‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ এবং ‘হীরক রাজার দেশে’: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ-২.০
- আপডেট সময় : ০৭:০৮:১০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / ৫০৩০ বার পড়া হয়েছে
গ্রেট ডিক্টেটরই বলি বা হীরক রাজা, তারাও হয়ে উঠেছিলেন ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন এবং হয়েছিলেন নিজেদের ধ্বংসের কারণ। বাংলাদেশের জনগণ দুই হাজার চব্বিশে সেই ফ্র্যাঙ্কেস্টাইনকে ধ্বংস করেছে, এটা দৃশ্যত সত্য। তবে, সেই ধ্বংসের সুযোগ ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন নিজেই তৈরি করে দিয়েছিলেন।
‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ এবং ‘হীরক রাজার দেশে’: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ-২.০
‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ ও ‘হীরক রাজার দেশ’– মাঝে ৪০ বছর; চ্যাপলিন ও সত্যজিৎ রাজনীতির যে মুখোশটি উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন, তাতে দেখা গেল, শাসকের চরিত্র ও শাসন ব্যবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয় না।
জগদ্বিখ্যাত অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন পরিচালিত কৌতুকপ্রধান চলচ্চিত্র ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৪০ সালের ৩১ অক্টোবর। অন্যদিকে, পৃথিবীর আরেকপ্রান্তে অস্কারবিজয়ী কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ব্যঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র ‘হীরক রাজার দেশে’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯ ডিসেম্বর ১৯৮০ সালে, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সিরিজের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে। মাঝে ৪০ বছরের পার্থক্য। সময়ের পার্থক্য যত বছরেরই থাকুক, রাজনীতির যে মুখটির মুখোশ চলচ্চিত্রকারদ্বয় উন্মোচন করতে চেয়েছিলেন, তাতে দেখা গেল, শাসকের চরিত্র ও ব্যবস্থার অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।
চ্যাপলিন এই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন জার্মানির কুখ্যাত স্বৈরাচারী শাসক অ্যাডলফ হিটলার ও ন্যাৎসিবাদকে ব্যঙ্গ এবং ইহুদি-বিদ্বেষের নিন্দা করে; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে, তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে। সত্যজিৎ তথাকথিত আধুনিক শাসনব্যবস্থায় থাকলেন না, তিনি ফিরে গেলেন সামন্তযুগে, সে যুগের এমন এক রাজাকে চলচ্চিত্রায়িত করলেন, যিনি স্বৈরাচারী ও খাঁটি আমিত্বের অহমে দুর্নিবার। মোটা দাগে উভয় চলচ্চিত্রে পার্থক্য দুটি শাসনব্যবস্থার, কিন্তু শাসকের শোষণের রূপটি একই।
এই লেখায় অবশ্য চলচ্চিত্র দুটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনার সম্ভাবনা নেই। এটুকু শুধু ভূমিকামাত্র। এ লেখার বার্তা অন্য।
২.
‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ চ্যাপলিনের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র, যেখানে তিনি দুটি ভূমিকায় অভিনয় করেন— ঘেটোর ইহুদি নাপিত ও স্বৈরশাসক হাইনকেল। ঘটনা পরম্পরায় স্মৃতিভ্রষ্ট নাপিত কী করে স্বৈরশাসক হাইনকেলের ছদ্মবেশ ধারণ করলেন, তা আমরা জানি। কিন্তু, এই ছদ্মবেশী হাইনকেল বয়ে নিয়ে আসেন শান্তি-সাম্য-সহানুভূতি-মানবিকতার বার্তা। এই বার্তারই একটি বিশেষ আলোচ্য বস্তু চলচ্চিত্রের শেষাংশে হাইনকেলের সেই বক্তৃতা, যা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ও নন্দিত হয়।
‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ চ্যাপলিনের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র, যেখানে তিনি দুটি ভূমিকায় অভিনয় করেন— ঘেটোর ইহুদি নাপিত ও স্বৈরশাসক হাইনকেল।
‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটর’ চ্যাপলিনের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র, যেখানে তিনি দুটি ভূমিকায় অভিনয় করেন— ঘেটোর ইহুদি নাপিত ও স্বৈরশাসক হাইনকেল।
‘মাই অটোবায়োগ্রাফি’ গ্রন্থে চ্যাপলিন লিখেছেন, ‘নাৎসিবিরোধী হওয়ার জন্য একজনকে ইহুদি হওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু একজন সাধারণ গুণসম্পন্ন মানুষ হলেই যথেষ্ট।’ ইহুদিবিদ্বেষী ফ্যাসিবাদী হিটলার আধিপত্যবাদবিরোধী চ্যাপলিনের মাত্র ৪ দিন পরে জন্মেছিলেন। সেদিকটির ইঙ্গিত করে চ্যাপলিনের জীবনীকার ডেভিড রবসন লিখেছেন, ‘সাদৃশ্যের প্রশ্নে সেই ছোট্ট ভবঘুরে ও অ্যাডলফ হিটলারের মধ্যে রহস্যময় একটা ব্যাপার ঘটে গেল, তারা দুজন মানবতার দুই প্রান্তের প্রতিনিধি হয়ে উঠলেন।’
চলচ্চিত্রে দেখব, স্বৈরশাসক হাইনকেলের ছদ্মরূপে চ্যাপলিন হয়ে উঠলেন মানবতার ফেরিওয়ালা, যিনি সত্যিকার অর্থে কুঠারাঘাত করছেন হিটলারি ফ্যাসিবাদকে, তার বক্তৃতার মধ্যদিয়ে। এই বক্তৃতাটি তৈরি করতে চ্যাপলিন বহু মাস কাজ করেছেন, খসড়া করেছেন, পরিমার্জন করেছেন।
সেই বক্তৃতাটিই এখানে অনূদিত হলো। যদিও এটি মৌলিক কোনো অনুবাদ নয় এবং হয়তো অন্যান্য অনেক অনুবাদের মতোই এখানেও চ্যাপলিনের সেই উদাত্তবাণীর আবেগটি সেভাবে ধরা পড়ল না, কিন্তু স্পিরিটটি ধরে রাখার চেষ্টা থাকল প্রাণান্ত। তবে, তার আগে কিছু কথা।
এ অনুবাদটি করেছিলাম গত ১৬ এপ্রিল। মহাত্মা চার্লি চ্যাপলিনের ১৩৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে। এখনকার কালে কিছু একটা নামিয়ে ফেললেই, যে পরিমাণ প্রকাশচাঞ্চল্য লেখকের তরফে তৈরি হয়, তা আমাকেও মাঝেমধ্যে ঝুঁকিতে ফেলে। কিন্তু, এই অনুবাদটা করে আমি একে মানোত্তীর্ণ করতে সময় নিচ্ছিলাম। পরিমার্জন ও সম্পাদনা করেছি। করে রেখে দিয়েছি। যেমন-তেমনভাবে ফেইসবুকে পোস্ট করতে পারতাম। কিন্তু, রেখে দিয়ে চ্যাপলিনকে বরং অন্যভাবে শ্রদ্ধা জানিয়েছি।
ঠিক এ সময়ে এসে জগদ্বিখ্যাত এ ফিকশনাল বক্তৃতাটি নিজের মতো নিজের ভাষায় অনুবাদ করার কারণ তো ছিলই, এখন বোধহয় সেটা না বললেও যে কেউই বুঝবেন।
সে সময় যে এতো দ্রুত চলে আসবে, তা কে ভেবেছিল! তবুও, ৫ অগাস্টের পর কোথাও এ বক্তব্য প্রকাশ করিনি। এই শম্বুকগতির কারণ ছিল একটাই— লেট দ্য ক্রুয়েলেস্ট অগাস্ট গো। ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’ আমাদের যে কারণে বিধ্বস্ত করেছে, ঠিক সে কারণেই আমাদের বীরত্বও তৈরি করেছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থী-জনতা সেই বীরত্বকে আরও লম্বা করেছেন। ফলে জুলাই প্রলম্বিত হয়েছে, জুলাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘৩৬ দিনে’র লিজেন্ডে পরিণত হয়েছে। সে হিসেবে অগাস্ট শুধু এবার একাই গেল না, জুলাইকেও সঙ্গে নিয়ে গেল!
