পূর্ববঙ্গীয় বদ্বীপাঞ্চলের রেলপথ এবং জলপথ
এই নিবন্ধটি পূর্ব বঙ্গীয় দ্বীপাঞ্চলের (মোটামুটিভাবে বর্তমান বাংলাদেশ) ক্রম বিলীয়মান নদীব্যবস্থার মোকাবিলায় রেলওয়ের সঙ্কট ও বিরোধ সৃষ্টির বিষয়টি পরখ করেছে। সামগ্রিকভাবে ভারতে এবং বিশেষত বাংলায় রেলওয়ের প্রভাব সম্পর্কিত বিতর্কের ইতিহাস ১৯২০-র দশকের দিকের হলেও এক বিশাল নদী ব্যবস্থার পূর্বাঞ্চলীয় বদ্বীপে রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার যোগাড়যন্ত্র এবং প্রভাব পর্যাপ্তভাবে বিবেচিত হয়নি, একে বিস্ময়কর বলতে হবে। বর্তমান রচনাটি এই অঞ্চলের বিশ শতকের গোড়ার দিকের কৃষির ইতিহাস পুনর্নির্মাণের লক্ষ্যে রেলওয়ের পুরোনো বিতর্কে যোগ দানেরই প্রয়াস।
হিমালয় পর্বতমালার তিনটি প্রধান নদী বঙ্গীয় বদ্বীপ গড়ে তুলেছে। এগুলো হলো: গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা। তেরো শতকের দিকে গঙ্গা হুগলি নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে প্রবাহিত হতো। পরবর্তী তিনশো বছরে এটি ধীরে ধীরে পুব দিকে সরে এসে শেষতক উনিশ শতকের গোড়ায় ঢাকার কাছে গোয়ালন্দে ব্রহ্মপুত্র নদের সাথে মিলে যায়। এ দুটি নদীর মিলিত ধারা এরপর আধুনিক চাঁদপুরে মেঘনার সাথে মিশে আমাযনের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী গড়ে তোলে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করেছে। এটাই আবার বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপের প্রাণকেন্দ্র সৃষ্টি করেছে। তিনটি প্রধান নদ-নদীর সমস্ত শাখা উপশাখার পাশাপাশি খাল এবং নালার মতো অন্যান্য জলধারা চ্যাপ্টা ঝুড়িতে ছেড়ে দেওয়া অগুনতি সাপের মতো বদ্বীপকে ঘিরে রেখেছে। আনুমানিক ৫৬ হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিভিন্ন ধরনের অন্ততপক্ষে ২৪,০০০ কিলোমিটার ব্যাপী ৬০০ জলধারার অস্তিত্ব রয়েছে। নদীর এমনি দাপট বদ্বীপাঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে মোকাবিলা করা অন্তহীন জটিলতা ও সমস্যাকে প্রতীকিভাবে তুলে ধরেছে। কিন্তু তার বদলে ‘এটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জল ব্যবস্থা’ হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
বাংলার বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ এখন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিচারে উনিশ শতকের পুর্ববঙ্গীয় বদ্বীপ বা পূর্ব বাংলা পশ্চিম বাংলা বা উত্তর বঙ্গ থেকে উন্নত ছিল বলে একমত প্রকাশ করেন। মূলতঃ এ-অঞ্চলের নদী ব্যবস্থার গঠনমূলক ভূমিকার উপর ভিত্তি করেই এই ধরনের ধারণা তুলে ধরা হয়। পূর্ব বাংলার নদী ব্যবস্থা উজান থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন কিউবিক ফুট পলিমাটি বয়ে এনে বিভিন্ন চর এবং দ্বীপের আকারে উর্বর জমি গড়ে তুলেছে। উপনিবেশিক রাষ্ট্র গোড়ার দিকে ভূস্বামী অভিজাত গোষ্ঠীকে আনুকূল্য দিলেও ১৮৩০-র দশকের দিকে এই সরকার পলিমাটি ব্যবস্থা এবং বদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তের সুন্দরবন থেকে উদ্ধার করা ভূমির প্রাথমিক উৎপাদকদের সাথে নিবিড় কর্মসম্পর্ক গড়ে তোলার নীতি গ্রহণ করে। রাজের তরফে আকস্মিক একতরফা ব্যবস্থার চেয়ে বরং প্রান্তিক বুনো এলাকায় নতুন গড়ে ওঠা এবং উদ্ধারকৃত জমিনের কাম্য ব্যবহার ও নদীবহুল পরিবেশ বিবেচনায় এই নীতিগত পরিবর্তন এসেছিল। অবশ্য, প্রকৃত কৃষকরা যতদূর সম্পর্কিত, গোটা প্রক্রিয়াটি অঞ্চলের অর্থনীতি ও সমাজে লক্ষণীয় উর্ধ্বমুখী পরিবর্তন নিয়ে আসে।
তবে বিশ শতকের শুরুর দিকের দশকগুলোয় কর্মকর্তাদের মনে পূর্ব বাংলা সম্পর্কে এক ধরনের নদীবহুল ইউটোপিয়ার ধারণা অটুট ছিল। এই পর্যায়ে নিশ্চিতভাবে উনিশ শতকের অবস্থার তুলনায় জল ব্যবস্থার ব্যাপক অবনতি ঘটে। সুতরাং বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার জল ব্যবস্থার উন্নয়নের যেকোনও ধরনের চিন্তা মূলতঃ ইতিমধ্যে সুবিদিত পশ্চিম এবং উত্তর বঙ্গের ‘অবনতিশীল’ বা ‘মুমূর্ষূ’ অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত ছিল। এই প্রক্রিয়ায় পূর্ব বাংলাকে নিজস্ব নদী ব্যবস্থার অতীত ছায়ায় ফেলে রাখা হয়। বাংলার সমসাময়িক ইতিহাসবিদদের ক্ষেত্রে একথা খাটে, যারা এপর্যন্ত সমৃদ্ধ পূর্ব বাংলায় কৃষি উৎপাদন হ্রাস নিয়ে প্রচুর যুক্তিতর্কের অবতারণা করলেও গুরুত্বের সাথে অর্থনৈতিভাবে সচল, সজীব একটি কৃষিভিত্তিক সমাজের বন্ধ্যা ও পতনশীল দশা দেখা দেওয়ার পেছনে এর নদীব্যবস্থার ভূমিকা বিবেচনায় নেননি। এই পরিপ্রেক্ষিতে এই নিবন্ধটি জল ব্যবস্থার পাশাপাশি রেলওয়ের প্রতিও নতুন দৃষ্টিপাত করেছে।
