তাপসের প্রকৌশলী চক্রের ২০০ কোটি লোপাট
- আপডেট সময় : ০৮:৫২:০৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৫৬ বার পড়া হয়েছে
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) কয়েকজন প্রকৌশলীকে নিয়ে চক্র গড়ে তুলেছিলেন সংস্থাটির সদ্য সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এ চক্রের মাধ্যমে কয়েকশ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।
এ চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন সংস্থাটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) কাজী বোরহান উদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) আনিছুর রহমান ও অঞ্চল-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মিথুন চন্দ্র শীলসহ আরও বেশ কয়েকজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকৌশলী চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে নিয়োগে জালিয়াতি থেকে শুরু করে প্রকল্পের টাকা লুটপাট, ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি, দরপত্র জালিয়াতি করে অর্থ আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি তাপস। বরং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অভিযুক্তদের নানাভাবে অনিয়ম করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় করপোরেশনের কয়েকশ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের লোভনীয় নানা প্রকল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সম্প্রতি ডিএসসিসির নানা বিষয় বিশেষভাবে পর্যালোচনা শুরু করেছে তারা। এতে সংস্থাটির বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীর অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র পাওয়া গেছে। এসব অনিয়মের তদন্ত করতে সিটি করপোরেশনকে আগেও একাধিকবার চিঠি দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের হাতেই তুলে দেওয়া হয় বড় বড় প্রকল্প।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগেই বিদেশে পাড়ি জমান শেখ তাপস। এরপর থেকে রঙ পাল্টে ফেলার চেষ্টা করছেন অভিযুক্ত প্রকৌশলীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপিন্থি একজন প্রকৌশলী ও শ্রমিক দলের নেতাদের সামনে রেখে সিটি করপোরেশনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে কাজী বোরহান উদ্দিন, আনিছুর রহমান ও মিথুন চন্দ্র শীলের বিরুদ্ধে।
জালিয়াতিতে সিদ্ধহস্ত বোরহান-মিথুন চক্র : ডিএসসিসির সঙ্গে নতুন সংযুক্ত ‘অনুন্নত’ এলাকার সড়ক উন্নয়নে ‘শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল ও সারুলিয়া এলাকা সড়ক অবকাঠামো এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। ১৭৪ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের জন্য ৭৬৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। ২০১৭ সালে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটির কাজ শেষ দেখানো হয় ২০১৯ সালে। কাগজপত্রে কাজ শেষ দেখানোর সময় অনেক কাজ বাকি ছিল। যে কাজ শেষ করতে আরও সময় নেন প্রকল্প পরিচালক বোরহান উদ্দিন ও নির্বাহী প্রকৌশলী মিথুন চন্দ্র শীল।
সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত এত বড় বাজেটের সড়ক নির্মাণের পর পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে কোনো সংস্কারকাজ করতে হয় না। কিন্তু এই প্রকল্পের এমন অবস্থা করেছে যে, একদিক দিয়ে নির্মাণকাজ চলেছে অন্যদিকে ভেঙে গেছে। এক-দেড় বছরের মাথায় সড়ক খানাখন্দ দেখা দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় জনগণ বেশ বড় আকারে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ প্রকল্পে অন্তত ১৫৪ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এরপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ডিএসসিসি। পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ডিএসসিসিকে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয়।
সেই চিঠির আলোকে গত ৫ মে সংস্থাটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাছিম আহমেদের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করে ডিএসসিসি। কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হলেও এখন পর্যন্ত তা দেওয়া হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, বোরহান ও মিথুন সাবেক মেয়র শেখ তাপসের ঘনিষ্ঠদের ম্যানেজ করে ওই প্রতিবেদন ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির একজন সদস্য জানিয়েছেন, ওপরের নির্দেশেই তদন্তে বিলম্ব করেছেন তারা। এ ছাড়া ‘নাসিরাবাদ, ডেমরা ও মান্ডা এলাকার সড়ক অবকাঠামো এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের (প্যাকেজ-১৭) বিল ও জামানত পরিশোধের জন্য মিথ্যা, প্রতারণামূলক প্রত্যয়ন ও জালিয়াতি ধরা পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ এপ্রিল একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএসসিসি। এই কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়। কিন্তু গত চার মাসেও এ প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদার ও এ দুই প্রকৌশলী মিলে এ তদন্তও ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন।
রায়েরবাজার-কামরাঙ্গীরচর ৮ লেনের সড়কে দরপত্র জালিয়াতি : ‘রায়ের বাজার সøুইসগেট থেকে লোহার ব্রিজ পর্যন্ত ইনার সার্কুলার রিং রোডের উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির অভিযোগ আছে কাজী বোরহান উদ্দিনের বিরুদ্ধে। ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনের জন্য নেওয়া ৯৭৪ কোটি টাকার প্রকল্পটি গত ২৫ মে উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ প্রকল্পের পরিচালক ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী বোরহানের বিরুদ্ধে দরপত্র জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে।
