ঢাকা ১১:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে নির্বাচন সংস্কার কমিশন গঠন আমি স্যামসাং ব্যবহার করি, স্ক্রিনশট গেছে আইফোনের : জনপ্রশাসন সচিব উন্নয়নের ভ্রান্ত ধারণা: ঋণে ডুবে থাকা দেশ টাইম ম্যাগাজিনের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় নাহিদ ইসলাম আমার টাকা-পয়সার প্রতি লোভ নেই, ৫ কোটি হলেই চলবে এক দিনেই হাওয়া ৮ হাজার কোটি টাকার বাজার মূলধন অবশেষে দেখা মিলল আসাদুজ্জামান কামালের ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ কারাগারে কেমন আছেন ‘ভিআইপি’ বন্দীরা একটি ফোনকল যেভাবে বদলে দিয়েছে ড. ইউনূসের জীবনের গতিপথ ড. ইউনুসের Three Zeros থিয়োরি বর্তমান উপদেষ্টাদের সঙ্গে নতুন চার-পাঁচজন মুখ যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কয়েকটি জাতীয় দিবস বাতিল করতে পারে সরকার সমবায় ব্যাংকের ১২ হাজার ভরি স্বর্ণ গায়েব: উপদেষ্টা “প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস: বাংলার গর্ব, বৈশ্বিক সম্প্রীতির প্রতীক” খেলোয়াড় সাকিবের নিরাপত্তা আছে, ফ্যাসিস্ট সাকিবের ক্ষেত্রে অবান্তর: ক্রীড়া উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ সম্মেলন থেকে কী অর্জন করলেন? জাতিসংঘে তিন-শুন্যের ধারণা দিলেন ড. ইউনুস যন্ত্রণার নাম ব্যাটারি রিকশা তরুণ সমাজের অফুরান শক্তি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে— ড. ইউনূস

পোশাক কারখানার শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যে কী

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ০৮:২১:৪৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৪৭ বার পড়া হয়েছে
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

 

সাভারের আশুলিয়ার মণ্ডল মার্কেট এলাকায় গতকাল সোমবার বন্ধ একটি পোশাক কারখানার গেটে উঁকি মারছিলেন দুই তরুণী। সুমাইয়া আর খাদিজা, দু’জনই ‘হরিহর আত্মা’। সিরাজগঞ্জের তাড়াশে দু’জনার গ্রামের বাড়ি। চাকরির জন্য বেশ কিছু দিন ধরে এভাবে একেক কারখানার দরজায় কড়া নাড়ছেন। সুমাইয়া জানান, আশুলিয়ার এস-২১ নামে একটি কারখানায় চাকরি করতেন তিনি। অসুস্থ হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যান। সুস্থ হয়ে ১৫ দিন আগে আশুলিয়া ফিরে পোশাক কারখানায় অস্থিরতা দেখেন। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে কোনো জায়গায় এখনও চাকরি জোটাতে পারেননি। তাই সংসারের খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। এ দুই তরুণীর মতো অনেকেই শ্রমিক অসন্তোষের কারণে নানামুখী বিপদে।

দাবি-দাওয়া নিয়ে আশুলিয়ায় এখনও বিরাজ করছে শ্রমিক অসন্তোষ। বিশেষ করে আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নে যেসব কারখানা, সেখানে বেশ অস্থিরতা। গতকালও পুরো এলাকা ছিল থমথমে। বন্ধ ছিল ৭৯ কারখানা। হঠাৎ বিভিন্ন দাবির বিষয় সামনে এনে যে বিক্ষোভ চলছে, এর নেপথ্যে আছে নানা কারণ। আশুলিয়ায় গতকাল দিনভর ঘুরে শ্রমিক, মালিকপক্ষ, রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘সুবিধাভোগী’ নানা গ্রুপ এর পেছনে রয়েছে। কোনো কোনো কারখানায় হামলার সঙ্গে জড়িতরা বহিরাগত। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে মালিকপক্ষ বলছে, নিজেদের কারখানায় শ্রমিকরা হামলায় জড়িত ছিলেন না। অনেকে আবার বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঝুট কারবার হাতবদল নিয়ে বিরোধ রয়েছে। তারা কারখানায় অস্থিরতা তৈরি করে নিজেদের নতুন প্রভাব বলয় তৈরি করছেন। গত দুই সপ্তাহে ঝুট ব্যবসা নিয়ে একাধিক গ্রুপের মধ্যে আশুলিয়ায় সংঘর্ষ হয়েছে।

