ঢাকা ১২:০৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে নির্বাচন সংস্কার কমিশন গঠন আমি স্যামসাং ব্যবহার করি, স্ক্রিনশট গেছে আইফোনের : জনপ্রশাসন সচিব উন্নয়নের ভ্রান্ত ধারণা: ঋণে ডুবে থাকা দেশ টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় নাহিদ ইসলাম আমার টাকা-পয়সার প্রতি লোভ নেই, ৫ কোটি হলেই চলবে এক দিনেই হাওয়া ৮ হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন অবশেষে দেখা মিলল আসাদুজ্জামান কামালের ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ কারাগারে কেমন আছেন ‘ভিআইপি’ বন্দীরা একটি ফোনকল যেভাবে বদলে দিয়েছে ড. ইউনূসের জীবনের গতিপথ ড. ইউনুসের Three Zeros থিয়োরি বর্তমান উপদেষ্টাদের সঙ্গে নতুন চার-পাঁচজন মুখ যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কয়েকটি জাতীয় দিবস বাতিল করতে পারে সরকার সমবায় ব্যাংকের ১২ হাজার ভরি স্বর্ণ গায়েব: উপদেষ্টা “প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস: বাংলার গর্ব, বৈশ্বিক সম্প্রীতির প্রতীক” খেলোয়াড় সাকিবের নিরাপত্তা আছে, ফ্যাসিস্ট সাকিবের ক্ষেত্রে অবান্তর: ক্রীড়া উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সম্মেলন থেকে কী অর্জন করলেন? জাতিসংঘে তিন-শুন্যের ধারণা দিলেন ড. ইউনুস যন্ত্রণার নাম ব্যাটারি রিকশা তরুণ সমাজের অফুরান শক্তি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে— ড. ইউনূস

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর ইতিহাস, গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত এবং আমাদের করনীয়

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ০৮:১৪:১৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৩৯ বার পড়া হয়েছে
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য

সৃষ্টির প্রথম থেকেই মানুষের ফিতরাত বা স্বভাব হচ্ছে এই যে, মানুষ সুন্দর, আনন্দদায়ক, কল্যাণকর কোন বস্তু, ব্যক্তি ও ঘটনায় আনন্দিত হয়, আর অসুন্দর, দুঃখজনক ও অকল্যাণকর অবস্থায় ব্যথিত হয়। স্বভাব এমন যে, দুঃখের জীবন থেকে বের হয়ে আসতে সে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যাবে যখনই মানুষ অন্যায়, অসত্য ও জুলুম-নির্যাতনের স্টীম রোলারে নিষ্পেষিত হয়েছে তখনই মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রাণপণে খুঁজেছে একজন মুক্তিদাতা, ত্রাণকর্তা যাকে কেন্দ্র করে এবং যার নেতৃত্বে ঘটাবে সকল দুঃখের অবসান, চিরতরে বিলীন করবে সকল অশুভ শক্তিকে।

মানুষ যখনই এ দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেছে তখনই স্বধর্মীয়, স্বগোত্রীয় লোকদের নিয়ে করেছে আনন্দানুষ্ঠান। এ আনন্দানুষ্ঠানকে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে ঈদ (عيد)। অভিধানে ঈদ বলতে বুঝায় : ‘কোন মর্যাদাবান ব্যক্তি অথবা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমবেত হওয়ার দিন বা স্মৃতিচারণের দিবসই ঈদ। কেউ কেউ বলেছেন, ঈদকে এজন্যই ঈদ বলা হয় যে, প্রতিবছর নব আনন্দ নিয়ে তা ফিরে আসে।’ (আল-মুন্জিদ, পৃ. ৫৩৯)

আর মিলাদ ميلاد শব্দের অর্থ وقت الولادة জন্ম সময়। (আল-মুনজিদ, পৃ. ৯১৮)। পারিভাষিক অর্থে মিলাদ বলতে জন্ম সময়, জন্ম বৃত্তান্ত তথা কারো জন্ম তারিখে তার জীবন চরিত আলোচনা ও তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের অঙ্গীকার করা। মিলাদ শব্দটি যদিও আরবি, কিন্তু আমাদের দেশে এর প্রচলন ফারসি ভাষা থেকে হয়েছে। অনেকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট না জেনে এ শব্দটি আরবি ভাষার আঙ্গিকে তুলে ধরে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করেন। ফারসিতে মিলাদ অর্থ زمان تولد জন্ম সময়। (ফারহাঙ্গে জবানে ফারসি, পৃ. ১০৬৭)

 

পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বিশ্বের ঈমানি প্রেরনার জয় ধ্বনী নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে আসে রবিউল আওয়াল মাসে। পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্যতম উৎসব।

কোন নেয়ামত ও রহমত লাভ করলেই আনন্দোৎসব করা যেরূপ মানুষের স্বভাবজাত কাজ তদ্রূপ আল্লাহ তাআলার নির্দেশও তাই। যেমন কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে : ‘(হে রাসূল!) বল : আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক।’ (সূরা ইউনুছ : ৫৮)

এ আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর অনুগ্রহ فضل الله এবং তাঁর রহমত رحمة বলতে কী বুঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে ইবনে জারির তাবারী (রহ.) তাঁর তাফসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন : অনুগ্রহ (فضل الله) বলতে ইসলাম আর রহমত (رحمة) দ্বারা আল-কুরআনে বুঝানো হয়েছে।

আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রহ.) আদ্দুররুল মানসুর তাফসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন : ‘এখানে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ বলতে ইল্ম বুঝানো হয়েছে। আর ‘রহমত’ দ্বারা বুঝানো হয়েছে মুহাম্মাদ (সা.)-কে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘আমিতো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)

অর্থাৎ তোমরা মহামূল্যবান সম্পদ আল-কুরআন ও ইসলাম বা রাসূলে খোদা (সা.)-কে পেয়েছ, এর জন্য আনন্দ করা তোমাদের অন্যতম কাজ। যদি কুরআন মজীদ ও দীন ইসলাম পাওয়ার কারণে আনন্দ করতে হয় তাহলে যার মাধ্যমে কুরআন ও দীন পেয়েছি, যিনি ছিলেন সমগ্র জগতের রহমত, তাঁর আগমন যে কত বড় নেয়ামত ও রহমত তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না।

আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলভী (রহ.) তাইতো তাঁর রচিত ‘মা সাবাতা মিনাসসুন্নাহ’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘হাজার মাসের চেয়ে উত্তম লাইলাতুল কাদর, ফজিলতের রাত্রি শবে বরাত, শবে মেরাজ, দুই ঈদের রাত এ সবই রাহমাতুল্লিল আলামীনকে দান করা হয়েছে। যাঁকে দান করা রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, স্বয়ং তাঁর আগমন দিবস যে কত লক্ষ-কোটি দিবস-রজনীর চেয়ে উত্তম তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।’

 

সামান্য জাগতিক নেয়ামত লাভ করলেও তার জন্য ঈদ উৎসব করার সরাসরি উদাহরণ আমরা আল-কুরআনে দেখতে পাই। যেমন আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ কামনা করে হযরত ঈসা (আ.) যে দোয়া করেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য। এরশাদ হয়েছে :

‘ঈসা ইবনে মারইয়াম বলল : হে আল্লাহ! আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য ঊর্ধজগৎ হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন। এ হবে আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকলের জন্য ঈদস্বরূপ, আর আপনার অন্যতম নিদর্শন।’ (সূরা মায়িদা : ১১৪)

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে খাঞ্চা ভরা খাওয়া পেলে তা যদি হযরত ঈসা (আ.)-এর ভাষায় সৃষ্টির আদি হতে অন্ত পর্যন্ত আনন্দোৎসবের কারণ ও আল্লাহ তাআলার নিদর্শন হয় তাহলে সৃষ্টির সেরা মানব, রহমতের ভাণ্ডার রাসূলে পাক (সা.)-এর মতো এ মহান নেয়ামতের আগমন দিবস কতই না মর্যাদাবান, গুরুত্ববহ, কতই না আনন্দের তা সহজেই অনুমেয়।

হযরত ইমাম বুখারী (রহ.) বর্ণনা করেন : ‘আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার বংশের একজন স্বপ্নে তাকে খুবই খারাপ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনার অবস্থা কি? সে জবাবে বলল, তোমাদেরকে ছেড়ে আসার পর আমার কল্যাণজনক কিছুই হয়নি, হ্যাঁ, এই আঙ্গুল (শাহাদাত অঙ্গুলি) দ্বারা পানি পাই। কারণ, এ আঙ্গুলের ইশারায় আমি দাসী সুয়াইবাকে মুক্তি দিয়েছিলাম।’

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ফাতহুল বারী এবং আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (রহ.) তাঁর রচিত ‘আইনী’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন : ইমাম সুহাইলী (রহ.) উল্লেখ করেন যে, হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর তাকে স্বপ্নে দেখি যে, অত্যন্ত দুরবস্থার মাঝে পতিত রয়েছে। সে বলল, ‘তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর আমি শান্তির মুখ দেখিনি। তবে প্রতি সোমবার আমার আযাব লাঘব করা হয়।’ হযরত আব্বাস (রা.) বলেন : ‘তার এ আযাব লাঘবের কারণ হলো রাসূলে পাক (সা.)-এর জন্মদিন ছিল সোমবার। তাঁর জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আসায় দাসী সুয়াইবাকে সে খুশিতে মুক্তি দেয়। (ফাতহুল বারী, ৯ম খ-, পৃ. ১১৮; আইনী, ২০/৯৫)

যে কাফের সম্পর্কে কুরআন মজীদে সরাসরি নাযিল হয়েছে :

