মন্তব্য করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করারও দাবি জানানো হচ্ছে, প্রশ্ন উঠছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়েও?

এহেন পরিস্থিতিতে জাতীয় সংগীত বদলে ফেলার আলোচনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে আমাদের। আমার মনে হয়, পুরোনো তর্ককে সামনে এনে আমাদের পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই জোর প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে। বারবার গাইতে হবে– ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে…’

এই তিনটি বিষয় নিয়ে তর্কের অবতারণা নতুন নয়। অন্তত তিন বার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আলাপ সরকারি পর্যায়েও হয়েছে বলে জানা যায় গবেষক ও সাংবাদিক হাসান শান্তনুর লেখা থেকে। এখন আবার পুরোনো আলাপটিকে নতুন করে সামনে এনে আমাদের যে পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। হাসান শান্তনুর লেখার অংশবিশেষ হুবহু উদ্ধৃত করছি এখানে–“দেশের জাতীয় সঙ্গীত বদলানোর লক্ষ্যে এ পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগ দেখা যায় তিনবার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খ. মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদে বসে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনে কমিটি গঠন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে চেয়ারম্যান করে গঠিত ওই কমিটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’, ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরি’ কবিতাকে জাতীয় সঙ্গীত করতে প্রস্তাব দেয়। ‘৭৯ সালের ৩০ এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’কে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত করতে প্রস্তাব করা হয়। মোশতাকের সরকার পাল্টা ক্যু ও জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় সেসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি। জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০১-‘০৬ সালে, চারদলের জোট সরকারের আমলে। ‘০২ সালের ১৯ মার্চ তখনকার দুই মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনে যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন। তখনের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রস্তাবটি পরে আমলে নেননি।”

বাংলাদেশ মানে, আমার কাছে, আমাদের কাছে ভালোবাসার অন্য নাম। বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মুক্তিসংগ্রাম আর ভাষার প্রতি ভালোবাসা। বাংলার মানুষ, তার চেতনা, তার নিরন্তর সংগ্রাম আর যাপিত জীবনের প্রতি ভালোবাসা। এ ভালোবাসায় বিবৃত আছে মাটি-মানুষের সম্পর্ক, ভাইয়ের-মায়ের অপত্য স্নেহের শান্তি গাথা, স্বজন-পরিজন-প্রতিজনের মন-মনন, আশা-নৈরাশ্য, ভয়-ভরসা, আত্মপ্রত্যয়-আত্মগ্লানি, সুকৃতি-দুষ্কৃতি, সংগ্রাম-পরাবশ্যতা সর্বোপরি তার দৈনন্দিন আনন্দ বেদনার কাব্য। আর বাঙালির এই স্বজাত্যবোধ ও স্বাদেশিকতার মূর্ত প্রতীক তার একান্ত নিজস্ব আবাসভূমি বাংলাদেশের হৃদয়গ্রাহী জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”। বিশ্বের যেকোনো জাতিগোষ্ঠী তার আত্মপরিচয়ের প্রধানতম অনুষঙ্গ জাতীয় সংগীত নিয়ে গর্ব অনুভব করবে, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইবে সেটাই যৌক্তিক, ন্যায়সংগত। দুর্ভাগ্যক্রমে আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতির পক্ষেই সম্ভব স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও নিজের জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া, শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সন্দিহান হওয়া, যে জাতীয় সংগীত স্বাধীনতা যুদ্ধে তার নিরন্তর আত্মত্যাগের স্মারক, যার কাঁধে রয়েছে এক সাগর রক্তের ঋণ। আজ তাই নবপ্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে বাংলার মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে অপূর্ব মেলবন্ধন সৃষ্টিকারী আমাদের জাতীয় সংগীতের স্বকীয়তা আর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের আশাতেই এ লেখার প্রয়াস পেয়েছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলোর মধ্যে অনন্যসাধারণ “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”—এর প্রথম দশ চরণ আমাদের জাতীয় সংগীত। কবিগুরুর স্বদেশ পর্যায়ের অধিকাংশ গানের মতো এ গানটিও রচিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের রেশ ধরে। যদিও বিশ শতকের প্রথমভাগে স্বদেশি আন্দোলনের উত্তাল সময়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে বাঙালি গানটিকে আত্মপ্রচারের মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তবে গানখানির পূর্ণজন্মের মূল প্রেক্ষাপট বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম।

’৪৭-এর অলীক বিভাজনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির শাসকরা তার জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালির প্রাণসঞ্জীবনী রবীন্দ্রনাথের গানের উপর কুঠারাঘাত করেছে বারবার। নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে রবীন্দ্রনাথকে। এ ঘোষণার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের অভিষেকসহ অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানে গানটি বারবার গীত হয়েছে সার্বিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। এই সিনেমায় ব্যবহৃত পাঁচটি গানের একটি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। প্রকৃতপক্ষে তারও আগে থেকে একুশের প্রভাত ফেরির অন্যতম গান হয়ে ওঠেছিল এটি। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে প্রতীকায়িত করেছিল এবং এই সিনেমায় গানটির ব্যবহার তাই মাত্রা পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২৮ জুন কুড়িগ্রামের রৌমারী ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’র ভিডিও আমাদের প্রাণে শিহরণ জাগায় এখনও।

’৬৯-এর উত্তাল গণ-অভ্যুত্থানের কাল পেরিয়ে ’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১-এ মুক্তিসংগ্রামের ব্রত নিয়ে সংগঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ’৭১-এর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ক্যান্টিনে জাতীয় সংগীত সংক্রান্ত আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্ধারণের প্রস্তাব গ্রহণ করে। জাতীয় নেতারা বিষয়টিতে সম্মতি দিলে ঢাকায় ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী জনসভায় এবং ৭ মার্চ রেসকোর্সের ঐতিহাসিক জনসভায় গানটি গীত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চের কালরাত ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুজিবনগর সরকার গানটিকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয় জাতীয় সংগীত বাজিয়ে। সেদিন থেকে গানটি বাঙালির একান্ত আপনার। তার আত্মপরিচয়ের মূলমন্ত্র। আত্মচেতনার হাতিয়ার। এক সাগররক্তের পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে পাওয়া ’৭২-এর সংবিধানে অন্তভুর্ক্তির মধ্য দিয়ে জাতীয় সংগীত পায় সুসংহত ভিত্তি।

বাঙালির ইতিহাস রোমন্থনে একথা স্পষ্ট যে, প্রকৃতির অকৃপণ হাতের অকৃত্রিম সৃষ্টি বাংলার জনভূমি। প্রকৃতি মাতা যেন নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন এ ভূমির দৃশ্যপট আর মানুষের মনন। প্রকৃতি এ জাতিকে শিখিয়েছে অকৃপণতা আর অকৃত্রিম আতিথেয়তার মন্ত্র। বারবার আক্রান্ত বাংলা জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার হয়েছে, বিভাজিত হয়েছে কিন্তু মাথা নোয়ায়নি অশুভের কাছে। বাংলার ইতিহাস তাই নিরন্তর সংগ্রাম আর নবসৃষ্টির ইতিহাস। স্বাজাত্যভিমানে গর্বিত বাঙালির প্রাণের আবেগ আর আত্মার সম্পর্ক যেন অনন্য বাঙময় হয়ে ফুটে উঠেছে তার জাতীয় সংগীতে।

জাতীয় সংগীত সবসময় একটি জাতির জাতীয় সত্তার প্রকাশ ঘটাবে, তার সৃজন, মনন তার আত্মার বৈশিষ্ট্যকে বিচ্ছুরিত করবে– এটাই স্বাভাবিক, এটাই কাম্য। জাতি হিসেবে আমরা সৌভাগ্যবান বাঙালির আত্মিক ভাবনার সঙ্গে সম্পর্কিত, ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সঙ্গে মিশে থাকা সর্বাধিক জনপ্রিয় গানটি তার জাতীয় সংগীত। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আমান আযমীর মতো অনেককেই বলতে শোনা যাচ্ছে, জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলার’ যৌক্তিকতা কতখানি? এই জাতীয় সংগীত বাংলাদেশকে ধারণ করে না। অনেকেই নানা দেশের জাতীয় সংগীতের পরিবর্তনকে উদাহরণ হিসেবে সামনে আনছেন। অন্যান্য দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে তুলনায় নামিয়ে জাতীয় সংগীতকে নিক্তি পরিমাপকে তুলে দেয়। জাতীয় সংগীতের রচয়িতার ধর্মপরিচয়কে সামনে এনে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছে! বাঙালির দুই নয়নসম রবীন্দ্র-নজরুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের তুলাদণ্ড নিয়ে দণ্ডায়মান হচ্ছে। আবার কখনো বা গানটির চরণগুলোর ক্লেদার্ত বিশ্লেষণ করে জন্মভূমির বন্দনাকে তথাকথিত মূর্তিপূজার সঙ্গে তুলনা করে নিজেদের চরম মানসিক দীনতা আর দারিদ্র্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।

