ঢাকা ০৫:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২২ জুন ২০২৫, ৭ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
তিন দলই প্রধান উপদেষ্টার অধীনে নির্বাচন চায়: প্রেস সচিব টিউলিপ বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্টধারী, রয়েছে টিআইএনও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়াই হোক নববর্ষের অঙ্গীকার: প্রধান উপদেষ্টা নরেন্দ্র মোদিকে উপহার দেওয়া ছবিটি সম্পর্কে যা জানা গেল বিমসটেকের পরবর্তী চেয়ারম্যান ড. ইউনূস বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে মোদির ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন: প্রেসসচিব চীন সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে ভারতে তোলপাড় ড. ইউনূসকে ঈদগাহের মুসল্লিরাঃ আপনি ৫ বছর দায়িত্বে থাকুন, এটাই দেশের মানুষের চাওয়া বাংলাদেশে বিশ্বমানের হাসপাতালের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লবের সূচনা! খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ঈদের দাওয়াত দিলেন প্রধান উপদেষ্টা যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন সেনাপ্রধান পররাষ্ট্র নীতিতে ড. ইউনূসের কাছে হেরে গেছেন নরেন্দ্র মোদী! ৩ এপ্রিলও ছুটির প্রস্তাব, মিলতে পারে ৯ দিনের ছুটি বউয়ের টিকটকেই ধরা সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ, ‘ক্লু’ ছিল গাড়িতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মঈনুদ্দিনের পরিচয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের পরিচয় শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে সব প্রমাণ সরকারের কাছে আছে জেলায় জেলায় সরকারি অর্থে ‘আওয়ামী পল্লি’

টাকা পাচারের স্বর্গ বাংলাদেশ

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ০৬:০৩:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / 121
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

গত দেড় দশকে টাকা পাচারের স্বর্গরাজ্য ছিল বাংলাদেশ। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সুশাসনের অভাব আর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রশ্রয়ে এ দেশের টাকা খুব সহজেই পাচার হয়েছে ভিনদেশে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, এ সময়ে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সরকারের অন্তত সাতটি নজরদারি সংস্থা থাকার পরও সবার নাকের ডগায় এই বিপুল অঙ্কের টাকা চলে গেছে বিদেশে।

আর এই পাচারের প্রায় ৮০ শতাংশই হয়েছে বাণিজ্যের আড়ালে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, নজরদারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবসহ অন্তত এক ডজন কারণে টাকা পাচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। আশার কথা হচ্ছে, অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই টাকা পাচার ঠেকানো এবং পাচার করা টাকা ফেরাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এরই মধ্যে টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত ও দুদকের বিগত বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনায় এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে গতকাল দুদকে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) দুজন প্রতিনিধি। তাঁদের কাছে পাচারের টাকা ফেরাতে সহায়তা চেয়েছে দুদক।

তথ্য-উপাত্ত থেকে আরো জানা যায়, পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বড় অঙ্কের মুদ্রা পাচার করা হয়।

কখনো আন্ডার ইনভয়েস কখনো বা ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে এই পাচার হয়ে থাকে। প্রবাসীদের বাড়তি টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে হুন্ডির মাধ্যমেও একটি বড় অঙ্কের টাকা পাচার হয়। দেশের গুটিকয়েক অসাধু শীর্ষ ব্যবসায়ী থেকে মাঝারি স্তরের ব্যবসায়ী-আমদানিকারকরাও এই পাচারচক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কাস্টমস, বন্দরসহ অনেক সংস্থার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ থাকার প্রমাণ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুসারে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।

বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচার করা টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা ধরে)। এ হিসাবে গড়ে প্রতিবছর পাচার করা হয়েছে অন্তত এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা।

এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টাকা পাচারের অন্যতম কারণ হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। পাচার করা সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও এটিই বাধা ছিল। এর সঙ্গে দুদকসহ অন্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাও দায়ী। তবে পাচারের টাকা ফেরানোর এখনই উপযুক্ত সময়।’