‘ধ্বংস হয়েছে আবু লাহাবের দু’হাত এবং সে নিজেও।’ সে যদি একজন কাফের হওয়া সত্ত্বেও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর খুশির কারণে তার প্রতি সোমবার আযাব লাঘব হয়, শাহাদাত অঙ্গুলি দিয়ে পানি বের হয়- যা খেয়ে সে তৃপ্ত হয়, একজন মুসলমান ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন ও আনন্দানুষ্ঠান করলে তাতে রহমত, বরকত লাভ এবং আযাব থেকে মুক্তিলাভের এক বিরাট সুযোগ তা যে কোন বিবেকবান ব্যক্তি সহজেই অনুধাবন করতে পারে। কবি শেখ সাদী (রহ.)-এর ভাষায় :

دوستان را کجا کنی محروم

تو که با دشمانان نظرداری

‘বন্ধুদের বঞ্চিত করার প্রশ্নই আসে না, তুমি তো এমন সত্তা যে, দুশমনের দিকেও লক্ষ্য রাখ।’

মিলাদুন্নবী উদযাপন দিবসকে কেন্দ্র করে রাসূলের পুরো জীবনকে আয়নার মতো নিজের জীবনের সামনে তুলে ধরা এবং সে অনুযায়ী ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ জীবন গড়ে তোলার সংকল্প গ্রহণের মতো উত্তম ও বরকতময় কাজ আর কী হতে পারে? রাসূলের মর্যাদা বর্ণনা করার সাথে সাথে তাঁর দাওয়াত ও হেদায়াত গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। অতীতে মনীষিগণ রাসূলের প্রশংসা বর্ণনার সাথে সাথে রাসূলের সুন্নাতকে তাঁদের জীবনে বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। হযরত আলী (রা.) যেমন ছিলেন রাসূলের সুন্নাতের ধারক তদ্রূপ প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। তিনি বলেন :

اختاره من شجرة النبياء و نشكاة الضياء و ذوابة العلياء و سرّة التئحاء و مصباح الظلمة و ينابيع الحكمة

‘নবুওয়াত বৃক্ষের মাঝে তিনি বাছাইকৃত আলোকের আধার, সম্মানের সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিষ্ঠিত, বাতহা তথা মক্কা মুয়াজ্জমার মূলকেন্দ্র, অন্ধকারের বাতি, হেকমত ও প্রজ্ঞার উৎস-প্রস্রবণ।’ (নাহজুল বালাগা, খুতবা ১০৭)

হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) তাইতো বলেছিলেন :

روشن زوجود تست کونین

ای ظاهر و باطنت همه نور

‘আপনার অস্তিত্বের আলোয় উভয় জাহান আলোকিত, হে মহান! আপনার জাহের ও বাতেন সবই নূর।’ (কাসিদায়ে গাউসুল আজম)

তাইতো আল্লামা বুছিরী (রহ.) বলেছেন :

لو لاه ما خلق الافلاک خالقها

لو لاه ما خرج الانسان من عدم

‘তিনি না হলে আসমান স্রষ্টা তা সৃষ্টি করতেন না, তিনি না হলে মানবজাতি অনস্তিত্বের গ-ি হতে বের হয়ে আসত না।’

তাঁর মহান সত্তা সম্পর্কে শেখ সাদী (রহ.) বলেছেন :

بلغ العلی بکماله

کشف الدجی بجماله

حسنت جمیع خصاله

صلوا علیه و آله

‘মানবতার শীর্ষে তুমি হলে উপনীত,

রূপের ছটায় দূর করলে আঁধার ছিল যত-

সকল গুণের সমাবেশে চরিত্রে মহান,

তুমি ও তোমার বংশ পরে হাজারো সালাম।’

 

কবি ফররুখ বলেন :

‘হারা সম্বিত ফিরে দিতে বুকে তুমি

আনো প্রিয় আবহায়াত

জানি সিরাজাম মুনীরা তোমার রশ্মিতে

জাগে কোটি প্রভাত।’

কবি আল মাহমুদ বলেন :

‘এই নামে ফোটে হৃদয়ে গোলাপ কলি

যেন অদৃশ্য গন্ধে মাতাল মন,

যেন ঘনঘোর আঁধারে আলোর কলি

অকুল পাথারে আল্লার আয়োজন।’

মোটকথা, সকল লেখক, কবি-সাহিত্যিকই রাসূলের শানে কিছু না কিছু লিখতে চেষ্টা করেছেন। অধুনা বিশ্বে কলমের সাথে আমলের দিক থেকে রাসূলের আদর্শের রূপায়নই হবে সবচেয়ে বড় কাজ।

যে সময় আল্লাহর ঘরে স্থান পেয়েছে তিন শতাধিক মূর্তি। আইন, বিচার ও প্রশাসন সবক্ষেত্রে চলছে তাগুতী শাসন, মানুষে মানুষে হানাহানি, উটকে পানি খাওয়ানোর মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে চলছিল যুগের পর যুগ যুদ্ধ। জীবন্ত কবর দিচ্ছিল বাবা নিজ কন্যাকে, সুদ ছিল দুনিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি, ব্যভিচার, মদ ও জুয়া ছিল সমাজের ওপর তলার লোকদের নিত্যদিনের কাজ। অসহায়, ইয়াতিম, অনাথ বঞ্চিত মানবতা যখন করছিল গগনবিদারি ফরিয়াদ, নারী জাতি ছিল মর্যাদাহীন খেলনার বস্তু। আদর্শিক, নৈতিক অবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। এ সময় ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল সুখময় বসন্তকাল হিসাবে যিনি আগমন করেছিলেন তিনিই হলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। বিশ্ববিখ্যাত হাদীস বিশারদ মোল্লা আলী কারীর ভাষায় :

ربیع فی ربیع فی ربیع

ولکن فوق نور فوق نور

‘তিনি ছিলেন বসন্তকাল, যার আগমনে যেমন আগমন করেছে প্রাকৃতিক বসন্ত, তেমনি নৈতিকতা ও আদর্শের ভুবনেও আগমন করেছে নববসন্তের জোয়ার। তিনি ছিলেন জাগতিক বসন্তের চেয়ে লাখ-কোটি গুণ অধিক আলোদানকারী নূর।’ (মেরকাতুল মাফাতিহ)

এ শিশুর শুভাগমন সারা দুনিয়াকে নাড়া দেয়। একদিকে মা আমেনার জীর্ণ কুটির স্বর্গীয় আলোতে ঝলমল, প্রকৃতির বস্তু নিচয় আনন্দাপ্লুত। আজ ইবরাহীমের তাওহিদী হুংকার, মূসার অলৌকিক অসি, ঈসা মসীহর আলৌকিকত্ব সবই নয়া সাজে সজ্জিত আর তাগুত, শয়তান জালেমের গায়ে লেগেছে আগুন। এ রাতে কিসরার প্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ভেঙে পড়েছে, পারস্যের হাজার হাজার বছরের অগ্নি নিভে গেছে, শাতিল নদী শুকিয়ে গেছে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি শুধু কিসরার গম্বুজই নয় বরং আজমীদের শান-শওকত, রোমানদের আড়ম্বর, চীনের প্রাচীরের মতো গগনচুম্বী মহলরাজি ভেঙে পড়েছিল। শুধু পারস্যের অগ্নিই নয় বরং অবিশ্বাসের গভীর ঘন অন্ধকার এবং পথভ্রষ্টতার বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ‘তাফসীরে সোরাবাদীর’ ভাষ্য অনুযায়ী ২৫টিরও অধিক অলৌকিক ঘটনার সমাহার নিয়ে তিনি আগমন করলেন এ ধরায়। তাই তো কবি বলেছেন :

‘তাঁর গুণ বৈশিষ্ট্য লেখার সাধ্য কারো আছে কি? তিনি তো আপাদমস্তক অলৌকিকত্ব নিয়েই এসেছেন।’

‘মুহাম্মাদ’ কতই না সুন্দর নাম!

কী চমৎকার শিশু! যার দুনিয়ায় আগমনের সময় মা আমেনার প্রসব বেদনা হয়নি, নাভি মায়ের নাভির সাথে সংযুক্ত নয়, যার খতনা মায়ের পেটেই সম্পন্ন, পুত-পবিত্র গোসল করা ও সেজদারত অবস্থায় তাশরিফ এনেছেন। কবি নজরুল বলেন :

‘দেখ আমেনা মায়ের কোলে

দোলে শিশু ইসলাম দোলে

কচি মুখে শাহাদাতের

বাণী সে শুনায়।’

যার আগমনের সাথে আকাশ, বাতাস মুখরিত হচ্ছে সালাম আর সওগাতে। তাঁর নাম যে কত তাৎপর্যবহ হবে তা তো সহজেই অনুমেয়।

পিতৃহীন স্বর্গীয় নাতিকে প্রথমবারের মতো কোলে নিয়ে আবদুল মুত্তালিব পুত্রবধূ আমেনাকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘এ চাঁদের নাম কী রাখা যায়?’ জবাবে আমেনা বললেন : “স্বপ্নে আমাকে কে যেন বলেছে, শিশুর নাম হবে ‘মুহাম্মদ’।” দাদা এ নাম শুনে খুশি হয়ে এ নামেই ডাকতে লাগলেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, নেহায়াতুল আরব) যার অর্থ চরম প্রশংসিত। অভিধানের দৃষ্টিতে মুহাম্মাদ অর্থ যার প্রশংসা অতীতে চলেছে, বর্তমানে চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে, তিনিই হলেন মুহাম্মাদ।

‘মুহাম্মাদ তাকেই বলে যার মাঝে প্রশংসনীয় চরিত্রের সমাহার ঘটেছে।’

কবি হাসসান বিন ছাবিত তাইতো মসজিদে নববীর মিম্বারে বসে আল্লাহর রাসূলকে সামনে নিয়ে গেয়েছেন :

وشق له اسمه لیجله- فذو العرش محمود و هذا محمد

‘আল্লাহ (আদর ও সোহাগ করে) নিজের নাম হতে তাঁর নামকে বের করেছেন। অধিকন্তু মহান আরশের অধিপতি হচ্ছেন মাহমুদ (প্রশংসিত) আর হযরতের নাম হলো মুহাম্মাদ (চরম প্রশংসিত)।’

