ঢাকা ০৮:২১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৯ জুন ২০২৫, ২৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
তিন দলই প্রধান উপদেষ্টার অধীনে নির্বাচন চায়: প্রেস সচিব টিউলিপ বাংলাদেশি এনআইডি ও পাসপোর্টধারী, রয়েছে টিআইএনও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়াই হোক নববর্ষের অঙ্গীকার: প্রধান উপদেষ্টা নরেন্দ্র মোদিকে উপহার দেওয়া ছবিটি সম্পর্কে যা জানা গেল বিমসটেকের পরবর্তী চেয়ারম্যান ড. ইউনূস বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক হতে পারে মোদির ২০২৬ সালের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন: প্রেসসচিব চীন সফরে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্যে ভারতে তোলপাড় ড. ইউনূসকে ঈদগাহের মুসল্লিরাঃ আপনি ৫ বছর দায়িত্বে থাকুন, এটাই দেশের মানুষের চাওয়া বাংলাদেশে বিশ্বমানের হাসপাতালের মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লবের সূচনা! খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে ঈদের দাওয়াত দিলেন প্রধান উপদেষ্টা যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন সেনাপ্রধান পররাষ্ট্র নীতিতে ড. ইউনূসের কাছে হেরে গেছেন নরেন্দ্র মোদী! ৩ এপ্রিলও ছুটির প্রস্তাব, মিলতে পারে ৯ দিনের ছুটি বউয়ের টিকটকেই ধরা সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ, ‘ক্লু’ ছিল গাড়িতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী শেখ মঈনুদ্দিনের পরিচয় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যবের পরিচয় শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে সব প্রমাণ সরকারের কাছে আছে জেলায় জেলায় সরকারি অর্থে ‘আওয়ামী পল্লি’

প্লাস্টিক ব্যবহার করে সড়ক নির্মাণ কতটা পরিবেশবান্ধব ?

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ০৩:৪৫:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪
  • / 76
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

একসময়ের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার প্লাস্টিক এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিনথেটিক বস্তু প্লাস্টিক তৈরি হয় বড় জৈব পলিমার থেকে। অপচনশীল এই বর্জ্য পরিবেশে ৫০০ থেকে এক হাজার বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। মাটি বা বায়ু দূষণ থেকে শুরু করে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র সবক্ষেত্রেই নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে প্লাস্টিক। বর্তমানে বিশ্বনেতাদের মাথা ব্যথার বড় কারণ এই বর্জ্য। বাংলাদেশেও বিপদজনক হারে বাড়ছে প্লাস্টিক দূষণ।
পরিবেশের কথা মাথায় রেখে গত ১ নভেম্বর দেশের সুপারশপে পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে বলেও জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তবে খোলাবাজারে এখনও হারহামিশা দেখা মিলছে পলিথিনের ব্যবহার।

এদিকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই প্লাস্টিক মিশিয়ে দেশে পরীক্ষামূলক সড়ক নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) সড়ক গবেষণাগার। রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধ নামে পরিচিত সড়কের সম্প্রসারিত ২২৫ মিটার অংশ নির্মাণ করা হয়েছে ফেলে দেয়া প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে। উন্নত দেশে বিটুমিনে (পিচে) প্লাস্টিক মিশিয়ে সড়ক নির্মাণ পুরোনো হলেও দেশে এটিই প্রথম।

এই সড়কের উপরিভাগে (সারফেস কোর্সে) পিচের সঙ্গে প্লাস্টিক মেশানোর পাশাপাশি নিচের স্তরেও (বেইজ কোর্স-১) পাথরের সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সওজ’র তথ্যমতে সড়কের নিচে পাঁচ শতাংশ প্লাস্টিক ছোট পাথরের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিন বর্জ্যের টেকসই ব্যবস্থাপনাবিষয়ক ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেনের গবেষণা অনুযায়ী সড়কটি নির্মিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ল্যাবে প্লাস্টিক সড়কের স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয় বলে জানা গেছে।

