ঢাকা ০৮:৫৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ১০ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
কিভাবে বাড়ছে বাংলাদেশের আয়তন? পাল্টে যাচ্ছে পুলিশ, র‌্যাব, আনসারের পোশাক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে পদত্যাগ করছেন পুতুল? চারটি প্রদেশ নিয়ে গঠিত হবে নতুন বাংলাদেশ! সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক : প্রেসসচিব অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন: সাংবাদিকদের নামে মামলা নতুন অডিও ফাঁস : কাঁদতে কাঁদতে যা বললেন শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব শেখ হাসিনার বিচার করা: শফিকুল আলম পুতুলকে ডব্লিউএইচও থেকে অপসারণে অনলাইনে স্বাক্ষর জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে জনসাধারণের অভিমত চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা শাপলা চত্বরে হেফাজত দমন : অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট বেগম জিয়াকে হিংসা করতেন হাসিনা ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন শেখ হাসিনা? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাত্রদের ঘোষণাপত্র দিতে বারণের কারণ জানালেন ড. ইউনূস  ঐক্যবদ্ধভাবে দিতে না পারলে জুলাই ঘোষণাপত্রের দরকারই নাই রেস্তোরাঁ, ওষুধ ও মোবাইল রিচার্জে বাড়ছে না ভ্যাট ধর্মনিরপেক্ষতাসহ রাষ্ট্র পরিচালনার ৩ মূলনীতি বাদ পদত্যাগপত্রে যা বললেন টিউলিপ সিদ্দিক পদত্যাগ করলেন টিউলিপ সিদ্দিক আমার মেয়ের খুনি কে, আমি কি বিচার পাব না: প্রশ্ন তিন্নির বাবার

পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনার পরিমাণ কত?

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ০৪:৩২:১০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪
  • / 91
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের অনেক হিসাব-নিকাশ বাকি। রয়েছে পাওনার বিপুল হিসাবও। কিন্তু রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কি আদৌ পাকিস্তানের কাছ থেকে তার পাওনা অর্থ আদায় করতে পারবে? পাকিস্তানিদের আগ্রাসন আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর চলে গেছে ৫ দশক। গণহত্যা চালানো পাকসেনাদের বিচার দূরে থাক, আর্থিক পাওনাই আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশ। পাকিস্তানের গোঁয়ার্তুমিই এজন্য দায়ী। পাশাপাশি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা তো রয়েছেই।

১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসলে বঙ্গবন্ধু সরকার তার কাছে ন্যায্য পাওনা ৪শ কোটি ডলার দাবি করেন। ভুট্টো কৌশলে বঙ্গবন্ধুর দাবি এড়িয়ে যান। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সরকারগুলোর পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সাথে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

পাকিস্তান আমলের ডলারের মান ছিল ১ টাকার বিপরীতে ৮ ডলার। সে হিসাবে বাংলাদেশ তৎকালীন হিসেবে পাকিস্তানের কাছ থেকে ৪ হাজার কোটি ডলার বা ৩২ হাজার কোটি টাকা। সুদ না ধরলেও ডলারের বর্তমান বিনিময় হারে তা প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকার মত। সুদ ধরলে সেটি আরও কয়েক গুণ হয়।

১৯৯৭ সালের ২৪শে মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তান সফরে এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে ২০০২ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ঢাকায় আসলেও সম্পদ বণ্টন বিষয়টির কোন সুরাহা হয়নি।

২০০৬ এর ১২-১৪ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিহারি প্রত্যাবাসন ও সম্পদ বণ্টন বিষয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা করবেন বলে জানান। তবে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি অমীমাংসিত রেখেই ৪টি সমঝোতা স্মারক, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সমঝোতা শেষে দেশে ফিরে আসেন।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাট এবং ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষয়-ক্ষতি হিসেব করে অর্থনীতিবিদরা দেখেছেন, যুদ্ধের ৯ মাস সরকারি ও বেসরকারি খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১২৪৯ কোটি টাকা বা ১.২ বিলিয়ন ডলার।