আমেনার আদরের দুলাল মুহাম্মাদ (সা.) তো প্রশংসা পাবারই পাত্র। যে হযরত হালিমার দুধপান করতে গিয়েও একটি স্তনের দুধ পান করছেন আরেকটি রেখে দিচ্ছেন দুধ ভাই আবদুল্লাহর জন্য। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের দরদ, সাম্যের এরূপ নিদর্শন দুনিয়ার ইতিহাসে আরেকটি কি খুঁজে পাওয়া যাবে? শিশু মুহাম্মাদ (সা.)-এর আচার-আচরণ দেখে হালিমার আশপাশের নারীরা হিংসায় জ্বলে যেত। সবাই ভাবত, এরূপ একটি শিশুর লালন যদি আমার ভাগ্যে জুটত। দুধ ভাইয়ের এ আদর্শ দেখেই দুধবোন সায়মা কোলে নিয়ে বলছেন :

‘বেঁচে থাকুক মুহাম্মদ- সে দীর্ঘজীবী হোক

চির তরুণ চির কিশোর চির মধুর রোক।

হয় যেন সে সরদার আর পায় যেন সে মান

শত্রু তাহার ধ্বংস হোক ঘুচুক অকল্যাণ।

মুহাম্মদের পানে খোদা করুন চোখে চাও

চিরস্থায়ী গৌরব যা-তাই তাহারে দাও।’

(অনুবাদ-কবি গোলাম মোস্তফা)

 

শৈশবের ঘটনাবহুল দিনগুলো পেরিয়ে কৈশোরে প্রতিষ্ঠিত হলেন কিশোর মুহাম্মাদ (সা.) ‘আল-আমীন’ মুহাম্মাদ রূপে। যার অর্থ শান্তিপ্রিয়, সম্প্রীতির আধার, চরম সত্যবাদী ও পরম বিশ্বস্ত। মক্কার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল ‘মুহাম্মাদ’ (সা.) এমন এক কিশোর যে মিথ্যা কথা বলে না, আমানতের খেয়ানত করে না, অন্যের উপকার করা যার কাজ, বড়দের সম্মান ছোটদের স্নেহ করা যার চরিত্র। গোটা মক্কার জনগোষ্ঠীর মনের মাঝে এ কিশোরের স্থান ছিল অনন্য। সবার সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে, অথচ সে অন্যায়, অশ্লীলতার ধারে কাছেও যায় না। কটুবাক্য সে বলেনি যা অন্যের মনে কষ্ট হতে পারে। আজকের কিশোর সমাজ আদর্শ কিশোর হতে হলে যে জীবন্ত প্রতীকের অনুসরণ করবে তিনি হলেন কিশোর মুহাম্মাদ (সা.)।

যুবক মুহাম্মাদ (সা.) মক্কার যুব সমাজকে নিয়ে যদিও সমাজ সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছেন, কাবা ঘরে পাথর বসানো নিয়ে বিভিন্ন গোত্রের বিবাদ শান্তিপূর্ণভাবে মিমাংসা করতে সক্ষম হয়েছিলেন; কিন্তু মক্কা তথা গোটা দুনিয়ার মানুষ র্শিকে নিমজ্জিত ছিল। র্শিক থেকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল এক মহা শক্তির প্রত্যক্ষ মদদ যা সকল তাগুতী শক্তিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। যতদিন যেতে লাগল মুহাম্মাদ (সা.)-এর মনে ততই চিন্তার পাহাড় জমতে থাকে। হেরা পর্বতের গুহায় বসে ভাবছিলেন কি করে এ বিশ্বকে র্শিকমুক্ত করা যায়। খোদায়ী ওহী ধারণ করার জন্য যেসব মানবীয় গুণ ও নৈতিক চরিত্র দরকার, জনমনে যে আসন লাভ করা প্রয়োজন সে চারিত্রিক ও গুণগত বৈশিষ্ট্য ফুলে-ফলে সুশোভিত হওয়ার পরই নাযিল হলো লওহ মাহফুজে লেখা আল্লাহর বাণী আল-কুরআন। ঘোষিত হলো :

‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আলাক : ১)

এ খোদায়ী নূরানি কুরআনকে যারা ধারণ করতে চায় তাদেরকেও রাসূল চরিত্রের অনুকরণীয় চরিত্র অর্জন করতে হবে।

কুরআনের নূরানি ঝলক, পুত-পবিত্র ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের মুখে ‘লা শারিক’-এর ঘোষণা সকল স্বার্থান্বেষী, সুবিধাভোগী আমলা ও দুর্নীতিবাজ শোষক শ্রেণির মাথায় হানলো এক বজ্রাঘাত। অত্যাচার, নিপীড়ন, অর্থনৈতিক অবরোধ, সামাজিক বয়কট, হত্যার হুমকি, কুৎসা রটনা এবং পাগল-যাদুকর, দেশদ্রোহী, ধর্মবিরোধীরূপে আখ্যাসহ সকল প্রকার প্রচার অর্থাৎ শয়তানি শক্তির সকল বাধা বিপত্তির মুখে দৃঢ় চিত্ত ঈমান নিয়ে আল্লাহর নবী নিজেকে ও সাহাবায়ে কেরামগণকে গড়ে তোলেন কুরআনি আদর্শে। কায়েম হলো আল্লাহর রাজ। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, আদল-ইনসাফভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত প্রশাসন উপহার দেয়ার জন্য শারীরিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক দৈন্য সবকিছু সহ্য করেছেন, প্রয়োজনে পেটে পাথর বেঁধেছেন, গাছের পাতা খেয়েছেন; কিন্তু অন্যায়ের সাথে, র্শিকের সাথে, হারামের সাথে, দুর্নীতির সাথে আপোষ করেননি। মানুষের তৈরি খোদাবিমুখ আইন-কানুন, সংবিধান, সম্পূর্ণ উল্টিয়ে আল-কুরআনকে বসিয়েছেন সবার ঊর্ধ্বে। সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। মোটকথা, মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে আল্লাহর রাসূলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এক আদর্শ সভ্যতা, উন্নত সংস্কৃতি ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা।

রাসূলে খোদা (সা.)-এর জীবন চরিত্র-সুন্নাহ হলো আল্লাহর কুরআনের বাস্তব দিক। যারা এ সুন্নাহর পুরোপুরি অনুসরণ করবেন, এ সুন্নাহকে বাস্তবায়ন করার কাজে ব্রতী হবেন তাঁদের জন্যই হবে রাসূলের জন্ম দিবস আনন্দের। যারা প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-কে কেন্দ্র করে নিজের, পরিবারের, সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক কাজ-কর্মকে রাসূলের জীবনের সাথে মিলাবেন, সে আয়নায় নিজেদেরকে দেখবেন, নিজেদের দোষ-ত্রুটি চিহ্নিত করে পরবর্তী বছরের জন্য প্রস্তুতি নেবেন তাঁদের জন্য হবে এ দিবস ঈদের দিন।

কিন্তু যে দেশের সংবিধান র্শিকমিশ্রিত, যেখানে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষকেই ক্ষমতার উৎস বলা হয়- সে দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন আল্লাহর রাসূলের সাথে উপহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

যে ব্যক্তি সুদ খায়, সুদ দেয়, সুদী কারবার করে, ঘুষ খায়, ঘুষ দেয়, ঘুষের লেনদেনে জড়িত, যে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রশাসনে দুর্নীতি ঢুকায়, যে ব্যবসা-বাণিজ্যে পরকে ঠকানোর ব্যবস্থা করে, যে মালিক অন্যায়ভাবে তার শ্রমিকদের ঠকায় ও শ্রমের মর্যাদা দেয় না, যে শ্রমিক কাজে ফাঁকি দেয় তার জন্য রাসূলে খোদার জন্মদিন হবে ভয়ের দিন, দুঃখের দিন। তার জন্য এ দিবস কিছুতেই ঈদ বা খুশির হতে পারে না। যে মিলাদ মাহফিলে রাসূলের জীবন চরিত্র আলোচনা হয় না, সুদ ঘুষ ও চোরাচালানির পয়সা দিয়ে যেখানে মিষ্টি হালুয়া ক্রয় করা হয়, তাদের এ মাহফিল ও পয়সা ব্যয় রাসূলে পাকের গলায় ছুরি চালানোর মতো। যে আলেম সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে রাসূলের নির্দেশিত সত্যকে গোপন রাখে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে না, সামান্য দাওয়াতের জন্য সুদখোর, মদখোর, জুয়াড়ি, বেনামাযী খোদাদ্রোহীর সাথে সম্পর্ক রাখে, তাদের ঈদে মিলাদুন্নবী পালন হবে বনি ইসরাইলের স্বার্থান্বেষী দরবারি আলেমদের মতো যাদেরকে কুরআনে কুকুর বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

‘তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শুনাও যাকে আমি দিয়েছিলাম নিদর্শন। সে তা বর্জন করে (তাকে নিদর্শন মুক্ত পেয়ে) শয়তান তার পেছনে লাগে, আর সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। আমি ইচ্ছা করলে এ সব (নিদর্শন) দ্বারা তাকে উচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করতাম। কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে ও তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে- তার অবস্থা কুকুরের ন্যায়। তার ওপর তুমি বোঝা চাপালেও সে হাঁপাতে থাকে আর বোঝা না চাপালেও সে হাঁপায়। যে সম্প্রদায় আমার নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের অবস্থাও এইরূপ। তুমি ঘটনা বলে দাও যাতে তারা চিন্তা করে।’ (সূরা আরাফ : ১৭৫-১৭৬)

‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন হচ্ছে জান্নাত পাওয়ার মাধ্যম এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল। তাই সাহাবায়ে কেরামের সাথে একমত পোষন করে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাহফিল করা ঈমানদারদের জন্য একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন যেন মোনাফিকদের খপ্পর থেকে আমাদের ঈমানকে হেফাজত করেন। “আমীন” বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন।