কিছুদিন ধরেই আশুলিয়ায় কারখানায় ভাঙচুর, হামলা, লুট ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। কয়েকটি কারখানায় হাজিরা দিয়েই শ্রমিকরা বের হয়ে যাচ্ছেন। অব্যাহত বিশৃঙ্খলায় শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কায় আছেন মালিকপক্ষ। এ সমস্যা দ্রুত নিরসনে বিজিএমইএ, কারখানার মালিক, প্রশাসনের লোকজন ধারাবাহিক বৈঠক করছেন।

নেপথ্যে নানা হিসাব

রোববার আশুলিয়ায় আলিফ ভিলেজ নামে একটি পোশাক কারখানায় ব্যাপক ভাঙচুর ও লুট হয়। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ওই কারখানায় মেশিনপত্র তছনছ। ভাঙচুর করা হয়

মেডিকেল সেন্টার, সাব-স্টেশন রুম ও ফায়ার কন্ট্রোল রুম। কবে নাগাদ কারখানা চালু করা যাবে, তা নিশ্চিত করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। আলিফ ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, রোববার সকালে দু’দফা হামলা হয়েছে। ভয়ে আমরা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। এখনও আমরা আতঙ্কিত। হামলা করার অনেক পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আসেন। যারা কারখানায় হামলা করেছে, তারা কেউ আমাদের শ্রমিক না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আশুলিয়ার এক বাসিন্দা বলেন, যারা কারখানায় হামলা করছে তাদের অনেকেই শিশু-কিশোর। আবার এক এলাকার লোক অন্য এলাকায় যাচ্ছে বিশৃঙ্খলা ঘটাতে। অনেক রিকশা ও ভ্যানচালক হামলায় জড়াচ্ছে। এসব চালকের দুরভিসন্ধি না থাকলে কেন তারা এ ধরনের হামলায় জড়াবে? তাঁর ভাষ্য, তৃতীয় কোনো পক্ষ শ্রমিকদের উস্কে দিতে চাইছে। কারখানায় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর সঙ্গে রিকশা-ভ্যানচালকদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে– এ প্রশ্ন তোলেন তিনি।

গতকাল সাভারের পুরাতন ইপিজেড এলাকায় ন্যানি ফ্যাশন নামে একটি কারখানার কয়েক হাজার সাবেক শ্রমিক একত্রিত হয়ে মানববন্ধন করেছেন। ওই কারখানা বছর চারেক আগে বন্ধ হয়। এক মাসের পাওনা বেতনের দাবিতে এত বছর পর একত্রিত হয়ে মানববন্ধনের বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে করছেন কেউ কেউ।

