পুলিশের ‘ট্রমা’ কাটবে কী করে
- আপডেট সময় : ১০:৪৩:১৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৪৯ বার পড়া হয়েছে
HIGH COURT, DHAKA, BANGLADESH - 2024/07/31: Police stand guard outside the High Court building during a protest call 'March for Justice' in front of the High Court area in Dhaka. A nationwide 'March for Justice' was called on 31 July by the Students Against Discrimination group, which has led the quota reform protests, in courts, campuses and on the streets to protest against the 'killings, attacks, and enforced disappearances', and to demand an investigation by the United Nations into the violence that occurred during the student-led protests against the government's job quota system, according to the group's coordinator. (Photo by K M Asad/LightRocket via Getty Images)
“পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এ অবস্থা থেকে বের হতে সব কিছুর আগে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে,” বলেন অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুক।
চোখের সামনে নৃশংসতা দেখে আর সহকর্মীদের মৃত্যুর খবর পেয়ে মানসিক বিপর্যয়ে ভোগা এক কনস্টেবল এখনও তার ‘ট্রমা’ কাটিয়ে উঠতে না পারার অস্বস্তির কথা বলছিলেন।
তিন দশকের বেশি চাকরি জীবনের বেশিরভাগ সময় ঢাকাতেই কেটেছে ‘বেইজলাইন’ বলে পরিচিত কনস্টেবল স্তরের এই পুলিশ সদস্যের। কিন্তু গত ৫ অগাস্ট তার সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে।
সেদিন ও তার পরের কয়েকটি দিন জীবন ঝুঁকিতে ছিলেন; কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে দায়িত্বে ফিরলেও তিনি পুলিশের চাকরি আর বেশিদিন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এখনও আতঙ্কে থাকা এই কনস্টেবল পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। তার মত আরও অনেকেই একইরকম মানসিক চাপের মধ্যে থাকার কথা বলেছেন।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে মাঠপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষায়- ঢালাও মামলা ও বদলি না করে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ধীরে ধীরে যোগ্য পুলিশ সদস্যদের মাঠের কাজে অন্তর্ভুক্ত করলে আস্থা ফিরতে পারে।
ওই কনস্টেবল বলছিলেন, “ছোট র্যাংক হলেও অনেক ভক্তি-শ্রদ্ধা নিয়ে চাকরিটা করেছি। এখন ভেতর থেকেই ভক্তি-শ্রদ্ধাটা নষ্ট হয়ে গেছে। গত ৫ তারিখের ঘটনায় একেবারে মন উঠে গেছে। হয়ত আর চাকরি করব না, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রিজাইন দিয়ে দেব।”
পলিশ সদস্যরা বলছেন, তারাও নিরাপত্তাহীনতা ভুগছেন। তাই এলাকাভিত্তিক টহল কার্যক্রম ও গ্রেপ্তার অভিযান প্রায় থমকে রয়েছে।
‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের এক মাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশি কার্যক্রম সদস্যদের থানায় অবস্থান এবং জিডি, মামলা ও অভিযোগ গ্রহণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কার্যত বাইরে পুলিশের স্বাভাবিক উপস্থিতি না থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যেও চাপা অস্বস্তি রয়েছে।
চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া ওই পুলিশ কনস্টেবল বলেন, “পুলিশ মানুষের নিরাপত্তা দেয় কিন্তু এখন পুলিশের নিরাপত্তা নাই। সে জায়গায় কীভাবে চাকরিটা করব বলেন? ৫ অগাস্ট চোখের সামনে মরণ দেখছি, আল্লাহ নিজ হাতে বাঁচাইছে। তখন শুধু ভাবছি; মারা গেলে লাশটাও বাড়ি যাইব না।
“ঘটনার পর কয়েকটা দিন শুধু কাঁদছি, ভালোভাবে কথা বলতে পারতাম না। এখন পোস্টিং হয়ে গেছে, ঢাকা ছাড়তে পারলেই বাঁচি।”
তিনি বলেন, “পুলিশের এখন সবই চলতেছে, আগে যেভাবে এলাকায় টহল টিম থাকত সেভাবে অবশ্য হচ্ছে না। কেউ কল করলে পুলিশ যাচ্ছে, গিয়ে সলভ করে চলে আসতেছে। কিন্তু এলাকায় থাকার অর্ডার নাই, যদি কোনো প্রবলেম হয়…। এখন পাবলিকের হাতে অস্ত্র চলে গেছে। আগে যেভাবে থাকতাম, ঘোরাফেরা করতাম; সেটা করতেছি না।”
পুলিশ সদস্যদের আত্মবিশ্বাস ফেরাতে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ওমর ফারুক।
তিনি বলেন, “পুলিশ সদস্যরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তারা নিজেরা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা পরিচয় দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে বের হতে সবার আগে তাদের কনফিডেন্স ডেভেলপ করতে হবে। সেজন্য তাদের জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।”
মঙ্গলবার ঢাকার আদাবর থানায় গিয়ে দেখা যায়, লুটপাটের পর ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে একরকম বিধ্বস্ত করে দেওয়া থানাটি নতুন করে সাজানোর চেষ্টা চলছে। দেয়ালে নতুন রং করে জানালাসহ বিভিন্ন আসবাব মেরামতের কাজ চলছে। ডিউটি অফিসারের কক্ষে একটি টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার নিয়ে থানায় আসা নাগরিকদের সেবা দেওয়া হচ্ছে।
মঙ্গলবার পর্যন্ত আদাবর থানার লকআপ খালি ছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ৫ অগাস্টের পর এই থানায় কোনো গ্রেপ্তার নেই।
ডিউটি অফিসার উপ-পরিদর্শক মো. নাসির উদ্দন বলেন, “থানার সব কাজ- মামলা, জিডি ও অভিযোগ গ্রহণ স্বাভাবিকভাবেই চলছে।”
থানায় জিডি করতে আসা এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, “আমার বাসার বিদ্যুতের মিটার চুরি হয়ে গেছে। এ কারণে জিডি করতে এসেছি। পুলিশের কাজ টুকটাক চলছে; আগের মত আর পুলিশ সদস্যদের দেখা যায় না। এ কারণে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে।”
বাইরের কার্যক্রমের বিষয়ে আদাবর থানার এএসআই ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, “স্বল্প পরিসরে কাজ শুরু হয়েছে, এখনও তেমন জোরালো কিছু না। আস্তে আস্তে সব কিছু স্বাভাবিক হবে।”
লুটপাট ও আগুনের ঘটনার মাস পেরিয়ে গেলেও ভাটারা থানা ভবনে কোনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি পুলিশ।
মঙ্গলবার থানা ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটিতে সংস্কারের কাজ চলছে। ভেঙে ফেলা হাজতখানাসহ বিভিন্ন কক্ষ মেরামত করছেন কয়েকজন। এখনও থানায় স্তূপ করে রাখা আছে পোড়া যানবাহনসহ নানা ধরনের আসবাব।
ভেতরে কোনো কার্যক্রম না চললেও থানা ভবনের সামনে এএসআই মো. মামুনের নেতৃত্বে কয়েকজন কনস্টেবল দায়িত্ব পালন করছিলেন।
তিনি বলেন, “এই ভবনটি এখনও কাজ করার উপযোগী না হওয়ায় গুলশান থানা ভবনে একটি সাব-অফিস করে ভাটারা থানার কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এ এলাকার কারও পুলিশি সেবা পেতে আপাতত সেখানেই যেতে হচ্ছে।”
গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের অধিকাংশ থানায় হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেওয়ার খবর আসতে থাকে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সহিংসতায় অন্তত ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
এসব হামলায় নথিপত্র, আসবাবপত্রের পাশাপাশি পুড়ে গেছে থানায় থাকা সব গাড়ি। লুট হয়ে গেছে অনেক অস্ত্র ও গুলি। এরপর থেকে কার্যত স্থবির হয়ে যায় দেশের পুলিশি ব্যবস্থা। জীবন রক্ষার্থে আত্মগোপনে থাকা পুলিশ সদস্যরা কাজে ফিরতে ১১ দফা দাবি তুলে ধরেছিলেন।
এম সাখাওয়াত হোসেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার আগে ১১ অগাস্ট তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়েছিলেন পুলিশ সদস্যরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরদিন থেকে তাদের বেশিরভাগই থানায় যোগ দেন। ১৫ অগাস্ট পুলিশ সদর দপ্তরের এক বার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশ পুলিশের সকল থানায় ‘অপারেশনাল কার্যক্রম’ শুরু হয়েছে।
থানাগুলোতে লুট ও পুড়ে যাওয়া মামলার নথির বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. ইসরাইল হাওলাদার বলেন, “থানা ফাঁড়িগুলোতে হামলা চালিয়ে অনেক সম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি সাক্ষ্য-প্রমাণ ও নথি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো নিয়ে আমাদের কাজ চলছে, আইনগতভাবে যা যা করা দরকার, তার সবই করা হবে।
“থানায় অনেক মামলার আলামত থাকে, যেগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে আইনগতভাবে কীভাবে কী করা যায়, যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।”
বদলি আতঙ্কে কাটছে দিন
পুলিশের ওই কনস্টেবল বদলিতে খুশি হলেও বেশিরভাগ সদস্যদের মধ্যেই এ নিয়ে আতঙ্ক রয়েছে। তাদের মতে, সবারই একটা প্রস্তুতি থাকে, সবাই যার যার মত পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। হুটহাট করে এমন বদলির সিদ্ধান্তে সবাই এক রকম চিন্তিত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক উপ-পরিদর্শক নাম প্রকাশ না করে বলেন, “আমরা অনেকে এখনও ট্রমার মধ্যে আছি। তার ওপর যোগ হয়েছে পোস্টিংয়ের চিন্তা। সব সময় মনে হয় যেখানে আছি, সেখানে মনে হয় থাকতে পারব না।”
“সব কিছু কেমন যেন হয়ে গেছে। যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত, সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ আছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমের ভিডিও ফুটেজ আছে; এসব দেখে অতিউৎসাহী যারা ছিলেন, তাদের ব্যবস্থা নিক। কিন্তু এই যে গণহারে পোস্টিং, এটা কী কারণে?”
তিনি বলেন, “আর যে পরিস্থিতি হয়েছিল সেখানে নিচের দিকের পুলিশ সদস্যদের কী করার ছিল? বস যেটা আদেশ দেবন, সেটা জুনিয়ররা মানতে বাধ্য, আমাদের কথায় তো আর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। মাথা যদি ঠিক থাকে, তাহলে পুরো টিম ঠিক থাকে।”
পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, “পুলিশে চেইঞ্জের দরকার আছে, কিন্তু এক দিনে সব ইউনিট চেইঞ্জ না করে ৬-৭ মাসে বা এক বছরের প্ল্যান করেন। এখন হুট করে ঢাকার সব অফিসারদের খাগড়াছড়ি পাঠিয়ে দিলেন, আবার খাগড়াছড়ির সব অফিসারকে ঢাকায় নিয়ে আসলেন। তাহলে তারা হঠাৎ করে নতুন একটা জায়গায় গিয়ে কী করবেন?