এ ধরনের আলোচনা সামনে এলে অব্যক্ত যন্ত্রণা আর ঘৃণায় মন আচ্ছাদিত হয়। শুধু মনে হয় জাতি হিসেবে বাঙালি কি আত্মবিস্মৃত, আত্মপরিচয়হীন হতে চলেছে? নিজেদের ধ্বংস কি নিজেরাই ডেকে আনছে? মনে হয়; পাকিস্তানের প্রেতাত্মা কি আজও আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে? ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা তাদের শাসন নির্যাতনের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে দ্বিজাতিতত্ত্বের (নাকি দ্বিসম্প্রদায়তত্ত্ব বলব) মতো যে কুটিল সিদ্ধান্ত বঙ্গভঙ্গের নামে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল তার নীল বিষ কি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে বেড়াতেই হবে? পরক্ষণেই মন বিদ্রোহ করে ওঠে। প্রতিনিয়ত লাঞ্ছনার পাকাপোক্ত জবাব দিতে খুলে বসি বিশ্বের নানা দেশের জাতীয় সংগীতের তালিকা। হন্যে হয়ে খুজঁতে থাকি সেগুলোর অনুবাদ আর পেছনের ইতিহাস। আশ্চর্যের বিষয়, যতই খুজেঁছি যতই পড়েছি, বিস্মিত হয়েছি, আনন্দিত হয়েছি, গর্বিত হয়েছি। কয়েকটি উদাহরণ দিলে আমার সঙ্গে আপনারাও একমত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। বিশ্লেষণের শুরুতেই ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আপন জাতিসত্তার অনন্যতা প্রমাণের প্রয়াসেই শুধু অন্য দেশের জাতীয় সংগীতকে তুলনার মানদণ্ডে দাঁড় করিয়েছি কোনো জাতিসত্তাকে ক্ষুদ্র বা অবমূল্যায়ন করার উদ্দেশ্যে নয়।

প্রথমেই আসি ইংল্যান্ডের জাতীয় সংগীতে। ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত এ গানটি ১৯০০ শতাব্দীর গোড়ায় জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করে। গানটির বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় অনেকটা এরকম–

“রানিকে রক্ষা কর ভগবান

রানি আমাদের হোক আয়ুস্মান

জয়ী কর তাঁরে; দাও তাঁরে যশ

দাও দাও তাঁরে বিমল হরষ

সুখ শান্তিতে রাজ্য করুক, এই কর ভগবান

জাগো জাগো প্রভু! জাগো জাগো ভগবান!

শত্রু দলিতে হও হে অধিষ্ঠান

নষ্ট কর হে শত্রুর ছল

নাশো দুষ্টের বুদ্ধি ও বল

হে চির-শরণ, বিপদে মোদের অভয় কর হে দান”

একটি দেশের জাতীয় সংগীতের ওপর শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, গানটিতে দেশ বন্দনার লেশ মাত্র নেই। নেই দেশের মানুষের জন্য কল্যাণকামনা। আদ্যোপান্ত রানির মঙ্গল প্রার্থনা করা হয়েছে এতে। দেশ ও জাতির পারস্পরিক সম্পর্কসূত্রের উল্লেখ এখানে সুদূর কল্পনাতেও স্থান পেয়েছে বলে মনে হয় না।

তাকাই ফ্রান্সের দিকে। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত একটি কবিতা জাতীয় সংগীত হিসেবে গণ্য হয়। যার পটভূমি ফ্রান্স থেকে অস্ট্রিয়ার যুদ্ধ ঘোষণা। রচনাকাল ১৭৯২-এর এপ্রিল। এটি রাইনের সৈন্যবাহিনীর যুদ্ধের গান হিসেবে পরিচিত। গানটির বাংলা অনুবাদটি এরকম–

“ফরাসি ভূমির সন্তানসবে আয়রে আয়রে আয়

কীর্তিলাভের শুভ অবসর যায় রে যায় বহিয়া যায়

অত্যাচারের উদ্যত ধ্বজা রক্তে করিয়া স্নান

আমাদের পরে বৈর সাধিতে হয়েছে অধিষ্ঠান

শুনিছ কি সবে কী ভীষণ রবে কাঁপায়ে জলস্থল,

দম্ভের ভরে গর্জন করে শত্রু সৈন্যদল!

তারা যে আসিছে কেড়ে নিতে বলে তোমার সকল ধন,

গ্রাসিতে শস্য—ক্ষেত্র নাশিতে পুত্র ও পরিজন

ধর হাতিয়ার ফ্রান্সের লোক, বাঁধ দল, বাঁধ দল!

চল রে চল চল রে চল!

ঘৃণা শোণিতে হবে কি সিক্ত মোদের ক্ষেত্রতল!”

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গানটি শুধুমাত্র যুদ্ধের বারতা দেয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর একটি দেশের এ জাতীয় আক্রমণাত্মক জাতীয় সংগীত ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসকেই পুনর্জাগরুক করে!

১৮২৩ সালে রচিত একটি গান ১৮৪৪ সালে হাঙ্গেরির জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত হয়। সার্বজনীনতা আর জাতিসত্তার পরিচয়হীন এই গানটিও যেন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজায়। মূল গানের বাংলা ভাষান্তর—

“দেশের দশের ডাক শোন ওই

ওঠ ওঠ ম্যাগিয়ার

এই বেলা যদি পারো তো পারলে

নইলে হলো না আর

মুক্ত হবে? না রইবে অধীন

বুঝে চিনে লও পথ

ম্যাগিয়ার আর রবে না অধীন

করিনু এই শপথ

আমরা সবাই করিনু শপথ

লয়ে দেবতার নাম

আর রবো না অধীন প্রভু!

পুরাও মনস্কাম।”

জানি না স্বাধীনতা লাভের প্রায় দুইশ বছর পরও অধীনতা থেকে মুক্তির ক্রমাগত প্রার্থনা কতখানি যৌক্তিক ও সৌন্দর্যমণ্ডিত!

জাপানের জাতীয় সংগীত পৃথিবীর প্রাচীনতম কবিতা। ৭৯৪ সালে থেকে ১১৮৫ সাল পর্যন্ত যা বারবার সম্প্রসারিত এবং পরিবর্তন করা হয়েছে। মূল সংস্কারক হেইকান কাল। প্রথম চারটি লাইন তুলে ধরলেই পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হবে এর সারমর্ম–

“অযুত যুগ ধরি বিরাজো মহারাজ

রাজা হোক তব অক্ষয়

উপল যতদিন না হয় মহীষর

প্রভূত শৈবালে শোভাময়”

এর বিপরীত চিত্র কি নেই? অবশ্যই আছে। আসুন চোখ রাখি মিশরে। প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি এ দেশটির জাতীয় সংগীত পরিবর্তিত হয়েছে কয়েকবার। যার মূল কারণ রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ আবার পরবর্তীতে স্বৈরতন্ত্রে অবনমণ। বর্তমানে প্রচলিত জাতীয় সংগীতটি গৃহীত হয় ১৯৭৯ সালে। গাওয়া হয় মূল ছয়টি থেকে প্রথম দুটি পয়ার।

“আমার দেশ, আমার দেশ, আমার দেশ

তোমার কাছে রয়েছে আমার প্রেম এবং আমার হৃদয়

আমার মাতৃভূমি, আমার মাতৃভূমি, আমার মাতৃভূমি

আমার প্রেম এবং হৃদয় তোমার জন্য

তবে আমার কাছে গানটি শুধুই একটি দেশাত্মবোধক সংগীত যার নেই কোনো সমৃদ্ধ ইতিহাস!

