বড় দু:সংবাদ দিয়ে কা.ন্নায় ভেঙে পড়লেন আবুল হায়াত ও তার স্ত্রীও
- আপডেট সময় : ১১:১০:০৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩ নভেম্বর ২০২৪ ৭৬ বার পড়া হয়েছে
সময় শনিবার বিকেল ৫টা। বাংলাদেশ শিল্পকলার জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তন। এখানে অতিথি কানায় কানায় পরিপূর্ণ। একটু পরেই বরেণ্য অভিনেতা আবুল হায়াতের আত্মজীবনী বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে।
বর্ষীয়ান অভিনেতা আবুল হায়াত। ষাটের দশক থেকে নিয়মিত অভিনয় করে যাওয়া আবুল হায়াত শুধু অভিনেতাই নন, একাধারে নাট্যকার এবং নির্মাতাও। এবার ৮০ বছর পার করে ৮১ বছরে এসে ‘রবি পথ’ নামে একটি আত্মজীবনী বই লিখেছেন তিনি।
গতকাল এ অনুষ্ঠানটি আয়োজন করেছে বাংলাদেশ অভিনয়শিল্পী সংঘ। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন অভিনেত্রী অপি করিম। অনুষ্ঠানের শুরুতেই এই বইয়ের দুটি অনুচ্ছেদ তিনি পড়ে শোনালেন।
এরপর মঞ্চে উঠে একে একে বক্তব্য রাখেন গুণীজন তারিক আনাম খান, নরেশ ভুঁইয়া, সারা যাকের, মামুনুর রশিদ, মঞ্জুরুল ইসলাম। তাদের বক্তব্যের মাঝে একে একে বইয়ের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ করেন অভিনয়শিল্পী অপি করিম, ইন্তেখাব দিনার, রওনাক হাসান, দীপা খন্দকার ও আজাদ আবুল কালাম।
এরপর আত্মজীবনীমূলক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান শেষে জীবনসঙ্গীনি মাহফুজা খাতুন শিরিন ও দুই মেয়ে বিপাশা হায়াত ও নাতাশা হায়াতকে নিয়ে মঞ্চে ওঠেন আবুল হায়াত।
শুরুতে আত্মজীবনী প্রকাশ প্রসঙ্গে আবুল হায়াত বলেন, ‘বইটা কেন লিখেছি, এর কোনো জবাব নেই। ১০ বছর ধরে লিখেছি। বইটা পড়লেও সবাই তা টের পাবেন। আমি নিজেও তো অনেকের বই পড়েছি। ভাবলাম, লিখি না, আমার জীবনেও তো অনেক ঘটনা আছে। বই লেখার ক্ষেত্রে যে ঘটনা আমাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে, মুর্শিদাবাদ থেকে একটি পরিবার চট্টগ্রামে এলো শুধু টেবিলে বসে একটা দাগ টানার কারণে। যখন বলা হলো, এটা হিন্দুস্তান, এটা পাকিস্তান। তার কারণে আমার মা-বাবা একটা দেশ ছেড়ে আরেকটা দেশে এলেন। বোঝালেন যে, এটা তোমার দেশ না, এটা তোমার দেশ। প্রথমত, সেখান থেকে কষ্টটা, ক্ষতটা আমি আমার লেখায় ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারপর আমি যে তিন বছর বয়সে এলাম, এরপর বড় হলাম। সেই বিষয়গুলো লিখতে লিখতে মনে হলো, বাকি জীবনটা লিখে ফেলি। এরপর অনেকবার ফেলে রেখেছি, অবহেলা করেছি। এক পাতা লিখেছি, ছিঁড়ে ফেলেছি। দশ পাতা লিখেছি। তারপরও পড়ে ছিল বহুদিন। বিপাশা নিয়মিত বলত লেখার ব্যাপারে। আমি বলেছিলাম, “আমার জীবনী কে পড়বে?” তখন বিপাশা বলেছিল, “তুমি তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখক। তোমার জীবনী তোমার চেয়ে ভালো কেউ লিখতে পারবে না। আমি চাই, তোমার জীবনীটা লেখা হোক।” এটা মনে হয়েছে, হ্যাঁ, তাই তো, আমার জীবনী আমার চেয়ে ভালো আর কে লিখবে। আমিও তারপর ভাবলাম, লিখি। এরপর তিথি (সুবর্ণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী) যখন বলল, “আমি ছাপাব।” তখন তাড়াতাড়ি লেখা শেষ করলাম। ভেবেছি আর সময় পাব কি না। এভাবেই লেখা হলো।’