আমরা এমন এক পৃথিবী, এমন এক দেশে বসবাস করছি, যেখানে আজও ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটরে’র বক্তৃতা সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়।
আমরা এমন এক পৃথিবী, এমন এক দেশে বসবাস করছি, যেখানে আজও ‘দ্য গ্রেট ডিক্টেটরে’র বক্তৃতা সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়।
বিগত ও অনাগত যে কোনো স্বৈরাচারের জন্য যে শিক্ষা চব্বিশের শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থান রচনা করেছে, সেটির প্রেক্ষিতে আজ আরেকবার এ বক্তৃতাটি জনসম্মুখে আনার শ্রেষ্ঠ সময় বলেই মনে করি। বেদনার বিষয় হলো, আমরা এমন এক পৃথিবী, এমন এক দেশে বসবাস করছি, যেখানে আজও এই বক্তৃতা সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে, এতো বছর পরও! বক্তৃতাটি এমন:
“দুঃখিত, আমি সম্রাট হতে চাই না। সেটা আমার কাজ না। আমি কাউকে শাসন বা পরাজিত করতে চাই না। সম্ভব হলে আমি ইহুদি-বিধর্মী, কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ সকলকেই সাহায্য করতে চাই। আমরা সবাই একে অপরের পাশে দাঁড়াতে চাই। মানুষের তো এমনই হওয়া উচিত। দুর্দশা নয়, আমরা একে অপরের আনন্দ উপভোগ করতে চাই। আমরা কাউকে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করতে চাই না। এ পৃথিবীটা সবার। সুন্দর এ পৃথিবী অনেক সমৃদ্ধ আর প্রত্যেকেরই রয়েছে এর অংশীদারিত্ব। তাই, জীবনপথ হতে হবে মুক্ত ও সুন্দর; কিন্তু, আমরা তো আজ পথহারা!
লোভ মানুষের হৃদয়কে করে ফেলেছে বিষাক্ত। সারাবিশ্বকে আটকে ফেলেছে ঘৃণার জালে। আমাদের নিপতিত করেছে দুর্দশা ও রক্তপাতে। আমরা গতিশীল হয়েছি, কিন্তু আমরা যান্ত্রিকতায় বদ্ধ করে তুলেছি নিজেদের। যান্ত্রিকতা প্রাচুর্য দিয়েছে ঠিকই, তবে আমাদের আকাঙ্ক্ষা-জর্জরিতও করে তুলেছে। আমাদের জ্ঞান আমাদের নৈরাশ্যবাদী করে ফেলেছে। আমাদের চাতুর্য হয়েছে কঠিন ও নির্দয়। আমরা অতিচিন্তা করি, কিন্তু অনুভব করি খুব কম। যন্ত্রের চেয়ে আমাদের বেশি প্রয়োজন মানবিকতা। চাতুর্যের চেয়ে আমাদের বেশি প্রয়োজন মমতা ও নম্রতা। এই গুণাবলি ছাড়া, জীবন হয়ে উঠবে সহিংস এবং সবকিছুই একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে।
বিমান ও বেতার আমাদের অনেক নিকটবর্তী করেছে। এই উদ্ভাবনগুলো প্রকৃতির নিয়মেই মানুষের মধ্যে ভালোত্ব, বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের আহবান জানিয়েছে। এমনকি এখন আমার কণ্ঠ সারা বিশ্বের যে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে— লক্ষ লক্ষ দুর্দশাগ্রস্ত নারী-পুরুষ-শিশু— তারা এমন একটি ব্যবস্থার শিকার, যে ব্যবস্থা নিরাপরাধ মানুষকে বন্দি ও নির্যাতন করছে।