প্রতিবেশী দেশ নেপালের জাতীয় সংগীত–

“শত পুস্পে গাঁথা একটি মালা নেপালী

বিস্তৃত সার্বভৌম মেচি হতে মহাকালী।

প্রকৃতির কোটি সম্পদের আঁচল

বীরদের আত্মত্যাগে স্বতন্ত্র ও অটল

জ্ঞানভূমি, শান্তিভূমি, তরাই পাহাড়

হিমালয় অখণ্ড যে আদরে মোদের

মাতৃভূমি নেপাল।

বহুজাতি ভাষা ধর্ম সংস্কৃতি বিশাল

অগ্রগামী দেশ মোদের

জয় জয় নেপাল”

১৯৪৮ সালে স্বাধীন হয় শ্রীলংকা। তারও দুবছর পর পর্যন্ত ব্রিটিশ জাতীয় সংগীতই শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত হিসেবে গীত হতো। কী সকরুণ দীনতা! অবশেষে ১৯৫০ বাঙালির ত্রাতারূপী রবীন্দ্রনাথ রচিত গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়; যার মূল রচনা কাল ১৯৩৮।

“আমার শ্রীলংকা নমো

নমো নমো নমো মাতা

সুন্দর শ্রীবরণী

সুন্দরী শ্রেষ্ঠ লংকা

ধনধান্যে ভরা জননী

তুমি সকলের সেরা জয়া

সেরা ভূমি যথা,

আমাদের রেখেছ সযতনে

ওহে প্রিয় দেশমাতা

তোমারই প্রতি মোদের ভক্তি পূজা

নমো নমো নমো মাতা”

কিন্তু এগানগুলোর কোনোটিই জাতিসত্তার বিকাশ আর সংগ্রামের ধারার সঙ্গে সঙ্গে পথ হাঁটেনি। ইতিহাসের সঙ্গী হয়নি।

আসুন এবার ফিরি নিজের মাটিতে। একটু দেখতে চেষ্টা করি কেন, কীভাবে ‘আমার সোনার বাংলা’ আমাদের জাতীয় সংগীত? এ গানটির বাণী আর সুরের শ্রেষ্ঠত্ব কোথায় এবং এ গান আর বাঙালির ইতিহাস কীভাবে আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত একাঙ্গী? এ বিষয়ে বাংলার সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে প্রাতস্মরণীয় নাম ড. আহমদ শরীফের ৩টি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত উদ্বৃতি স্মৃতব্য-

“মা জন্ম দেয়, মাটি লালন করে, তাই দেশের মাটিকে মায়ের মতোই ভালোবাসতে হয়। বাঙালির ইতিহাস রোমন্থনে দেখা যায় শত বিরূপ বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও তার মাটি ও মর্ত্যপ্রীতি সর্বত্র সুপ্রকট”,

কিংবা

“বস্তুত বাঙালির ইতিহাস লোকধর্মের, লোকায়ত দর্শনের, লোকসাহিত্যের, লোকশিল্পের, লোকসংগীতের ও লোকবিশ্বাসের—সংস্কারের ইতিকথারই অন্য নাম।”

আবার অন্যত্র তিনি বলেছেন, “বাঙালি যেখানে স্বকীয় মহিমায় সমুন্নত, যেখানে সে অতুল্য এবং প্রাচ্যদেশে প্রায় অজেয়, তা বিদ্যা ও বুদ্ধির ক্ষেত্রে বাঙালির অবদান। তার সাহিত্য ও তার দর্শন তার গৌরবের ও গর্বের এবং অপরের ঈর্ষার বস্তু।”

বাঙালির ইতিহাস নিরন্তর সংগ্রামের। এ সংগ্রাম বিজাতি, তার ভাষা আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, এ সংগ্রাম আপন সংস্কৃতি, আপন সত্তার অস্তিত্ব রক্ষার। আর তিন হাজার বছরের এ সংগ্রামের ধারায় নবতর সংযোজন দুশো বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ আর তারপর ধর্মীয় চেতনার ভিত্তিতে অলীক রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ হয়ে ২৪ বছরের গ্লানিময় কালাতিপাত। দুই শতকের শাসনে বিপর্যস্ত ভারতবর্ষে নানামুখি বিদ্রোহের সূতিকাগার ছিল এই বাংলা। তাই শাসকশ্রেণীর মূলনীতি ছিল বাংলার মানুষের কৌশলগত বিভাজন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ নীতি ছিল বাংলার সাধারণ মানুষের বিপক্ষে স্মৃতব্য সময়ে ব্রিটিশ বেনিয়া তথা বিজাতীয় শাসকের প্রথম সফল কূটচাল। যা বাঙালির মধ্যে প্রথমবারের মতো দীর্ঘস্থায়ী বিভেদরেখা টানতে সক্ষম হয়েছিল। শুরু থেকেই মুক্তমনা বাংলা এ ভাঙনের বিরোধিতা করেছিল। কারণ তারা বুঝেছিল এ ভাঙনের প্রতিধ্বনি প্রবাহিত হবে রক্তের ধারাবাহিকতায়। বাংলার স্বপ্নচারী ও অভ্যস্ত মানসিকতায় নির্মম আঘাত হেনে তার স্বকীয়তা থেকে, জাত্যাভিমান থেকে তাকে টেনে নেওয়া হবে অনেক দূরে। তাইতো এ ভাঙনের মুখে বাঁধ দিতে বাঙালি রুখে দাঁড়ায় তার চিরকালীন অসাম্প্রাদায়িক চেতনাকে পাথেয় করে। এ সময়ে বাঙালির প্রাণভোমরাসম রবীন্দ্রনাথ পথে নামলেন অবিভক্ত বাংলার দাবিকে বুকে ধারণ করে; তার অমর সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি কণ্ঠে নিয়ে। গানটির সুরের ক্ষেত্রেও তিনি বেছে নিলেন বাংলার লোকায়ত বাউল সুর, লোক—ঢং। বাংলার পরিব্রাজক বাউল গগণ হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটির সুরের আদলে। যার প্রতিটি স্বরমালিকায় লুকিয়ে আছে মাটির ছোঁয়া আর মাটির টান। এ গান বাংলার মানুষ শুনেছে, হৃদয়ে স্থান দিয়েছে, সুরে সুর মিলিয়ে অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবি উচ্চারণ করেছে স্বদম্ভে। বলেছে, শাসকচক্র বাংলাকে কলমের টানে বিভক্ত করলেও তার প্রকৃতি, আকাশ-বাতাস, মানুষের আত্মার সম্পর্ক, তার হৃদয়কে বিভক্ত করা সম্ভব নয়। প্রবহমান আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হলেও বাঙালির দুঃখের কাল যেন শেষ হয় না। তার জাতিসত্তার পরিচয়কে ভুলিয়ে আরোপিত, উদ্ভাবিত ধর্মীয় জাতিসত্তার পরিচয়কে সামনে এনে ’৪৭-এ বাংলার সাধারণ জনজীবনের মতামতকে মূল্যায়নের মধ্যে না এনে তাকে যুক্ত করা হয় পাকিস্তান নামক এক অসার, বাস্তববর্জিত রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে। ১৯৪১-এ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর থেকে ’৪৭ পর্যন্ত ভাগ্যনিয়ন্তা অবাঙালি নেতাদের ক্রীড়নক হয়ে বাঙালি তার জাতিসত্তাকে ভুলে ধর্মীয় পরিচয়কে মাথায় তুলে নিয়ে হয়ে উঠল পাকিস্তানি। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যে মোহভঙ্গের দুঃসহ যাতনায় তাপিত বাঙালি বিদ্রোহীর বেশে আবিভূর্ত হলো। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি ফিরল তার আপন সত্তায়, খুঁজে পেল নিজেকে, তার বাংলাকে, বাংলাভাষাকে আর সংস্কৃতিকে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর পৌনঃপুনিক বৈরিতা আর স্বভূমির বর্ণচোরা চিরকালীন বিভীষণদের মোকাবিলা করেছে দৃঢ় চিত্তে। ইতিহাসের এ বৈরিসময়ে বিবর্জিত রবীন্দ্রনাথ আর খণ্ডিত নজরুলকে বাঙালি ধারণ করেছে তার কণ্ঠে জীবনীশক্তিরূপে, গেয়ে উঠেছে বাংলা মায়ের চরণে অর্পিত সেই চিরকালীন মহাকাব্য ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এ যেন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা এক সুরের স্রোতস্বিনী এ গানের ছত্রে ছত্রে মিশে আছে বাংলার আকাশ-বাতাস, ফাগুনের আমের বনের ঘ্রাণ, অঘ্রাণের ভরা খেতের হাসি, বটের মূলে—নদীর কূলের শোভা, স্নেহ-মায়া আর মায়ের সঙ্গে সন্তানের অচ্ছেদ্য বন্ধনের চিরন্তনী সাবলীল প্রকাশ।