স্ত্রী মাহফুজা খাতুন শিরিনের হাত ধরে মঞ্চের কিছুটা সামনে এগিয়ে নিয়ে আসেন আবুল হায়াত। একপর্যায়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। পুরো অডিটোরিয়াম জুড়ে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা।
কান্নাভরা কণ্ঠে স্ত্রীকে জড়িয়ে আবুল হায়াত বলেন, “এই মানুষটি আমাকে জীবনে সব ধরনের সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। আজ থেকে দুই বছর আগে আমার হাসপাতালে গিয়ে আমরা শুনতে পাই আমি ক্যানসারে আক্রান্ত। এই কথা শোনার পর আমি চুপ হয়ে গেছি। পুরো রাস্তা আসার সময় তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। রাতে খাওয়া দাওয়া করে আমি শুয়ে ছিলাম। তিনি অন্ধকারে গিয়ে আমাকে জড়িয়ে কি যে কান্না। এটা হয়তো বলে বোঝানো যাবে না। ও শুধু বলছিল, ‘সৃষ্টিকর্তা কি আমাকে চোখে দেখলো না?’ সারাজীবন ও আমার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, এখনও করছে।”
এ প্রবীণ অভিনেতা বলেন, ‘হঠাৎ মনে হয়েছিল, জীবনে তো অনেক ঘটনা আছে। ছোটবেলা থেকে অনেক কিছু দেখেছি। সেগুলো গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছি বইতে। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা জানেও না, এ রকম পুরোনো অনেক ঘটনা আছে। আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব সবাই উৎসাহ দিয়েছে। পরে ভাবলাম, লিখেই ফেলি। আমার মনে হয়, এটার একটা ভালো দিক আছে। ৮০ বছরের একটা ভ্রমণ আমার, অনেক কিছু দেখেছি, যা অনেকে হয়ত জানে না। সুতরাং আমার মতো যারা আছেন, তারাও যদি নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আত্মজীবনী লেখেন, তাহলে অবশ্যই সেটা নতুন প্রজন্মের জন্য ভালো।’
অভিনেতা আবু হায়াত নিজের জীবনের নানা কথা, গল্প আর ঘটনা নিয়ে ‘রবি পথ’ বইটি সাজিয়েছেন। প্রায় দশ বছর ধরে পরম যত্নসহকারে এ বইয়ের কাজ করেছেন বলে জানান তিনি। আবুল হায়াতের ডাক নাম রবি। ডাক নামেই নিজের আত্মজীবনীর নাম রাখা হয়েছে বলে জানান এ অভিনেতা।
উল্লেখ্য, ১৯৪৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন আবুল হায়াত। ১৯৪৭ সালে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন চট্টগ্রামে। মাত্র ১০ বছর বয়সে মঞ্চে ওঠেন অভিনয়ের জন্য। যে অভিনয়ের সঙ্গে এখনও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন অভিনেতা।
এরপর ১৯৬৯ সাল থেকে টিভি নাটকে অভিনয় করছেন তিনি। দীর্ঘ অভিনয় জীবনে নাটকের পাশাপাশি ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘জয়যাত্রা’, ‘গহীনে শব্দ’সহ আরো কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ২০০৮ সালে তৌকীর আহমেদ পরিচালিত ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ‘দারুচিনি দ্বীপ’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০১৫ সালে তিনি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘একুশে পদক’এ ভূষিত হন।