যারা আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন, তাদের বলছি, হতাশ হবেন না। আমাদের বর্তমান দুর্দশার কারণ মনুষ্য লোভ ও তিক্ততা, যেগুলো মানবসমাজের প্রগতিকে ভয় পায়। মানুষে-মানুষে ঘৃণা একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং স্বৈরশাসকদের মৃত্যু ঘটবে। জনগণের যে ক্ষমতা তারা কেড়ে নিয়েছিল, তা জনগণের কাছে ফিরে আসবে। আর মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন স্বাধীনতাও টিকে থাকবে।
সৈন্যবৃন্দ! নিজেদের বর্বরদের হাতে সঁপে দেবেন না, যারা আপনাদের অবজ্ঞা করে, দাস বানায়, আপনাদের জীবনকে কুঠরিবদ্ধ করে, আপনাদের কর্মকে এবং চিন্তা ও অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করে! যারা আপনাদের অনুশীলন করায়, খাদ্যতালিকা নিয়ন্ত্রণ করে— আপনাদের মনে করে গবাদিতুল্য পশু কিংবা কামানের খাদ্যবস্তুতুল্য— এদের তরে নিজেদের বিলিয়ে দেয়ার কোনো মানে হয় না। এরা অপ্রাকৃতিক মানুষ, এরা যান্ত্রিক মন ও যান্ত্রিক হৃদয়ের মানুষ! আপনারা যন্ত্র নন! আপনারা গবাদি নন! আপনারা মানুষ! আপনাদের হৃদয়ে আছে মানবতার জন্য ভালোবাসা! ঘৃণা করবেন না! একমাত্র ভালোবাসাহীনতা ও ঘৃণাই হলো অপ্রাকৃতিক! সৈন্যবৃন্দ! দাসত্বের জন্য নয়, বরং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করুন!
সেন্ট লুকের ১৭তম অধ্যায়ে লেখা আছে: “ঈশ্বরের রাজ্য মানুষের মধ্যেই বিরাজমান”—কেবল একজন মানুষ কিংবা কতিপয় গোষ্ঠী নয়, সমস্ত মানুষের মধ্যে! জনগণই সবকিছুর ক্ষমতাধিকারী— আপনাদের ক্ষমতা আছে যন্ত্র সৃষ্টির। ক্ষমতা আছে সুখ সৃষ্টির! জনগণেরই ক্ষমতা আছে এ জীবনকে মুক্ত ও সুন্দর করার, এ জীবনকে বিস্ময়কর অ্যাডভেঞ্চারে পরিণত করার।
অতএব, গণতন্ত্রের নামে, আসুন সেই শক্তি ব্যবহার করে আমরা ঐক্যবদ্ধ হই। আসুন আমরা এমন এক নতুন পৃথিবীর জন্য লড়াই করি, যা হবে শোভন ও সুন্দর। এমন পৃথিবী, যা মানুষকে দেবে কাজের নিশ্চয়তা, তরুণদের দেবে ভবিষ্যৎ এবং বয়োঃজেষ্ঠদের দেবে নিরাপত্তা। এসবের প্রতিশ্রুতি দিয়েই দানবরা ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু তারা মিথ্যাবাদী! তারা প্রতিশ্রুতি পূরণ করে না। কখনই করে না!
স্বৈরাচাররা নিজেদের মুক্ত করে জনগণকে দাস বানায়! আসুন, আমরা প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য লড়াই করি! আসুন বিশ্বকে মুক্ত করতে আমরা লড়াই করি, জাতীয়তার গণ্ডি পেরিয়ে, লোভকে বশ মানিয়ে, অসহিষ্ণুতাকে দূর করে লড়াই করি। আসুন আমরা যুক্তির জগতের জন্য লড়াই করি, যেখানে বিজ্ঞান ও প্রগতি সমস্ত মানুষের জন্য বয়ে আনবে সুখ।
সৈন্যবৃন্দ, গণতন্ত্রের নামে, আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই!”