এ ছাড়া আশুলিয়ায় অস্থিরতার পেছনে ঝুট ব্যবসাকেন্দ্রিক বিরোধও একটি কারণ– বলছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী অধিকাংশ কারখানায় ঝুটের কারবার নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। সরকার পতনের পর তাদের অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন। ‘পলাতক’ থাকা অবস্থায় কেউ কেউ ব্যবসার নাটাই ছাড়তে চান না। তবে এখন বিএনপি নেতাকর্মী ঝুটের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। এরই মধ্যে এ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইপিজেডে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আশুলিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক জিল্লুর রহমানকে গতকাল তাঁর নেতাকর্মীকে নিয়ে ‘শান্তিপূর্ণ অবস্থান’ কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। তাঁর দাবি, এখনও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ঝুট ব্যবসা করে যাচ্ছেন। আমরা আগে পোশাক খাতে চলমান অস্থিরতা নিরসন করতে চাই। শ্রমিকরা যে দাবি-দাওয়া করছেন, তার বেশির ভাগ অযৌক্তিক। দু’দিন আগেও ঢাকা উত্তরের সাবেক সিটি মেয়র আতিকুল ইসলামের কারখানা ‘বি রোজ’ থেকে ঝুট বের করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা কবির সরকার। আমাদের লোকজন ১৫ বছর এসবের ধারেকাছে ছিল না। এখন যদি কেউ শুরু করে, সে তো মারামারি করবে না। ঝুট কারবার নিয়ে ইপিজেডে দুই পক্ষের মারামারির কথা শুনেছি। তাঁর ভাষ্য, এখনও আশুলিয়ায় ঝুট কারবারের সঙ্গে ইয়ারপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সুমন ভূঁইয়া, ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি নুরুল আমিন সরকার, আশুলিয়া থানা যুবলীগের আহ্বায়ক কবির সরকার জড়িত। এ ছাড়া রাজন নামে এক ইউপি সদস্যের কথা বলছেন কেউ কেউ। পালিয়ে থাকায় অভিযোগের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তবে একাধিক কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কারখানায় নতুনভাবে অস্থিরতা বজায় রেখে মালিকদের কাছে নিজেদের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করছে নতুন একটি পক্ষ। তারা পুরোনোদের হটিয়ে নতুন করে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চায়। নতুন পক্ষটি এরই মধ্যে বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে ফোন করে ঝুট ব্যবসা তাদের দেওয়ার দাবি করেছে।
এদিকে শ্রমিক নেতা কেউ কেউ কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছেন। তবে মালিকপক্ষের কারও কারও ভাষ্য, বাংলাদেশে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের নজির ভালো কিছু বয়ে আনেনি। তাই তারা এ প্রস্তাবের পক্ষে নন।

শ্রমিকের দাবি-দাওয়া

আশুলিয়া ঘুরে জানা গেছে, এবার যেসব দাবি-দাওয়া নিয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন, সেখানে সমন্বিত কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা বলছেন, আগের যে কোনো শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনায় নির্দিষ্ট দাবি-দাওয়া ছিল। এবার সুনির্দিষ্ট দাবির বদলে ‘অযৌক্তিক’ দাবির দিকে ঝুঁকে একটি পক্ষ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। একেক কারখানার শ্রমিকরা একেক ধরনের দাবি-দাওয়ার কথা জানাচ্ছে। আবার কিছু দাবি রয়েছে অভিন্ন।

কিছু দিন ধরেই আল-মুসলিম অ্যাপারেলস লিমিটেড বন্ধ। ওই কারখানার শ্রমিকদের দাবির মধ্যে রয়েছে– সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ১ তারিখের মধ্যে পে স্লিপ ও ৫ তারিখের মধ্যে বেতন দিতে হবে। মাসে হাজিরা বোনাস সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা দাবি করেছেন তারা। নিয়োগের ক্ষেত্রে পুরুষ ৭০ শতাংশ ও নারী ৩০ শতাংশ হতে হবে। দুই ঈদে মূল বেতনের (বেসিক) ১০০ শতাংশ চান তারা। প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট ১৫ শতাংশ। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা গেলে তাঁর লাশ কোম্পানি নিজ দায়িত্বে বাড়ি পৌঁছাবে। অন্তঃসত্ত্বার ক্ষেত্রে ছুটি চার মাস হবে। এ ছাড়া ছুটির টাকা অগ্রিম দেওয়ার কথা বলেন। ছুটি পাস হওয়ার সময় হাজিরা বোনাস কাটা যাবে না। ঈদের ছুটি হবে সর্বনিম্ন ১২ দিন। চাকরির বয়স ৫ বছর হলে কোনো কারণে তাঁকে ছাঁটাই করলে সার্ভিস বেনিফিট দিতে কোম্পানি বাধ্য থাকবে। শ্রমিক-কর্মচারী অসুস্থ হলে তাঁর চিকিৎসার খরচ কোম্পানি বহন করবে। আন্দোলনকারী কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা যাবে না।