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সহায়তা হিসেবে বিভিন্ন দেশের পাঠানো ২০ কোটি ডলারও পায়নি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের মানুষ। যে রিলিফের অর্থ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এদিকে মানুষ মরেছে হাজারে হাজারে আর বিদেশিদের অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা জমিয়েছে তাদের ব্যাংক আর গুদামে।

পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা এখানকার রপ্তানি খাত থেকে হওয়া আয়ের প্রায় পুরোটাই পাচার করেছে। এদেশের কৃষক- শ্রমিকের খাজনার টাকা গেছে পশ্চিম পাকিস্তানের পেটে। পূর্ব পাকিস্তানের টাকায় গড়ে উঠেছে করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ আর রাওয়ালপিন্ডির আধুনিক ভবন আর রাস্তাঘাট। এই হিসেব নেবে কে? দুই যুগে পাচার হওয়া বাংলাদেশের সম্পদ ফেরত চেয়ে পাঠানোর আছে কোন উপায়? আছে কোন উদ্যোগ?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪টি নীতি অনুসারে বাংলাদেশের দাবি সম্পূর্ণই যৌক্তিক। জনসংখ্যা নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৫৬ শতাংশ সম্পদ দাবি করতে পারে। সমতার নীতিতে বাংলাদেশ ৫০ শতাংশ দাবি করতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রানীতির ভিত্তিতে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক অর্জিত মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ভিত্তিতে ৫৪ শতাংশ সম্পদের দাবি করতে পারে। এছাড়া সমগ্র দেশের সম্পদের অনুপাতের নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৪৪ শতাংশ সম্পদ দাবি করতে পারে।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো দেশ বিভক্ত হয়ে পড়লে বা স্বাধীন হলে দেশটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিও বণ্টন হয়ে থাকে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের সম্পদের একটি অংশ বাংলাদেশের প্রাপ্য হলেও স্বাধীনতার ৫ দশক অতিবাহিত হওয়ার পরও কোনো সম্পদ পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ এখনো পায়নি।

পাকিস্তান শাসনামলে যেখানে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের ৫৬ শতাংশ কিংবা সমবণ্টনের ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ ঋণ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য ছিল, সেখানে পাকিস্তান ৭ হাজার ৬৪০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পেলেও পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে মাত্র ২ হাজার ২৪ মিলিয়ন ডলার বা ২৬.৬ শতাংশ। ঋণের ৬ হাজার ৪৩৯ মিলিয়ন ডলার কাজে লাগানো হয় এবং বাংলাদেশ পায় ১ হাজার ৯৪১ মিলিয়ন ডলার বা ৩০ শতাংশ।

পাকিস্তানের অধীনে পূর্ব পাকিস্তান রপ্তানির মোট আয় করেছিল প্রায় ৫৪.৭ শতাংশ বা ২৫ হাজার ৫৫৯ মিলিয়ন টাকা বা ৫ হাজার ৩৭০ মিলিয়ন ডলার। এখানে পশ্চিম পাকিস্তানের আয় ছিল ২১,১৩৭ মিলিয়ন টাকা বা ৪ হাজার ৪৪০ মিলিয়ন ডলার। ৪৬ হাজার ৬৯৬ মিলিয়ন টাকার মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের আমদানির জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ২০ হাজার ৬৭ মিলিয়ন টাকা। অর্থাৎ ৪ হাজার ২২৬ মিলিয়ন ডলার। যেখানে পশ্চিম পাকিস্তান পেয়েছে ৯ হাজার ৩১২ মিলিয়ন ডলার।

পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের উদ্বৃত্ত ৪ হাজার ৪২২ কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যায় করা হয়। পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণের মধ্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালের মধ্যে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে সমাপ্ত প্রকল্পের মোট ৫০৬.৭৬১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩.৪৮৫ মিলিয়ন ডলারের দায় গ্রহণ করে।

এ ছাড়াও সেসময় চলমান প্রকল্পের ১৪৫.৮৬ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩৬.১২১ মিলিয়ন ডলারের দায়ও বাংলাদেশ গ্রহণ করে। তৎকালীন, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক যেসকল পাকিস্তানি ছিল তারা যুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতার পূর্ব মূহূর্তে তাদের সম্পত্তি রেখেই বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায়।

পাওনা অর্থ আদায় কীভাবে সম্ভব?