এই বক্তৃতার সারবত্তা এই যে, পৃথিবীর যে কোনো শাসক যেন স্বৈরাচার হওয়ার বিন্দুমাত্র চিন্তা করার আগে ভাবেন, গণতন্ত্র প্রথম, গণতন্ত্র দ্বিতীয় ও গণতন্ত্র সর্বদা। এ বক্তৃতা এজন্যই কালোত্তীর্ণ হয়ে গেছে, যা শুনলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়, হৃদয়ে স্পন্দিত হয় স্বাধীনতাকামী মানুষের চূড়ান্ত সাহসী আস্ফালন।
গত অগাস্টের ঘটনা পরম্পরায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বক্তৃতাটি যথার্থ— যেন মনে হচ্ছিল সেনাপ্রধান তার সৈন্যবাহিনীকে দরবারে ঠিক এ বার্তাগুলোই দিয়েছেন, আর তাতেই সেনাবাহিনী হয়ে উঠল ‘পিপলস আর্মি’। ক্ষমতা নয়, থাকতে হবে জনতার পাশে।
৩.
বাংলা ভাষাটা বোঝেন, এমন যে কেউই সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রের শানে নজুল জানেন।
বাংলা ভাষাটা বোঝেন, এমন যে কেউই সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রের শানে নজুল জানেন।
‘হীরক রাজার দেশে’ সম্পর্কে ভূমিকা আরও কম। বাংলা ভাষাটা বোঝেন, এমন যে কেউই সত্যজিৎ রায়ের এই চলচ্চিত্রের শানে নজুল জানেন। ছড়ার মাধ্যমে সংলাপ তুলে ধরা এই চলচ্চিত্রের একটি লক্ষণীয় ব্যাপার। তবে, চরিত্রগুলোর মধ্যে একজন কিন্তু এই ক্যাটাগরির বাইরে, তিনি পাঠশালার শিক্ষক উদয়ন পণ্ডিত। এর মানে কি এই যে, শিক্ষক আবদ্ধ-চিন্তা নয়, বরং আস্থা রাখবেন মুক্তচিন্তায়, করবেন সমস্ত কূপমণ্ডূকবিরোধী চর্চা? হওয়াটাই শ্রেয়।
‘হীরক রাজার দেশে’র চরিত্রগুলোর মধ্যে একজন কিন্তু ক্যাটাগরির বাইরের, তিনি উদয়ন পণ্ডিত, এর মানে কি এই শিক্ষক আবদ্ধ-চিন্তা নয়, বরং আস্থা রাখছেন মুক্তচিন্তায়?
‘হীরক রাজার দেশে’র চরিত্রগুলোর মধ্যে একজন কিন্তু ক্যাটাগরির বাইরের, তিনি উদয়ন পণ্ডিত, এর মানে কি এই শিক্ষক আবদ্ধ-চিন্তা নয়, বরং আস্থা রাখছেন মুক্তচিন্তায়?