আমার জানা নেই বিশ্বের কোনো দেশ তার জন্য এমন জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করেছে কিনা যে গান তার জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে রচিত এবং জাতির অস্তিত্ব আর তার ইতিহাসের পথ ধরেই হাতে হাত রেখে হাঁটে। তাই জাতি হিসেবে আমাদের সত্যিই গর্বিত হওয়া উচিত যে এমন একটি গান আমাদের জাতীয় সংগীত যা আমাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে আমাদের পায়ে পায়ে পথ চলেছে। মহাকাব্যিক সংগ্রামের অংশ হয়েছে। শুধু কি তাই? প্রকৃতি আপন বৈশিষ্ট্য যে রূপে প্রোথিত করেছে বাঙালির মননে, বাঙালির সত্তায় তার বাঙময় প্রকাশ কি গানটির প্রতিটি চরণে প্রশ্নাতীতভাবে প্রকাশ পায় না? মা আর সন্তানের চিরন্তন সম্পর্ক, মাকে ভালোবাসার সদম্ভ উচ্চারণ, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা বাঙালির মনন কি এ গানের প্রতিটি চরণ উচ্চারণ করে বারবার বলছে না–‘মাগো তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছ, তুমি আমার শ্রেষ্ঠতম ভালোবাসা, তোমার আকাশ—বাতাস অঘ্রাণ—ফাগুনের প্রকৃতি আমাকে প্রতিটি ক্ষণে বিমোহিত করে, আমোদিত করে; তোমার স্নেহ—মায়া আমাদের স্বজন—প্রিয়জনকে ভালোবাসতে শেখায়, পরস্পরকে আত্মার বন্ধনে যুক্ত করে। নদীর কূলে, বটের মূলে বিছানো আঁচল আমাকে প্রতিক্ষণে অভয় দেয়। মায়ের সুধাসম মুখের বাণী যেন ডেকে বলে, ‘দুঃখ—বিপদ, হতাশা—নৈরাশ্য, হাসি আর আনন্দে আমি আছি তোমার প্রেরণাদাত্রী রূপে। বিপরীতে সন্তানও যেন মাকে অভয় দেয়, ‘মা তোমার মলিনরূপ আমার চোখে অশ্রুধারা হয়ে ঝরে। সেই জলে আছে দ্রোহ, মাকে রক্ষার সর্বময় শক্তির প্রকাশ।’ সন্তান যেন মাকে বলছে ‘তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।’ মা আর সন্তানের মধ্যকার এই যে চিরকালের সম্পর্কসূত্র, এই যে স্নেহ-মায়া, খুনসুটি-আব্দার, মমতার বন্ধন সারাবিশ্বে তার তুলনা আছে কিনা জানা নেই। এই গান এতটাই আধুনিক যে তার অন্তর্নিহিত বাণী অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, উচতা—নিচতার প্রভাবমুক্ত। শুধুমাত্র মা আর সন্তানের অপত্য স্নেহের গল্প। প্রকৃতি আর বাঙালির নাড়িছেঁড়া সম্পর্কের ইতিবৃত্ত।

এ পর্যায়ে গানটির সুরের ব্যঞ্জনার কথা না বললেই নয়। বাঙালির মিলন-বিচ্ছেদ, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-যন্ত্রণা, চেতনা-দ্যোতনা লুকায়িত আছে এ সুরের প্রবাহে। এ বাঁশির মোহনীয় সুরে বাঙালির ঘুম ভাঙে। এ সুরে ধেনু চরে বাংলার মাঠে, মাঝি গায় জীবনের গান, গৃহের প্রতিকোণে জ্বলে সন্ধ্যাপ্রদীপ, সারাদিনের শ্রমের শেষে হৃদয়মথিত এ ঘুমপাড়ানি সুরে বাঙালি সুখেনিদ্রা যায় বাংলা মায়ের কোলে। এ সুর তাই মিশে আছে আমাদের প্রতি নিশ্বাসে, বিশ্বাসে আর রক্তের প্রতিটি কণায়। এ গানের মতো করে বাংলাদেশকে ধারণ করতে পারে, বাংলার মানুষকে ধারণ করতে পারে এমন গান বাংলায় বিরল। আমি বিশ্বাস করি, এ গানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস, বাণী আর সুর একটি চেতনাকেই উর্ধ্বে তুলে ধরে তা হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলার চেতনা। ভীষণভাবে মনে রাখা প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথ নিজেই গগণ হরকরার নামকে সামনে এনেছেন, সুরকে স্বীকৃতি ।

এ প্রসঙ্গে চোখ রাখি অধ্যাপক মনসুরউদ্দিনের বাংলা লোকগীতি নিয়ে ১৩ খণ্ডের অমর রচনা ‘হারামণি’র আশীর্বাদ অংশে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘‘আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স,—শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল,

“কোথায় পাব তারে

আমার মনের মানুষ যে রে!

হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে

দেশবিদেশ বেড়াই ঘুরে।”

কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূৰ্ব্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হ’য়ে উঠেছিল।”

ফলে চৌর্যবৃত্তির ভাবনা মনে আসাই অবমাননাকর। শুধু বাউল ভাবের সুরই নয় রবীন্দ্রনাথ তার কয়েক শত গানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সুরকে গ্রহণ করেছেন। এগুলোকে আমরা ভাঙ্গা গান হিসেবেই জানি। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন বিশ্বের সকল সংগীত স্রষ্টারাই এধরনের সুরের বিনিময় করেন এবং সব ক্ষেত্রেই যে সুরস্রষ্টারা পরস্পর পরস্পরের পরিচিত বা কোনভাবে মিলিত হয়েছেন এমন নয়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা যেনো ইতিহাস ঐতিহ্য এমনকি বংশগত ধারাবাহিকতা রহিত মানুষ। অর্থাৎ আমাদের পিতৃপুরুষ বলতে কিছু নেই, ‘কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়’– এসব কোনো পরম্পরা আমাদের নেই। নাহলে আমরা কিভাবে বলতে পারি ১৯০৫-এ রচিত গান আমাদের জাতীয় সংগীত হয় কিভাবে? আমাদের জন্মের কোনো পরম্পরা, ইতিহাসের কোন পরম্পরা কি সত্যিই নেই। যে মানুষ নিজের জন্মগত পরম্পরাকে অস্বীকার করে ‘সে জন কাহার জন্ম’– আমরা নির্ণয় করতে পারব তো!

তথ্যসূত্র :

১. বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব — আহমদ শরীফ

২. বাঙালীর জাতীয়তাবাদ— সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

৩. বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন—শতবর্ষ স্মারক সংগ্রহ

৪. বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংবর্ধনা— বাংলা একাডেমি

৫. ভ্রান্তি অবসানে আর কালক্ষয় নয়— ড. সাখাওয়াৎ হোসেন ((দৈনিক সমকাল—২৬ আগষ্ট ২০১৮)

৬. বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষায় ঐক্য — এম আর খায়রুল উমাম

৭. শুদ্ধ সুরেই জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হোক— শীলা মোমেন (দৈনিক সমকাল— ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮)

৮. জাতীয় সংগীত গাইতে হবে শুদ্ধ ভাবে—আ.ব.ম রবিউল ইসলাম (দৈনিক সংবাদ, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮)

৯. দেশ—বিদেশের জাতীয় সঙ্গীতের কথা— হাবিবুর রহমান স্বপন ( ২৭—০৯—২০১৫)

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

জাতীয় সংগীত: পুরোনো তর্ক, নতুন পরীক্ষা

আপডেট সময় : ১০:৫২:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

 

অন্তত তিন বার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আলাপ সরকারি পর্যায়েও হয়েছে। এখন আবার পুরোনো আলাপটিকে নতুন করে সামনে এনে আমাদের যে পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।

জাতীয় সংগীত নিয়ে একটি তর্কের শুরু হয়েছে। সুশীলদের অনেককেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটিকে ‘কুতর্ক’ আখ্যা দিয়ে এ নিয়ে কথা বলাটাই অবান্তর বলে উড়িয়ে দিতে দেখতে পাচ্ছি। ভাবখানা এই রকম কোথাকার কে কি বললেন, তা নিয়ে ভাবার কোনো দরকার নেই। এখন জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারের বিদায়ের পর দেশ গঠনের কথা ভাবতে পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

এ তো গেল তর্ক, বিতর্ক বা কুতর্কের একটা দিক। অন্যদিকে অনেকেই এটিকে ‘কুতর্ক’ বলে উড়িয়ে দিতে নারাজ। বরং তারা দেশ উল্টোরথে চড়ে বসেছে কিনা, এ নিয়ে বিচলিত হচ্ছেন। স্বৈরাচারবিহীন দেশে আমরা একমাস পার করে ফেলেছি। ইতিবাচক, নেতিবাচক নানামুখী কর্মকাণ্ড ঘটছে, জাতীয় সংগীতসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ‘আমরা সবাই রাজা’ স্টাইলে মতামত প্রদান চলছে। সংবাদ সম্মেলন ডেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে, বাহাত্তরের সংবিধান ‘বৈধ নয়’ মন্তব্য করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করারও দাবি জানানো হচ্ছে, প্রশ্ন উঠছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়েও?