প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে যেমন বর্জ্যের সঠিক ব্যবহার হবে, অন্যদিকে কম খরচে টেকসই সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মান নিয়ন্ত্রক ও প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রকৌশলী শামীমা ইয়াসমিন চ্যানেল 24 অনলাইনকে জানান, প্লাস্টিকের ব্যবহারের কারণে এই সড়ক নির্মাণের খরচ কমেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বা বৃষ্টিতে সাধারণত দেশের সড়কে যেমন ক্ষতি হয়, প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে সেটাও প্রতিরোধ করা যাবে। আমাদের টার্গেট ছিল এক বর্ষা মওসুমের পর পারফরমেন্স দেখা। আমরা এক বর্ষা শেষে দেখেছি সড়কের অবস্থা বেশ ভালো। গেল বর্ষায় অনেক বৃষ্টি হলেও সড়কে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, তাই আমরা আরও কিছুদিন দেখবো।

এই পদ্ধতিতে নির্মিত সড়ক পরিবেশবান্ধব কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে শামীমা ইয়াসমিন চ্যানেল 24 অনলাইনকে জানান, এতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎপাদনের একটা বিষয় থাকছে, যেটা সাধারণ সড়কেও থাকে। তবে এখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হচ্ছে নিচের লেয়ারে মাটির সঙ্গে। যার সঙ্গে গাড়ির চাকার কোনো ঘর্ষণ হচ্ছে না, ফলে অতিরিক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপাদনের সুযোগ খুব কম। পাশাপাশি বিটুমিনের সঙ্গে যে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটাও চাকার সংস্পর্শে আসবে না, কারণ এই স্তরে প্লাস্টিক পাথরের সঙ্গে কোড হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে অতিরিক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপাদনের সম্ভাবনা খুবই কম।রাস্তা ভেঙে গেলে পাথরের সঙ্গে থাকা প্লাস্টিকের বাইরে এসে মাটি দূষণ করবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, সাধারণত রিকনস্ট্রাকশন কাজের সময় নিচের লেয়ার তুলে ফেলা হয়। এই ক্ষেত্রেও তাই করা হবে। এখানে সুবিধা হলো প্লাস্টিকগুলো গলে যাবে না, বা উড়ে যাবে না। তাই প্লাস্টিক সহজেই আলাদা করা যাবে এবং প্রয়োজনে পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব। এমন পদ্ধতির মাধ্যমে একেবারেই দূষণ হবে না সেটা বলা যাবে না, তবে দূষণের মাত্রা থাকবে অনেকটাই কম।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ সুমন বলেন, এখানে দেখতে হবে বিটুমিনের সঙ্গে প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে অন্যকোনো যৌগ তৈরি হয়ে পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে কি না। এই পদ্ধতির ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, প্রোপার স্ট্যাডির মাধ্যমে পাওয়া ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ করে এধরনের কাজ করা উচিত। পাশাপাশি প্লাস্টিক ব্যবহারের তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির বিষয়ও জনসাধারণের সমানে আনতে হবে। প্লাস্টিককে প্রসেস করে এখন ব্যবহার করলেও ১০-১৫ বছর পর কী ক্ষতি হতে পারে সেগুলোও সামনে আনতে হবে। কারণ দিন শেষে রাস্তাটা ব্যবহার করবেন জনগণ।

সড়কে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে পরিবেশবিদ অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, পদ্ধতিটি এখনো পরীক্ষামূলক অবস্থায় আছে। এর যেমন সুবিধা আছে তেমন অসুবিধাও রয়েছে। সুবিধাগুলোর মধ্যে অন্যতম খুব সহজেই প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব, এর ব্যবস্থাপনাও সহজ। অন্য উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে প্লাস্টিক দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এর চ্যালেঞ্জও রয়েছে, কেননা এখান থেকে মাইক্রোপাস্টিক তৈরি হতে পারে। এছাড়া এখন পর্যন্ত বিষয়টির পরীক্ষামূলক আউটপুট, এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। কতদিনে এই প্লাস্টিকগুলো ক্ষয়ীভূত হয় সেটি এখনও জানা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে ল্যাবভিত্তিক কন্ট্রোল অ্যাসেসমেন্ট করে ফিল্ডে তা বাস্তবায়ন করলে আরো ভালো হবে।