আল-মুসলিম ছাড়া আরও বেশ কিছু কারখানার শ্রমিকরা নানা দাবি-দাওয়া সামনে আনছে। ‍আল-মুসলিমের শ্রমিক রওশন ফারুক বলেন, আশপাশের বেশ কিছু কারখানায় টিফিন বিল নগদ দেওয়া হয়। আমাদের কারখানা রুটি-কলা সরবরাহ করে। হাজিরা বোনাস মাসে ৩০০ টাকা। এটা বাড়ানোর দাবি শ্রমিকদের। এর আগে কখনোই আল-মুসলিমে সমস্যা হয়নি। কিছু যৌক্তিক দাবি মানা হলে বর্তমান সমস্যাও কেটে যাবে। ডেকো ডিজাইন লিমিটেড নামে আরেকটি কারখানার শ্রমিকদের ১৭ দফা দাবির মধ্যে আছে– অযৌক্তিকভাবে প্রডাকশন বাড়ানোর চাপ না দেওয়া। বছরে ১৮ দিনের ছুটির টাকা পরিশোধ। টিফিন বিল সন্ধ্যা ৭টার পর ৬০ টাকা ও নাইট বিল ১০০ টাকা করতে হবে। হাজিরা বোনাস দিতে হবে এক হাজার টাকা।

এ ছাড়া গতকাল আশুলিয়া ঘুরে বেশ কিছু কারখানা কর্তৃপক্ষ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে সমন্বয় বৈঠক করেছে। নিজেদের কারখানা সুরক্ষার জন্য তারা শপথ নেয়। কর্মকর্তাদের মধ্যে কাদের চাকরিচ্যুত করতে হবে, তাদের নাম কিছু কারখানার সামনে শ্রমিকরা কাগজ সাঁটিয়ে লিখে রাখেন। শ্রমিকদের দাবি, এসব কর্মকর্তা শ্রমিকদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেননি। নাসা গ্রুপের সামনে দেখা যায়, কারখানা কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে শ্রমিকদের কী দাবি পূরণ করেছে এমন একটি নোটিশ ঝুলানো। সেখানে লেখা আছে– হাজিরা বোনাস (অপারেটর) ৭০০ টাকা, হেলপারদের ৬০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। বেতন ৭ তারিখের মধ্যে দেওয়া হবে। ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হবে বছরের মধ্যে।

ব্যাপক নিরাপত্তা

গতকাল দিনভর আশুলিয়াজুড়ে ছিল ব্যাপক নিরাপত্তা। যৌথ বাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্তারা গতকাল সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। মালিকপক্ষের কারও কারও ভাষ্য, পুলিশের ভেঙে পড়া মনোবল পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে কেউ কেউ। অনেক কারখানা মালিকের অভিযোগ, শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে এবার দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। এ ব্যাপারে শিল্প পুলিশ-১ এর সুপার মোহাম্মদ সারওয়ার আলম বলেন, একসঙ্গে ৩-৪টি কারখানায় ঝামেলা হলে কীভাবে পুলিশ তাৎক্ষণিক সহযোগিতা করবে? পুলিশের যানবাহন সংকট রয়েছে। আর বল প্রয়োগ করে সবসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

পোশাক কারখানার শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যে কী

আপডেট সময় : ০৮:২১:৪৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

 

 

সাভারের আশুলিয়ার মণ্ডল মার্কেট এলাকায় গতকাল সোমবার বন্ধ একটি পোশাক কারখানার গেটে উঁকি মারছিলেন দুই তরুণী। সুমাইয়া আর খাদিজা, দু’জনই ‘হরিহর আত্মা’। সিরাজগঞ্জের তাড়াশে দু’জনার গ্রামের বাড়ি। চাকরির জন্য বেশ কিছু দিন ধরে এভাবে একেক কারখানার দরজায় কড়া নাড়ছেন। সুমাইয়া জানান, আশুলিয়ার এস-২১ নামে একটি কারখানায় চাকরি করতেন তিনি। অসুস্থ হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যান। সুস্থ হয়ে ১৫ দিন আগে আশুলিয়া ফিরে পোশাক কারখানায় অস্থিরতা দেখেন। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে কোনো জায়গায় এখনও চাকরি জোটাতে পারেননি। তাই সংসারের খরচ চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। এ দুই তরুণীর মতো অনেকেই শ্রমিক অসন্তোষের কারণে নানামুখী বিপদে।