এহেন পরিস্থিতিতে জাতীয় সংগীত বদলে ফেলার আলোচনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে আমাদের। আমার মনে হয়, পুরোনো তর্ককে সামনে এনে আমাদের পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই জোর প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে। বারবার গাইতে হবে– ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে…’

এই তিনটি বিষয় নিয়ে তর্কের অবতারণা নতুন নয়। অন্তত তিন বার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আলাপ সরকারি পর্যায়েও হয়েছে বলে জানা যায় গবেষক ও সাংবাদিক হাসান শান্তনুর লেখা থেকে। এখন আবার পুরোনো আলাপটিকে নতুন করে সামনে এনে আমাদের যে পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। হাসান শান্তনুর লেখার অংশবিশেষ হুবহু উদ্ধৃত করছি এখানে–“দেশের জাতীয় সঙ্গীত বদলানোর লক্ষ্যে এ পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগ দেখা যায় তিনবার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খ. মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদে বসে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনে কমিটি গঠন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে চেয়ারম্যান করে গঠিত ওই কমিটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’, ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরি’ কবিতাকে জাতীয় সঙ্গীত করতে প্রস্তাব দেয়। ‘৭৯ সালের ৩০ এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’কে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত করতে প্রস্তাব করা হয়। মোশতাকের সরকার পাল্টা ক্যু ও জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় সেসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি। জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০১-‘০৬ সালে, চারদলের জোট সরকারের আমলে। ‘০২ সালের ১৯ মার্চ তখনকার দুই মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনে যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন। তখনের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রস্তাবটি পরে আমলে নেননি।”

বাংলাদেশ মানে, আমার কাছে, আমাদের কাছে ভালোবাসার অন্য নাম। বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মুক্তিসংগ্রাম আর ভাষার প্রতি ভালোবাসা। বাংলার মানুষ, তার চেতনা, তার নিরন্তর সংগ্রাম আর যাপিত জীবনের প্রতি ভালোবাসা। এ ভালোবাসায় বিবৃত আছে মাটি-মানুষের সম্পর্ক, ভাইয়ের-মায়ের অপত্য স্নেহের শান্তি গাথা, স্বজন-পরিজন-প্রতিজনের মন-মনন, আশা-নৈরাশ্য, ভয়-ভরসা, আত্মপ্রত্যয়-আত্মগ্লানি, সুকৃতি-দুষ্কৃতি, সংগ্রাম-পরাবশ্যতা সর্বোপরি তার দৈনন্দিন আনন্দ বেদনার কাব্য। আর বাঙালির এই স্বজাত্যবোধ ও স্বাদেশিকতার মূর্ত প্রতীক তার একান্ত নিজস্ব আবাসভূমি বাংলাদেশের হৃদয়গ্রাহী জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”। বিশ্বের যেকোনো জাতিগোষ্ঠী তার আত্মপরিচয়ের প্রধানতম অনুষঙ্গ জাতীয় সংগীত নিয়ে গর্ব অনুভব করবে, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইবে সেটাই যৌক্তিক, ন্যায়সংগত। দুর্ভাগ্যক্রমে আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতির পক্ষেই সম্ভব স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও নিজের জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া, শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সন্দিহান হওয়া, যে জাতীয় সংগীত স্বাধীনতা যুদ্ধে তার নিরন্তর আত্মত্যাগের স্মারক, যার কাঁধে রয়েছে এক সাগর রক্তের ঋণ। আজ তাই নবপ্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে বাংলার মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে অপূর্ব মেলবন্ধন সৃষ্টিকারী আমাদের জাতীয় সংগীতের স্বকীয়তা আর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের আশাতেই এ লেখার প্রয়াস পেয়েছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলোর মধ্যে অনন্যসাধারণ “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”—এর প্রথম দশ চরণ আমাদের জাতীয় সংগীত। কবিগুরুর স্বদেশ পর্যায়ের অধিকাংশ গানের মতো এ গানটিও রচিত হয়েছিল বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের রেশ ধরে। যদিও বিশ শতকের প্রথমভাগে স্বদেশি আন্দোলনের উত্তাল সময়ে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে বাঙালি গানটিকে আত্মপ্রচারের মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তবে গানখানির পূর্ণজন্মের মূল প্রেক্ষাপট বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম।

’৪৭-এর অলীক বিভাজনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির শাসকরা তার জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালির প্রাণসঞ্জীবনী রবীন্দ্রনাথের গানের উপর কুঠারাঘাত করেছে বারবার। নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে রবীন্দ্রনাথকে। এ ঘোষণার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের অভিষেকসহ অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানে গানটি বারবার গীত হয়েছে সার্বিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। এই সিনেমায় ব্যবহৃত পাঁচটি গানের একটি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। প্রকৃতপক্ষে তারও আগে থেকে একুশের প্রভাত ফেরির অন্যতম গান হয়ে ওঠেছিল এটি। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে প্রতীকায়িত করেছিল এবং এই সিনেমায় গানটির ব্যবহার তাই মাত্রা পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২৮ জুন কুড়িগ্রামের রৌমারী ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’র ভিডিও আমাদের প্রাণে শিহরণ জাগায় এখনও।

’৬৯-এর উত্তাল গণ-অভ্যুত্থানের কাল পেরিয়ে ’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১-এ মুক্তিসংগ্রামের ব্রত নিয়ে সংগঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ’৭১-এর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ক্যান্টিনে জাতীয় সংগীত সংক্রান্ত আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্ধারণের প্রস্তাব গ্রহণ করে। জাতীয় নেতারা বিষয়টিতে সম্মতি দিলে ঢাকায় ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী জনসভায় এবং ৭ মার্চ রেসকোর্সের ঐতিহাসিক জনসভায় গানটি গীত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চের কালরাত ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুজিবনগর সরকার গানটিকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয় জাতীয় সংগীত বাজিয়ে। সেদিন থেকে গানটি বাঙালির একান্ত আপনার। তার আত্মপরিচয়ের মূলমন্ত্র। আত্মচেতনার হাতিয়ার। এক সাগররক্তের পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে পাওয়া ’৭২-এর সংবিধানে অন্তভুর্ক্তির মধ্য দিয়ে জাতীয় সংগীত পায় সুসংহত ভিত্তি।

বাঙালির ইতিহাস রোমন্থনে একথা স্পষ্ট যে, প্রকৃতির অকৃপণ হাতের অকৃত্রিম সৃষ্টি বাংলার জনভূমি। প্রকৃতি মাতা যেন নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন এ ভূমির দৃশ্যপট আর মানুষের মনন। প্রকৃতি এ জাতিকে শিখিয়েছে অকৃপণতা আর অকৃত্রিম আতিথেয়তার মন্ত্র। বারবার আক্রান্ত বাংলা জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার হয়েছে, বিভাজিত হয়েছে কিন্তু মাথা নোয়ায়নি অশুভের কাছে। বাংলার ইতিহাস তাই নিরন্তর সংগ্রাম আর নবসৃষ্টির ইতিহাস। স্বাজাত্যভিমানে গর্বিত বাঙালির প্রাণের আবেগ আর আত্মার সম্পর্ক যেন অনন্য বাঙময় হয়ে ফুটে উঠেছে তার জাতীয় সংগীতে।