“এখানে সিনিয়রদের অদূরদর্শিতা রয়েছে। যেখানে একটা টিম গিয়ে আরেকটা টিম আসছে। ফলাফল কী হবে; প্রসেস একই থাকছে শুধু মানুষগুলো পাল্টাচ্ছে। আপনি ডিভিশন ওয়াইজ পর্যায়ক্রমে চেইঞ্জগুলো করতে পারতেন।”
তিনি বলেন, “শোনা যাচ্ছে সামনে আবার ডিও হবে। সবাই তাকিয়ে আছে কোথায় কার পোস্টিং হয়। মানসিকভাবেও দ্বন্দ্বে আছেন। আর কিছুটা ভয় ও মানুষের ঘৃণা তো রয়েছেই। এখানে পুলিশ সদস্যদের মনোবল বাড়াতে হবে, যেটা গুরুত্বপূর্ণ; সেটা না করে ধরপাকড়-পানিশমেন্ট দিয়ে কাজ আদায় করে নিতে পারবেন না।”
সিনিয়রদের সঙ্গে নিচের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে বলে জানান এই পুলিশ সদস্য। তিনি বলেন, “থানাগুলো সেবা দেওয়ার জন্য সেটআপ হচ্ছে, পরিস্থিতি কন্ট্রোল করতে এখন সবাইকে ঠিকভাবে মেইনটেন করতে হবে। কাজের পরিবেশ দিতে হবে।”
কঠোর হতে মামলার ভয়
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক বলেন, “সবাই তো আর অতিউৎসাহী না, সবাই বলও প্রয়োগ করেনি। আবার যারা করেছে তাদের বেশিরভাগকেই বাধ্য করা হয়েছে। কিছু অতিউৎসাহী সদস্য যারা ছিলেন, যার যেটুকু অপরাধ সেটুকু, তারা সাজা পাক। কিন্তু এই যে ঢালাও মামলা করা হচ্ছে, এ নিয়ে আতঙ্ক কাজ করছে সবার মধ্যে। মামলায় পুরো থানার সবাইকে জড়িয়ে দিচ্ছে, সবাই তো আর জড়িত না।
“সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, নিজের নিরাপত্তা নেই। কোথাও যাবেন, অ্যাকশন নিবেন; আগের মত পারবেন না। পুলিশিং করতে যাবেন, কেউ বলে বসবে- আওয়ামী লীগের দালাল। কেউ বলবে, আইন অনুযায়ী কাজ করতেছে না।”
তিনি বলেন, “কোথাও গিয়ে কঠোর হবেন, খারাপ একটা পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। লিগ্যাল ওয়েতে কঠোর হলেও দালাল। ওখানে যারা আছে, তারা একটা সিনক্রিয়েট করে ফেলল।”
আরেক পুলিশ সদস্য বলেন, “যারা বিপরীত রাজনৈতিক পক্ষ তারা মামলাগুলোতে হয়ত কারও নাম ঢুকিয়ে দিচ্ছে তিন-চার বছর আগের কোনো বিরোধের জেরে। আমি একটা মাদক কারবারিকে ধরতে যাব, রিস্ক থাকে। আমার নামে আবার মামলা করা হয় কি না।”
স্বাভাবিক হবে কবে, জানেন না কেউ
পুলিশ সদস্যরা বলছেন, পুলিশের স্বাভাবিক হওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পুলিশকে যেভাবে গ্রহণ করছে মানুষ, এসব কারণে মনোবল ভেঙে গেছে পুরোপুরি। এছাড়া যারা হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন, তারা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
পুলিশের এক সদস্য বলেন, “মনোবল ফিরায়ে আনার জন্য এখন উচিত মোটিভেশন দেওয়া। ‘যে যেখানে আছো, তোমরা কাজ করো’- এটুকু অভয়ও কেউ কারও কাছ থেকে পাচ্ছে না। কাজ যে করব কারও কাছ থেকে মেসেজ ক্লিয়ার না। এই অবস্থা থেকে কীভাবে উঠে আসব?”
