বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের মন্তব্য ‘সমীচীন’ নয়: দিল্লিকে ঢাকা
![](https://bdsaradin24.com/wp-content/uploads/2024/08/cropped-sssssssssssssssssss-removebg-preview-1.png)
- আপডেট সময় : ০৫:৩১:৫৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪
- / 74
ঢাকা সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির সঙ্গে সোমবার বিভিন্ন বৈঠকের বিষয় তুলে ধরতে ব্রিফিংয়ে আসেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও তাদের স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চার বিষয়টি অভ্যন্তরীণ হিসেবে তুলে ধরে এ নিয়ে অন্য দেশের মন্তব্য ‘সমীচিন নয়’ বলে ঢাকা সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির কাছে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
দু’দেশের মধ্যে আস্থা ফেরাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধে ভারতের ভূমিকার প্রত্যাশার কথাও বলেন তিনি।
ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাংলাদেশে সবার স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চা করে আসছে। এ বিষয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের সুযোগ নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
দেশে-বিদেশে সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এ নিয়ে অপপ্রচার চলার মধ্যে সরকার বাস্তব অবস্থা দেখতে ও পর্যবেক্ষণে বিদেশি সাংবাদিকদের বাংলাদেশ সফরের আহ্বান জানিয়েছে বলেও তুলে ধরেন তিনি।
সোমবার ঢাকায় ভারতের সঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন’ (এফওসি) শেষে বিফ্রিং করছিলেন পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিন।
এফওসি বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় আসা বিক্রম মিশ্রির সঙ্গে সচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের আলোচনার বিষয়ে বিফ্রিংয়ে বিস্তারিত কথা বলেন জসীম উদ্দিন।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে বক্তব্য ও পাল্টা বক্তব্যের মধ্যে এটিই ছিল প্রথম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক। সর্বশেষ বৈঠক হয় ২০২৩ সালের নভেম্বরে, দিল্লিতে।
দিনের প্রথমভাগে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকের পর সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জসীম উদ্দিন বলেন, “বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব এবং বিপ্লব-পরবর্তী সংখ্যালঘুদের প্রতি কথিত বৈরী আচরণ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে অপপ্রচার, মিথ্যা তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর বয়ান রয়েছে, সে বিষয়ে আমরা ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপের অনুরোধ জানিয়েছি।
“সেই সাথে আমরা এও বলেছি যে, এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের মন্তব্য সমীচিন নয়।
“আমি এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছি যে, বাংলাদেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য থেকে বিরত থাকে এবং অন্যান্য দেশেরও একই ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের প্রতি দেখানো উচিৎ।“
এসময় সচিব পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ‘ফ্রি, ফ্রাঙ্ক ও ক্যান্ডিড তথা খোলামনে আলোচনা হয়’ বলে মন্তব্য করেন।
দিল্লিতে সুবিধাজনক সময়ে পরের এফওসিতে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের নিকট আমরা আমাদের দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান সকল অনিষ্পন্ন বিষয়সমূহের দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য ভারতের সহযোগিতা কামনা করি এবং এই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করি।
“আমি দুই দেশের সাধারণ জনগণের ভেতর আস্থা ও বিশ্বাস বিনির্মাণের গুরুত্বের বিষয়ে জোর দেই এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা রোধে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা আশা করি।”
আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশনে হামলা নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা তো এটা বলেছি। বলার পর তিনি (ভারতের পররাষ্ট্র সচিব) বলেছেন, এ বিষয়ের ওপর নিরাপত্তা জোরদারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।”
সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা বাংলাদেশের অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরে এ বিষয়ে ভারত সরকারকে দৃশ্যমান কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব জসিম।
একই সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, মাদক পাচারসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রম নির্মূলে ভারতের সহযোগিতাসহ সীমান্ত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে, যোগ করেন তিনি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে আলাপ
প্রবল আন্দোলনে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যান। তাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব জসিম বলেন, “প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
“তাকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি অন্য মন্ত্রণালয় থেকে আসার বিষয়। এবং এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। যখন এ সিদ্ধান্ত হবে তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।”