তবে, এই চলচ্চিত্রের ছড়ারূপ সংলাপগুলোর মধ্যে সবগুলোই এতো সমসাময়িক হয়ে উঠেছে যে, কোনোটিকেই ব্রাত্য ভাবাব সুযোগ নেই। তবুও, যদি একটিকে আপাত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে হয়, তবে হয়তো ‘যায় যদি যাক প্রাণ/ হীরকের রাজা ভগবান’ উক্তিটিই এগিয়ে থাকবে। মানে, প্রজার প্রাণ নিয়ে হলেও রাজাকে ভগবান তথা চরম শক্তিমান হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই হবে।
সে যাই হোক, আসল কথায় আসি। কথা বলতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে নৈর্ব্যক্তিকই হয়ে উঠেছে। অভিজ্ঞতাটা গত ১৪ ফেব্রুয়ারির। স্বভাবতই বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ছিল সেদিন। দিনটি তারুণ্যের।
বলা আবশ্যক, ১৪ ফেব্রুয়ারি আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ দিন, এদিনটিও তারুণ্যের। ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে এদিন জীবন দিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী, তাই সেদিনটি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে সমাদৃত। যদিও, ভালোবাসা দিবসের প্রতাপে বাংলাদেশের ‘অরাজনৈতিক’রা দিনটিকে বিস্মৃত হয়েছেন, কিন্তু তবুও এর একটা সরল রাজনৈতিক আবেদন থাকে— ‘ভালোবাসার ফুল দিও শহীদেরও চরণে’। মানে ভালোবাসার মানুষের হাতে যেমন ফুল দিচ্ছি, শহীদের চরণেও যেন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাই। বিস্মৃত ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে আবারও, চব্বিশের বৈষম্যবিরোধিতা জেগে ওঠা অভ্যুত্থান হয়তো এবারের এবং বয়ান-একাত্তরের শহীদদের পাশাপাশি বাষট্টি কিংবা তিরাশির সেই শহীদেরও সর্বজনীনভাবে স্মরণযোগ্য করে তুলতে পারে। সে আশাবাদ তোলা থাকল জেন-জি ও অনাগত কালের বিবেচনার খাতায়।
এবারের ১৪ ফেব্রুয়ারি আরেকটি উপলক্ষ ছিল, সেটিও ছিল তারুণ্যের দিন। শুক্লাপঞ্চমী তিথিতে বাণী বন্দনা, মানে সরস্বতী পূজা। ঢাকা শহরে এদিনে যেমনটা হয়, সমস্ত রাস্তা যেন মিশে এক মোহনায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের খেলার মাঠে। তারুণ্যের সমাগমে গমগম করে পুরো মাঠ। এবার ভালোবাসা দিবস হওয়ায় তাতে যেন বাড়তি মোহমুগ্ধতা যুক্ত হয়েছিল। আড্ডা, হৈ হৈ উল্লাস আর মাঠ প্রদক্ষিণ চলে পাল্লা দিয়ে, সব বিভাগের মণ্ডপ দর্শনের উদ্দেশ্যে।
সে উদ্দেশ্যে আমি ও আমার সঙ্গীরাও সওয়ার হলাম। দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেল গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মণ্ডপে। এতো ভিড় যে কাছেই যাওয়া যাচ্ছিল না। অগত্যা দূর থেকেই দেখলাম। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে দেখে তো চোখ ছানাবড়া!
যে সময়ের কথা, সে সময় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ নানা কারণে আলোচিত ও সমালোচিত। একজন শিক্ষকের ইচ্ছাকৃত শিক্ষার্থীদের কম নম্বর দেওয়া এবং অপর একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নিয়ে তোলপাড় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন। এবার বিভাগের শিক্ষার্থীরা সরস্বতী পূজায় যেন পুরো বাংলাদেশেই তোলপাড় লাগিয়ে দিলেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে। কারণ, সরস্বতী পূজায় তাদের আমন্ত্রণপত্রের ডিজাইন এবং মণ্ডপের থিম। (সংবাদ)পত্রের থিম নজরকাড়া আর মণ্ডপের থিম অভূতপূর্ব প্রলয়ংকারী!
মণ্ডপের থিমের প্রায় সবকিছুই ছিল মস্তিষ্কে বেত্রাঘাত করার মতো! যে বিভাগের এতো কেলেংকারির খবর প্রকাশিত হয়েছে, তারা কি না এই নষ্ট-ভ্রষ্ট শিক্ষা ও চিন্তাব্যবস্থা নিয়ে এতো র্যাডিকেল থিম তৈরি করেছে! মনে মনে সেদিন শুধু বাহবাই দেইনি, চোখ বন্ধ করে কল্পনা করছিলাম, এদেশের ‘হীরক রাজা’ এই মণ্ডপের সামনে পড়ে গেলে, কী বিব্রতই না হতেন!
