‘দুঃখের জালে’ মা-ইলিশের মরণ
- আপডেট সময় : ০৬:৩৫:৩৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪
- / 51
মা-ইলিশ শিকারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ছিল ১৩ অক্টোবর রাত ১২টা থেকে ৩ নভেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত মোট ২২ দিন। এই সময়ে কী চলে উপকূলের নদীগুলোতে? নিজের চোখে দেখার জন্য গত ৩০ অক্টোবর বুধবার রাতের ভাত খেয়ে ঠিক ১০টায় স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। সঙ্গে নিলাম ছেলের একটা স্কুলব্যাগ, একটা তোয়ালে, লুঙ্গি ও এক জোড়া শার্ট-প্যান্ট। মোবাইল ফোনের চার্জারটাও নিতে ভুললাম না।
শর্টপ্যান্টের পকেটে নিয়ে নিলাম হাজার তিনেক টাকা। তারপর পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা সদর থেকে তেঁতুলিয়া নদীপারের একটি ঘাটে পৌঁছতে ভাড়ার মোটরসাইকেলে লাগল ২৮ মিনিট।
‘দুঃখের জালে’ মা-ইলিশের মরণঘাটে অনেক মানুষ, কিন্তু কোনো কোলাহল নেই। কথাবার্তা চলছে চাপা স্বরে।
বুঝতে বাকি রইল না, এরা সবাই জেলে। প্রস্তুতি চলছে ইলিশ শিকারের। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু পুব আকাশে একটা উজ্জ্বল তারা।
সেটির দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকোয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. লোকমান আলীর কথাগুলো। তিনি বলেছিলেন, ‘কদিন আগে আমি ঢাকা যাওয়ার সময় দেখেছি, তেঁতুলিয়া নদীতে জেলেরা বেপরোয়াভাবে মা-ইলিশ শিকার করছে। তার মানে, সরকারের বর্তমান পরিকল্পনা সঠিক নয়। জেলেদের দেওয়া প্রণোদনা যথেষ্ট নয়। এ কারণেই এমন দৃশ্য দেখতে হয়।
এভাবে চলতে থাকলে তো দেশ থেকে ইলিশ হারিয়ে যাবে।’
হঠাৎ জেলেদের আলাপ কানে আসতেই সংবিৎ ফেরে। জানা গেল, রাত ১টা ২০ মিনিট থেকে ৩টা পর্যন্ত ইলিশ শিকারের ‘জো’ বা ‘জোবা’। অর্থাৎ ওই সময় জালে ইলিশ ধরা পড়বে। জেলেরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে নামার জন্য। ঘাটের পাশেই ছোট একটি খাল থেকে একে একে জেলে নৌকাগুলো নিঃশব্দে রওনা হচ্ছে তেঁতুলিয়া নদীতে। ঘাটপারের কয়েকটি দোকান এখনো খোলা। সেখান থেকে কেউ সিগারেট, কেউ বিস্কুট, চানাচুর, মুড়ি কিনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন নদীতে নামার। কেনাকাটায় ব্যস্ত ১২-১৪ জন জেলের মধ্যে পরিচিত দু-তিনজনের চোখে পড়ে যাই। তারা সটকে পড়ার চেষ্টা করেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আলাপ জুড়লে তাদের ভয়ের কারণটা জানা যায়। তারা ভেবেছেন, সাংবাদিক এসেছেন, নিষিদ্ধ মৌসুমে ইলিশ শিকারের বিষয়টি পুলিশকে খবর দিয়ে ধরিয়ে দিতে পারেন।
কানে বাজল ঢাকার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ, অ্যাকোয়াকালচার অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের শিক্ষক-গবেষক মীর মোহাম্মদ আলীর কণ্ঠ। তিনি বলেছিলেন, ‘নিষিদ্ধ মৌসুমে জেলেদের যে প্রণোদনা দেওয়া হয়, তা সঠিক নীতিতে হয় না। দেখা যায়, এক উপজেলায় নিবন্ধিত জেলে আছে এক লাখ, কিন্তু প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে ৫০ হাজারকে। বাকি ৫০ হাজারের কী অবস্থা হবে? আবার তাদের দেখাদেখি যারা প্রণোদনা পায়, তারাও চুরি করবে—এটা মানুষের স্বভাব।’