আজকের সমাজে বিদ্যমান সকল অন্যায়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে র্শিক থেকে মুক্ত করার জন্য মুসলিম বিশ্বের ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক মাত্র পথ হলো আল-কুরআনকে আঁকড়ে ধরা, রাসূলে খোদা (সা.)-এর সুন্নাহকে বাস্তবায়নের সর্বাত্মক চেষ্টা করা। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) রাসূলের এ চিরন্তন দাওয়াত পৌঁছানোর এবং তাঁর সাথে ভালোবাসা গড়ে তোলার মোক্ষম সময়। আমরা রাসূলের সাথে যত বেশি মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারব, যত বেশি দরুদ ও সালাম পাঠাব ততই বাতিল, তাগুত আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। আসুন ঘরে ঘরে রাসূলের জীবন চরিত্র আলোচনা ও বাস্তবে তা পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। ঈদে মিলাদুন্নবী সবার জন্য হোক মুবারক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

ঈদে মিলাদুন্নবী-এর ইতিহাস, তাৎপর্য, গুরুত্ব, ফজিলত ও করণীয়

ঈদে মিলাদুন্নবী:

ঈদে মিলাদুন্নবী হলো ইসলামের শেষ নবী ও রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর আগমন উপলক্ষে মুসলিমদের মাঝে পালিত এক আনন্দ উৎসব। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ১২ ই রবিউল আউয়াল হিজরিতে জন্ম গ্রহণ করেন। প্রায় সব জায়গায় ১২ রবিউল আউয়াল হিজরিতেই ঈদে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান পালন করা হয়।

ঈদ অর্থ হচ্ছে খুশি বা আনন্দ প্রকাশ করা। আর মিলাদ ও নবী দুটি শব্দ একত্রে মিলিয়ে মিলাদুন্নবী বলা হয়। আর নবী শব্দ দ্বারা রাহমাতুলি্লল আলামিন হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (দ.) কে বোঝানো হয়েছে। এককথায়, ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থ হুজুর পাক (সা.) এর পবিত্র ‘বেলাদত শরিফ’ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করা।

‘মিলাদ’ বা ‘মিলাদুন্নবী’ বলতে শুধুমাত্র নবীজী (সা.)-এর জন্মের সময়ের আলোচনা, জীবনী পাঠ, তাঁর বাণী, তাঁর শরিয়ত বা তাঁর হাদিস আলোচনা, তাঁর আকৃতি-প্রকৃতি আলোচনা, তাঁর উপর একাকী বা সম্মিলিতভাবে দরুদ শরীফ পাঠ, সালাম পাঠ, কিয়াম ইত্যাদি বুঝায়। আল-কুরআনে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) : মহান আল্লাহ পাকের বিশেষ কোন রহমত ও নিয়ামত দানের দিনকে ঈদরূপে পালন করার সুস্পষ্ট প্রমাণ আল-কুরআন।

বাংলাদেশে এই দিনটাকে মিলাদুন্নবী হিসেবে বলা হলেও অন্যান্য জায়গায় অন্যান্য নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম গন এই দিনটাকে নবী দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।

ঈদে মিলাদুন্নবীর ইতিহাস:-
পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল বিশ্ব ভুবনের জন্য নিঃসন্দেহে রহমত ও বরকতময়। নবী (স:) আগমনের দিনে বিশ্বের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান অত্যন্ত আদব ও সম্মানের সঙ্গে প্রিয় নবীর আগমনক্ষণ বিভিন্ন নাতে রাসুল, জশনেজুলুস, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁর জন্মসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি স্মরণ করে তথা শানে রিসালাতের অনুপম আদর্শ ও শিক্ষার ওপর সারগর্ভ আলোচনার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আনন্দ ও খুশি উদ্যাপন করে। হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে মিলাদুন্নবীর প্রচলন শুরু হয়। ইরাক অঞ্চলের ইরবিল প্রদেশের আবু সাঈদ কুকবুরী ঈদে মিলাদুন্নবীকে মুসলিমবিশ্বের অন্যতম উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, । জানা যায়, ৭ম হিজরী থেকে আনুষ্ঠানিক মিলাদ উদ্যাপন শুরু হয়। মিলাদের উপর সর্বপ্রথম গ্রন্থ রচনা করে আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে হাসান ইবনে দেহিয়া আল কালবী ।

ঈদে মিলাদুন্নবী পালনকারী দেশ :

মূলধারার সুন্নি ইসলাম, শিয়া ইসলাম এবং ইসলামের অন্যান্য শাখার অনুসারীগণ

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করে থাকে। । আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, বাহরাইন, বাংলাদেশ,

ব্রুনাই, বুরকিনা ফাসো, চাদ, মিশর, গাম্বিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, জর্দান,

কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া,

মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মালি, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, নাইজার, নাইজেরিয়া, ওমান,

পাকিস্তান, সেনেগাল, সোমালিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া এবং ইয়েমেনে

সরকারি ছুটির দিন হিসেবে উৎযাপিত হয়।

ঈদে মিলাদুন্নবীর তাৎপর্য ও ফজিলত:

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা পোষণ করা ইমানের পূর্বশর্ত। এটি আল্লাহর মহব্বত ও ভালোবাসাপ্রাপ্তির একমাত্র মাধ্যম। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ ইমানদার হবে না যতক্ষণ তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে আপন আর বেশি প্রিয় না হই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তোমাদের নিয়ামত দান করেন সেজন্য তোমরা তাঁকে ভালোবাসবে আর তাঁর মহব্বত পাওয়ার জন্য তোমরা আমাকে ভালোবাসবে।

নবীজি সম্পর্কে আল্লাহর হুকুম কী, সেই জ্ঞান অর্জন করে সেভাবে ইবাদত করতে হবে। মহান রাব্বুল আলামিন নবীজির শান বুলন্দ করে বলেন- হে মাহবুব! আপনি বলে দিন, ‘হে মানব জাতি, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো, তবে আমার অনুসারী হয়ে যাও, (ফলে) আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ্ ক্ষমা করবেন । নবী (সা.) এর ইত্তিবা ও সর্বাঙ্গীণ অনুসরণ আমাদের কর্তব্য। আল্লাহ কোরআন মাজিদে উল্লেখ করেছেন, ‘বলুন তোমরা যদি আল্লাহকে মহব্বত করে থাকো তাহলে তোমরা আমার ইত্তিবা ও অনুসরণ কর তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করবেন। আল্লাহ মহাক্ষমাশীল ও অপার দয়ালু।’ (সূরা আলে ইমরান : ৩১)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রসুলের আনুগত্য কর তাহলে তোমরা দয়াপ্রাপ্ত হবে। ’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩২)।

প্রিয় নবী (সা.)-এর অনুপম আদর্শ অনুসরণ করা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই রসুলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য। ’ (সূরা আহজাব : ২১)।

ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনে করণীয় :

বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বহু বছর ধরে পবিত্র ‘১২ রবিউল আউয়াল’ দয়াল নবীজির পবিত্র বেলাদত (শুভাগমন) দিবস উপলক্ষে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে মিলাদুন্নবী, জশনে-জুলুস ইত্যাদি পালন করে আসছে, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে বেদায়াতে হাছানা ও মোস্তাহাব। উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হুজুর (সা.)-এর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান, দরুদ ও সালাম পেশ করা অতি উত্তম ইবাদত।প্রিয় নবী (সা.)-এর শুভাগমনে অকৃপণ ও বিশাল উদারতায় আনন্দ প্রকাশ করা আমাদের জন্য পরম কল্যাণকর। হাদিসে এসেছে। প্রিয়নবী (সা.)-এর জন্মের সংবাদ শুনে তাঁর চাচা আবু লাহাব তার দাসী সুরাইবাকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এই দিনে স্মরণসভা, আলোচনা সভা, সেমিনার, কোরআনখানি, দোয়া মাহফিল, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের মাধ্যমে ওই স্মরণীয় দিবসের ইতিহাস, গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরার মধ্যে বিবিধ উপকার ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ একদিকে ধর্মীয় দিবসের তাৎপর্য ও প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবনে এবং এ আদর্শের যথার্থ অনুসরণ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে একটি আদর্শ শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সক্ষম হবে, অন্যদিকে এসব কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির প্রকৃত ইতিহাস জানার ও সংরক্ষণের সুযোগ পাবে।

পরিভাষায় বললে, হজরত মুহাম্মদ (দ.) এর শুভাগমন স্মরণে খুশি প্রকাশ করে মিলাদ শরিফ মাহফিলের ব্যবস্থা করা, শান-মান, মর্যাদা-মর্তবা আলোচনা করা, কোরআন তেলাওয়াত, দরুদ শরিফ পাঠ, তাওয়াল্লুদ বা জন্মকালীন ঘটনা মজলিস করে আলোচনা করা, দাঁড়িয়ে সালাম, কাসিদা বা প্রশংসামূলক কবিতা, ওয়াজ-নসিহত, দোয়া-মোনাজাত, সম্ভব মতো মেহমান নেওয়াজির সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান করা।

বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন :
বাংলাদেশে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা এবং ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন করেন। মসজিদে মসজিদে, নিজ নিজ বাসায় কোরআন খতম ও জিকির আজগারের মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামিন এবং মহানবী (সা.)-এর বিশেষ রহমত কামনা করেন মুসলমান ভাই-বোনেরা।

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ পৃথক পৃখক বাণী দিয়ে থাকেন। এদিন তারা দেশবাসীসহ বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ’র প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং মোবারকবাদ জানিয়ে থাকেন।

ঈদে মিলাদুন্নবীতে পত্রিকাগুলো ক্রোড়পত্র প্রকাশের ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। টেলিভিশন ও রেডিওতে দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে।

বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

পরিশেষে , মিলাদুন্নবী (সা.)-এর মাসে আমরা আমাদের নবীপ্রেমকে শাণিত করি, মহান আল্লাহর দরবারে লাখো কোটিবার শুকরিয়া জ্ঞাপন করি এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর অনুসরণে জীবনযাপন করে ইহকালীন-পরকালীন কামিয়াবি অর্জন করি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দিন। আমিন।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর ইতিহাস, গুরুত্ব, তাৎপর্য ও ফজিলত এবং আমাদের করনীয়