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদেশ থেকে পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরত আনতে চাইলে প্রথমেই দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এ ছাড়া অর্থপাচার রোধে সরকারি সংস্থাগুলোকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।’

পাচারের টাকা ফেরাতে কঠোর অন্তর্বর্তী সরকার : বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে জোরালো উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকের সময় পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সহায়তা চেয়েছেন তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থসম্পদ সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন দেশে চিঠি দেওয়া শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিবৃতি দিয়ে হাসিনা সরকারের অন্তত এক লাখ কোটি টাকা ফিরিয়ে আনবেন বলে জানিয়েছেন। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।

অর্থপাচার ঠেকাতে ৭ সংস্থা : সিআইডি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএসইসি ও দুদক অর্থপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে দুদক শুধু ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’র মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অর্থের মানি লন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে। বাকি ২৬টি সম্পৃক্ত অপরাধের তদন্তভার সিআইডি, এনবিআরসহ অন্য সংস্থাগুলোর কাছে ন্যস্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরা একযোগে কাজ করলেই পাচার কমে যাবে।

অর্থপাচারের কারণ ও প্রতিকার : বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, বিশেষজ্ঞদের মতামত ও দুদকের বিগত বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ থেকে জানা যায়, অর্থপাচার ঠেকাতে না পারার পেছনে অন্তত এক ডজন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, দুদকসহ সাতটি সংস্থার সমন্বিত অনুসন্ধানের উদ্যোগের অভাব, মানি লন্ডারিং ও আর্থিক অপরাধ উদঘাটনের ক্ষেত্রে ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিং টেকনিকের অভাব দায়ী। এ ছাড়া দুদকসহ অন্য সংস্থাগুলোতে আন্ডারকাভার অপারেশন পরিচালনার নীতিমালার অভাব, ক্রস-বর্ডার অপরাধের ক্ষেত্রে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক বা অ্যান্টিকরাপশন এজেন্সিগুলো নিয়ে গঠিত আঞ্চলিত প্ল্যাটফরম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) প্রণয়ন ও প্রেরণে দুর্বলতাও অনেকাংশে দায়ী। টাকা পাচার হওয়া দেশের সঙ্গে কার্যকর দ্বিপক্ষীয় আইনি সহযোগিতা চুক্তির অভাব, বিদ্যমান অনুসন্ধান ও তদন্তের সংখ্যার বিপরীতে কর্মকর্তাদের ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিং, ডিজিটাল ফরেনসিক, সার্ভেইল্যান্স ও আন্ডারকাভার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও স্টাডি ট্যুরের অভাবসহ আরো বেশ কয়েকটি কারণেও পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না বলে বিশ্লেষকরা জানান।

টাকা পাচারের জনপ্রিয় গন্তব্য : তথ্য-উপাত্ত বলছে, একসময় বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের জনপ্রিয় গন্তব্য ছিল সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ করস্বর্গ খ্যাত কিছু দ্বীপরাষ্ট্র। তবে গত কয়েক বছরে অর্থপাচারের গন্তব্য বদলে গেছে। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো অর্থের নিরাপদ গন্তব্য হয়ে উঠছে।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে দেশটিতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ ১১ হাজার সুইস ফ্রাঁ। ২০২২ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা আমানতের পরিমাণ ছিল পাঁচ কোটি ৫২ লাখ ১১ হাজার সুইস ফ্রাঁ এবং ২০২৩ সাল শেষে এটি নেমে এসেছে এক কোটি ৭৭ লাখ ১২ হাজার সুইস ফ্রাঁয়।

এদিকে, ব্রিটিশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারিতেও যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে সম্পত্তি মালিকের বাংলাদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধিত প্রপার্টির সংখ্যা ছিল ১৫। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ এবং ২০২১ সালের আগস্টে এই সংখ্যা বেড়ে ১০৭-এ উন্নীত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিএফএডিএস) সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কেনেন ৪৫৯ বাংলাদেশি। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাঁদের মালিকানায় মোট ৯৭২টি প্রপার্টি কেনার তথ্য পাওয়া গেছে, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায়ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। এখন পর্যন্ত তিন হাজার ৬০৪ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ গড়েছেন বলে গত মার্চে জানিয়েছেন দেশটির শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী টিয়ং কিং সিং।