ভীত-চিন্তিত জেলেদের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে মিশে তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা, অভাব-দারিদ্র্য আর ঋণে জর্জরিত অসহায় জীবনের কথা সব জানা আছে ইত্যাদি জানিয়ে তাদের অভয় দেওয়ার চেষ্টা করি। কিছুটা কাজ হলো বলে মনে হলো। রাজীব, নিজাম, রহিম, জয়নাল, ইব্রাহিম, এছাহাকসহ বেশ কয়েকজন জেলে মুখ খুললেন। বললেন, ‘আমরা অ্যাহন নদীতে ইলিশ ধরতে নামমু। সরকারের আইনে আমরা চোর। ধরা পড়লে জেল, জাল-নৌকা সবই যাইবে। কিন্তু এই চুরি ছাড়া আমাগো কোনো উপায় নাই।’
কবির নামের এক জেলে তার পরিবারের অভাব-অনটনের কথা বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘আশা ব্যাংকে (আশা এনজিও) আমার ৮০ আজার টাহা লোন; সপ্তাহে দুই হাজার ৫০০ টাহা কিস্তি। ব্র্যাকে ৮০ হাজার টাহা লোন; ওইহানে দেওয়া লাগে মাসে আট আজার টাহা কিস্তি। বউয়ের মেরুদণ্ডে সমস্যা; খালি ব্যতায় চিল্লায়। ভালো ডাক্তার দেহাইতে টাহা লাগে। সংসারের খরচ আছে। সবই জাল-নৌকার উপরে। এ ছাড়া আমার কোনো কামাই নাই। মাছ চুরি না করলে করমু কী? আমরা মানুষ, কিন্তু চোর! অ্যাহন আর কতা কইতে পারমু না; চুরি করতে নামমু!’
আমাকে আপনাদের সঙ্গে নেবেন?—এমন প্রশ্নের জবাবে কেউই রাজি হননি। সবার এক কথা, ‘ধরা পড়লে আমরা জেলে যামু। আমনেরেও জেল দেবে; অপমান করবে। কিন্তু আমনে তো চোর না। আমনেরে আমরা নেতে পারমু না।’
ধরা পড়লে আমিও জেলে যাব; অপমান করলে অপমান হব, সমস্যা নাই ইত্যাদি বলে অনেক পীড়াপীড়ি শুরু করলে সেই কবির জেলের মন গলল; রাজি হলেন তার নৌকায় নিতে।
রাতের আঁধারে : ঘড়ির কাঁটায় রাত ১টা ৩ মিনিট। শুরু হলো তেঁতুলিয়া নদীতে আমাদের ‘অশুভ যাত্রা’। নৌকায় কবিরের সঙ্গে আরো দুজন জেলে। বরেণ্য সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র মাঝির নাম ছিল কুবের, আর আমাদের মাঝির নাম কবির। তবে এই কবির এখন আইনের দৃষ্টিতে মাঝি বা জেলে নন—‘চোর’; আর আমিও যেন সাংবাদিক নই—‘চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা’। কথাগুলো ভাবতেই বেশ রোমাঞ্চ জাগল মনে।
মাঝনদীতে পৌঁছানোর পর হঠাৎ কুয়াশায় ঢেকে গেল চারদিক। শীত শীত ভাব হলো। ব্যাগ থেকে তোয়ালেটা বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। তবে মিনিট দশেক নৌকা এগোতেই কুয়াশা কেটে গেল। ইঞ্জিন বন্ধ রেখে দাঁড়-বইঠা বেয়েই নৌকা চলল লঞ্চঘাট থেকে উত্তর-পূর্ব কোণে চন্দ্রদ্বীপ এলাকায়। পুলিশের ভয়ে সব নৌকা ইঞ্জিন বন্ধ রেখেই চলছে ইলিশ শিকারে।
রাত ১টা ৩৯ মিনিটে আমাদের নৌকা থেকে প্রথম জাল ফেলা হলো। ফাঁসের মাপ অনুমান করে বোঝা গেল, এই জাল নিষিদ্ধ। জেলেরাও সেটা মেনে নিয়ে বললেন, ‘যা দ্যাখবেন, সবই নিষিদ্ধ জাল। এইয়া বাদে জাল পাইবেন কই?’
