জাস্টিস ফর মৌমিতা, জাস্টিস ফর উইমেন
অলোক আচার্য
- আপডেট সময় :
০৪:১৪:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২১ অগাস্ট ২০২৪
- /
৫০৫০
বার পড়া হয়েছে
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ
(Google News) ফিডটি মৌমিতা ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডে ভারত এখন উত্তাল। এর রেশ এসেছে বাংলাদেশেও। আসবেই। কারণ পাশাপাশি দুটি দেশ এবং বাংলাদেশেও ধর্ষণ একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। ঘটনা হলো, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ১৩৮ বছরের পুরনো আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যাকে ঘিরে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে চলছে একটানা বিক্ষোভ। সেখানকার মূখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবীও জোরালো হয়েছে। নিহত চিকিৎসক ছিলেন কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসক। এ অভিযোগ ওঠার পর সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কার্যত ফুঁসে উঠেছে। কলকাতার বিক্ষোভকারীরা জানান, ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই। ধর্ষককে ফাঁসি দাও, নারীদের বাঁচাও।’ নারীদের প্রতি যৌন সহিংসতা ভারতে একটি বড় সমস্যা।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ভারতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সেই বছর পুলিশ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল কথিত নৃশংস গণধর্ষণ মামলায়। এ ছাড়া ২০২২ সালে ভারতে একজন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়েকে ধর্ষণ করার অভিযোগ ওঠে এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে স্বামীর সঙ্গে মোটরসাইকেলে ভ্রমণের সময় এক স্প্যানিশ পর্যটককে গণধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় একাধিক ভারতীয় পুরুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। আক্রমণের ভয়াবহতার কারণে অনেকে নিহত মৌমিতা দেবনাথের ঘটনাকে ২০১২ সালে দিল্লিতে ঘটা ধর্ষণ ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। বাসে এক যুবতীকে নৃশংভাবে গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল। তার মৃত্যুতে দিল্লিসহ অন্যান্য রাজ্যে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। চাপের মুখে সরকার ধর্ষকদের কঠোর শাস্তি এবং পুনরাবৃত্তি অপরাধীদের জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রবর্তন করে। আপনাদের হয়তো নির্ভয়ার কথা মনে থাকবে। নির্ভয়া ধর্ষণকাণ্ডেও ভারত এভাবেই জ্বলে উঠেছিল। ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন সঞ্জয় রায় নামের এক ব্যক্তি। গণমাধ্যমে জানা যায়, সঞ্জয় যে এবারই প্রথম এ ধরনের অপরাধ করেছের তা নয়। এর আগেও সে অন্য এক নারীকে হয়রানি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে এক চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন থেকে এক নারীর ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন সঞ্জয়।
ভারতের নির্ভয়ারা নির্ভয়ে থাকতে পারে না। দীর্ঘ সাত বছর পর নির্ভয়াকাণ্ডে দোষীদের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়। নির্ভয়ারা সাত বছর আগেও যেমন নির্ভয়ে থাকতে পারেনি আজ পারে না। নির্ভয়ারাও নির্ভয়ে থাকতে পারে না। সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। কখন, কোথায় কীভাবে নির্যাতনের শিকার হবে তা কেউ বলতে পারে না। হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অন্য কোথাও সে নিরাপদ থাকতে পারে না। আমাদের নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুরা তালিকাও ক্রমেই বাড়ছে। থামছে তো না উপরন্তু প্রতিটি ঘটনাই বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সবাই যখন উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত ঠিক সেই সময়েও কেউ না কেউ ধর্ষিত হচ্ছে। কে যে ধর্ষক আর কে যে মানুষ তা নির্ধারণ করা আজ আর সম্ভব নয়। বিকৃত মানসিকতার মানুষেরা তাদের বিকৃত কাম চরিতার্থ করতে শুরু করেছে। ভারতে এই ঘটনার পরেও একটি নার্স ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের ঘটনা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। পত্রিকার পাতায় সে খবর আমরা পাই। এরই মধ্যে কোনো কোনো ঘটনায় দেশের শুভ চেতনার মানুষ রাস্তায় নামে। প্রতিবাদ জানায়। তারপও আবার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এই চলছে গত কয়েক বছর ধরেই। অদৃশ্য দানব চেপে বসছে আমাদের মাঝে। ধর্ষকদের আইনের আওতায় আনাও হচ্ছে। শাস্তিও হচ্ছে। তাও যেন কোনোভাবেই ধর্ষণের ঘটনা কমানো যাচ্ছে না। এটি এখন মানসিক বিকৃতির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ঘরে, রাস্তায়, দোকানে, চাকরিতে, স্কুল-কলেজে কোথাও তারা নিরাপদ নয়।
যে পরিবারের একটা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয় সেই পরিবারই যন্ত্রণা বোঝে। কারণ সমাজটা বড় অদ্ভূত। ধর্ষিতাকেই নানা কটু কথা শুনতে হয়। আবার ধর্ষকদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার লোকেরও অভাব হয় না। মেয়েটার কত দোষ চোখে আঙুল দিয়ে বের করে দেয়। এই সাফাই গাওয়ার প্রবণতা ধর্ষকদের উৎসাহ দেওয়ারই নামান্তর। কিন্তু আমরা তো একটা ধর্ষণকারী মুক্ত সমাজ চাই। ধর্ষণ তো কামের কুপ্রবৃত্তির চূড়ান্ত রূপ। কামের বশবর্তী হয়ে ওরা যে সমাজটাকেই ধর্ষণ করে চলেছে তার খবর ওরা রাখে না। সভ্য সমাজে অসভ্য হায়েনার নাচ আর কতকাল দেখতে হবে কে জানে। অবশ্য সভ্যতার দোহাই দিয়ে আজকাল আমরা যা করছি তাতে আর নিজেদের সভ্য বলা যায় কি না ভেবে দেখতে হবে। যারা ধর্ষক বা অত্যাচারকারী বা নির্যাতনকারী তাদেরও কি বোন নেই। তারাও কি তার ভাইয়ের মতো অন্য কাউকে ভয় পায়। সে কি আদৌ জানে তার পরিচিত মুখ কতটা ভয়ংকর। অনেক পরিবারে মেয়ে জন্ম হলে যেন পরিবারে আনন্দিত হওয়ার বদলে কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা যেত এবং আজও যায়। কন্যাশিশু জন্ম হওয়াতে পরিবারের সবার কপালে এই ভাঁজ পরতো। মেয়েদের ক্ষেত্রে ছিল পদে পদে নিষেধাজ্ঞা। তাদের পৃথিবী ছিল ছোট। আজ তাদের চলায় সেসব বাধা নেই। তবে চলার পথ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বিপদের শঙ্কাও বেড়েছে বহুগুণ। আগে মেয়েদের এটি করা যাবে না ওটি করা যাবে না। এখানে মেয়েদের থাকা ঠিক না বা মেয়েরা এ কাজ করতে পারে না। তাদেরকে নানাভাবে ছোট করা হয়েছে, বানানো হয়েছে পুতুল। আগেই বলেছি পোশাকে হয় না, সভ্যতা হয় মনে। মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন অসম্ভব। মেয়েদের ভোগের বস্তুর দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার আগে একবার নিজের পরিবারের দিকে তাকাই। মানুষই রক্ষক আবার মানুষই ভক্ষক। মানুষই বিচার চায়, বিচারহীনতায় ভোগে আবার মানুষই সঠিক বিচার করছে।
একটি সমাজ তার নিজস্ব গতিধারায় চলে। ইতিহাস স্বাক্ষী আছে সেই ধারায় সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছে নারীরা। আজও যতই অধিকারের কথা বলা হোক অবস্থার উন্নতি খুব বেশি হয়নি। মানসিকতার পরিবর্তন করতে পারিনি। সমাজের সেই গতিধারা ইতিবাচক না নেতিবাচক হবে তা নির্ভর করবে সেই সমাজের মানুষের ওপর। আমাদের মানবিক গতিধারা এখন নেতিবাচকভাবেই প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা সেই ধারায় প্রবাহিত হচ্ছি। কিন্তু এর থেকে উত্তরণের উপায় কি? ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন যে ঘটনাই ঘটুক আমরা তা প্রতিরোধ করতে পারছি না। তার কারণ আমরা এটিই জানি না আমাদের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোর কে কতটা মানবিক বা কার ভেতর কখন সেই নিষ্ঠুর দৈত্য জেগে উঠবে তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। ফলে আমরা তা ঠেকাতে পারছি না। এর থেকে স্থায়ী প্রতকিার পেতে হলে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। বিবেকহীন, নিষ্ঠুর, হিংস্র মানুষ যে সমাজ থেকে একেবারে নির্মুল করা সম্ভব হবে তা বলা যায় না। শরীরে যেমন রোগের জীবাণু থাকবেই, তার যেমন প্রতিষেধক আছে তেমনি ধর্ষণ নামক এই ব্যাধীরও প্রতিষেধক আছে। তা খুঁজে বের করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমরা যারা একটি সুস্থ সমাজ, একটি সুস্থ দেশ আমাদের সকলের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
নিউজটি শেয়ার করুন