এদিকে টেকসইয়ের বিষয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, প্লাস্টিক বিভিন্ন সোর্স থেকে আনা এবং টেকসইভাবে পরিষ্কার করে তা ব্যবহার করার প্রি-প্রোসেসের ঝামেলা অনেক। সে কারণে আন্তর্জাতিকভাবে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন (পিএমভি) ব্যবহৃত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিটুমিনের নিজস্ব যে দুর্বলতা আছে, বেশি তাপমাত্রায় গলে যায় এবং কম তাপমাত্রায় এগুলো ফেটে যায়, সেটা সবল করার জন্য বিটুমিনের সঙ্গে পলিমার মিশিয়ে দিলে পারফরমেন্স বাড়ে। প্রায় ৫০-৬০ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন সবাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহারের কথা বলছে। এটা অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ, কিন্তু এর সাপ্লাই চেইনটা দেখতে হবে। বাংলাদেশে এসব বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় মূলত বিভিন্ন ময়লার মধ্য থেকে। এটা বিটুমিনের সঙ্গে মেশাতে গিয়ে অনেক সময় ঝামেলায় পড়তে হয়। প্রথমত, এর সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করা, দ্বিতীয়ত বড় আকারে ব্যবহার করতে গেলে, এই সোর্স কীভাবে কাজ করবে এবং এর গুণগতমান কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে সেটা দেখতে হবে।

এই গবেষকের মতে, প্লাস্টিক, পলিমার বা রাবারের রাস্তা নতুন কিছু নয়। এগুলো সবসময় ভালো পারফরমেন্স দেয়, বিশেষ করে জলাবদ্ধ এলাকায় ভালো সার্ভিস দেয় -এটা সবাই জানে। কিন্তু জাতীয়ভাবে করতে গেলে তখন সাপ্লাই নিশ্চিত করা, সঠিক মান রক্ষা করা যায় না। যার ফলে মানুষ এখন কমার্শিয়াল পলিমার গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করে। এখন আপনি যদি নিজে ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন দেশে ৫০-৬০ বছর ধরে প্রথমে রাবার, পরে টায়ার গলিয়ে বিটুমিনের সঙ্গে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু গুণগত মান নিশ্চিত করতে না পারায়, তারাও এগুলো থেকে সরে আসছে। জাতীয় পর্যায়ে কমার্শিয়াল পলিমার ব্যবহার করছে। এখন বাংলাদেশে এগুলো শুরু হয়েছে, যেকোনো ধরনের পলিমার (পলিথিন, প্লাস্টিক এবং রাবার) ব্যবহার সুন্দরভাবে মেশানো গেলে তা ভালো। কিন্তু পলিমার দিয়ে রাস্তা বানানো বেশ কঠিন। কারণ এগুলো মেশানো এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখা খুব জরুরী। এগুলো ধাপে ধাপে নজরদারি করতে হয়, তা সঠিকভাবে করতে না পারলে হিতেবিপরীত হতে পারে।

 

এছাড়া জায়গাভেদে প্লাস্টিকের কম বেশিও একটা সমস্যা হতে পারে। যেমন ঢাকার ক্ষেত্রে যতটা সহজে প্লাস্টিক পাচ্ছি, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় বা পাহাড়ি অঞ্চলে ততটা প্লাস্টিক পাওয়া সম্ভব হবে না। ফলে তখন এই বর্জ্যের ব্যবহার করা কঠিন হতে পারে। তবে দূষণের বিষয়ে এই গবেষক বলেন, একেবারে দূষণ-মুক্ত কিছু করা মুশকিল। সাধারণ সড়ক থেকেও মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপাদন হয়। এছাড়া মেয়েদের প্রসাধনীতে এর চাইতে বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক আছে। মূলত কোয়ালিটি নিশ্চিত করে প্লাস্টিক ব্যবহার করলে তা টেকসই হতে পারে।