জাতীয় সংগীত সবসময় একটি জাতির জাতীয় সত্তার প্রকাশ ঘটাবে, তার সৃজন, মনন তার আত্মার বৈশিষ্ট্যকে বিচ্ছুরিত করবে– এটাই স্বাভাবিক, এটাই কাম্য। জাতি হিসেবে আমরা সৌভাগ্যবান বাঙালির আত্মিক ভাবনার সঙ্গে সম্পর্কিত, ইতিহাসের ধারাবাহিকতার সঙ্গে মিশে থাকা সর্বাধিক জনপ্রিয় গানটি তার জাতীয় সংগীত। অথচ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আমান আযমীর মতো অনেককেই বলতে শোনা যাচ্ছে, জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলার’ যৌক্তিকতা কতখানি? এই জাতীয় সংগীত বাংলাদেশকে ধারণ করে না। অনেকেই নানা দেশের জাতীয় সংগীতের পরিবর্তনকে উদাহরণ হিসেবে সামনে আনছেন। অন্যান্য দেশাত্মবোধক গানের সঙ্গে তুলনায় নামিয়ে জাতীয় সংগীতকে নিক্তি পরিমাপকে তুলে দেয়। জাতীয় সংগীতের রচয়িতার ধর্মপরিচয়কে সামনে এনে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছে! বাঙালির দুই নয়নসম রবীন্দ্র-নজরুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের তুলাদণ্ড নিয়ে দণ্ডায়মান হচ্ছে। আবার কখনো বা গানটির চরণগুলোর ক্লেদার্ত বিশ্লেষণ করে জন্মভূমির বন্দনাকে তথাকথিত মূর্তিপূজার সঙ্গে তুলনা করে নিজেদের চরম মানসিক দীনতা আর দারিদ্র্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।

এ ধরনের আলোচনা সামনে এলে অব্যক্ত যন্ত্রণা আর ঘৃণায় মন আচ্ছাদিত হয়। শুধু মনে হয় জাতি হিসেবে বাঙালি কি আত্মবিস্মৃত, আত্মপরিচয়হীন হতে চলেছে? নিজেদের ধ্বংস কি নিজেরাই ডেকে আনছে? মনে হয়; পাকিস্তানের প্রেতাত্মা কি আজও আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে? ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা তাদের শাসন নির্যাতনের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে দ্বিজাতিতত্ত্বের (নাকি দ্বিসম্প্রদায়তত্ত্ব বলব) মতো যে কুটিল সিদ্ধান্ত বঙ্গভঙ্গের নামে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল তার নীল বিষ কি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে বেড়াতেই হবে? পরক্ষণেই মন বিদ্রোহ করে ওঠে। প্রতিনিয়ত লাঞ্ছনার পাকাপোক্ত জবাব দিতে খুলে বসি বিশ্বের নানা দেশের জাতীয় সংগীতের তালিকা। হন্যে হয়ে খুজঁতে থাকি সেগুলোর অনুবাদ আর পেছনের ইতিহাস। আশ্চর্যের বিষয়, যতই খুজেঁছি যতই পড়েছি, বিস্মিত হয়েছি, আনন্দিত হয়েছি, গর্বিত হয়েছি। কয়েকটি উদাহরণ দিলে আমার সঙ্গে আপনারাও একমত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। বিশ্লেষণের শুরুতেই ক্ষমা প্রার্থনা করছি, আপন জাতিসত্তার অনন্যতা প্রমাণের প্রয়াসেই শুধু অন্য দেশের জাতীয় সংগীতকে তুলনার মানদণ্ডে দাঁড় করিয়েছি কোনো জাতিসত্তাকে ক্ষুদ্র বা অবমূল্যায়ন করার উদ্দেশ্যে নয়।

প্রথমেই আসি ইংল্যান্ডের জাতীয় সংগীতে। ১৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত এ গানটি ১৯০০ শতাব্দীর গোড়ায় জাতীয় সংগীতের মর্যাদা লাভ করে। গানটির বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় অনেকটা এরকম–

“রানিকে রক্ষা কর ভগবান

রানি আমাদের হোক আয়ুস্মান

জয়ী কর তাঁরে; দাও তাঁরে যশ

দাও দাও তাঁরে বিমল হরষ

সুখ শান্তিতে রাজ্য করুক, এই কর ভগবান

জাগো জাগো প্রভু! জাগো জাগো ভগবান!

শত্রু দলিতে হও হে অধিষ্ঠান

নষ্ট কর হে শত্রুর ছল

নাশো দুষ্টের বুদ্ধি ও বল

হে চির-শরণ, বিপদে মোদের অভয় কর হে দান”

একটি দেশের জাতীয় সংগীতের ওপর শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, গানটিতে দেশ বন্দনার লেশ মাত্র নেই। নেই দেশের মানুষের জন্য কল্যাণকামনা। আদ্যোপান্ত রানির মঙ্গল প্রার্থনা করা হয়েছে এতে। দেশ ও জাতির পারস্পরিক সম্পর্কসূত্রের উল্লেখ এখানে সুদূর কল্পনাতেও স্থান পেয়েছে বলে মনে হয় না।

তাকাই ফ্রান্সের দিকে। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে রচিত একটি কবিতা জাতীয় সংগীত হিসেবে গণ্য হয়। যার পটভূমি ফ্রান্স থেকে অস্ট্রিয়ার যুদ্ধ ঘোষণা। রচনাকাল ১৭৯২-এর এপ্রিল। এটি রাইনের সৈন্যবাহিনীর যুদ্ধের গান হিসেবে পরিচিত। গানটির বাংলা অনুবাদটি এরকম–

“ফরাসি ভূমির সন্তানসবে আয়রে আয়রে আয়

কীর্তিলাভের শুভ অবসর যায় রে যায় বহিয়া যায়

অত্যাচারের উদ্যত ধ্বজা রক্তে করিয়া স্নান

আমাদের পরে বৈর সাধিতে হয়েছে অধিষ্ঠান

শুনিছ কি সবে কী ভীষণ রবে কাঁপায়ে জলস্থল,

দম্ভের ভরে গর্জন করে শত্রু সৈন্যদল!

তারা যে আসিছে কেড়ে নিতে বলে তোমার সকল ধন,

গ্রাসিতে শস্য—ক্ষেত্র নাশিতে পুত্র ও পরিজন

ধর হাতিয়ার ফ্রান্সের লোক, বাঁধ দল, বাঁধ দল!

চল রে চল চল রে চল!

ঘৃণা শোণিতে হবে কি সিক্ত মোদের ক্ষেত্রতল!”

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গানটি শুধুমাত্র যুদ্ধের বারতা দেয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর একটি দেশের এ জাতীয় আক্রমণাত্মক জাতীয় সংগীত ঔপনিবেশিকতার ইতিহাসকেই পুনর্জাগরুক করে!

১৮২৩ সালে রচিত একটি গান ১৮৪৪ সালে হাঙ্গেরির জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত হয়। সার্বজনীনতা আর জাতিসত্তার পরিচয়হীন এই গানটিও যেন যুদ্ধের ডঙ্কা বাজায়। মূল গানের বাংলা ভাষান্তর—

“দেশের দশের ডাক শোন ওই

ওঠ ওঠ ম্যাগিয়ার

এই বেলা যদি পারো তো পারলে

নইলে হলো না আর

মুক্ত হবে? না রইবে অধীন

বুঝে চিনে লও পথ

ম্যাগিয়ার আর রবে না অধীন

করিনু এই শপথ

আমরা সবাই করিনু শপথ

লয়ে দেবতার নাম

আর রবো না অধীন প্রভু!

পুরাও মনস্কাম।”

জানি না স্বাধীনতা লাভের প্রায় দুইশ বছর পরও অধীনতা থেকে মুক্তির ক্রমাগত প্রার্থনা কতখানি যৌক্তিক ও সৌন্দর্যমণ্ডিত!

জাপানের জাতীয় সংগীত পৃথিবীর প্রাচীনতম কবিতা। ৭৯৪ সালে থেকে ১১৮৫ সাল পর্যন্ত যা বারবার সম্প্রসারিত এবং পরিবর্তন করা হয়েছে। মূল সংস্কারক হেইকান কাল। প্রথম চারটি লাইন তুলে ধরলেই পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হবে এর সারমর্ম–

“অযুত যুগ ধরি বিরাজো মহারাজ

রাজা হোক তব অক্ষয়

উপল যতদিন না হয় মহীষর

প্রভূত শৈবালে শোভাময়”

এর বিপরীত চিত্র কি নেই? অবশ্যই আছে। আসুন চোখ রাখি মিশরে। প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি এ দেশটির জাতীয় সংগীত পরিবর্তিত হয়েছে কয়েকবার। যার মূল কারণ রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ আবার পরবর্তীতে স্বৈরতন্ত্রে অবনমণ। বর্তমানে প্রচলিত জাতীয় সংগীতটি গৃহীত হয় ১৯৭৯ সালে। গাওয়া হয় মূল ছয়টি থেকে প্রথম দুটি পয়ার।

“আমার দেশ, আমার দেশ, আমার দেশ

তোমার কাছে রয়েছে আমার প্রেম এবং আমার হৃদয়

আমার মাতৃভূমি, আমার মাতৃভূমি, আমার মাতৃভূমি

আমার প্রেম এবং হৃদয় তোমার জন্য

তবে আমার কাছে গানটি শুধুই একটি দেশাত্মবোধক সংগীত যার নেই কোনো সমৃদ্ধ ইতিহাস!