ডিএসসিসির নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, জালিয়াতি করে, মোট ব্যয় অপরিবর্তিত রেখে প্রধান প্রধান আইটেমের দর বৃদ্ধি, স্পেসিফিকেশন নিম্নমানে পরিবর্তন করে ই-জিপিতে দুবার বিওকিউ পরিবর্তন এবং দরপত্র দাখিলের সময় বাড়িয়ে অন্তত ৩০ কোটি টাকা ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে আত্মসাৎ করা হয়েছে। ডিএসসিসির কালো তালিকাভুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে এনডিইকে এ প্রকল্পের কাজ দেওয়া হয়। ই-জিপির দরপত্র-৯৫১০৭৪ পরীক্ষা করলেই জালিয়াতি প্রমাণিত হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তাছাড়া মেয়র সাঈদ খোকনের আমলে বোরহান অন্তত ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। সেখানেও অনিয়ম-দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ ওঠে। কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ উপায় উপার্জিত অর্থের জোরে বারবার পার পেয়ে যান এ প্রকৌশলী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ও ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাছিম আহমেদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি প্রক্রিয়াধীন আছে। আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সময় বাড়িয়ে নিয়েছি।’
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, কাজী বোরহান উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন প্রকৌশলীর ব্যাপারে ডিএসসিসি থেকে একটি পর্যবেক্ষণ তারা পেয়েছেন। সেই পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কোনো নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়াই ২০০১ সালের ৭ মে তৎকালীন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন বোরহান উদ্দিন। অপেক্ষমাণ তালিকাসংক্রান্ত সভার কার্যবিবরণী জালিয়াতি করে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। তবে প্রথম শ্রেণির পদে অপেক্ষমাণ তালিকা প্রস্তুত বা অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে নিয়োগের সুযোগ নেই। পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বোরহান উদ্দিন নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সাবেক মেয়র শেখ তাপস দায়িত্ব নেওয়ার চার মাস আগে বাছাই কমিটির সভার কার্যবিবরণীতে বোরহান উদ্দিনের নাম যুক্ত করা হয়। যদিও সরকারি নিয়মানুসারে সভা অনুষ্ঠানের চার মাস পর দাপ্তরিক আদেশ জারি করার কোনো সুযোগ বা বৈধতা থাকে না।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী বোরহান উদ্দিন দেশ রূপান্তরের কাছে দাবি করেন, তার প্রকল্পে কোনো নিম্নমানের কাজ হয়নি। যে বিষয়গুলো তদন্তাধীন আছে, তাতে কমিটি রিপোর্ট দিলে সব স্পষ্ট হবে।
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য নিতে অঞ্চল-৩-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মিথুন চন্দ্র শীলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগর চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
দুর্নীতি প্রমাণের পরও বহাল তবিয়তে আনিছুর : মালামাল না পেয়েই বিল দিয়ে দেওয়া এবং রোড মার্কিং না করেই ভুয়া ব্যাখ্যা দেওয়াসহ নানা অভিযোগ উঠেছে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে। তার দুর্নীতিসংক্রান্ত বেশ কিছু নথি দেশ রূপান্তরের হাতে এসেছে।
এসব নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত এপ্রিল মাসে প্রকৌশলী আনিছুরের বিরুদ্ধে ‘সাপ্লাই জেনসোলিন এবং থার্মোপ্লাস্টিক পেইন্ট’ শীর্ষক কাজের মালামাল সংগ্রহ না করেই ২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বিল পরিশোধ এবং ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকার বিল পরিশোধের প্রত্যয়নে দুর্নীতি প্রমাণিত হয়। যার ফলে ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর প্রকল্প পরিচালক ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। বিধি অনুসারে এ সংক্রান্ত নথি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু সাবেক মেয়রের ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে এ বিষয়টি চাপা দেন আনিছুর। চার বছরেও এ তথ্য দুদকে পাঠায়নি ডিএসসিসি।
চুক্তির শর্ত পূরণ না করেই ‘সাপ্লাই পোর্টেবল এয়ার কম্প্রেশার-২’ এবং ‘সাপ্লাই ব্র্যান্ড নিউ বিটুমেন প্রেশার ডিস্ট্রিবিউটর’ শীর্ষক দুটি কাজের জন্য ৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা বিল জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাকডেট দিয়ে পরিশোধ করা হয়েছে।
ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, গত বছর আনিছুর রহমান মেয়াদ উল্লেখ ছাড়া এবং মেয়াদোত্তীর্ণ মালামাল যান্ত্রিক বিভাগের গুদামে রাখেন। তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী সরেজমিন পরিদর্শনে বিষয়টির সত্যতা পান। তখন প্রকল্প পরিচালক ও প্রকৌশলীদের মেয়াদোত্তীর্ণ ও চুক্তিবহির্ভূত পণ্য অপসারণের অনুরোধ করা হয়।
ডিএসসিসির নথি বলছে, পণ্যের বৈশিষ্ট্য এবং মান সম্পর্কে সঠিক ও পরিপূর্ণ বর্ণনা সংশ্লিষ্ট নথিতে পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে প্রমাণসহ লিখিতভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য গত বছর ১৭ জুলাই প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আনিছুরসহ দুই প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেওয়া হয়। তারা ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন, বিভিন্ন জায়গায় রোড মার্কিংয়ের কাজ করেছেন। কিন্তু ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগের পরিদর্শনে সেই রোড মার্কিংয়ের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় গত বছর ১৯ সেপ্টেম্বর আনিছুর রহমানসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেন ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান।
অভিযোগের বিষয়ে আনিছুর রহমানের মোবাইল ফোনে গত শনিবার যোগাযোগ করলে তিনি পরে কথা বলবেন বলে জানান। কিন্তু এরপর একাধিকবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রশাসক মহ. শের আলী সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে গত শনি ও রবিবার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।