জাল ফেলার ২৭ মিনিট পর ২টা ১৭ মিনিটে সেই জাল টানা শুরু করলেন জেলেরা। সুঠাম দেহে শক্ত হাতে জেলেদের জাল টানার দৃশ্য রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে দেখছিলাম। ঠিক সাত মিনিটের মাথায় ঘোর অন্ধকারে বিজলির মতো ঝিলিক দিয়ে উঠল বহু কাঙ্ক্ষিত আমাদের জাতীয় মাছ, দেশের গর্ব ইলিশ। মাঝারি আকার, ৬০০ গ্রামের মতো ওজন, তবে পেট ভরা ডিম।
এবার কানে বাজল কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহার দেওয়া তথ্য—‘একটা মা-ইলিশের পেটে যে ডিমের চাকা হয়, আকারভেদে তা থেকে অন্তত দুই লাখ, এমনকি ২৪ লাখ পর্যন্ত ইলিশ পোনার জন্ম হতে পারে।’
মনটা বিষিয়ে গেল। বিমর্ষ হৃদয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলাম জেলেদের জাল টানার দৃশ্য। প্রথম মা-ইলিশটা ওঠার দুই মিনিট বাদে একই আকারের আরেকটি ইলিশের দেখা মিলল। এর ১৫ মিনিটের মধ্যে ৩০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের আরো পাঁচটি ইলিশ উঠে এলো জালে। চার মিনিট পর পাওয়া গেল আরো দুটি ছোট ইলিশ। ৩৭ মিনিটের মধ্যে জাল টানা শেষ হয়ে যায়। ৯টি ইলিশের মধ্যে ৭টির পেটেই ডিম।
বিষণ্ন মনে তাকিয়ে রইলাম নদীর দিকে। কানে ভেসে এলো শিক্ষক-গবেষক মীর মোহাম্মদ আলীর বাকি কথাগুলো, “নদী হলো মা-ইলিশের ‘মায়ের বাড়ি’। এখানে ডিম ছাড়তে এসে কত যে বিপদ ওদের! যে এলাকার ৫০ হাজার নিবন্ধিত জেলেকে প্রণোদনার আওতায় নেওয়া হলো, সেই এলাকায় হয়তো অনিবন্ধিত জেলে আছে আরো ৫০ হাজার। তারা কী করবে? বাঁচার জন্য তারাও তো মাছ চুরি করবে। তার ওপর প্রতিবছর নদী ও সাগরে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় যে তিন দফায়, সেই সময়গুলোতে অভাবী ও ঋণগ্রস্ত জেলেরা বাধ্য হয়েই মা-ইলিশ, চাপলি (ইলিশের বাচ্চা), জাটকা চুরি করে শিকার করে থাকে।’
কবিরের কাছে জানা গেল, তিনিও নিবন্ধিত জেলে। গত বছর না পেলেও এবার প্রণোদনার চাল পেয়েছেন; তবে দোকানে নিয়ে মেপে দেখেন, ২৫ কেজি কোথায়, চাল আছে ১৭ কেজি। কিন্তু অভিযোগ করার কোনো উপায় নেই। নৌকার অন্য দুই জেলের মধ্যে একজন নিবন্ধিত, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও প্রণোদনার চাল পাননি। আরেকজন নিবন্ধনের সুযোগই পাননি।
ঘড়ির কাঁটায় যখন রাত ৪টা ৭ মিনিট, আমাদের নৌকা তখন আগের ঘাটে এসে ভিড়ল। জেলেদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করবেন এই মাছগুলো? জবাব এলো, ‘কাস্টমার ঠিক করা আছে। টাহাও দেওয়া আছে অনেকের। অ্যাহন ফোন করব; এসে নিয়ে যাবে। বেয়ান (সকাল) হওয়ার আগেই শ্যাষ অইয়া যাইবে।’
জানা গেল, অবরোধের (নিষেধাজ্ঞার) সময় সবাই এভাবেই মাছ বিক্রি করে। ৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হবে ৬০০ টাকায়; ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রামেরটা বিক্রি হবে ৮০০ টাকায়; ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রামেরটা ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা; আর এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হবে ১২০০ টাকায়। তীরে পৌঁছতে না পৌঁছতেই তিনজন মানুষ এসে ইলিশগুলো ওজন দিয়ে কিনে নিয়ে গেলেন।
এ সময় আরো পাঁচটি জেলে নৌকা এসে ভিড়ল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, একটি নৌকায় ইলিশ মিলেছে ছয়টি, অন্যটিতে সাতটি, আরেকটিতে চারটি, বাকি দুটিতে ৯টি ও পাঁচটি করে ইলিশ পাওয়া গেছে। এগুলোও আগে থেকে ঠিক করা ক্রেতারা এসে নিয়ে গেলেন। আরো প্রায় ৩০ জনকে অপেক্ষায় থাকতে দেখা গেল তীরে।
তীরে নেমে কবির মাঝি বললেন, ‘এত রাইতে কই যাইবেন?’