প্রতিবেশী দেশ নেপালের জাতীয় সংগীত–

“শত পুস্পে গাঁথা একটি মালা নেপালী

বিস্তৃত সার্বভৌম মেচি হতে মহাকালী।

প্রকৃতির কোটি সম্পদের আঁচল

বীরদের আত্মত্যাগে স্বতন্ত্র ও অটল

জ্ঞানভূমি, শান্তিভূমি, তরাই পাহাড়

হিমালয় অখণ্ড যে আদরে মোদের

মাতৃভূমি নেপাল।

বহুজাতি ভাষা ধর্ম সংস্কৃতি বিশাল

অগ্রগামী দেশ মোদের

জয় জয় নেপাল”

১৯৪৮ সালে স্বাধীন হয় শ্রীলংকা। তারও দুবছর পর পর্যন্ত ব্রিটিশ জাতীয় সংগীতই শ্রীলংকার জাতীয় সংগীত হিসেবে গীত হতো। কী সকরুণ দীনতা! অবশেষে ১৯৫০ বাঙালির ত্রাতারূপী রবীন্দ্রনাথ রচিত গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়; যার মূল রচনা কাল ১৯৩৮।

“আমার শ্রীলংকা নমো

নমো নমো নমো মাতা

সুন্দর শ্রীবরণী

সুন্দরী শ্রেষ্ঠ লংকা

ধনধান্যে ভরা জননী

তুমি সকলের সেরা জয়া

সেরা ভূমি যথা,

আমাদের রেখেছ সযতনে

ওহে প্রিয় দেশমাতা

তোমারই প্রতি মোদের ভক্তি পূজা

নমো নমো নমো মাতা”

কিন্তু এগানগুলোর কোনোটিই জাতিসত্তার বিকাশ আর সংগ্রামের ধারার সঙ্গে সঙ্গে পথ হাঁটেনি। ইতিহাসের সঙ্গী হয়নি।

আসুন এবার ফিরি নিজের মাটিতে। একটু দেখতে চেষ্টা করি কেন, কীভাবে ‘আমার সোনার বাংলা’ আমাদের জাতীয় সংগীত? এ গানটির বাণী আর সুরের শ্রেষ্ঠত্ব কোথায় এবং এ গান আর বাঙালির ইতিহাস কীভাবে আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত একাঙ্গী? এ বিষয়ে বাংলার সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে প্রাতস্মরণীয় নাম ড. আহমদ শরীফের ৩টি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত উদ্বৃতি স্মৃতব্য-

“মা জন্ম দেয়, মাটি লালন করে, তাই দেশের মাটিকে মায়ের মতোই ভালোবাসতে হয়। বাঙালির ইতিহাস রোমন্থনে দেখা যায় শত বিরূপ বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও তার মাটি ও মর্ত্যপ্রীতি সর্বত্র সুপ্রকট”,

কিংবা

“বস্তুত বাঙালির ইতিহাস লোকধর্মের, লোকায়ত দর্শনের, লোকসাহিত্যের, লোকশিল্পের, লোকসংগীতের ও লোকবিশ্বাসের—সংস্কারের ইতিকথারই অন্য নাম।”

আবার অন্যত্র তিনি বলেছেন, “বাঙালি যেখানে স্বকীয় মহিমায় সমুন্নত, যেখানে সে অতুল্য এবং প্রাচ্যদেশে প্রায় অজেয়, তা বিদ্যা ও বুদ্ধির ক্ষেত্রে বাঙালির অবদান। তার সাহিত্য ও তার দর্শন তার গৌরবের ও গর্বের এবং অপরের ঈর্ষার বস্তু।”

বাঙালির ইতিহাস নিরন্তর সংগ্রামের। এ সংগ্রাম বিজাতি, তার ভাষা আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, এ সংগ্রাম আপন সংস্কৃতি, আপন সত্তার অস্তিত্ব রক্ষার। আর তিন হাজার বছরের এ সংগ্রামের ধারায় নবতর সংযোজন দুশো বছরের ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ আর তারপর ধর্মীয় চেতনার ভিত্তিতে অলীক রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ হয়ে ২৪ বছরের গ্লানিময় কালাতিপাত। দুই শতকের শাসনে বিপর্যস্ত ভারতবর্ষে নানামুখি বিদ্রোহের সূতিকাগার ছিল এই বাংলা। তাই শাসকশ্রেণীর মূলনীতি ছিল বাংলার মানুষের কৌশলগত বিভাজন। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ নীতি ছিল বাংলার সাধারণ মানুষের বিপক্ষে স্মৃতব্য সময়ে ব্রিটিশ বেনিয়া তথা বিজাতীয় শাসকের প্রথম সফল কূটচাল। যা বাঙালির মধ্যে প্রথমবারের মতো দীর্ঘস্থায়ী বিভেদরেখা টানতে সক্ষম হয়েছিল। শুরু থেকেই মুক্তমনা বাংলা এ ভাঙনের বিরোধিতা করেছিল। কারণ তারা বুঝেছিল এ ভাঙনের প্রতিধ্বনি প্রবাহিত হবে রক্তের ধারাবাহিকতায়। বাংলার স্বপ্নচারী ও অভ্যস্ত মানসিকতায় নির্মম আঘাত হেনে তার স্বকীয়তা থেকে, জাত্যাভিমান থেকে তাকে টেনে নেওয়া হবে অনেক দূরে। তাইতো এ ভাঙনের মুখে বাঁধ দিতে বাঙালি রুখে দাঁড়ায় তার চিরকালীন অসাম্প্রাদায়িক চেতনাকে পাথেয় করে। এ সময়ে বাঙালির প্রাণভোমরাসম রবীন্দ্রনাথ পথে নামলেন অবিভক্ত বাংলার দাবিকে বুকে ধারণ করে; তার অমর সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি কণ্ঠে নিয়ে। গানটির সুরের ক্ষেত্রেও তিনি বেছে নিলেন বাংলার লোকায়ত বাউল সুর, লোক—ঢং। বাংলার পরিব্রাজক বাউল গগণ হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটির সুরের আদলে। যার প্রতিটি স্বরমালিকায় লুকিয়ে আছে মাটির ছোঁয়া আর মাটির টান। এ গান বাংলার মানুষ শুনেছে, হৃদয়ে স্থান দিয়েছে, সুরে সুর মিলিয়ে অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবি উচ্চারণ করেছে স্বদম্ভে। বলেছে, শাসকচক্র বাংলাকে কলমের টানে বিভক্ত করলেও তার প্রকৃতি, আকাশ-বাতাস, মানুষের আত্মার সম্পর্ক, তার হৃদয়কে বিভক্ত করা সম্ভব নয়। প্রবহমান আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত হলেও বাঙালির দুঃখের কাল যেন শেষ হয় না। তার জাতিসত্তার পরিচয়কে ভুলিয়ে আরোপিত, উদ্ভাবিত ধর্মীয় জাতিসত্তার পরিচয়কে সামনে এনে ’৪৭-এ বাংলার সাধারণ জনজীবনের মতামতকে মূল্যায়নের মধ্যে না এনে তাকে যুক্ত করা হয় পাকিস্তান নামক এক অসার, বাস্তববর্জিত রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে। ১৯৪১-এ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের পর থেকে ’৪৭ পর্যন্ত ভাগ্যনিয়ন্তা অবাঙালি নেতাদের ক্রীড়নক হয়ে বাঙালি তার জাতিসত্তাকে ভুলে ধর্মীয় পরিচয়কে মাথায় তুলে নিয়ে হয়ে উঠল পাকিস্তানি। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের এক বছরের মধ্যে মোহভঙ্গের দুঃসহ যাতনায় তাপিত বাঙালি বিদ্রোহীর বেশে আবিভূর্ত হলো। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি ফিরল তার আপন সত্তায়, খুঁজে পেল নিজেকে, তার বাংলাকে, বাংলাভাষাকে আর সংস্কৃতিকে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর পৌনঃপুনিক বৈরিতা আর স্বভূমির বর্ণচোরা চিরকালীন বিভীষণদের মোকাবিলা করেছে দৃঢ় চিত্তে। ইতিহাসের এ বৈরিসময়ে বিবর্জিত রবীন্দ্রনাথ আর খণ্ডিত নজরুলকে বাঙালি ধারণ করেছে তার কণ্ঠে জীবনীশক্তিরূপে, গেয়ে উঠেছে বাংলা মায়ের চরণে অর্পিত সেই চিরকালীন মহাকাব্য ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। এ যেন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা এক সুরের স্রোতস্বিনী এ গানের ছত্রে ছত্রে মিশে আছে বাংলার আকাশ-বাতাস, ফাগুনের আমের বনের ঘ্রাণ, অঘ্রাণের ভরা খেতের হাসি, বটের মূলে—নদীর কূলের শোভা, স্নেহ-মায়া আর মায়ের সঙ্গে সন্তানের অচ্ছেদ্য বন্ধনের চিরন্তনী সাবলীল প্রকাশ।