প্রকৌশলী শামীমা ইয়াসমিনও মনে করেন, প্লাস্টিক ব্যবহার করে সড়ক নির্মাণ করলে তা বেশ টেকসই হবে। তবে প্লাস্টিক ব্যবহার করে দেশে সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে সঠিক মান নিশ্চিত করা কঠিন হবে না। সাধারণভাবে সড়ক নির্মাণে এখন যে তাপমাত্রা বজায় রাখতে হয়, এক্ষেত্রে হালকা একটু বেশি তাপমাত্রা বজায় রাখতে হবে, তবে বাকি সব প্রক্রিয়া একই থাকবে। তাই কোয়ালিটি নিশ্চিত করা সম্ভব। এছাড়া বড় আকারে সড়ক নির্মাণে প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে চেইন অব সাপ্লাই ম্যানেজ করাও অসম্ভব হবে না বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

প্লাস্টিক ব্যবহার করে সড়ক নির্মাণ কতটা পরিবেশবান্ধব ?

আপডেট সময় : ০৩:৪৫:৫৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪

একসময়ের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার প্লাস্টিক এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিনথেটিক বস্তু প্লাস্টিক তৈরি হয় বড় জৈব পলিমার থেকে। অপচনশীল এই বর্জ্য পরিবেশে ৫০০ থেকে এক হাজার বছর পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। মাটি বা বায়ু দূষণ থেকে শুরু করে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র সবক্ষেত্রেই নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে প্লাস্টিক। বর্তমানে বিশ্বনেতাদের মাথা ব্যথার বড় কারণ এই বর্জ্য। বাংলাদেশেও বিপদজনক হারে বাড়ছে প্লাস্টিক দূষণ।
পরিবেশের কথা মাথায় রেখে গত ১ নভেম্বর দেশের সুপারশপে পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের জন্য রাখা হবে বলেও জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তবে খোলাবাজারে এখনও হারহামিশা দেখা মিলছে পলিথিনের ব্যবহার।

এদিকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই প্লাস্টিক মিশিয়ে দেশে পরীক্ষামূলক সড়ক নির্মাণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) সড়ক গবেষণাগার। রাজধানী ঢাকার মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধ নামে পরিচিত সড়কের সম্প্রসারিত ২২৫ মিটার অংশ নির্মাণ করা হয়েছে ফেলে দেয়া প্লাস্টিক বর্জ্য দিয়ে। উন্নত দেশে বিটুমিনে (পিচে) প্লাস্টিক মিশিয়ে সড়ক নির্মাণ পুরোনো হলেও দেশে এটিই প্রথম।

এই সড়কের উপরিভাগে (সারফেস কোর্সে) পিচের সঙ্গে প্লাস্টিক মেশানোর পাশাপাশি নিচের স্তরেও (বেইজ কোর্স-১) পাথরের সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করা হয়েছে। সওজ’র তথ্যমতে সড়কের নিচে পাঁচ শতাংশ প্লাস্টিক ছোট পাথরের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠিন বর্জ্যের টেকসই ব্যবস্থাপনাবিষয়ক ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেনের গবেষণা অনুযায়ী সড়কটি নির্মিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ল্যাবে প্লাস্টিক সড়কের স্পেসিফিকেশন তৈরি করা হয় বলে জানা গেছে।

প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার ব্যবহারের মাধ্যমে একদিকে যেমন বর্জ্যের সঠিক ব্যবহার হবে, অন্যদিকে কম খরচে টেকসই সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের মান নিয়ন্ত্রক ও প্রশিক্ষণ বিভাগের প্রকৌশলী শামীমা ইয়াসমিন চ্যানেল 24 অনলাইনকে জানান, প্লাস্টিকের ব্যবহারের কারণে এই সড়ক নির্মাণের খরচ কমেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বা বৃষ্টিতে সাধারণত দেশের সড়কে যেমন ক্ষতি হয়, প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে সেটাও প্রতিরোধ করা যাবে। আমাদের টার্গেট ছিল এক বর্ষা মওসুমের পর পারফরমেন্স দেখা। আমরা এক বর্ষা শেষে দেখেছি সড়কের অবস্থা বেশ ভালো। গেল বর্ষায় অনেক বৃষ্টি হলেও সড়কে তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি, তাই আমরা আরও কিছুদিন দেখবো।