পাকিস্তানের কাছে পাওনা আদায় করা প্রসঙ্গে ঝানু অর্থনীতিবিদ আনু মোহাম্মদ ইতিপূর্বে বলেছিলেন, পাকিস্তান থেকে এই অর্থ উদ্ধারের জন্য সরকারকেই উদ্দ্যোগ নিয়ে প্রয়োজনে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সরকার যদি সুষ্ঠু হিসাব-নিকাশ করে একটি দাবিপত্র বিশ্বের সকল বড় অর্থকরি প্রতিষ্ঠানে জমা দেয়, তবে পাকিস্তান থেকে পাওনা অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়ায় গতি আসবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রনীতি ও পরিকল্পনার কারণে বাংলাদেশের পুরো অঞ্চলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তাদের এই নীতির কারণে কিছু গোষ্ঠি লাভবান হয়েছে। পাকিস্তানি শাসকদের গড়িমসির অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে হওয়া তাদের সকল অন্যায় ও দায়কে এড়িয়ে যাওয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, সরকারিভাবে দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় পর্যায় বৈঠক করেতে হবে। এখানে পাকিস্তানের কোন সাড়া না পেলে প্রয়োজনে পার্শবর্তী দেশ ভারতসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তুলে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা জরুরি।

ডলারের বর্তমান মূল্যে প্রাপ্য অর্থ দাবি করা উচিত বলে মনে করেন এই সমাজবিজ্ঞানী। তিনি আরও বলেন, যে যার কাছে টাকা পাবে সে তাকে পাওনা পরিশোধ করেব, এটাই হওয়া উচিৎ। পাকিস্তানি সম্পত্তির হিসাব ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পাওনার সমন্বয় করেও এ সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব।

১৯৪৭ এর পর থেকে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের বৈষম্য এখনও শেষ হয়নি। বর্তমান বৈষম্যবিরোধী সংস্কারকরা রাষ্ট্রক্ষমতায়। তাদের সাথে পাকিস্তানের বোঝাপড়াও বেশ ভালো। এখন সময় এসেছে পাকিস্তানের কাছ থেকে তাদের সকল বৈষম্যের হিসাব কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেওয়া। এমনটাই অভিমত সাধারণ মানুষের।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনার পরিমাণ কত?

আপডেট সময় : ০৪:৩২:১০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ ডিসেম্বর ২০২৪

 

বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের অনেক হিসাব-নিকাশ বাকি। রয়েছে পাওনার বিপুল হিসাবও। কিন্তু রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ কি আদৌ পাকিস্তানের কাছ থেকে তার পাওনা অর্থ আদায় করতে পারবে? পাকিস্তানিদের আগ্রাসন আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর চলে গেছে ৫ দশক। গণহত্যা চালানো পাকসেনাদের বিচার দূরে থাক, আর্থিক পাওনাই আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশ। পাকিস্তানের গোঁয়ার্তুমিই এজন্য দায়ী। পাশাপাশি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা তো রয়েছেই।

১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসলে বঙ্গবন্ধু সরকার তার কাছে ন্যায্য পাওনা ৪শ কোটি ডলার দাবি করেন। ভুট্টো কৌশলে বঙ্গবন্ধুর দাবি এড়িয়ে যান। বঙ্গবন্ধু পরবর্তী সরকারগুলোর পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সাথে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

পাকিস্তান আমলের ডলারের মান ছিল ১ টাকার বিপরীতে ৮ ডলার। সে হিসাবে বাংলাদেশ তৎকালীন হিসেবে পাকিস্তানের কাছ থেকে ৪ হাজার কোটি ডলার বা ৩২ হাজার কোটি টাকা। সুদ না ধরলেও ডলারের বর্তমান বিনিময় হারে তা প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকার মত। সুদ ধরলে সেটি আরও কয়েক গুণ হয়।