আমার জানা নেই বিশ্বের কোনো দেশ তার জন্য এমন জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করেছে কিনা যে গান তার জাতিসত্তার অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে রচিত এবং জাতির অস্তিত্ব আর তার ইতিহাসের পথ ধরেই হাতে হাত রেখে হাঁটে। তাই জাতি হিসেবে আমাদের সত্যিই গর্বিত হওয়া উচিত যে এমন একটি গান আমাদের জাতীয় সংগীত যা আমাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে আমাদের পায়ে পায়ে পথ চলেছে। মহাকাব্যিক সংগ্রামের অংশ হয়েছে। শুধু কি তাই? প্রকৃতি আপন বৈশিষ্ট্য যে রূপে প্রোথিত করেছে বাঙালির মননে, বাঙালির সত্তায় তার বাঙময় প্রকাশ কি গানটির প্রতিটি চরণে প্রশ্নাতীতভাবে প্রকাশ পায় না? মা আর সন্তানের চিরন্তন সম্পর্ক, মাকে ভালোবাসার সদম্ভ উচ্চারণ, প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা বাঙালির মনন কি এ গানের প্রতিটি চরণ উচ্চারণ করে বারবার বলছে না–‘মাগো তুমি আমাকে জন্ম দিয়েছ, তুমি আমার শ্রেষ্ঠতম ভালোবাসা, তোমার আকাশ—বাতাস অঘ্রাণ—ফাগুনের প্রকৃতি আমাকে প্রতিটি ক্ষণে বিমোহিত করে, আমোদিত করে; তোমার স্নেহ—মায়া আমাদের স্বজন—প্রিয়জনকে ভালোবাসতে শেখায়, পরস্পরকে আত্মার বন্ধনে যুক্ত করে। নদীর কূলে, বটের মূলে বিছানো আঁচল আমাকে প্রতিক্ষণে অভয় দেয়। মায়ের সুধাসম মুখের বাণী যেন ডেকে বলে, ‘দুঃখ—বিপদ, হতাশা—নৈরাশ্য, হাসি আর আনন্দে আমি আছি তোমার প্রেরণাদাত্রী রূপে। বিপরীতে সন্তানও যেন মাকে অভয় দেয়, ‘মা তোমার মলিনরূপ আমার চোখে অশ্রুধারা হয়ে ঝরে। সেই জলে আছে দ্রোহ, মাকে রক্ষার সর্বময় শক্তির প্রকাশ।’ সন্তান যেন মাকে বলছে ‘তোমার ভয় নেই মা, আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।’ মা আর সন্তানের মধ্যকার এই যে চিরকালের সম্পর্কসূত্র, এই যে স্নেহ-মায়া, খুনসুটি-আব্দার, মমতার বন্ধন সারাবিশ্বে তার তুলনা আছে কিনা জানা নেই। এই গান এতটাই আধুনিক যে তার অন্তর্নিহিত বাণী অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, উচতা—নিচতার প্রভাবমুক্ত। শুধুমাত্র মা আর সন্তানের অপত্য স্নেহের গল্প। প্রকৃতি আর বাঙালির নাড়িছেঁড়া সম্পর্কের ইতিবৃত্ত।

এ পর্যায়ে গানটির সুরের ব্যঞ্জনার কথা না বললেই নয়। বাঙালির মিলন-বিচ্ছেদ, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-যন্ত্রণা, চেতনা-দ্যোতনা লুকায়িত আছে এ সুরের প্রবাহে। এ বাঁশির মোহনীয় সুরে বাঙালির ঘুম ভাঙে। এ সুরে ধেনু চরে বাংলার মাঠে, মাঝি গায় জীবনের গান, গৃহের প্রতিকোণে জ্বলে সন্ধ্যাপ্রদীপ, সারাদিনের শ্রমের শেষে হৃদয়মথিত এ ঘুমপাড়ানি সুরে বাঙালি সুখেনিদ্রা যায় বাংলা মায়ের কোলে। এ সুর তাই মিশে আছে আমাদের প্রতি নিশ্বাসে, বিশ্বাসে আর রক্তের প্রতিটি কণায়। এ গানের মতো করে বাংলাদেশকে ধারণ করতে পারে, বাংলার মানুষকে ধারণ করতে পারে এমন গান বাংলায় বিরল। আমি বিশ্বাস করি, এ গানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস, বাণী আর সুর একটি চেতনাকেই উর্ধ্বে তুলে ধরে তা হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলার চেতনা। ভীষণভাবে মনে রাখা প্রয়োজন রবীন্দ্রনাথ নিজেই গগণ হরকরার নামকে সামনে এনেছেন, সুরকে স্বীকৃতি ।

এ প্রসঙ্গে চোখ রাখি অধ্যাপক মনসুরউদ্দিনের বাংলা লোকগীতি নিয়ে ১৩ খণ্ডের অমর রচনা ‘হারামণি’র আশীর্বাদ অংশে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘‘আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স,—শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল,

“কোথায় পাব তারে

আমার মনের মানুষ যে রে!

হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে

দেশবিদেশ বেড়াই ঘুরে।”

কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূৰ্ব্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হ’য়ে উঠেছিল।”

ফলে চৌর্যবৃত্তির ভাবনা মনে আসাই অবমাননাকর। শুধু বাউল ভাবের সুরই নয় রবীন্দ্রনাথ তার কয়েক শত গানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সুরকে গ্রহণ করেছেন। এগুলোকে আমরা ভাঙ্গা গান হিসেবেই জানি। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন বিশ্বের সকল সংগীত স্রষ্টারাই এধরনের সুরের বিনিময় করেন এবং সব ক্ষেত্রেই যে সুরস্রষ্টারা পরস্পর পরস্পরের পরিচিত বা কোনভাবে মিলিত হয়েছেন এমন নয়।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা যেনো ইতিহাস ঐতিহ্য এমনকি বংশগত ধারাবাহিকতা রহিত মানুষ। অর্থাৎ আমাদের পিতৃপুরুষ বলতে কিছু নেই, ‘কইতো যাহা আমার দাদায়, কইছে তাহা আমার বাবায়’– এসব কোনো পরম্পরা আমাদের নেই। নাহলে আমরা কিভাবে বলতে পারি ১৯০৫-এ রচিত গান আমাদের জাতীয় সংগীত হয় কিভাবে? আমাদের জন্মের কোনো পরম্পরা, ইতিহাসের কোন পরম্পরা কি সত্যিই নেই। যে মানুষ নিজের জন্মগত পরম্পরাকে অস্বীকার করে ‘সে জন কাহার জন্ম’– আমরা নির্ণয় করতে পারব তো!

তথ্যসূত্র :

১. বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব — আহমদ শরীফ

২. বাঙালীর জাতীয়তাবাদ— সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

৩. বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন—শতবর্ষ স্মারক সংগ্রহ

৪. বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংবর্ধনা— বাংলা একাডেমি

৫. ভ্রান্তি অবসানে আর কালক্ষয় নয়— ড. সাখাওয়াৎ হোসেন ((দৈনিক সমকাল—২৬ আগষ্ট ২০১৮)

৬. বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষায় ঐক্য — এম আর খায়রুল উমাম

৭. শুদ্ধ সুরেই জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হোক— শীলা মোমেন (দৈনিক সমকাল— ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮)

৮. জাতীয় সংগীত গাইতে হবে শুদ্ধ ভাবে—আ.ব.ম রবিউল ইসলাম (দৈনিক সংবাদ, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮)

৯. দেশ—বিদেশের জাতীয় সঙ্গীতের কথা— হাবিবুর রহমান স্বপন ( ২৭—০৯—২০১৫)