দাবি-দাওয়া নিয়ে আশুলিয়ায় এখনও বিরাজ করছে শ্রমিক অসন্তোষ। বিশেষ করে আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নে যেসব কারখানা, সেখানে বেশ অস্থিরতা। গতকালও পুরো এলাকা ছিল থমথমে। বন্ধ ছিল ৭৯ কারখানা। হঠাৎ বিভিন্ন দাবির বিষয় সামনে এনে যে বিক্ষোভ চলছে, এর নেপথ্যে আছে নানা কারণ। আশুলিয়ায় গতকাল দিনভর ঘুরে শ্রমিক, মালিকপক্ষ, রাজনৈতিক নেতা, স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ‘সুবিধাভোগী’ নানা গ্রুপ এর পেছনে রয়েছে। কোনো কোনো কারখানায় হামলার সঙ্গে জড়িতরা বহিরাগত। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে মালিকপক্ষ বলছে, নিজেদের কারখানায় শ্রমিকরা হামলায় জড়িত ছিলেন না। অনেকে আবার বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঝুট কারবার হাতবদল নিয়ে বিরোধ রয়েছে। তারা কারখানায় অস্থিরতা তৈরি করে নিজেদের নতুন প্রভাব বলয় তৈরি করছেন। গত দুই সপ্তাহে ঝুট ব্যবসা নিয়ে একাধিক গ্রুপের মধ্যে আশুলিয়ায় সংঘর্ষ হয়েছে।

কিছুদিন ধরেই আশুলিয়ায় কারখানায় ভাঙচুর, হামলা, লুট ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। কয়েকটি কারখানায় হাজিরা দিয়েই শ্রমিকরা বের হয়ে যাচ্ছেন। অব্যাহত বিশৃঙ্খলায় শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কায় আছেন মালিকপক্ষ। এ সমস্যা দ্রুত নিরসনে বিজিএমইএ, কারখানার মালিক, প্রশাসনের লোকজন ধারাবাহিক বৈঠক করছেন।

নেপথ্যে নানা হিসাব

রোববার আশুলিয়ায় আলিফ ভিলেজ নামে একটি পোশাক কারখানায় ব্যাপক ভাঙচুর ও লুট হয়। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ওই কারখানায় মেশিনপত্র তছনছ। ভাঙচুর করা হয়

মেডিকেল সেন্টার, সাব-স্টেশন রুম ও ফায়ার কন্ট্রোল রুম। কবে নাগাদ কারখানা চালু করা যাবে, তা নিশ্চিত করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। আলিফ ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, রোববার সকালে দু’দফা হামলা হয়েছে। ভয়ে আমরা বাথরুমে লুকিয়ে ছিলাম। এখনও আমরা আতঙ্কিত। হামলা করার অনেক পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আসেন। যারা কারখানায় হামলা করেছে, তারা কেউ আমাদের শ্রমিক না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আশুলিয়ার এক বাসিন্দা বলেন, যারা কারখানায় হামলা করছে তাদের অনেকেই শিশু-কিশোর। আবার এক এলাকার লোক অন্য এলাকায় যাচ্ছে বিশৃঙ্খলা ঘটাতে। অনেক রিকশা ও ভ্যানচালক হামলায় জড়াচ্ছে। এসব চালকের দুরভিসন্ধি না থাকলে কেন তারা এ ধরনের হামলায় জড়াবে? তাঁর ভাষ্য, তৃতীয় কোনো পক্ষ শ্রমিকদের উস্কে দিতে চাইছে। কারখানায় সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর সঙ্গে রিকশা-ভ্যানচালকদের কী সম্পর্ক থাকতে পারে– এ প্রশ্ন তোলেন তিনি।

গতকাল সাভারের পুরাতন ইপিজেড এলাকায় ন্যানি ফ্যাশন নামে একটি কারখানার কয়েক হাজার সাবেক শ্রমিক একত্রিত হয়ে মানববন্ধন করেছেন। ওই কারখানা বছর চারেক আগে বন্ধ হয়। এক মাসের পাওনা বেতনের দাবিতে এত বছর পর একত্রিত হয়ে মানববন্ধনের বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে করছেন কেউ কেউ।