১৯৯৭ সালের ২৪শে মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাকিস্তান সফরে এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা করেন। পরে ২০০২ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ঢাকায় আসলেও সম্পদ বণ্টন বিষয়টির কোন সুরাহা হয়নি।

২০০৬ এর ১২-১৪ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বিহারি প্রত্যাবাসন ও সম্পদ বণ্টন বিষয় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা করবেন বলে জানান। তবে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি অমীমাংসিত রেখেই ৪টি সমঝোতা স্মারক, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সমঝোতা শেষে দেশে ফিরে আসেন।

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও লুটপাট এবং ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা ইত্যাদি মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষয়-ক্ষতি হিসেব করে অর্থনীতিবিদরা দেখেছেন, যুদ্ধের ৯ মাস সরকারি ও বেসরকারি খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১২৪৯ কোটি টাকা বা ১.২ বিলিয়ন ডলার।

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সহায়তা হিসেবে বিভিন্ন দেশের পাঠানো ২০ কোটি ডলারও পায়নি তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের মানুষ। যে রিলিফের অর্থ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এদিকে মানুষ মরেছে হাজারে হাজারে আর বিদেশিদের অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা জমিয়েছে তাদের ব্যাংক আর গুদামে।

পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানিরা এখানকার রপ্তানি খাত থেকে হওয়া আয়ের প্রায় পুরোটাই পাচার করেছে। এদেশের কৃষক- শ্রমিকের খাজনার টাকা গেছে পশ্চিম পাকিস্তানের পেটে। পূর্ব পাকিস্তানের টাকায় গড়ে উঠেছে করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ আর রাওয়ালপিন্ডির আধুনিক ভবন আর রাস্তাঘাট। এই হিসেব নেবে কে? দুই যুগে পাচার হওয়া বাংলাদেশের সম্পদ ফেরত চেয়ে পাঠানোর আছে কোন উপায়? আছে কোন উদ্যোগ?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪টি নীতি অনুসারে বাংলাদেশের দাবি সম্পূর্ণই যৌক্তিক। জনসংখ্যা নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৫৬ শতাংশ সম্পদ দাবি করতে পারে। সমতার নীতিতে বাংলাদেশ ৫০ শতাংশ দাবি করতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রানীতির ভিত্তিতে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক অর্জিত মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ভিত্তিতে ৫৪ শতাংশ সম্পদের দাবি করতে পারে। এছাড়া সমগ্র দেশের সম্পদের অনুপাতের নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ ৪৪ শতাংশ সম্পদ দাবি করতে পারে।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো দেশ বিভক্ত হয়ে পড়লে বা স্বাধীন হলে দেশটির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিও বণ্টন হয়ে থাকে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের সম্পদের একটি অংশ বাংলাদেশের প্রাপ্য হলেও স্বাধীনতার ৫ দশক অতিবাহিত হওয়ার পরও কোনো সম্পদ পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ এখনো পায়নি।

পাকিস্তান শাসনামলে যেখানে জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্ত বৈদেশিক সাহায্যের ৫৬ শতাংশ কিংবা সমবণ্টনের ভিত্তিতে ৫০ শতাংশ ঋণ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য ছিল, সেখানে পাকিস্তান ৭ হাজার ৬৪০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি পেলেও পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছে মাত্র ২ হাজার ২৪ মিলিয়ন ডলার বা ২৬.৬ শতাংশ। ঋণের ৬ হাজার ৪৩৯ মিলিয়ন ডলার কাজে লাগানো হয় এবং বাংলাদেশ পায় ১ হাজার ৯৪১ মিলিয়ন ডলার বা ৩০ শতাংশ।