বললাম, পাশে মসজিদ আছে, ওখানেই বিশ্রাম নেব। মসজিদের বারান্দায় গিয়ে বসতেই চোখ ভেঙে তন্দ্রা এলো; ভাঙল মাইকে আজানের ধ্বনিতে। নামাজ সেরে মুসল্লিরা চলে যাওয়ার পর মসজিদের মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ি। কোলাহলে জেগে দেখি, ঘড়িতে সকাল ৮টা। পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট দিয়ে গলা ভেজাই। স্থানীয়দের সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা চলে প্রায় ৯টা পর্যন্ত। হঠাৎ হাজির হন কবির জেলে। এভাবে দেখে আফসোসের সুরে বলেন, ‘ভাই, আমনে এসব কী করতেয়াছেন? এখন কী করবেন? কই যাইবেন?’
আমার পাল্টা প্রশ্ন, দিনে কখন নামবেন নদীতে?’
শুনে ভীষণ অবাক জেলে ভাই। বললেন, ‘১১টায় জো শুরু অইবে।’
আমিও যাব আপনার সঙ্গে।
এবার প্রায় আঁতকে উঠে আমাকে পাশে ডেকে নিয়ে কবির বললেন, ‘ভাই, ভাত খান।’ অনেক চেষ্টা করেও যখন ভাত খাওয়াতে পারলেন না, তখন বললেন, ‘এখানে শুয়ে পড়েন। আমি যখন নদীতে যামু, আমনেরে ঘুমের তন উডাইয়া নিমু।’
দিনের আলোয় : কবির মাঝি এসে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন ১০টা ৩০ মিনিটে; যাত্রা শুরু করলেন ১০টা ৪২-এ। সঙ্গে রাতের দুই জেলেও। তেঁতুলিয়ার মাঝামাঝি গিয়ে জাল পাতা শুরু হলো সকাল ১১টা ২৭ মিনিটে, শেষ হলো ১২টা ১৭ মিনিটে। এরপর নৌকাটি একটি ডুবোচরে ধানক্ষেতের আড়ালে ছোট খালের মধ্যে নোঙর করে রাখা হলো। পাশাপাশি আরো ১৪টি নৌকা একইভাবে জাল ফেলে নোঙর করা। হঠাৎ একজন জেলের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। খবর এলো, প্রশাসনের লোকজন স্পিডবোট নিয়ে এদিকেই আসছে। তড়িঘড়ি জেলেরা নৌকাগুলো খালের মধ্যে ঢুকিয়ে দৌড়ে লুকিয়ে পড়েন ডুবোচরের ধানক্ষেতে। তাদের ইশারায় আমিও ছুট লাগাই; ভিজে যায় পরিধানের কাপড়চোপড়। লুকিয়ে থেকেই আলাপচারিতায় জানা গেল, ইলিশের এই ডিম পাড়া আর জাটকা রক্ষা—এই দুটি নিষেধাজ্ঞার সময় খুব কড়াকড়ি থাকে। ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত এসে জাল-নৌকা আটকে জেল-জরিমানা করে দেন। তবে অন্য সময়ের অভিযান কোনো ব্যাপার না; পুলিশ-প্রশাসনকে নিয়মিত ঘুষ-মাসোহারা দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে নিষিদ্ধ জালে ইলিশ শিকার।