দূর থেকে এক পলকে চোখে পড়েছিল থিমের চারটি বিষয়। দেখে তাৎক্ষণিক যা মনে হয়েছিল, তা-ই বিবৃত করছি।
প্রথমটি ছিল, শেকলে বাঁধা কলম ও নিচে তিনটি তালায় লেখা: ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র’। সমীর রায়ের কথা এবং প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সুর ও স্বরের বিখ্যাত ‘আলু বেচো ছোলা বেচো’ গণসঙ্গীতটির দুটি চরণের কথা সবারই মনে থাকার কথা: “হাতের কলম জনম দুঃখী/ তাকে বেচো না।” অথবা ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যগ্রন্থে আল মাহমুদ যেমনটা লিখেছিলেন: “পোকায় ধরেছে আজ এ দেশের ললিত বিবেকে/ মগজ বিকিয়ে দিয়ে পরিতৃপ্ত পণ্ডিত সমাজ।”
বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেন সত্যস্লোগানে পরিণত হয়েছে উল্লিখিত দুই কবিতা/গীতির চরণগুলো। ক্ষমতাবানের কাছে কলম বিক্রি করে বুদ্ধিবৃত্তিক শঠ হয়েছেন এ দেশের কলমবাজ বুদ্ধিজীবীরা। কিংবা আরও আগে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরীক্ষা পদ্ধতির সমালোচনা করতে গিয়ে যা বলেছিলেন, সেটিও উল্লেখযোগ্য: “মুখস্থ করিয়া পাস করাই তো চৌর্যবৃত্তি! যে ছেলে পরীক্ষাশালায় গোপনে বই লইয়া যায় তাকে খেদাইয়া দেওয়া হয়; আর যে ছেলে তার চেয়েও লুকাইয়া লয়, অর্থাৎ চাদরের মধ্যে না লইয়া মগজের মধ্যে লইয়া যায়, সেই-বা কম কী করিল?”
তো তালাবদ্ধ ও শেকলবদ্ধ ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালন কক্ষ’ কথাটাকে এরকম যে কোনো আলাপের সঙ্গে মিলিয়েই পাঠ করা যায়। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বের একদম সারাংশ এই থিম। বীণাপাণির বর আজ এখানেই সীমাবদ্ধ!
গেল ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সরস্বতী পূজার মণ্ডপটি হয়েছিল মস্তিষ্কে বেত্রাঘাত করার মতো!
গেল ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সরস্বতী পূজার মণ্ডপটি হয়েছিল মস্তিষ্কে বেত্রাঘাত করার মতো!