আপডেট সময় : ০৮:১৪:১৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

 

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য

সৃষ্টির প্রথম থেকেই মানুষের ফিতরাত বা স্বভাব হচ্ছে এই যে, মানুষ সুন্দর, আনন্দদায়ক, কল্যাণকর কোন বস্তু, ব্যক্তি ও ঘটনায় আনন্দিত হয়, আর অসুন্দর, দুঃখজনক ও অকল্যাণকর অবস্থায় ব্যথিত হয়। স্বভাব এমন যে, দুঃখের জীবন থেকে বের হয়ে আসতে সে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যাবে যখনই মানুষ অন্যায়, অসত্য ও জুলুম-নির্যাতনের স্টীম রোলারে নিষ্পেষিত হয়েছে তখনই মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রাণপণে খুঁজেছে একজন মুক্তিদাতা, ত্রাণকর্তা যাকে কেন্দ্র করে এবং যার নেতৃত্বে ঘটাবে সকল দুঃখের অবসান, চিরতরে বিলীন করবে সকল অশুভ শক্তিকে।

মানুষ যখনই এ দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলেছে তখনই স্বধর্মীয়, স্বগোত্রীয় লোকদের নিয়ে করেছে আনন্দানুষ্ঠান। এ আনন্দানুষ্ঠানকে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের ভাষায় বলা হয়েছে ঈদ (عيد)। অভিধানে ঈদ বলতে বুঝায় : ‘কোন মর্যাদাবান ব্যক্তি অথবা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমবেত হওয়ার দিন বা স্মৃতিচারণের দিবসই ঈদ। কেউ কেউ বলেছেন, ঈদকে এজন্যই ঈদ বলা হয় যে, প্রতিবছর নব আনন্দ নিয়ে তা ফিরে আসে।’ (আল-মুন্জিদ, পৃ. ৫৩৯)

আর মিলাদ ميلاد শব্দের অর্থ وقت الولادة জন্ম সময়। (আল-মুনজিদ, পৃ. ৯১৮)। পারিভাষিক অর্থে মিলাদ বলতে জন্ম সময়, জন্ম বৃত্তান্ত তথা কারো জন্ম তারিখে তার জীবন চরিত আলোচনা ও তার জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের অঙ্গীকার করা। মিলাদ শব্দটি যদিও আরবি, কিন্তু আমাদের দেশে এর প্রচলন ফারসি ভাষা থেকে হয়েছে। অনেকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট না জেনে এ শব্দটি আরবি ভাষার আঙ্গিকে তুলে ধরে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি করেন। ফারসিতে মিলাদ অর্থ زمان تولد জন্ম সময়। (ফারহাঙ্গে জবানে ফারসি, পৃ. ১০৬৭)

 

পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিম বিশ্বের ঈমানি প্রেরনার জয় ধ্বনী নিয়ে প্রতি বছর আমাদের মাঝে আসে রবিউল আওয়াল মাসে। পবিত্র ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন করা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্যতম উৎসব।

কোন নেয়ামত ও রহমত লাভ করলেই আনন্দোৎসব করা যেরূপ মানুষের স্বভাবজাত কাজ তদ্রূপ আল্লাহ তাআলার নির্দেশও তাই। যেমন কুরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে : ‘(হে রাসূল!) বল : আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক।’ (সূরা ইউনুছ : ৫৮)

এ আয়াতে বর্ণিত আল্লাহর অনুগ্রহ فضل الله এবং তাঁর রহমত رحمة বলতে কী বুঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে ইবনে জারির তাবারী (রহ.) তাঁর তাফসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণনা করেছেন : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন : অনুগ্রহ (فضل الله) বলতে ইসলাম আর রহমত (رحمة) দ্বারা আল-কুরআনে বুঝানো হয়েছে।

আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ূতী (রহ.) আদ্দুররুল মানসুর তাফসীরে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন : ‘এখানে ‘আল্লাহর অনুগ্রহ’ বলতে ইল্ম বুঝানো হয়েছে। আর ‘রহমত’ দ্বারা বুঝানো হয়েছে মুহাম্মাদ (সা.)-কে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন : ‘আমিতো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)

অর্থাৎ তোমরা মহামূল্যবান সম্পদ আল-কুরআন ও ইসলাম বা রাসূলে খোদা (সা.)-কে পেয়েছ, এর জন্য আনন্দ করা তোমাদের অন্যতম কাজ। যদি কুরআন মজীদ ও দীন ইসলাম পাওয়ার কারণে আনন্দ করতে হয় তাহলে যার মাধ্যমে কুরআন ও দীন পেয়েছি, যিনি ছিলেন সমগ্র জগতের রহমত, তাঁর আগমন যে কত বড় নেয়ামত ও রহমত তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না।

আবদুল হক মুহাদ্দেসে দেহলভী (রহ.) তাইতো তাঁর রচিত ‘মা সাবাতা মিনাসসুন্নাহ’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘হাজার মাসের চেয়ে উত্তম লাইলাতুল কাদর, ফজিলতের রাত্রি শবে বরাত, শবে মেরাজ, দুই ঈদের রাত এ সবই রাহমাতুল্লিল আলামীনকে দান করা হয়েছে। যাঁকে দান করা রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম, স্বয়ং তাঁর আগমন দিবস যে কত লক্ষ-কোটি দিবস-রজনীর চেয়ে উত্তম তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।’

 

সামান্য জাগতিক নেয়ামত লাভ করলেও তার জন্য ঈদ উৎসব করার সরাসরি উদাহরণ আমরা আল-কুরআনে দেখতে পাই। যেমন আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ কামনা করে হযরত ঈসা (আ.) যে দোয়া করেছিলেন তা প্রণিধানযোগ্য। এরশাদ হয়েছে :

‘ঈসা ইবনে মারইয়াম বলল : হে আল্লাহ! আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য ঊর্ধজগৎ হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন। এ হবে আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সকলের জন্য ঈদস্বরূপ, আর আপনার অন্যতম নিদর্শন।’ (সূরা মায়িদা : ১১৪)

মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে খাঞ্চা ভরা খাওয়া পেলে তা যদি হযরত ঈসা (আ.)-এর ভাষায় সৃষ্টির আদি হতে অন্ত পর্যন্ত আনন্দোৎসবের কারণ ও আল্লাহ তাআলার নিদর্শন হয় তাহলে সৃষ্টির সেরা মানব, রহমতের ভাণ্ডার রাসূলে পাক (সা.)-এর মতো এ মহান নেয়ামতের আগমন দিবস কতই না মর্যাদাবান, গুরুত্ববহ, কতই না আনন্দের তা সহজেই অনুমেয়।

হযরত ইমাম বুখারী (রহ.) বর্ণনা করেন : ‘আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার বংশের একজন স্বপ্নে তাকে খুবই খারাপ অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করল, আপনার অবস্থা কি? সে জবাবে বলল, তোমাদেরকে ছেড়ে আসার পর আমার কল্যাণজনক কিছুই হয়নি, হ্যাঁ, এই আঙ্গুল (শাহাদাত অঙ্গুলি) দ্বারা পানি পাই। কারণ, এ আঙ্গুলের ইশারায় আমি দাসী সুয়াইবাকে মুক্তি দিয়েছিলাম।’

এই হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) তাঁর বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ফাতহুল বারী এবং আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী (রহ.) তাঁর রচিত ‘আইনী’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন : ইমাম সুহাইলী (রহ.) উল্লেখ করেন যে, হযরত আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর তাকে স্বপ্নে দেখি যে, অত্যন্ত দুরবস্থার মাঝে পতিত রয়েছে। সে বলল, ‘তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর আমি শান্তির মুখ দেখিনি। তবে প্রতি সোমবার আমার আযাব লাঘব করা হয়।’ হযরত আব্বাস (রা.) বলেন : ‘তার এ আযাব লাঘবের কারণ হলো রাসূলে পাক (সা.)-এর জন্মদিন ছিল সোমবার। তাঁর জন্মের সুসংবাদ নিয়ে আসায় দাসী সুয়াইবাকে সে খুশিতে মুক্তি দেয়। (ফাতহুল বারী, ৯ম খ-, পৃ. ১১৮; আইনী, ২০/৯৫)

যে কাফের সম্পর্কে কুরআন মজীদে সরাসরি নাযিল হয়েছে :

‘ধ্বংস হয়েছে আবু লাহাবের দু’হাত এবং সে নিজেও।’ সে যদি একজন কাফের হওয়া সত্ত্বেও ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর খুশির কারণে তার প্রতি সোমবার আযাব লাঘব হয়, শাহাদাত অঙ্গুলি দিয়ে পানি বের হয়- যা খেয়ে সে তৃপ্ত হয়, একজন মুসলমান ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন ও আনন্দানুষ্ঠান করলে তাতে রহমত, বরকত লাভ এবং আযাব থেকে মুক্তিলাভের এক বিরাট সুযোগ তা যে কোন বিবেকবান ব্যক্তি সহজেই অনুধাবন করতে পারে। কবি শেখ সাদী (রহ.)-এর ভাষায় :

دوستان را کجا کنی محروم

تو که با دشمانان نظرداری

‘বন্ধুদের বঞ্চিত করার প্রশ্নই আসে না, তুমি তো এমন সত্তা যে, দুশমনের দিকেও লক্ষ্য রাখ।’

মিলাদুন্নবী উদযাপন দিবসকে কেন্দ্র করে রাসূলের পুরো জীবনকে আয়নার মতো নিজের জীবনের সামনে তুলে ধরা এবং সে অনুযায়ী ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ জীবন গড়ে তোলার সংকল্প গ্রহণের মতো উত্তম ও বরকতময় কাজ আর কী হতে পারে? রাসূলের মর্যাদা বর্ণনা করার সাথে সাথে তাঁর দাওয়াত ও হেদায়াত গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। অতীতে মনীষিগণ রাসূলের প্রশংসা বর্ণনার সাথে সাথে রাসূলের সুন্নাতকে তাঁদের জীবনে বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। হযরত আলী (রা.) যেমন ছিলেন রাসূলের সুন্নাতের ধারক তদ্রূপ প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। তিনি বলেন :

