জুলাই বিপ্লবঃ নাফিসার লাশ নিয়ে ফেরার পথেও হামলা চালায় ছাত্রলীগ-যুবলীগ

- আপডেট সময় : ১০:০৮:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ এপ্রিল ২০২৫
- / 14
নাফিসা হোসেন মারওয়া অনেক মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হয়ে জাতিকে সুচিকিৎসা দেওয়া। তার এসব আকাঙ্ক্ষা কাজকর্মে স্পষ্ট ছিল। কিন্তু এর বাইরে তার আরও বড় পরিচয় ছিল, সাচ্চা দেশপ্রেমিক। লাল-সবুজ পতাকার প্রতি তার সেই সুপ্ত ভালোবাসা কখনোই উপলব্ধি করতে পারেনি পরিবার। কথাগুলো বলেন, শহীদ নাফিসার বাবা চা-দোকানি আবুল হোসেন।
আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘জুলাইয়ে আন্দোলনের প্রথম দিকে মাঠে নামায় রাগ করেছি, বকা দিয়েছি। তখন তো বুঝিনি, আমার মেয়ের রক্ত ১৮ কোটি বাংলাদেশির প্রাণের আবেগে পরিণত হবে। রক্তের প্রতিদানে দেশের মানুষের জন্য বসন্ত এনে দেওয়া মেয়েটা আকাশের মতো বিশাল, সহজ আর মহৎÑ এ সত্যটা উপলব্ধি করে আরও কষ্ট পাচ্ছি।’
মেয়ে শাহাদাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে অঝোরে চোখের পানি ফেলেন আবুল হোসেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, নাফিসার বয়স ছিল ১৭ বছর। টঙ্গীর সাহাজউদ্দিন সরকারি বিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে, তখন নাফিসা ও তার কয়েকজন বান্ধবী মেসেঞ্জারে গ্রুপ খুলে আলোচনা করে প্রতিদিন রাস্তায় নামত, রাজপথে নেতৃত্ব দিত।
টঙ্গীতে এক রুমের ছোট্ট ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকত তারা। বছর দুয়েক ধরে মা কুয়েতে। প্রতিদিন ভোরে দোকানে চলে যান আবুল হোসন, ফেরেন রাত ১০টা-১১টায়। বাবার আগেই বাসায় ফিরত বলে আন্দোলনে যাওয়ার বিষয়ে কিছুই জানতেন না আবুল হোসেন। ছোট মেয়ে থাকে সাভারে নানুর বাসায়। পড়ালেখার জন্য বাবার কাছে থাকলেও নাফিসা সাভারে বেশির ভাগ সময় থাকত।
একদিন প্রতিবেশীর কাছে মেয়ের আন্দোলনে যাওয়ার কথা জানতে পেরে বাসায় ফিরে তাকে বকাঝকা করেন। এর মধ্যে ২৭ জুলাই মেয়ে বলে, সাভারে মামার বাসায় যাবে। যেহেতু আন্দোলনের কারণে উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা স্থগিত, তাই বাবা বাধা দিলেন না। সেখানে মামারা হয়তো আন্দোলনে যেতে দেবে না, এ চিন্তাও করলেন।
প্রতিদিন আন্দোলনে চলে যেত। মামারা নিষেধ করলেও শুনত না। ৩ আগস্ট বিকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনে থেকে মাথায় পতাকা বাঁধা একটা সেলফি তুলে বাবাকে পাঠায়। ছবি দেখে বাবা রেগে যান। মোবাইলে কল দিয়ে মেয়েকে বকাঝকা করেন।
৫ আগস্ট সকালে আবারও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় লং মার্চে। দুপুর আড়াইটার দিকে নাফিসা বাবাকে কল দিয়ে বলে, ‘আব্বু, হাসিনা পলাইছে।’ বাবা রাগত স্বরে বলে ওঠেন, ‘হাসিনা পলাইছে, তোর বাপের কী? তোর বাপ হইল চা দোয়ানদার। তোর কিছু হইলে কে দেখব?’ নাফিসা বাবাকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘আরেহ কিছু হবে না, আব্বু। হাসিনা পলাই গেছে। ভার্সিটির বড় ভাইয়া-আপুদের সঙ্গে আছি।’ বাবা কড়া নির্দেশ দেন, ‘তাড়াতাড়ি বাসায় যা।’ নাফিসার জবাব আসে, ‘আর পেছনে ফিরে যাওয়ার সময় নাই আব্বু। আল্লাহ যা কপালে রাখছে তা হবে।’
এর কয়েক মিনিট পর ওদের দলটি যখন সাভার মডেল মসজিদ এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল, শুরু হয় পুলিশ-ছাত্রলীগ-যুবলীগের যৌথ হামলা। পুলিশ ছত্রভঙ্গ করতে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। মিছিলের সামনে থাকায় গুলিবিদ্ধ হয় নাফিসা। তাকে দ্রুত নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় ল্যাবজোন হাসপাতালে।
এরই মধ্যে বাবা একবার কল দেন। বাসায় ফিরছে কি না জানতে; কিন্তু কল রিসিভ হয় না। কিছুক্ষণ পর আবার বাবার নম্বরে কল আসে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা ছেলের কণ্ঠ শোনা যায়, ‘আপনি ওর কী হন?’ জবাব দেন, ‘বাবা’। তখন বলা হয়, ‘তাড়াতাড়ি ল্যাবজোন হাসপাতালে আসেন। ওর গায়ে গুলি লেগেছে।’
আচমকা এমন সংবাদে দিশাহারা হয়ে যান আবুল হোসেন।
শেষবারের মতো সোয়া ৩টার দিকে নাফিসা কল দেয় বাবাকে, বলেÑ ‘আমি মরে যাব লাশটা নিয়ে যাইও’। এ কথা শুনে নাফিসার বাবা শুধু দৌড়াতে থাকে, আর ফোন করতে থাকে। এর মধ্যে মামারাও খবর পেয়ে ছুটে যান হাসপাতালে। সেখান থেকে নাফিসাকে নিয়ে যাওয়া হয় এনাম মেডিকেলের দিকে। পথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে নাফিসা।
নাফিসার বাবা বলেন, ‘আমি যেখানে থাকি, সেখান থেকে সাভার ৩৫ কিলোমিটার দূরে। কোনো গাড়ি নেই, বাস নেই, রিকশা নেই। মেয়ের কাছে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ততক্ষণে সব শেষ। মেয়ে আর আমার সঙ্গে কথা বলেনি।’
মেডিকেল থেকে লাশ নিয়ে ফেরার পথে মুক্তির মোড়ে আরেক দফায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলার শিকার হয় তার মামারা। পুলিশের রাবার বুলেটে আহত হন এক মামা। পরে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় লাশ নিয়ে আসা হয় মামার বাসায়। সাভারে ৫ আগস্ট রাত ৯টায় প্রথম জানাজা শেষে নিয়ে যাওয়া হয় টঙ্গীতে বাবার এলাকায়। এরশাদনগরে পৈতৃক ভিটামাটিতে দাফন করা হয় নাফিসাকে।
আবুল হোসেন জানান, তার মেয়ে শহীদ হওয়ার পরে সরকার বা সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কেউ যোগাযোগ করেনি। তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও কিছু সাংবাদিক তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।
এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সাদিয়া ফারজানা দিনা আমার দেশকে বলেন, শহীদ নারীদের নিয়ে কাজ করতে চাই বলেই তালিকা তৈরি করেছি। সংগঠনের মধ্যে ইতোমধ্যে ক্লোজডোর কিছু পরিকল্পনাও হয়েছে। তবে কী কী করব, এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।