দ্বিতীয়টি ছিল, ‘মেধা = MCQ?’, এ সময়ের সবচেয়ে মর্মান্তিক শিক্ষাধ্বংসী ব্যবস্থা। মুখস্থ করুন, গোল্লাভরাট করুন এবং মেধাবীর স্বীকৃতি লুফে নিন। কোনো বিশ্লেষণ শক্তি ও তত্ত্ব জানার প্রয়োজন নেই। সাফল্য মানেই MCQ ও তথ্য মুখস্থ করার চৌর্যবৃত্তি। এ নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না৷ তাই বলা বাহুল্য।
তৃতীয়টি ছিল, ‘হীরক রাজার দেশে’র সেই কুখ্যাত কয়েকটি বক্রোক্তির দুটি: “লেখাপড়া করে যে-ই/ অনাহারে মরে সে-ই” এবং “বিদ্যালাভে লোকসান/ নাই অর্থ নাই মান।” এগুলো ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। আপনি প্রথম ও দ্বিতীয়টি নিয়ে বেশি যদি না ভাবেন, তাহলে তৃতীয়টি এমনিতেই ‘ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা’য় পরিণত হতে বাধ্য।
চতুর্থ তথা শেষটি আগে চোখে পড়া দরকার ছিল। কিন্তু, পড়ল পরে। এবং এটাই সবকিছুর মূল কারণ। হীরক রাজা ও তার সেই যন্তরমন্তর ঘর। যার রাজত্বে ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে’ গেছে এবং যার রাজত্বে সবকিছুতেই ‘হ্যাঁ-তে হ্যাঁ, না-তে না’ বলতে হয়। উল্টোটা হলে ঢুকিয়ে দেয়া হয় সেই যন্তরমন্তর ঘরে, যেখানে রাজা যা চান, তাই মগজ ধোলাইয়ের মধ্য দিয়ে উচ্চারণ করতে হয়। রাজার শেখানো নানাবিধ মন্ত্র মুখস্থ করতে হয়, যেগুলোর প্রধান স্লোগান (উপরেও বলেছি) হয়ে উঠেছিল ‘যায় যদি যাক প্রাণ/ হীরকের রাজা ভগবান!’ যন্তরমন্তর কি এই বাংলাদেশের আয়নাঘর? সেদিন অবশ্য এ কথা মনে হয়নি, বাংলাদেশ ২.০-তে এসে সে কথাই মনে হচ্ছে দৃঢ়ভাবে।
এই থিম দেখে সেদিন মনে মনে শুধু দারুণ বাহবাই দেইনি, ফেইসবুকেও লিখেছিলাম। এখানেও সেই লেখার কিয়দাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। লিখতে লিখতে বারবার ভাবছিলাম, বাংলাদেশের স্বৈরাচারী হীরক রাজার যে তল্পিবাহকরা এই থিমটি নিশ্চিতভাবেই দেখেছেন, তারা কি লজ্জা পাননি একটুও? একটুও কেঁপে উঠেনি তাদের বক্ষ বা মসনদ? এতটুকুও কি তারা বুঝতে পেরেছিলেন, কথা বলতে না পারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা একটু হলেও স্বর প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, সেই বিভাগের শিক্ষার্থীরা কী নীরবে ও রূপকের আশ্রয়ে বৈপ্লবিক এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন!
বস্তুত, শাসক ও তার অন্ধ অনুকারকদের তা বোঝার হৃদয় থাকে না। থাকলে আজ হয়তো ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হতো! কিন্তু, সবকিছুই তো নগুগি ওয়া থিওঙ্গর সেই ‘থিংস ফল এপার্ট’— সবকিছু ধ্বসে পড়ে!
৪.
ফ্র্যাঙ্কেস্টাইনের কথা আমরা জানি। যে মনস্টার সৃষ্টি করে নিজেই নিজের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠেছিল। গ্রেট ডিক্টেটরই বলি বা হীরক রাজা, তারাও হয়ে উঠেছিলেন ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন এবং হয়েছিলেন ধ্বংসের কারণ। বাংলাদেশের জনগণ দুই হাজার চব্বিশে সেই ফ্র্যাঙ্কেস্টাইনকে ধ্বংস করেছে, এটা দৃশ্যত সত্য। তবে, সেই ধ্বংসের সুযোগ ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন নিজেই তৈরি করে দিয়েছিলেন।
ইতিহাসের শিক্ষা হলো এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, ফিকশন থেকে নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। নিলে হয়তো চ্যাপলিনের সেই মহানুভব মানবতাবাদী বাণী কিংবা হীরক রাজার ‘দড়ি ধরে মারো টান/ রাজা হবে খান খান’ রূপ পরিণতিও এই নতুন ফ্র্যাঙ্কেস্টাইনের কানে যেত। যায়নি। ভবিষ্যতে যারা আসবেন, তাদের যেন যায়। না গেলে বাংলাদেশের চব্বিশের জুলাই-অগাস্ট আরও দীর্ঘ হবে, আরও সে দীর্ঘজীবী হবে!