এ ছাড়া বারমুডা, কেইম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো অফশোর বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত দ্বীপদেশগুলোয়ও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশিদের বিপুল বিনিয়োগের তথ্য বের হচ্ছে। অতীতেও পানামা পেপার্স ও প্যান্ডোরা পেপার্স নথিতে এমন কিছু দেশে বিনিয়োগ করা বাংলাদেশির তথ্য উঠে এসেছিল। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর ও কানাডায়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

টাকা পাচারের স্বর্গ বাংলাদেশ

আপডেট সময় : ০৬:০৩:৪১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

 

গত দেড় দশকে টাকা পাচারের স্বর্গরাজ্য ছিল বাংলাদেশ। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সুশাসনের অভাব আর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির প্রশ্রয়ে এ দেশের টাকা খুব সহজেই পাচার হয়েছে ভিনদেশে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলছে, এ সময়ে প্রায় সাড়ে ১৭ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সরকারের অন্তত সাতটি নজরদারি সংস্থা থাকার পরও সবার নাকের ডগায় এই বিপুল অঙ্কের টাকা চলে গেছে বিদেশে।

আর এই পাচারের প্রায় ৮০ শতাংশই হয়েছে বাণিজ্যের আড়ালে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, নজরদারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবসহ অন্তত এক ডজন কারণে টাকা পাচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। আশার কথা হচ্ছে, অর্ন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই টাকা পাচার ঠেকানো এবং পাচার করা টাকা ফেরাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এরই মধ্যে টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত ও দুদকের বিগত বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনায় এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে গতকাল দুদকে বৈঠক করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) দুজন প্রতিনিধি। তাঁদের কাছে পাচারের টাকা ফেরাতে সহায়তা চেয়েছে দুদক।

তথ্য-উপাত্ত থেকে আরো জানা যায়, পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বড় অঙ্কের মুদ্রা পাচার করা হয়।

কখনো আন্ডার ইনভয়েস কখনো বা ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে এই পাচার হয়ে থাকে। প্রবাসীদের বাড়তি টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে হুন্ডির মাধ্যমেও একটি বড় অঙ্কের টাকা পাচার হয়। দেশের গুটিকয়েক অসাধু শীর্ষ ব্যবসায়ী থেকে মাঝারি স্তরের ব্যবসায়ী-আমদানিকারকরাও এই পাচারচক্রের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, কাস্টমস, বন্দরসহ অনেক সংস্থার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ থাকার প্রমাণ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যানশিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুসারে, গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯.২০ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে।

বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচার করা টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা ধরে)। এ হিসাবে গড়ে প্রতিবছর পাচার করা হয়েছে অন্তত এক লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা।

এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘টাকা পাচারের অন্যতম কারণ হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। পাচার করা সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও এটিই বাধা ছিল। এর সঙ্গে দুদকসহ অন্য সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাও দায়ী। তবে পাচারের টাকা ফেরানোর এখনই উপযুক্ত সময়।’

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিদেশ থেকে পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরত আনতে চাইলে প্রথমেই দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এ ছাড়া অর্থপাচার রোধে সরকারি সংস্থাগুলোকে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।’

পাচারের টাকা ফেরাতে কঠোর অন্তর্বর্তী সরকার : বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্যে জোরালো উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকের সময় পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সহায়তা চেয়েছেন তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থসম্পদ সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন দেশে চিঠি দেওয়া শুরু করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিবৃতি দিয়ে হাসিনা সরকারের অন্তত এক লাখ কোটি টাকা ফিরিয়ে আনবেন বলে জানিয়েছেন। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।

অর্থপাচার ঠেকাতে ৭ সংস্থা : সিআইডি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিএসইসি ও দুদক অর্থপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে দুদক শুধু ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’র মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অর্থের মানি লন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে। বাকি ২৬টি সম্পৃক্ত অপরাধের তদন্তভার সিআইডি, এনবিআরসহ অন্য সংস্থাগুলোর কাছে ন্যস্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরা একযোগে কাজ করলেই পাচার কমে যাবে।