اختاره من شجرة النبياء و نشكاة الضياء و ذوابة العلياء و سرّة التئحاء و مصباح الظلمة و ينابيع الحكمة

‘নবুওয়াত বৃক্ষের মাঝে তিনি বাছাইকৃত আলোকের আধার, সম্মানের সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিষ্ঠিত, বাতহা তথা মক্কা মুয়াজ্জমার মূলকেন্দ্র, অন্ধকারের বাতি, হেকমত ও প্রজ্ঞার উৎস-প্রস্রবণ।’ (নাহজুল বালাগা, খুতবা ১০৭)

হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) তাইতো বলেছিলেন :

روشن زوجود تست کونین

ای ظاهر و باطنت همه نور

‘আপনার অস্তিত্বের আলোয় উভয় জাহান আলোকিত, হে মহান! আপনার জাহের ও বাতেন সবই নূর।’ (কাসিদায়ে গাউসুল আজম)

তাইতো আল্লামা বুছিরী (রহ.) বলেছেন :

لو لاه ما خلق الافلاک خالقها

لو لاه ما خرج الانسان من عدم

‘তিনি না হলে আসমান স্রষ্টা তা সৃষ্টি করতেন না, তিনি না হলে মানবজাতি অনস্তিত্বের গ-ি হতে বের হয়ে আসত না।’

তাঁর মহান সত্তা সম্পর্কে শেখ সাদী (রহ.) বলেছেন :

بلغ العلی بکماله

کشف الدجی بجماله

حسنت جمیع خصاله

صلوا علیه و آله

‘মানবতার শীর্ষে তুমি হলে উপনীত,

রূপের ছটায় দূর করলে আঁধার ছিল যত-

সকল গুণের সমাবেশে চরিত্রে মহান,

তুমি ও তোমার বংশ পরে হাজারো সালাম।’

 

কবি ফররুখ বলেন :

‘হারা সম্বিত ফিরে দিতে বুকে তুমি

আনো প্রিয় আবহায়াত

জানি সিরাজাম মুনীরা তোমার রশ্মিতে

জাগে কোটি প্রভাত।’

কবি আল মাহমুদ বলেন :

‘এই নামে ফোটে হৃদয়ে গোলাপ কলি

যেন অদৃশ্য গন্ধে মাতাল মন,

যেন ঘনঘোর আঁধারে আলোর কলি

অকুল পাথারে আল্লার আয়োজন।’

মোটকথা, সকল লেখক, কবি-সাহিত্যিকই রাসূলের শানে কিছু না কিছু লিখতে চেষ্টা করেছেন। অধুনা বিশ্বে কলমের সাথে আমলের দিক থেকে রাসূলের আদর্শের রূপায়নই হবে সবচেয়ে বড় কাজ।

যে সময় আল্লাহর ঘরে স্থান পেয়েছে তিন শতাধিক মূর্তি। আইন, বিচার ও প্রশাসন সবক্ষেত্রে চলছে তাগুতী শাসন, মানুষে মানুষে হানাহানি, উটকে পানি খাওয়ানোর মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে চলছিল যুগের পর যুগ যুদ্ধ। জীবন্ত কবর দিচ্ছিল বাবা নিজ কন্যাকে, সুদ ছিল দুনিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি, ব্যভিচার, মদ ও জুয়া ছিল সমাজের ওপর তলার লোকদের নিত্যদিনের কাজ। অসহায়, ইয়াতিম, অনাথ বঞ্চিত মানবতা যখন করছিল গগনবিদারি ফরিয়াদ, নারী জাতি ছিল মর্যাদাহীন খেলনার বস্তু। আদর্শিক, নৈতিক অবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। এ সময় ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল সুখময় বসন্তকাল হিসাবে যিনি আগমন করেছিলেন তিনিই হলেন রাহমাতুল্লিল আলামীন। বিশ্ববিখ্যাত হাদীস বিশারদ মোল্লা আলী কারীর ভাষায় :

ربیع فی ربیع فی ربیع

ولکن فوق نور فوق نور

‘তিনি ছিলেন বসন্তকাল, যার আগমনে যেমন আগমন করেছে প্রাকৃতিক বসন্ত, তেমনি নৈতিকতা ও আদর্শের ভুবনেও আগমন করেছে নববসন্তের জোয়ার। তিনি ছিলেন জাগতিক বসন্তের চেয়ে লাখ-কোটি গুণ অধিক আলোদানকারী নূর।’ (মেরকাতুল মাফাতিহ)

এ শিশুর শুভাগমন সারা দুনিয়াকে নাড়া দেয়। একদিকে মা আমেনার জীর্ণ কুটির স্বর্গীয় আলোতে ঝলমল, প্রকৃতির বস্তু নিচয় আনন্দাপ্লুত। আজ ইবরাহীমের তাওহিদী হুংকার, মূসার অলৌকিক অসি, ঈসা মসীহর আলৌকিকত্ব সবই নয়া সাজে সজ্জিত আর তাগুত, শয়তান জালেমের গায়ে লেগেছে আগুন। এ রাতে কিসরার প্রাসাদের ১৪টি গম্বুজ ভেঙে পড়েছে, পারস্যের হাজার হাজার বছরের অগ্নি নিভে গেছে, শাতিল নদী শুকিয়ে গেছে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি শুধু কিসরার গম্বুজই নয় বরং আজমীদের শান-শওকত, রোমানদের আড়ম্বর, চীনের প্রাচীরের মতো গগনচুম্বী মহলরাজি ভেঙে পড়েছিল। শুধু পারস্যের অগ্নিই নয় বরং অবিশ্বাসের গভীর ঘন অন্ধকার এবং পথভ্রষ্টতার বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ‘তাফসীরে সোরাবাদীর’ ভাষ্য অনুযায়ী ২৫টিরও অধিক অলৌকিক ঘটনার সমাহার নিয়ে তিনি আগমন করলেন এ ধরায়। তাই তো কবি বলেছেন :

‘তাঁর গুণ বৈশিষ্ট্য লেখার সাধ্য কারো আছে কি? তিনি তো আপাদমস্তক অলৌকিকত্ব নিয়েই এসেছেন।’

‘মুহাম্মাদ’ কতই না সুন্দর নাম!

কী চমৎকার শিশু! যার দুনিয়ায় আগমনের সময় মা আমেনার প্রসব বেদনা হয়নি, নাভি মায়ের নাভির সাথে সংযুক্ত নয়, যার খতনা মায়ের পেটেই সম্পন্ন, পুত-পবিত্র গোসল করা ও সেজদারত অবস্থায় তাশরিফ এনেছেন। কবি নজরুল বলেন :

‘দেখ আমেনা মায়ের কোলে

দোলে শিশু ইসলাম দোলে

কচি মুখে শাহাদাতের

বাণী সে শুনায়।’

যার আগমনের সাথে আকাশ, বাতাস মুখরিত হচ্ছে সালাম আর সওগাতে। তাঁর নাম যে কত তাৎপর্যবহ হবে তা তো সহজেই অনুমেয়।

পিতৃহীন স্বর্গীয় নাতিকে প্রথমবারের মতো কোলে নিয়ে আবদুল মুত্তালিব পুত্রবধূ আমেনাকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘এ চাঁদের নাম কী রাখা যায়?’ জবাবে আমেনা বললেন : “স্বপ্নে আমাকে কে যেন বলেছে, শিশুর নাম হবে ‘মুহাম্মদ’।” দাদা এ নাম শুনে খুশি হয়ে এ নামেই ডাকতে লাগলেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম, নেহায়াতুল আরব) যার অর্থ চরম প্রশংসিত। অভিধানের দৃষ্টিতে মুহাম্মাদ অর্থ যার প্রশংসা অতীতে চলেছে, বর্তমানে চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলবে, তিনিই হলেন মুহাম্মাদ।

‘মুহাম্মাদ তাকেই বলে যার মাঝে প্রশংসনীয় চরিত্রের সমাহার ঘটেছে।’

কবি হাসসান বিন ছাবিত তাইতো মসজিদে নববীর মিম্বারে বসে আল্লাহর রাসূলকে সামনে নিয়ে গেয়েছেন :

وشق له اسمه لیجله- فذو العرش محمود و هذا محمد

‘আল্লাহ (আদর ও সোহাগ করে) নিজের নাম হতে তাঁর নামকে বের করেছেন। অধিকন্তু মহান আরশের অধিপতি হচ্ছেন মাহমুদ (প্রশংসিত) আর হযরতের নাম হলো মুহাম্মাদ (চরম প্রশংসিত)।’

আমেনার আদরের দুলাল মুহাম্মাদ (সা.) তো প্রশংসা পাবারই পাত্র। যে হযরত হালিমার দুধপান করতে গিয়েও একটি স্তনের দুধ পান করছেন আরেকটি রেখে দিচ্ছেন দুধ ভাই আবদুল্লাহর জন্য। ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের দরদ, সাম্যের এরূপ নিদর্শন দুনিয়ার ইতিহাসে আরেকটি কি খুঁজে পাওয়া যাবে? শিশু মুহাম্মাদ (সা.)-এর আচার-আচরণ দেখে হালিমার আশপাশের নারীরা হিংসায় জ্বলে যেত। সবাই ভাবত, এরূপ একটি শিশুর লালন যদি আমার ভাগ্যে জুটত। দুধ ভাইয়ের এ আদর্শ দেখেই দুধবোন সায়মা কোলে নিয়ে বলছেন :

‘বেঁচে থাকুক মুহাম্মদ- সে দীর্ঘজীবী হোক

চির তরুণ চির কিশোর চির মধুর রোক।

হয় যেন সে সরদার আর পায় যেন সে মান

শত্রু তাহার ধ্বংস হোক ঘুচুক অকল্যাণ।

মুহাম্মদের পানে খোদা করুন চোখে চাও

চিরস্থায়ী গৌরব যা-তাই তাহারে দাও।’