“পরিদর্শক থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত আমাদের কথা, আমাদের কী দরকার; বসেরা জানার চেষ্টা করেন নাই, বোঝার চেষ্টা করেন নাই; আমাদের কথা শোনারও চেষ্টা করেন নাই তারা। মাঠপর্যায়ে এসআইকে বলা হয় মেরুদণ্ড আর কনস্টেবলকে বলা হয় বেইজ। তাদের ওপর খালি কাজ চাপিয়ে দেয় কিন্তু ফিল্ডে যা ফেস করতেছি, সেসব কখনও বলতে পারি না, বলার সুযোগ পাই না।”
সংঘবদ্ধ জনতার আক্রমণের ভয় এখনও কাটেনি পুলিশ সদস্যদের। এ নিয়ে কথা হলে একজন সদস্য বলেন, “সবার মনোবল ভেঙে পড়েছে, জনতার ঘৃণার মুখে কেউ কাজ করতে পারছে না। কোথাও গেলে দেখা গেল দুজন গালি দিল, কেউ মানতেছে না; তাই ফোর্সও ডেপ্লয় করতে পারছে না।
“অথচ এখন অনেক কাজ পুলিশের। এক বছরের কাজটা এখন এক সপ্তাহে করতে হবে। হারানো ইমেজ উদ্ধার করা, ক্রাইম কমানো, পেট্রোলিং বাড়ানো; সব কিছু আগের অবস্থায় ফেরাতে স্টেবল থাকতে হবে, নড়বড়ে থাকলে হবে না।”
তিনি বলেন, “ঢাকার বাইরের থানাগুলোতে দিনের বেলা স্বাভাবিক থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে সবার মধ্যে ভয় কাজ করছে। মানুষের ঘৃণার ভয় এবং পলিটিক্যাল বায়াসনেসের ভয়। এখন কোনো একটা পলিটিক্যাল পার্টি দিয়ে সিনিয়ররা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আবার আমাদের বিপদে ফেলছে কি-না, সেই ভয়ও রয়েছে।
“এখন থানাতে একটা পার্টি নাই কিন্তু আরেকটা পার্টি গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। যারা বিরাট ভূমিকা পালন করছে, থানায় মিটিং করছে। আজকে থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ল’ফুল নয় এমন কোনো কাজ পুলিশ করবে না। সিনিয়রদের বলতে হবে, কার কোথায় পোস্টিং সেটা দেখার বিষয় না। অপরাধ শতভাগ কন্ট্রোল করতে হবে।”
শৃঙ্খলা ফেরাতে ওই পুলিশ সদস্যের সাফ অবস্থান এমন- থানায় কেউ যাবেন না। এ-পার্টি, বি-পার্টি, স্টুডেন্ট কেউ যাবেন না। শুধু ভুক্তভোগী যাবেন। ভুক্তভোগীকে হয়রানি করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। এখন থানায় যারা যাচ্ছেন, দুই দিন পর তারাই দালাল হবেন; যার ক্রোধে থানা পুড়েছে তাকে থানায় নিয়ে লাভ নাই।
এখনও আক্রান্ত হচ্ছে পুলিশ
দেশের ক্ষমতার পালাবদলের এক মাস পরেও থানায় আক্রমণের শিকার হচ্ছে পুলিশ। গত সোমবার চাঁদপুর সদর থানায় শিক্ষার্থীরা হামলা চালায়, এতে একজন এসআইকে আহত হন।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গত ৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় চাঁদপুর শহরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কোড়ালিয়া পাটোয়ারী স্কুল মাঠে রিকশা যোগে যাওয়ার সময় মাছুমা বেগম (৪২) নামে একজনকে হেনস্থা করে স্থানীয় বিএনপি নয়ন বেপারীসহ (৪৫) আট থেকে ১০ জন ব্যক্তি।
এ ঘটনা মাছুমা বেগমের ছেলে তাহসিন হোসেনকে (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক) জানালে সে তার মাকে চাঁদপুর সদর হাসপাতলে ভর্তি করায় এবং রাত সাড়ে ১১টায় ২০-৩০ জন ছাত্রসহ থানায় গিয়ে ভিকটিম বাদী হয়ে অভিযোগ দাখিল করেন।
৯ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টায় এসআই সামাদ ফোর্সসহ ঘটনাস্থলে অভিযোগটি তদন্ত করতে গেলে বিবাদীরা পুলিশের সামনে ছাত্রদের আঘাত করে। পরে ছাত্ররা থানায় ঢুকে পুলিশের সামনে তাদের ওপর হামলার অভিযোগ করেন এবং এসআই সামাদকে মারধর করেন।