অর্থপাচারের কারণ ও প্রতিকার : বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, বিশেষজ্ঞদের মতামত ও দুদকের বিগত বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ থেকে জানা যায়, অর্থপাচার ঠেকাতে না পারার পেছনে অন্তত এক ডজন কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, দুদকসহ সাতটি সংস্থার সমন্বিত অনুসন্ধানের উদ্যোগের অভাব, মানি লন্ডারিং ও আর্থিক অপরাধ উদঘাটনের ক্ষেত্রে ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিং টেকনিকের অভাব দায়ী। এ ছাড়া দুদকসহ অন্য সংস্থাগুলোতে আন্ডারকাভার অপারেশন পরিচালনার নীতিমালার অভাব, ক্রস-বর্ডার অপরাধের ক্ষেত্রে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক বা অ্যান্টিকরাপশন এজেন্সিগুলো নিয়ে গঠিত আঞ্চলিত প্ল্যাটফরম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা, মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) প্রণয়ন ও প্রেরণে দুর্বলতাও অনেকাংশে দায়ী। টাকা পাচার হওয়া দেশের সঙ্গে কার্যকর দ্বিপক্ষীয় আইনি সহযোগিতা চুক্তির অভাব, বিদ্যমান অনুসন্ধান ও তদন্তের সংখ্যার বিপরীতে কর্মকর্তাদের ফরেনসিক অ্যাকাউন্টিং, ডিজিটাল ফরেনসিক, সার্ভেইল্যান্স ও আন্ডারকাভার বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও স্টাডি ট্যুরের অভাবসহ আরো বেশ কয়েকটি কারণেও পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না বলে বিশ্লেষকরা জানান।

টাকা পাচারের জনপ্রিয় গন্তব্য : তথ্য-উপাত্ত বলছে, একসময় বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের জনপ্রিয় গন্তব্য ছিল সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ করস্বর্গ খ্যাত কিছু দ্বীপরাষ্ট্র। তবে গত কয়েক বছরে অর্থপাচারের গন্তব্য বদলে গেছে। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো অর্থের নিরাপদ গন্তব্য হয়ে উঠছে।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে দেশটিতে বাংলাদেশিদের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ ১১ হাজার সুইস ফ্রাঁ। ২০২২ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা আমানতের পরিমাণ ছিল পাঁচ কোটি ৫২ লাখ ১১ হাজার সুইস ফ্রাঁ এবং ২০২৩ সাল শেষে এটি নেমে এসেছে এক কোটি ৭৭ লাখ ১২ হাজার সুইস ফ্রাঁয়।

এদিকে, ব্রিটিশ সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১০ সালের জানুয়ারিতেও যুক্তরাজ্যের আবাসন খাতে সম্পত্তি মালিকের বাংলাদেশের ঠিকানা ব্যবহার করে নিবন্ধিত প্রপার্টির সংখ্যা ছিল ১৫। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২ এবং ২০২১ সালের আগস্টে এই সংখ্যা বেড়ে ১০৭-এ উন্নীত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিএফএডিএস) সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কেনেন ৪৫৯ বাংলাদেশি। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাঁদের মালিকানায় মোট ৯৭২টি প্রপার্টি কেনার তথ্য পাওয়া গেছে, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায়ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। এখন পর্যন্ত তিন হাজার ৬০৪ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ গড়েছেন বলে গত মার্চে জানিয়েছেন দেশটির শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী টিয়ং কিং সিং।

এ ছাড়া বারমুডা, কেইম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডের মতো অফশোর বিনিয়োগের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত দ্বীপদেশগুলোয়ও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশিদের বিপুল বিনিয়োগের তথ্য বের হচ্ছে। অতীতেও পানামা পেপার্স ও প্যান্ডোরা পেপার্স নথিতে এমন কিছু দেশে বিনিয়োগ করা বাংলাদেশির তথ্য উঠে এসেছিল। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর ও কানাডায়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার করা হয়েছে।