তিনি বলেন, “এজন্য ফরেন অ্যাফেয়ার্স কনসালটেশন কেন, এটা যে কোনো ধরনের প্রক্রিয়ায় হতে পারে। সেটা কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানানো যায় কিংবা আমাদের যে মিশন আছে দিল্লিতে, তার মাধ্যমে জানানো যায়।
”দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তিনি ভারতে অবস্থান করে যেসমস্ত বক্তব্য রাখছেন সেই বক্তব্যের প্রতি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আপনারা গতকালও শুনেছেন, তিনি একটি বক্তব্য দিয়েছেন এবং সেই বক্তব্যটি সরকার পছন্দ করছেন না।
“এবং তারা (ভারতের পররাষ্ট্র সচিব) যে কথাটি বলেছেন যে, তার (শেখ হাসিনা) উপস্থিতি দু’দেশের সম্পর্কে কোনো সমস্যা তৈরি করবে না। এবং তারা এ বাস্তবতা সত্ত্বেও তারা আজকের দিনের সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চান।”
দু’দেশের মধ্যে ‘আস্থার ঘাটতি’
ক্ষমতার পটপরিবর্তনে দু’দেশের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে কি না এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, “ট্রাস্টের একটা ঘাটতি আছে। এটা আমি যদি সমস্যাটাকে স্বীকার না করি তাহলে সমাধানের দিকে যেতে পারব না।
“কাজেই এটা স্বীকার করে নিচ্ছি যে ট্রাস্টের একটা ঘাটতি ছিল বলেই আমাদের এ প্রক্রিয়ার পথটা অতিক্রম করতে হয়েছে। এবং আজকের যে বৈঠক, এটা হচ্ছে ঘাটতিটা মেটাবার পথে এগিয়ে যাওয়ার একটা পদক্ষেপ। পলিটিক্যাল মেসেজিং যদি বলেন, সেটা এই যে আমরা এই পথটাকে অনুসরণ করে পরবর্তী স্তরে যে আলাপ-আলোচনা যেন হয় সেটা আশা করব।”
এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। সেখানে বাংলাদেশের সঙ্গে অতীতের মত ভবিষ্যতেও ভারত ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় বলে তার দেশের অবস্থান তুলে ধরেন।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দুই দেশের সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে সচিব পর্যায়ের বৈঠক যোগ দিতে ঢাকায় এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি।
সকালে একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় পৌঁছার পর বেলা ১১টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ফরেন অফিস কনসালটেশনে (এফওসি) যোগ দেন বিক্রম মিশ্রি।
পরে তিনি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে মন্ত্রণালয়ে আসেন।
সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে তিনি বলেন, “আমরা অতীতে যেমন দেখেছি এবং ভবিষ্যতেও তেমনই দেখতে চাই। এই সম্পর্ককে আমরা সবসময় জনগণকেন্দ্রিক এবং জনগণের ভিত্তিতে সম্পর্ক হিসেবে মনে করি।”
আরও যেসব আলোচনা
এ বছরের মাঝামাঝিতে বন্যায় ভারতের তরফে পূর্বাভাস দেওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসে। একই সঙ্গে আন্ত:নদীগুলোর চুক্তি বিষয়ক আলাপও ফের পানি পায়। এছাড়া গঙ্গার পানি চুক্তির মেয়াদও দুবছরের মাঝে শেষ হতে যাচ্ছে।
এমন সব পরিস্থিতিতে আলোচনায় আন্তঃনদী বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে বলে তুলে ধরেন পররাষ্ট্র সচিব জসিম।
তিনি বলেন, “আমি তিস্তা নদীর পানি চুক্তি সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেই। গঙ্গা-পানি চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। সে প্রেক্ষিতে তা নবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব দেই।
“এছাড়াও আরো যে কয়টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বন্টন সংক্রান্ত চুক্তি দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনাধীন, সেসব সম্পন্ন করার জন্য বিশেষ জোর দেই। বন্যা পূর্বাভাস, উপাত্ত/ডাটা আদান-প্রদানসহ বন্যা প্রতিরোধে ভারতের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করি এবং এ বিষয়ে একটি উচ্চ-পর্যায়ের মেকানিজম গঠন করার বিষয়ে আলোচনা করি।”
সাম্প্রতিক সম্পর্কের টানাপড়েনে বাণিজ্যেও কিছুক্ষেত্রে বাধা দেখা দিয়েছে। যদিও দেশের অন্যতম আমদানি পণ্য সুতা ও তুলায় সংকট দেখা যায়নি। আনা গেছে খাদ্যদ্রব্যও। তবে এখনও ভারতের বাজারে শুল্ক বাধায় বেগ পেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
এ নিয়ে আলোচনার বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন “ভারতের সাথে আমাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান ট্যারিফ, প্যারা-ট্যারিফ এর মত বাধাসমূহ দূর করার উপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করেছি।
“আমরা ভারত থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছি।”
এ সময় ‘ভারত হতে বর্তমানে প্রায় ২৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করার’ তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, “চলমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সহযোগিতা বৃদ্ধি পেতে পারে। ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আনার বিষয়েও ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন।”
এছাড়া এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশে অবস্থানরত ১২ লাখ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ভারততে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা।
পর্যটন ও চিকিৎসা উপলক্ষে ভিসা প্রত্যাশী নাগরিকদের ভিসা প্রাপ্তি সহজ করাসহ অন্যান্য কনস্যুলার সেবা সহজ করার অনুরোধ করা হয়েছে।
যেসব বাংলাদেশি নাগরিক ভারতের আদালতের দেওয়া সাজা বাংলাদেশে অথবা ভারতে ভোগ করছে, তাদের সাজা মওকুফের বিষয়ে ভারতের যথাযথ বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে বলেন পররাষ্ট্র সচিব।
এছাড়া ভারতে আটক বাংলাদেশের জেলেদের মুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও তুলে ধরেন জসিম উদ্দিন।