পরে ওসির কক্ষে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করার একপর্যায়ে ছাত্ররা দাবি তোলে, এখনই আসামি গ্রেপ্তার করতে হবে। পরে ওসির নেতৃত্বে একটি টিমসহ ছাত্ররা ঘটনাস্থলে গিয়ে আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেন। কিন্তু আসামি পলাতক থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি।
চাঁদপুর সদর থানার ওসি আলমগীর হোসেন বলেন, “এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরা একটি মামলা দায়ের করেছেন। আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। শিক্ষার্থীদের মারধরে আহত এসআই সামাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।”
পুলিশ সংস্কারের উদ্যোগ
গত সোমবার বাংলাদেশে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টেফান লিলারের নেতৃত্বে আট সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, দেশ সংস্কারের প্রত্যয় নিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করা অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশি ব্যবস্থারও সংস্কার করবে।
সেজন্য একটি কমিটি গঠন করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখনও কোনো কমিটি হয়নি। তবে শিগগির পুলিশ সংস্কারে প্রাথমিক কমিটি গঠন করা হবে। কোন প্রক্রিয়ায়, কীভাবে ও কাদের অন্তর্ভুক্ত করে সংস্কার করা হবে, তা নির্ধারণ করবে প্রাথমিক কমিটি। পুলিশ সংস্কারে প্রাথমিক কমিটির সুপারিশ ও মতামত নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম করা হবে।“
অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, “পুলিশের আচরণগত পরিবর্তনের পাশাপাশি বিশ্বাসের জায়গাগুলোতে যে ঘাটতি আছে, সেগুলো পূরণ করতে হবে। এ জন্য ট্রেনিং করানো যেতে পারে। এটা তো এখনই সম্ভব নয়। তবে স্বল্প মেয়াদে, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা করে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো ডিজাইন করে কাজ করলে ট্রমা থেকে বের হতে পারবে।”
পুলিশের জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, “তাদের সামাজিক অ্যাক্টিভিটি বাড়াতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সমাজের বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করা যেতে পারে। সমাজের সকল পর্যায়ে মিথস্ক্রিয়তা ঘটলে তাদের কনফিডেন্ট গ্রো করবে এবং সেবার মান ত্বরান্বিত হবে। যথাযথ আইন অনুসরণ করে রাজনৈতিক শক্তির বাইরে গিয়ে রাষ্ট্রীয় কাজে শুধু জনগণের সেবায় নিয়োজিত রাখতে হবে পুলিশকে।”
‘একটি রাজনৈতিক বলয় থেকে বেরিয়ে পুলিশ অন্য রাজনৈতিক বলয়ের প্রবেশ করার আশঙ্কার’ বিষয়ে তিনি বলেন, “এর সমাধান একটাই। পুলিশের জন্য একটা স্বাধীন কমিশন গঠন করা। ভিন্ন একটা কাঠামো গঠন করে বিভিন্ন পেশাজীবীদের সেখানে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তাহলে যে সরকারই আসুক, তার নিজের স্বার্থে আর পুলিশকে ব্যবহার করতে পারবে না। যদি এটা সম্ভব না হয়, তাহলে পুলিশে কোনো দল বা গোষ্ঠীর প্রভাবের একটা আশঙ্কা থেকেই যায়।”