ঘড়ি ধরে ৩৭ মিনিট লুকিয়ে থেকেও কোনো সরকারি বোটের আওয়াজ না পেয়ে জেলেরা সবাই নদীতে নৌকায় ফিরে যে যার জাল তুলতে লেগে পড়েন। এবার কবির মাঝির জালে ধরা পড়েছে ১২টি ইলিশ। এর মধ্যে একটি জাটকা আর বাকিগুলো ডিমওয়ালা মা-ইলিশ। জাল টেনে তীরে ফিরতে ফিরতে দুপুর ২টা। ঘাটে পৌঁছার আগেই যাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া ছিল, তাদের ফোনে জানিয়ে দেওয়া হয়। ঘাটে ফিরে দেখি, ক্রেতারা হাজির; যার যার বায়না করা ইলিশ নিয়ে চলে গেলেন। ফের রাত ১০টায় ‘খ্যাও’ মারার কথা জানিয়ে জেলেরাও চলে গেলেন। দুপুরের ভাত খেয়ে আগে নিজের পেটটা শান্ত করি।
স্থানবদল : গত দুই দিনে আলো ও অন্ধকারে দুটি জালের খ্যাও। বিকেলের আগে এলাকা বদল করে খুঁজে বের করি রাকিব নামের পরিচিত এক জেলেকে। ইলিশ লাগবে, দেওয়া যাবে? প্রশ্ন করতেই ত্বরিত জবাব, ‘বিকাল ৪টার মধ্যে চলে আসেন।’ বললাম, ১০-১৫টা যা হয়, আমার বাসায় পৌঁছে দিতে হবে।’
রাকিব বললেন, ‘ইলিশ দিতে পারব, কিন্তু আপনার বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারব না।’ বললাম, তাহলে থাক। আমি আপনার সঙ্গেই থাকব। এক পাশে ডেকে নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালে রাকিব খানিকক্ষণ ইতস্তত করে পরে বললেন, ‘আমনে যাইতে পারলে আমি লইতে পারমু। রাত ১০টায় খ্যাও দিতে নামমু।’
বিকেলেই গিয়ে হাজির হই বগি নদীর পারে। দেখি, একই চিত্র। মনে হচ্ছে, ইলিশ ধরার ভরা মৌসুম শুরু হয়েছে। তাই উৎসব করে সবাই নদীতে নামছে। বিকেল ৫টা ১৩ মিনিটে আসমা নামের এক মহিলা এসে একজন জেলের কাছ থেকে চার কেজি ইলিশ কিনে পলিথিনে ভরে তারপর একটা স্কুলব্যাগে ঢুকিয়ে ছেলের কাঁধে তুলে দিয়ে ইজি বাইকে চড়ে চলে গেলেন। নদীর পারে ঘোরাঘুরি করি, আর ইলিশ নিধনের নানা দৃশ্য চোখে পড়ে। ঠিক রাত ১০টায় রাকিবের ফোন, ‘ঘাটে আসেন, ভাই।’ নৌকায় উঠলাম রাত ১০টা ২০ মিনিটে। আরো দুজন জেলেসহ নৌকাটি সোজা চলে যায় তেঁতুলিয়া নদীতে। একসময় ইলিশা জালের খ্যাও দেওয়া শুরু হয়; ঘণ্টাখানেক লাগে শেষ হতে। মুড়ি, চানাচুর, বিস্কুট খেতে খেতে মাত্র ১৫ মিনিট; তার পরই খ্যাও টানা শুরু। আর দেখে তো চোখ ছানাবড়া! জাল ভরা ইলিশ আর ইলিশ! প্রায় দুই ঘণ্টা লেগে যায় জাল ওঠাতে। বেশির ভাগই ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের। সব ইলিশের পেটেই ডিমের চাকা। ২২৮টি ইলিশ গোনা হলো; জেলেদের ভাষায় পৌনে তিন পোন। ৮০টা মাছে এক পোন। তিনজন জেলে সমান ভাগ করে নেন। নিষেধাজ্ঞা শুরুর দিকেও নাকি এ রকম আরেকটি ইলিশের ঝাঁক উঠেছিল তাদের জালে। ওই দিন ছিল ২৭৮টি ইলিশ।
রাত ২টায় ঘাটে ফিরে আমরা ঘুমিয়ে পড়ি মসজিদের মেঝেতে। ফজরের আজানের সময় উঠে নামাজ সেরে বেরিয়ে পড়ি। তখনো দেখি, ইলিশ কেনার জন্য লোকজন ছোটাছুটি করছে। গল্পে গল্পে রাকিব জানালেন, ‘নিষেধাজ্ঞার এই কয় দিনে এক লাখ ৩০ হাজার টাকার ইলিশ ধরেছেন। এর মধ্যে এক লাখ ২০ হাজার টাকাই দিয়েছেন এনজিওর কিস্তি। আর ১০ হাজার টাকা খরচ করেছেন সংসারে। অন্য দুই জেলেরও হিসাব প্রায় একই রকম।
