তারেক রহমানের এই দৃষ্টিভঙ্গি কি বিএনপির ‘ঘরে’ ফেরার লক্ষণ।
- আপডেট সময় : ০৬:৩৩:৩০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ ৮৫ বার পড়া হয়েছে
তারেক রহমানের এই দৃষ্টিভঙ্গি কি বিএনপির ‘ঘরে’ ফেরার লক্ষণ।
সাইমুম পারভেজ।
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে হাসিনা সরকারের পতন শুধু একটি শাসনক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজের কাঠামো পরিবর্তনে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার একটি স্পষ্ট প্রতিফলন। এই গণ-অভ্যুত্থান, বিশেষ করে তারুণ্যের জাগরণ বাংলাদেশে একটি নতুন ‘পাবলিক স্ফেয়ার’ বা জনপরিসর তৈরি করে করেছে।
সুশীল সমাজের বিন্যাসেও পরিবর্তন এসেছে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে অবদান রাখা, রাষ্ট্রকাঠামো ও শাসনব্যবস্থায় শরিক হওয়ার যে প্রবণতা, তা নতুন সময় ও বন্দোবস্তের ইঙ্গিত দেয়। এই নতুন সময়ের বুদ্ধিজীবিতা কেমন হবে এবং জনপরিসরে গণমানুষের পরিচয় তৈরিতে সুশীল সমাজ ও রাজনীতিকেরা কী ভূমিকা রাখবেন, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
এ কথা এখন স্পষ্ট যে বাংলাদেশে বর্তমান আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি জনভিত্তি ও প্রাসঙ্গিকতা—দুটিই হারিয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহযোগিতায় কাঠামোগত (সিস্টেমেটিক) হত্যাকাণ্ড হয়েছে, গুরুতর আহত হয়েছেন হাজারো মানুষ। এই হত্যাযজ্ঞ আওয়ামী লীগের রাজনীতির নৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে করে দিয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে অসামান্য অবদান রাখা এই দলকে এখন তার নিজের দেশের মানুষের ওপর নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের দায় নিতে হবে। হত্যাকাণ্ডের কুশীলবদের বিচারের মুখোমুখি করা এখন জনদাবি।
বাংলাদেশের সুশীল সমাজের পরিচয় নির্মাণপ্রক্রিয়ার একটি বড় অংশই প্রধানত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানবিরোধিতা ও শেখ মুজিবের বিশালতার যে মহাবয়ান (গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ), তার ওপর ভিত্তি করেই রচিত। আওয়ামী লীগের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এই একক বয়ানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বকে সমুন্নত রাখা, বাংলাদেশ গঠনে শেখ মুজিবের সঙ্গে সঙ্গে অন্য নেতাদেরও মূল্যায়ন করা এবং বহুত্ববাদ ও অসাম্প্রদায়িকতার ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে চ্যালেঞ্জ, তা বুদ্ধিজীবী ও রাষ্ট্র পরিচালকদের বোঝা জরুরি।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘সিভিক ন্যাশনালিজম’ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বাংলায় একে আমরা ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদ’ বলতে পারি। একই সংস্কৃতি, ভাষা বা ধর্মের ওপর ভিত্তি করে যে জাতীয়তাবাদ তা ‘এথনোসেন্ট্রিজম’ বা ‘জাতিকেন্দ্রিকতা’ দুষ্ট। অধ্যাপক ডোনাল্ড ইপারসিয়েলের মতে, এথনিক জাতীয়তাবাদ কর্তৃত্ববাদী, এমনকি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা তৈরির অনুকূল অবস্থা তৈরি করে (দেখুন কনস্টিটিউশনাল ডেমোক্রেসি অ্যান্ড সিভিক ন্যাশনালিজম, ২০০৭)।
এর বিপরীতে রাষ্ট্রের সীমানা নির্ভর নাগরিকত্বভিত্তিক যে জাতীয়তাবাদ, তাতে কাঠামোগতভাবেই বহুত্ববাদকে অনুপ্রাণিত করে। কারণ, সিভিক ন্যাশনালিজম বা নাগরিক জাতীয়তাবাদে এ একই ভাষা বা সংস্কৃতি নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, উদার নীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস আনাই জাতীয়তার শর্ত।
আর্নেস্ট রেনান (১৮৮২), হ্যান্স কোন (১৯৪৪) ও ক্লিফোর্ড গির্টজ (১৯৬৩)-এর গবেষণায়ও পশ্চিমের কার্যকর গণতন্ত্রের বিকাশের পেছনে নাগরিক জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদ’-এর আদলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাফল্য ইতিহাসে স্বীকৃত। রাষ্ট্রীয় আইনগত, নীতিগত ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক জাতীয়তাবাদে যে কেউ সহজেই একীভূত (ইন্টিগ্রেট) হতে পারে। এর বিপরীতে একই ভাষা, সংস্কৃতি, অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে তৈরি জাতীয়তাবাদ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অসহনশীলতার দিকে ঝুঁকে পড়ে। বাংলাদেশের মূলনীতি যদি সাম্য, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতা ও সহনশীলতার ওপর নির্মিত হয়, তবে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিভেদ থেকে অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব।
আওয়ামী লীগের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে দায় বিএনপির। নাগরিক জাতীয়তাবাদের ধারণা এই দলের কাছে নতুন নয়। কারণ, দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান যে জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন, তা আসলে তাত্ত্বিকভাবে ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদ’-এর সবচেয়ে কাছাকাছি। তবে জাতীয়তাবাদের এই ধারাও যেন কর্তৃত্ববাদে পরিণত না হয়, সে লক্ষ্যে নাগরিক সমাজ ও বিএনপির মধ্যে দূরত্ব কমানো প্রয়োজন।
বিএনপি গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের মধ্যে বিএনপিকে নিয়ে একধরনের দ্বিধা লক্ষ করা যায়। বিএনপির সঙ্গে সহযোগিতা করার এই দ্বিধা দল হিসেবে বিএনপি এবং দলটির নেতা তারেক রহমান উভয়ের প্রতিই। কিন্তু ন্যায়ভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে দুই পক্ষ থেকেই এই দ্বিধা কাটিয়ে তোলা জরুরি।