এ ছাড়া আশুলিয়ায় অস্থিরতার পেছনে ঝুট ব্যবসাকেন্দ্রিক বিরোধও একটি কারণ– বলছেন সংশ্লিষ্টরা। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী অধিকাংশ কারখানায় ঝুটের কারবার নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। সরকার পতনের পর তাদের অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন। ‘পলাতক’ থাকা অবস্থায় কেউ কেউ ব্যবসার নাটাই ছাড়তে চান না। তবে এখন বিএনপি নেতাকর্মী ঝুটের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে চান। এরই মধ্যে এ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইপিজেডে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আশুলিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক জিল্লুর রহমানকে গতকাল তাঁর নেতাকর্মীকে নিয়ে ‘শান্তিপূর্ণ অবস্থান’ কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। তাঁর দাবি, এখনও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ঝুট ব্যবসা করে যাচ্ছেন। আমরা আগে পোশাক খাতে চলমান অস্থিরতা নিরসন করতে চাই। শ্রমিকরা যে দাবি-দাওয়া করছেন, তার বেশির ভাগ অযৌক্তিক। দু’দিন আগেও ঢাকা উত্তরের সাবেক সিটি মেয়র আতিকুল ইসলামের কারখানা ‘বি রোজ’ থেকে ঝুট বের করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা কবির সরকার। আমাদের লোকজন ১৫ বছর এসবের ধারেকাছে ছিল না। এখন যদি কেউ শুরু করে, সে তো মারামারি করবে না। ঝুট কারবার নিয়ে ইপিজেডে দুই পক্ষের মারামারির কথা শুনেছি। তাঁর ভাষ্য, এখনও আশুলিয়ায় ঝুট কারবারের সঙ্গে ইয়ারপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান সুমন ভূঁইয়া, ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি নুরুল আমিন সরকার, আশুলিয়া থানা যুবলীগের আহ্বায়ক কবির সরকার জড়িত। এ ছাড়া রাজন নামে এক ইউপি সদস্যের কথা বলছেন কেউ কেউ। পালিয়ে থাকায় অভিযোগের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য নেওয়া যায়নি। তবে একাধিক কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কারখানায় নতুনভাবে অস্থিরতা বজায় রেখে মালিকদের কাছে নিজেদের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করছে নতুন একটি পক্ষ। তারা পুরোনোদের হটিয়ে নতুন করে ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চায়। নতুন পক্ষটি এরই মধ্যে বিভিন্ন কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে ফোন করে ঝুট ব্যবসা তাদের দেওয়ার দাবি করেছে।
এদিকে শ্রমিক নেতা কেউ কেউ কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছেন। তবে মালিকপক্ষের কারও কারও ভাষ্য, বাংলাদেশে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের নজির ভালো কিছু বয়ে আনেনি। তাই তারা এ প্রস্তাবের পক্ষে নন।

শ্রমিকের দাবি-দাওয়া

আশুলিয়া ঘুরে জানা গেছে, এবার যেসব দাবি-দাওয়া নিয়ে শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন, সেখানে সমন্বিত কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। মালিকপক্ষের প্রতিনিধিরা বলছেন, আগের যে কোনো শ্রমিক বিক্ষোভের ঘটনায় নির্দিষ্ট দাবি-দাওয়া ছিল। এবার সুনির্দিষ্ট দাবির বদলে ‘অযৌক্তিক’ দাবির দিকে ঝুঁকে একটি পক্ষ পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে বলে মনে করছেন তারা। একেক কারখানার শ্রমিকরা একেক ধরনের দাবি-দাওয়ার কথা জানাচ্ছে। আবার কিছু দাবি রয়েছে অভিন্ন।