১ নভেম্বর দুপুরে চলে যাই ধূলিয়া এলাকায়। এখানের চিত্র আরো ‘শান্তির’। ধুমসে চলছে ইলিশের কারবার। জেলেদের মধ্যে কোনো পেরেসানি নেই। একমাত্র ভোলার মোহসীন ডাকাত ছাড়া আর কোনো বিপদের কথা শোনা গেল না। বশার নামের এক জেলে বললেন, ‘প্যাডে ভাত নাই, কিস্তির জ্বালা। পুলিশে ধইরগা নেলে আপুত্তি নাই। তয় ভাই, ভোলার মোহসীন ডাহাইত খুব খারাপ। অস্ত্রপাতি লইয়া মাছ লুট কইরগ্যা লইয়া যায়। আবার মাইরও দেয়। খালি অরেই ডরাই।’
এখান থেকে বিকেল ৫টায় রওনা হই আবার সেই কবির মাঝির উদ্দেশে। রাত ১০টায় তিনি নদীর ঘাটে থাকতে বললেন। পথে পথে সময় কাটিয়ে ঠিক ১০টায় হাজির হই কবিরের নৌকায়। জো অনুযায়ী ১০টা ৪৫ মিনিটে যাত্রা শুরু হয়। ১১টা ২০ মিনিটে জাল পাতা শুরু হয়ে চলে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী। ৩০ মিনিটের বিরতি, তারপর জাল টানা শুরু। জাল যখন প্রায় অর্ধেক টানা হয়, এমন সময় কবিরের মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। খবর আসে, প্রশাসনের লোকজন দুটি বোট নিয়ে আসছে। ততক্ষণে জালে আটটি ইলিশ মিলেছে। ওই অবস্থায় জেলেরা ওঠানো জাল নদীতে ফেলে নৌকা নিয়ে ছুটতে থাকেন ডুবোচরের দিকে। তখন দক্ষিণ দিক থেকে দুটি ট্রলার তেড়ে আসতে দেখে সবাই তীরে উঠে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু একমাত্র আনাড়ি আমি টাল সামলাতে না পেরে চুবানি খাই পানিতে। হাতে ধরা ব্যাগ, মোবাইল ফোন—সব ভিজে একাকার। ওই অবস্থায় ১৪-১৫ মিনিট ডুবোচরের ধানক্ষেতে ছোটাছুটি শেষে ট্রলার দুটি যখন আমাদের অতিক্রম করে চলে যায়, তখন জেলেরা বুঝতে পারেন, এগুলো প্রশাসনের না; মালবাহী ট্রলার হবে হয়তো।
আমাকে খুঁজে পেতে ওদের সময় লাগল পাঁচ-সাত মিনিট। ততক্ষণে ভিজে যাওয়া মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে দিয়েছি। অন্ধকারে ভয় পাচ্ছিলাম শুধু সাপের। এক পর্যায়ে সবাই একত্র হয়ে নৌকা নিয়ে জাল খুঁজে পেতে সময় যায় আরো ৩০-৩৫ মিনিট। আমার অবস্থা দেখে আফসোসের শেষ নেই ওদের। একজন গামছা এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ভাই, আমনে জামা খুলে গা মোছেন।’
এ যাত্রায় নিষিদ্ধ মৌসুমে ইলিশ কারবার দেখার শখ মিটল। তীরে ফিরতে ভোর ৪টা ৪০ মিনিট। কবির মাঝি তার ঘরে নিয়ে আমাকে একটা লুঙ্গি দিলেন। ঘুমাতে বললেন। আমি লক্ষ্মী ছেলের মতো বিনা বাক্যে সব আদেশ পালন করলাম। সকাল ৬টায় উঠে ইলিশের মায়ের বাড়ি থেকে সোজা নিজের বাড়িতে।