এই পদ্ধতিতে নির্মিত সড়ক পরিবেশবান্ধব কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে শামীমা ইয়াসমিন চ্যানেল 24 অনলাইনকে জানান, এতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎপাদনের একটা বিষয় থাকছে, যেটা সাধারণ সড়কেও থাকে। তবে এখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার করা হচ্ছে নিচের লেয়ারে মাটির সঙ্গে। যার সঙ্গে গাড়ির চাকার কোনো ঘর্ষণ হচ্ছে না, ফলে অতিরিক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপাদনের সুযোগ খুব কম। পাশাপাশি বিটুমিনের সঙ্গে যে প্লাস্টিক ব্যবহৃত হচ্ছে, সেটাও চাকার সংস্পর্শে আসবে না, কারণ এই স্তরে প্লাস্টিক পাথরের সঙ্গে কোড হয়ে যাচ্ছে। এখান থেকে অতিরিক্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপাদনের সম্ভাবনা খুবই কম।রাস্তা ভেঙে গেলে পাথরের সঙ্গে থাকা প্লাস্টিকের বাইরে এসে মাটি দূষণ করবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, সাধারণত রিকনস্ট্রাকশন কাজের সময় নিচের লেয়ার তুলে ফেলা হয়। এই ক্ষেত্রেও তাই করা হবে। এখানে সুবিধা হলো প্লাস্টিকগুলো গলে যাবে না, বা উড়ে যাবে না। তাই প্লাস্টিক সহজেই আলাদা করা যাবে এবং প্রয়োজনে পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব। এমন পদ্ধতির মাধ্যমে একেবারেই দূষণ হবে না সেটা বলা যাবে না, তবে দূষণের মাত্রা থাকবে অনেকটাই কম।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ সুমন বলেন, এখানে দেখতে হবে বিটুমিনের সঙ্গে প্লাস্টিকের ব্যবহারের ফলে অন্যকোনো যৌগ তৈরি হয়ে পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে কি না। এই পদ্ধতির ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, প্রোপার স্ট্যাডির মাধ্যমে পাওয়া ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ করে এধরনের কাজ করা উচিত। পাশাপাশি প্লাস্টিক ব্যবহারের তাৎক্ষণিক এবং দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির বিষয়ও জনসাধারণের সমানে আনতে হবে। প্লাস্টিককে প্রসেস করে এখন ব্যবহার করলেও ১০-১৫ বছর পর কী ক্ষতি হতে পারে সেগুলোও সামনে আনতে হবে। কারণ দিন শেষে রাস্তাটা ব্যবহার করবেন জনগণ।

সড়কে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে পরিবেশবিদ অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, পদ্ধতিটি এখনো পরীক্ষামূলক অবস্থায় আছে। এর যেমন সুবিধা আছে তেমন অসুবিধাও রয়েছে। সুবিধাগুলোর মধ্যে অন্যতম খুব সহজেই প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার করা সম্ভব, এর ব্যবস্থাপনাও সহজ। অন্য উপাদানের সঙ্গে মিশিয়ে প্লাস্টিক দিয়ে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এর চ্যালেঞ্জও রয়েছে, কেননা এখান থেকে মাইক্রোপাস্টিক তৈরি হতে পারে। এছাড়া এখন পর্যন্ত বিষয়টির পরীক্ষামূলক আউটপুট, এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। কতদিনে এই প্লাস্টিকগুলো ক্ষয়ীভূত হয় সেটি এখনও জানা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে ল্যাবভিত্তিক কন্ট্রোল অ্যাসেসমেন্ট করে ফিল্ডে তা বাস্তবায়ন করলে আরো ভালো হবে।

এদিকে টেকসইয়ের বিষয়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, প্লাস্টিক বিভিন্ন সোর্স থেকে আনা এবং টেকসইভাবে পরিষ্কার করে তা ব্যবহার করার প্রি-প্রোসেসের ঝামেলা অনেক। সে কারণে আন্তর্জাতিকভাবে পলিমার মডিফায়েড বিটুমিন (পিএমভি) ব্যবহৃত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিটুমিনের নিজস্ব যে দুর্বলতা আছে, বেশি তাপমাত্রায় গলে যায় এবং কম তাপমাত্রায় এগুলো ফেটে যায়, সেটা সবল করার জন্য বিটুমিনের সঙ্গে পলিমার মিশিয়ে দিলে পারফরমেন্স বাড়ে। প্রায় ৫০-৬০ বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন সবাই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহারের কথা বলছে। এটা অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ, কিন্তু এর সাপ্লাই চেইনটা দেখতে হবে। বাংলাদেশে এসব বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় মূলত বিভিন্ন ময়লার মধ্য থেকে। এটা বিটুমিনের সঙ্গে মেশাতে গিয়ে অনেক সময় ঝামেলায় পড়তে হয়। প্রথমত, এর সাপ্লাই চেইন নিশ্চিত করা, দ্বিতীয়ত বড় আকারে ব্যবহার করতে গেলে, এই সোর্স কীভাবে কাজ করবে এবং এর গুণগতমান কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে সেটা দেখতে হবে।