(অনুবাদ-কবি গোলাম মোস্তফা)

 

শৈশবের ঘটনাবহুল দিনগুলো পেরিয়ে কৈশোরে প্রতিষ্ঠিত হলেন কিশোর মুহাম্মাদ (সা.) ‘আল-আমীন’ মুহাম্মাদ রূপে। যার অর্থ শান্তিপ্রিয়, সম্প্রীতির আধার, চরম সত্যবাদী ও পরম বিশ্বস্ত। মক্কার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল ‘মুহাম্মাদ’ (সা.) এমন এক কিশোর যে মিথ্যা কথা বলে না, আমানতের খেয়ানত করে না, অন্যের উপকার করা যার কাজ, বড়দের সম্মান ছোটদের স্নেহ করা যার চরিত্র। গোটা মক্কার জনগোষ্ঠীর মনের মাঝে এ কিশোরের স্থান ছিল অনন্য। সবার সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে, অথচ সে অন্যায়, অশ্লীলতার ধারে কাছেও যায় না। কটুবাক্য সে বলেনি যা অন্যের মনে কষ্ট হতে পারে। আজকের কিশোর সমাজ আদর্শ কিশোর হতে হলে যে জীবন্ত প্রতীকের অনুসরণ করবে তিনি হলেন কিশোর মুহাম্মাদ (সা.)।

যুবক মুহাম্মাদ (সা.) মক্কার যুব সমাজকে নিয়ে যদিও সমাজ সংস্কারের পদক্ষেপ নিয়েছেন, কাবা ঘরে পাথর বসানো নিয়ে বিভিন্ন গোত্রের বিবাদ শান্তিপূর্ণভাবে মিমাংসা করতে সক্ষম হয়েছিলেন; কিন্তু মক্কা তথা গোটা দুনিয়ার মানুষ র্শিকে নিমজ্জিত ছিল। র্শিক থেকে মুক্ত করার জন্য প্রয়োজন ছিল এক মহা শক্তির প্রত্যক্ষ মদদ যা সকল তাগুতী শক্তিকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। যতদিন যেতে লাগল মুহাম্মাদ (সা.)-এর মনে ততই চিন্তার পাহাড় জমতে থাকে। হেরা পর্বতের গুহায় বসে ভাবছিলেন কি করে এ বিশ্বকে র্শিকমুক্ত করা যায়। খোদায়ী ওহী ধারণ করার জন্য যেসব মানবীয় গুণ ও নৈতিক চরিত্র দরকার, জনমনে যে আসন লাভ করা প্রয়োজন সে চারিত্রিক ও গুণগত বৈশিষ্ট্য ফুলে-ফলে সুশোভিত হওয়ার পরই নাযিল হলো লওহ মাহফুজে লেখা আল্লাহর বাণী আল-কুরআন। ঘোষিত হলো :

‘পড় তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা আলাক : ১)

এ খোদায়ী নূরানি কুরআনকে যারা ধারণ করতে চায় তাদেরকেও রাসূল চরিত্রের অনুকরণীয় চরিত্র অর্জন করতে হবে।

কুরআনের নূরানি ঝলক, পুত-পবিত্র ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বের মুখে ‘লা শারিক’-এর ঘোষণা সকল স্বার্থান্বেষী, সুবিধাভোগী আমলা ও দুর্নীতিবাজ শোষক শ্রেণির মাথায় হানলো এক বজ্রাঘাত। অত্যাচার, নিপীড়ন, অর্থনৈতিক অবরোধ, সামাজিক বয়কট, হত্যার হুমকি, কুৎসা রটনা এবং পাগল-যাদুকর, দেশদ্রোহী, ধর্মবিরোধীরূপে আখ্যাসহ সকল প্রকার প্রচার অর্থাৎ শয়তানি শক্তির সকল বাধা বিপত্তির মুখে দৃঢ় চিত্ত ঈমান নিয়ে আল্লাহর নবী নিজেকে ও সাহাবায়ে কেরামগণকে গড়ে তোলেন কুরআনি আদর্শে। কায়েম হলো আল্লাহর রাজ। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, আদল-ইনসাফভিত্তিক বিচার ব্যবস্থা এবং দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত প্রশাসন উপহার দেয়ার জন্য শারীরিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক দৈন্য সবকিছু সহ্য করেছেন, প্রয়োজনে পেটে পাথর বেঁধেছেন, গাছের পাতা খেয়েছেন; কিন্তু অন্যায়ের সাথে, র্শিকের সাথে, হারামের সাথে, দুর্নীতির সাথে আপোষ করেননি। মানুষের তৈরি খোদাবিমুখ আইন-কানুন, সংবিধান, সম্পূর্ণ উল্টিয়ে আল-কুরআনকে বসিয়েছেন সবার ঊর্ধ্বে। সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠা করেছেন বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। মোটকথা, মাত্র তেইশ বছরের মধ্যে আল্লাহর রাসূলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে এক আদর্শ সভ্যতা, উন্নত সংস্কৃতি ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা।

রাসূলে খোদা (সা.)-এর জীবন চরিত্র-সুন্নাহ হলো আল্লাহর কুরআনের বাস্তব দিক। যারা এ সুন্নাহর পুরোপুরি অনুসরণ করবেন, এ সুন্নাহকে বাস্তবায়ন করার কাজে ব্রতী হবেন তাঁদের জন্যই হবে রাসূলের জন্ম দিবস আনন্দের। যারা প্রতিবছর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-কে কেন্দ্র করে নিজের, পরিবারের, সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক কাজ-কর্মকে রাসূলের জীবনের সাথে মিলাবেন, সে আয়নায় নিজেদেরকে দেখবেন, নিজেদের দোষ-ত্রুটি চিহ্নিত করে পরবর্তী বছরের জন্য প্রস্তুতি নেবেন তাঁদের জন্য হবে এ দিবস ঈদের দিন।

কিন্তু যে দেশের সংবিধান র্শিকমিশ্রিত, যেখানে আল্লাহকে বাদ দিয়ে মানুষকেই ক্ষমতার উৎস বলা হয়- সে দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন আল্লাহর রাসূলের সাথে উপহাস ছাড়া আর কিছুই নয়।

 

যে ব্যক্তি সুদ খায়, সুদ দেয়, সুদী কারবার করে, ঘুষ খায়, ঘুষ দেয়, ঘুষের লেনদেনে জড়িত, যে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে প্রশাসনে দুর্নীতি ঢুকায়, যে ব্যবসা-বাণিজ্যে পরকে ঠকানোর ব্যবস্থা করে, যে মালিক অন্যায়ভাবে তার শ্রমিকদের ঠকায় ও শ্রমের মর্যাদা দেয় না, যে শ্রমিক কাজে ফাঁকি দেয় তার জন্য রাসূলে খোদার জন্মদিন হবে ভয়ের দিন, দুঃখের দিন। তার জন্য এ দিবস কিছুতেই ঈদ বা খুশির হতে পারে না। যে মিলাদ মাহফিলে রাসূলের জীবন চরিত্র আলোচনা হয় না, সুদ ঘুষ ও চোরাচালানির পয়সা দিয়ে যেখানে মিষ্টি হালুয়া ক্রয় করা হয়, তাদের এ মাহফিল ও পয়সা ব্যয় রাসূলে পাকের গলায় ছুরি চালানোর মতো। যে আলেম সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে রাসূলের নির্দেশিত সত্যকে গোপন রাখে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে না, সামান্য দাওয়াতের জন্য সুদখোর, মদখোর, জুয়াড়ি, বেনামাযী খোদাদ্রোহীর সাথে সম্পর্ক রাখে, তাদের ঈদে মিলাদুন্নবী পালন হবে বনি ইসরাইলের স্বার্থান্বেষী দরবারি আলেমদের মতো যাদেরকে কুরআনে কুকুর বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। এরশাদ হয়েছে :

‘তাদেরকে ঐ ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শুনাও যাকে আমি দিয়েছিলাম নিদর্শন। সে তা বর্জন করে (তাকে নিদর্শন মুক্ত পেয়ে) শয়তান তার পেছনে লাগে, আর সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়। আমি ইচ্ছা করলে এ সব (নিদর্শন) দ্বারা তাকে উচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করতাম। কিন্তু সে দুনিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে ও তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে- তার অবস্থা কুকুরের ন্যায়। তার ওপর তুমি বোঝা চাপালেও সে হাঁপাতে থাকে আর বোঝা না চাপালেও সে হাঁপায়। যে সম্প্রদায় আমার নিদর্শনকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের অবস্থাও এইরূপ। তুমি ঘটনা বলে দাও যাতে তারা চিন্তা করে।’ (সূরা আরাফ : ১৭৫-১৭৬)

‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পালন হচ্ছে জান্নাত পাওয়ার মাধ্যম এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল। তাই সাহাবায়ে কেরামের সাথে একমত পোষন করে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাহফিল করা ঈমানদারদের জন্য একান্ত প্রয়োজন। আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন যেন মোনাফিকদের খপ্পর থেকে আমাদের ঈমানকে হেফাজত করেন। “আমীন” বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন।

আজকের সমাজে বিদ্যমান সকল অন্যায়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও জুলুম থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে র্শিক থেকে মুক্ত করার জন্য মুসলিম বিশ্বের ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এক মাত্র পথ হলো আল-কুরআনকে আঁকড়ে ধরা, রাসূলে খোদা (সা.)-এর সুন্নাহকে বাস্তবায়নের সর্বাত্মক চেষ্টা করা। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) রাসূলের এ চিরন্তন দাওয়াত পৌঁছানোর এবং তাঁর সাথে ভালোবাসা গড়ে তোলার মোক্ষম সময়। আমরা রাসূলের সাথে যত বেশি মহব্বতের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারব, যত বেশি দরুদ ও সালাম পাঠাব ততই বাতিল, তাগুত আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। আসুন ঘরে ঘরে রাসূলের জীবন চরিত্র আলোচনা ও বাস্তবে তা পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। ঈদে মিলাদুন্নবী সবার জন্য হোক মুবারক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