কিছু দিন ধরেই আল-মুসলিম অ্যাপারেলস লিমিটেড বন্ধ। ওই কারখানার শ্রমিকদের দাবির মধ্যে রয়েছে– সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ১ তারিখের মধ্যে পে স্লিপ ও ৫ তারিখের মধ্যে বেতন দিতে হবে। মাসে হাজিরা বোনাস সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা দাবি করেছেন তারা। নিয়োগের ক্ষেত্রে পুরুষ ৭০ শতাংশ ও নারী ৩০ শতাংশ হতে হবে। দুই ঈদে মূল বেতনের (বেসিক) ১০০ শতাংশ চান তারা। প্রতিবছর ইনক্রিমেন্ট ১৫ শতাংশ। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা গেলে তাঁর লাশ কোম্পানি নিজ দায়িত্বে বাড়ি পৌঁছাবে। অন্তঃসত্ত্বার ক্ষেত্রে ছুটি চার মাস হবে। এ ছাড়া ছুটির টাকা অগ্রিম দেওয়ার কথা বলেন। ছুটি পাস হওয়ার সময় হাজিরা বোনাস কাটা যাবে না। ঈদের ছুটি হবে সর্বনিম্ন ১২ দিন। চাকরির বয়স ৫ বছর হলে কোনো কারণে তাঁকে ছাঁটাই করলে সার্ভিস বেনিফিট দিতে কোম্পানি বাধ্য থাকবে। শ্রমিক-কর্মচারী অসুস্থ হলে তাঁর চিকিৎসার খরচ কোম্পানি বহন করবে। আন্দোলনকারী কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা যাবে না।

আল-মুসলিম ছাড়া আরও বেশ কিছু কারখানার শ্রমিকরা নানা দাবি-দাওয়া সামনে আনছে। ‍আল-মুসলিমের শ্রমিক রওশন ফারুক বলেন, আশপাশের বেশ কিছু কারখানায় টিফিন বিল নগদ দেওয়া হয়। আমাদের কারখানা রুটি-কলা সরবরাহ করে। হাজিরা বোনাস মাসে ৩০০ টাকা। এটা বাড়ানোর দাবি শ্রমিকদের। এর আগে কখনোই আল-মুসলিমে সমস্যা হয়নি। কিছু যৌক্তিক দাবি মানা হলে বর্তমান সমস্যাও কেটে যাবে। ডেকো ডিজাইন লিমিটেড নামে আরেকটি কারখানার শ্রমিকদের ১৭ দফা দাবির মধ্যে আছে– অযৌক্তিকভাবে প্রডাকশন বাড়ানোর চাপ না দেওয়া। বছরে ১৮ দিনের ছুটির টাকা পরিশোধ। টিফিন বিল সন্ধ্যা ৭টার পর ৬০ টাকা ও নাইট বিল ১০০ টাকা করতে হবে। হাজিরা বোনাস দিতে হবে এক হাজার টাকা।

এ ছাড়া গতকাল আশুলিয়া ঘুরে বেশ কিছু কারখানা কর্তৃপক্ষ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে সমন্বয় বৈঠক করেছে। নিজেদের কারখানা সুরক্ষার জন্য তারা শপথ নেয়। কর্মকর্তাদের মধ্যে কাদের চাকরিচ্যুত করতে হবে, তাদের নাম কিছু কারখানার সামনে শ্রমিকরা কাগজ সাঁটিয়ে লিখে রাখেন। শ্রমিকদের দাবি, এসব কর্মকর্তা শ্রমিকদের সঙ্গে ভালো আচরণ করেননি। নাসা গ্রুপের সামনে দেখা যায়, কারখানা কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে শ্রমিকদের কী দাবি পূরণ করেছে এমন একটি নোটিশ ঝুলানো। সেখানে লেখা আছে– হাজিরা বোনাস (অপারেটর) ৭০০ টাকা, হেলপারদের ৬০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। বেতন ৭ তারিখের মধ্যে দেওয়া হবে। ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হবে বছরের মধ্যে।

ব্যাপক নিরাপত্তা

গতকাল দিনভর আশুলিয়াজুড়ে ছিল ব্যাপক নিরাপত্তা। যৌথ বাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্তারা গতকাল সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। মালিকপক্ষের কারও কারও ভাষ্য, পুলিশের ভেঙে পড়া মনোবল পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে কেউ কেউ। অনেক কারখানা মালিকের অভিযোগ, শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে এবার দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। এ ব্যাপারে শিল্প পুলিশ-১ এর সুপার মোহাম্মদ সারওয়ার আলম বলেন, একসঙ্গে ৩-৪টি কারখানায় ঝামেলা হলে কীভাবে পুলিশ তাৎক্ষণিক সহযোগিতা করবে? পুলিশের যানবাহন সংকট রয়েছে। আর বল প্রয়োগ করে সবসময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।