পাকিস্তানের অধীনে পূর্ব পাকিস্তান রপ্তানির মোট আয় করেছিল প্রায় ৫৪.৭ শতাংশ বা ২৫ হাজার ৫৫৯ মিলিয়ন টাকা বা ৫ হাজার ৩৭০ মিলিয়ন ডলার। এখানে পশ্চিম পাকিস্তানের আয় ছিল ২১,১৩৭ মিলিয়ন টাকা বা ৪ হাজার ৪৪০ মিলিয়ন ডলার। ৪৬ হাজার ৬৯৬ মিলিয়ন টাকার মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের আমদানির জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ২০ হাজার ৬৭ মিলিয়ন টাকা। অর্থাৎ ৪ হাজার ২২৬ মিলিয়ন ডলার। যেখানে পশ্চিম পাকিস্তান পেয়েছে ৯ হাজার ৩১২ মিলিয়ন ডলার।

পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের উদ্বৃত্ত ৪ হাজার ৪২২ কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ব্যায় করা হয়। পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণের মধ্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালের মধ্যে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে সমাপ্ত প্রকল্পের মোট ৫০৬.৭৬১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩.৪৮৫ মিলিয়ন ডলারের দায় গ্রহণ করে।

এ ছাড়াও সেসময় চলমান প্রকল্পের ১৪৫.৮৬ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩৬.১২১ মিলিয়ন ডলারের দায়ও বাংলাদেশ গ্রহণ করে। তৎকালীন, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক যেসকল পাকিস্তানি ছিল তারা যুদ্ধের সময় এবং স্বাধীনতার পূর্ব মূহূর্তে তাদের সম্পত্তি রেখেই বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায়।

পাওনা অর্থ আদায় কীভাবে সম্ভব?

পাকিস্তানের কাছে পাওনা আদায় করা প্রসঙ্গে ঝানু অর্থনীতিবিদ আনু মোহাম্মদ ইতিপূর্বে বলেছিলেন, পাকিস্তান থেকে এই অর্থ উদ্ধারের জন্য সরকারকেই উদ্দ্যোগ নিয়ে প্রয়োজনে জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সরকার যদি সুষ্ঠু হিসাব-নিকাশ করে একটি দাবিপত্র বিশ্বের সকল বড় অর্থকরি প্রতিষ্ঠানে জমা দেয়, তবে পাকিস্তান থেকে পাওনা অর্থ আদায়ের প্রক্রিয়ায় গতি আসবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরও বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রনীতি ও পরিকল্পনার কারণে বাংলাদেশের পুরো অঞ্চলই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে তাদের এই নীতির কারণে কিছু গোষ্ঠি লাভবান হয়েছে। পাকিস্তানি শাসকদের গড়িমসির অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের সাথে হওয়া তাদের সকল অন্যায় ও দায়কে এড়িয়ে যাওয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলেন, সরকারিভাবে দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় পর্যায় বৈঠক করেতে হবে। এখানে পাকিস্তানের কোন সাড়া না পেলে প্রয়োজনে পার্শবর্তী দেশ ভারতসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তুলে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা জরুরি।

ডলারের বর্তমান মূল্যে প্রাপ্য অর্থ দাবি করা উচিত বলে মনে করেন এই সমাজবিজ্ঞানী। তিনি আরও বলেন, যে যার কাছে টাকা পাবে সে তাকে পাওনা পরিশোধ করেব, এটাই হওয়া উচিৎ। পাকিস্তানি সম্পত্তির হিসাব ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পাওনার সমন্বয় করেও এ সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব।

১৯৪৭ এর পর থেকে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের বৈষম্য এখনও শেষ হয়নি। বর্তমান বৈষম্যবিরোধী সংস্কারকরা রাষ্ট্রক্ষমতায়। তাদের সাথে পাকিস্তানের বোঝাপড়াও বেশ ভালো। এখন সময় এসেছে পাকিস্তানের কাছ থেকে তাদের সকল বৈষম্যের হিসাব কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেওয়া। এমনটাই অভিমত সাধারণ মানুষের।