ঈদে মিলাদুন্নবী-এর ইতিহাস, তাৎপর্য, গুরুত্ব, ফজিলত ও করণীয়

ঈদে মিলাদুন্নবী:

ঈদে মিলাদুন্নবী হলো ইসলামের শেষ নবী ও রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর আগমন উপলক্ষে মুসলিমদের মাঝে পালিত এক আনন্দ উৎসব। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) ১২ ই রবিউল আউয়াল হিজরিতে জন্ম গ্রহণ করেন। প্রায় সব জায়গায় ১২ রবিউল আউয়াল হিজরিতেই ঈদে মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান পালন করা হয়।

ঈদ অর্থ হচ্ছে খুশি বা আনন্দ প্রকাশ করা। আর মিলাদ ও নবী দুটি শব্দ একত্রে মিলিয়ে মিলাদুন্নবী বলা হয়। আর নবী শব্দ দ্বারা রাহমাতুলি্লল আলামিন হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা (দ.) কে বোঝানো হয়েছে। এককথায়, ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থ হুজুর পাক (সা.) এর পবিত্র ‘বেলাদত শরিফ’ উপলক্ষে খুশি প্রকাশ করা।

‘মিলাদ’ বা ‘মিলাদুন্নবী’ বলতে শুধুমাত্র নবীজী (সা.)-এর জন্মের সময়ের আলোচনা, জীবনী পাঠ, তাঁর বাণী, তাঁর শরিয়ত বা তাঁর হাদিস আলোচনা, তাঁর আকৃতি-প্রকৃতি আলোচনা, তাঁর উপর একাকী বা সম্মিলিতভাবে দরুদ শরীফ পাঠ, সালাম পাঠ, কিয়াম ইত্যাদি বুঝায়। আল-কুরআনে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) : মহান আল্লাহ পাকের বিশেষ কোন রহমত ও নিয়ামত দানের দিনকে ঈদরূপে পালন করার সুস্পষ্ট প্রমাণ আল-কুরআন।

বাংলাদেশে এই দিনটাকে মিলাদুন্নবী হিসেবে বলা হলেও অন্যান্য জায়গায় অন্যান্য নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম গন এই দিনটাকে নবী দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।

ঈদে মিলাদুন্নবীর ইতিহাস:-
পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল বিশ্ব ভুবনের জন্য নিঃসন্দেহে রহমত ও বরকতময়। নবী (স:) আগমনের দিনে বিশ্বের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মুসলমান অত্যন্ত আদব ও সম্মানের সঙ্গে প্রিয় নবীর আগমনক্ষণ বিভিন্ন নাতে রাসুল, জশনেজুলুস, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁর জন্মসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি স্মরণ করে তথা শানে রিসালাতের অনুপম আদর্শ ও শিক্ষার ওপর সারগর্ভ আলোচনার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আনন্দ ও খুশি উদ্যাপন করে। হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে মিলাদুন্নবীর প্রচলন শুরু হয়। ইরাক অঞ্চলের ইরবিল প্রদেশের আবু সাঈদ কুকবুরী ঈদে মিলাদুন্নবীকে মুসলিমবিশ্বের অন্যতম উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, । জানা যায়, ৭ম হিজরী থেকে আনুষ্ঠানিক মিলাদ উদ্যাপন শুরু হয়। মিলাদের উপর সর্বপ্রথম গ্রন্থ রচনা করে আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে হাসান ইবনে দেহিয়া আল কালবী ।

ঈদে মিলাদুন্নবী পালনকারী দেশ :

মূলধারার সুন্নি ইসলাম, শিয়া ইসলাম এবং ইসলামের অন্যান্য শাখার অনুসারীগণ

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করে থাকে। । আফগানিস্তান, আলজেরিয়া, বাহরাইন, বাংলাদেশ,

ব্রুনাই, বুরকিনা ফাসো, চাদ, মিশর, গাম্বিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, ইরাক, জর্দান,

কুয়েত, লেবানন, লিবিয়া,

মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মালি, মৌরিতানিয়া, মরক্কো, নাইজার, নাইজেরিয়া, ওমান,

পাকিস্তান, সেনেগাল, সোমালিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া এবং ইয়েমেনে

সরকারি ছুটির দিন হিসেবে উৎযাপিত হয়।

ঈদে মিলাদুন্নবীর তাৎপর্য ও ফজিলত:

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা পোষণ করা ইমানের পূর্বশর্ত। এটি আল্লাহর মহব্বত ও ভালোবাসাপ্রাপ্তির একমাত্র মাধ্যম। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ ইমানদার হবে না যতক্ষণ তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সব মানুষের চেয়ে আপন আর বেশি প্রিয় না হই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ তোমাদের নিয়ামত দান করেন সেজন্য তোমরা তাঁকে ভালোবাসবে আর তাঁর মহব্বত পাওয়ার জন্য তোমরা আমাকে ভালোবাসবে।

নবীজি সম্পর্কে আল্লাহর হুকুম কী, সেই জ্ঞান অর্জন করে সেভাবে ইবাদত করতে হবে। মহান রাব্বুল আলামিন নবীজির শান বুলন্দ করে বলেন- হে মাহবুব! আপনি বলে দিন, ‘হে মানব জাতি, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাকো, তবে আমার অনুসারী হয়ে যাও, (ফলে) আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ্ ক্ষমা করবেন । নবী (সা.) এর ইত্তিবা ও সর্বাঙ্গীণ অনুসরণ আমাদের কর্তব্য। আল্লাহ কোরআন মাজিদে উল্লেখ করেছেন, ‘বলুন তোমরা যদি আল্লাহকে মহব্বত করে থাকো তাহলে তোমরা আমার ইত্তিবা ও অনুসরণ কর তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করবেন। আল্লাহ মহাক্ষমাশীল ও অপার দয়ালু।’ (সূরা আলে ইমরান : ৩১)।

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং রসুলের আনুগত্য কর তাহলে তোমরা দয়াপ্রাপ্ত হবে। ’ (সূরা আলে ইমরান : ১৩২)।

প্রিয় নবী (সা.)-এর অনুপম আদর্শ অনুসরণ করা প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই রসুলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য। ’ (সূরা আহজাব : ২১)।

ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনে করণীয় :

বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বহু বছর ধরে পবিত্র ‘১২ রবিউল আউয়াল’ দয়াল নবীজির পবিত্র বেলাদত (শুভাগমন) দিবস উপলক্ষে অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে মিলাদুন্নবী, জশনে-জুলুস ইত্যাদি পালন করে আসছে, যা শরিয়তের দৃষ্টিতে বেদায়াতে হাছানা ও মোস্তাহাব। উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য এসব অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হুজুর (সা.)-এর প্রতি যথাযোগ্য সম্মান, দরুদ ও সালাম পেশ করা অতি উত্তম ইবাদত।প্রিয় নবী (সা.)-এর শুভাগমনে অকৃপণ ও বিশাল উদারতায় আনন্দ প্রকাশ করা আমাদের জন্য পরম কল্যাণকর। হাদিসে এসেছে। প্রিয়নবী (সা.)-এর জন্মের সংবাদ শুনে তাঁর চাচা আবু লাহাব তার দাসী সুরাইবাকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। এই দিনে স্মরণসভা, আলোচনা সভা, সেমিনার, কোরআনখানি, দোয়া মাহফিল, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের মাধ্যমে ওই স্মরণীয় দিবসের ইতিহাস, গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরার মধ্যে বিবিধ উপকার ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ একদিকে ধর্মীয় দিবসের তাৎপর্য ও প্রকৃত শিক্ষা অনুধাবনে এবং এ আদর্শের যথার্থ অনুসরণ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে একটি আদর্শ শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সক্ষম হবে, অন্যদিকে এসব কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির প্রকৃত ইতিহাস জানার ও সংরক্ষণের সুযোগ পাবে।

পরিভাষায় বললে, হজরত মুহাম্মদ (দ.) এর শুভাগমন স্মরণে খুশি প্রকাশ করে মিলাদ শরিফ মাহফিলের ব্যবস্থা করা, শান-মান, মর্যাদা-মর্তবা আলোচনা করা, কোরআন তেলাওয়াত, দরুদ শরিফ পাঠ, তাওয়াল্লুদ বা জন্মকালীন ঘটনা মজলিস করে আলোচনা করা, দাঁড়িয়ে সালাম, কাসিদা বা প্রশংসামূলক কবিতা, ওয়াজ-নসিহত, দোয়া-মোনাজাত, সম্ভব মতো মেহমান নেওয়াজির সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান করা।

বাংলাদেশে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন :
বাংলাদেশে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা এবং ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন করেন। মসজিদে মসজিদে, নিজ নিজ বাসায় কোরআন খতম ও জিকির আজগারের মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামিন এবং মহানবী (সা.)-এর বিশেষ রহমত কামনা করেন মুসলমান ভাই-বোনেরা।

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ পৃথক পৃখক বাণী দিয়ে থাকেন। এদিন তারা দেশবাসীসহ বিশ্বের মুসলিম উম্মাহ’র প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা এবং মোবারকবাদ জানিয়ে থাকেন।

ঈদে মিলাদুন্নবীতে পত্রিকাগুলো ক্রোড়পত্র প্রকাশের ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। টেলিভিশন ও রেডিওতে দিবসটির গুরুত্ব তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে।

বায়তুল মুকাররম জাতীয় মসজিদে পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

পরিশেষে , মিলাদুন্নবী (সা.)-এর মাসে আমরা আমাদের নবীপ্রেমকে শাণিত করি, মহান আল্লাহর দরবারে লাখো কোটিবার শুকরিয়া জ্ঞাপন করি এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর অনুসরণে জীবনযাপন করে ইহকালীন-পরকালীন কামিয়াবি অর্জন করি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দিন। আমিন।