এই গবেষকের মতে, প্লাস্টিক, পলিমার বা রাবারের রাস্তা নতুন কিছু নয়। এগুলো সবসময় ভালো পারফরমেন্স দেয়, বিশেষ করে জলাবদ্ধ এলাকায় ভালো সার্ভিস দেয় -এটা সবাই জানে। কিন্তু জাতীয়ভাবে করতে গেলে তখন সাপ্লাই নিশ্চিত করা, সঠিক মান রক্ষা করা যায় না। যার ফলে মানুষ এখন কমার্শিয়াল পলিমার গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করে। এখন আপনি যদি নিজে ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে অনেকগুলো বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন দেশে ৫০-৬০ বছর ধরে প্রথমে রাবার, পরে টায়ার গলিয়ে বিটুমিনের সঙ্গে ব্যবহার করা হতো। কিন্তু গুণগত মান নিশ্চিত করতে না পারায়, তারাও এগুলো থেকে সরে আসছে। জাতীয় পর্যায়ে কমার্শিয়াল পলিমার ব্যবহার করছে। এখন বাংলাদেশে এগুলো শুরু হয়েছে, যেকোনো ধরনের পলিমার (পলিথিন, প্লাস্টিক এবং রাবার) ব্যবহার সুন্দরভাবে মেশানো গেলে তা ভালো। কিন্তু পলিমার দিয়ে রাস্তা বানানো বেশ কঠিন। কারণ এগুলো মেশানো এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখা খুব জরুরী। এগুলো ধাপে ধাপে নজরদারি করতে হয়, তা সঠিকভাবে করতে না পারলে হিতেবিপরীত হতে পারে।

 

এছাড়া জায়গাভেদে প্লাস্টিকের কম বেশিও একটা সমস্যা হতে পারে। যেমন ঢাকার ক্ষেত্রে যতটা সহজে প্লাস্টিক পাচ্ছি, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় বা পাহাড়ি অঞ্চলে ততটা প্লাস্টিক পাওয়া সম্ভব হবে না। ফলে তখন এই বর্জ্যের ব্যবহার করা কঠিন হতে পারে। তবে দূষণের বিষয়ে এই গবেষক বলেন, একেবারে দূষণ-মুক্ত কিছু করা মুশকিল। সাধারণ সড়ক থেকেও মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপাদন হয়। এছাড়া মেয়েদের প্রসাধনীতে এর চাইতে বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক আছে। মূলত কোয়ালিটি নিশ্চিত করে প্লাস্টিক ব্যবহার করলে তা টেকসই হতে পারে।

প্রকৌশলী শামীমা ইয়াসমিনও মনে করেন, প্লাস্টিক ব্যবহার করে সড়ক নির্মাণ করলে তা বেশ টেকসই হবে। তবে প্লাস্টিক ব্যবহার করে দেশে সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে সঠিক মান নিশ্চিত করা কঠিন হবে না। সাধারণভাবে সড়ক নির্মাণে এখন যে তাপমাত্রা বজায় রাখতে হয়, এক্ষেত্রে হালকা একটু বেশি তাপমাত্রা বজায় রাখতে হবে, তবে বাকি সব প্রক্রিয়া একই থাকবে। তাই কোয়ালিটি নিশ্চিত করা সম্ভব। এছাড়া বড় আকারে সড়ক নির্মাণে প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে চেইন অব সাপ্লাই ম্যানেজ করাও অসম্ভব হবে না বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।