রেলওয়ের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
প্রথমত খোদ রেলওয়ে প্রতিষ্ঠায় নয়, বরং রেলওয়েকে উৎসাহিত করতে গিয়ে অভ্যন্তরীণ জলপথের আপেক্ষিক গুরুত্ব উপলব্ধিতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাতেই সমস্যার বীজ রয়ে গেছে। পূর্ব বাংলায় জলপথকে প্রায়শই যোগাযোগের উপায় হিসাবে রেলওয়ের প্রতিযোগি ভাবা হতো। রেলওয়ের কাজ শেষ হলেই পরিবহন এবং যোগাযোগ দ্রুততর ও নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠবে, এমন ধারণা ছিল। ধীরগতির জলপথ বিসর্জন দিয়েই সেটা সম্ভব হবে। রেলপথে বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহনের সুবাদে স্বল্পমেয়াদে এই ধারণা সফল প্রমাণিত হলেও মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। রেলওয়ে একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সম্ভব করে তুলেছিল বটে, কিন্তু পরিবহন বাদেও চাষ ব্যবস্থায় প্রকৃত গতি যোগানোয় পূর্ব বাংলায় জলপথই পরিবহনের অন্য যেকোনও মাধ্যমের তুলনায় ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
বাংলার জলপথ সম্পর্কিত ১৯০৬ সালের এক প্রতিবেদনে জলপথে বিশ্বব্যাপী চলাচলের খরচের বর্ণনা শেষে ভারত এই বিচারে অপেক্ষাকৃত কম খরচ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয় যে, বিগত ৪০ বছরে নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যয়ের পরিমাণ ৫,০০০,০০০ পাউন্ডের বেশি ছিল না, কিন্তু একই সময়ে রেলওয়ের ক্ষেত্রে খরচের পরিমাণ ছিল ২০০,০০০,০০০ পাউন্ড। পূর্ব বাংলার রেলওয়ের বেলায় ভারত সরকার আরও বেশি উদার ছিল্। ১৯২৮ সাল নাগাদ ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়েকে (ইবিআর) অন্যান্য ব্যবস্থার চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানা যায় এবং ১৯২৫-৩০ বছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল মোট কাঙ্খিত অর্থের দুই তৃতীয়াংশ, অথচ অন্যান্য ব্যবস্থা চাহিদার অর্ধেকেরও কম অর্থ পেয়েছে। যেকোনও বিচারেই বাংলার পরিবেশ বিশ্বের অন্য যেকোনও দেশের তুলনায় এই ধরনের নৌচলাচল সুবিধার উন্নয়ন সম্প্রসারণের পক্ষে ঢের অনুকূল থাকলেও পূর্ব বাংলায় রেলওয়ের প্রতি পক্ষপাত অব্যাহত থাকে। উত্তর-পশ্চিম, উত্তর এবং উত্তরপুব থেকে বঙ্গীয় বদ্বীপে প্রবেশ করা প্রধান নদীগুলোর মতো ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে এবং আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে (এবিআর) ধীরে ধীরে পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে এবং ১৯১৮ সাল নাগাদ প্রধান প্রধান শহর এবং থানা হেডকোয়াটার্সগুলো রেলপথের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়।
বেশ কয়েকজন ইতিহাসবিদ জনস্বাস্থ্যের উপর বিভিন্ন এম্ব্যাঙ্কমেন্টের প্রভাব সম্পর্কে তাদের যুক্তির সমর্থনে জনৈক বেঙ্গল পাবলিক হেল্থ মূখ্য কর্মকর্তা সি.এ. বেন্টলিকে উদ্ধৃত করেছেন, যদিও বেন্টলি তার প্রতিবেদনে কৃষিক্ষেত্রে এম্ব্যাঙ্কমেন্টের প্রভাবের দিকেই বেশি মনোযোগ দিয়েছেন। অবশ্য, পূর্ব বাংলা প্রশ্নে বেন্টলি এম্ব্যাঙ্কমেন্টের কারণে পূর্ব বাংলা উর্বরতম ও উৎপাদনশীল এলাকার স্থান হারানোর প্রেক্ষাপটে সামগ্রিকভাবে কোলকাতা এবং বাংলা প্রদেশের ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। পূর্ব বাংলার অবস্থা বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো থাকার কথা তিনি বিশ্বাস করতেন, তবে পূর্ব বাংলায় এম্ব্যাঙ্কমেন্ট নির্মাণের নীতি ও রেওয়াজের বিপর্যয়কর পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বেন্টলির অনুমান তিরিশ ও চল্লিশের দশকেই সত্যি প্রমাণিত হয়; বেন্টলির প্রতিবেদন রচনার সময়ের তুলনায় ১৯২০-র দশকে অবস্থা মোটেও সুবিধার ছিল না।
ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে (ইবিআর)
চলন বিল এলাকায় খোদ রেলওয়ের আবির্ভাবে ইবিআর-এর উত্তর-পশ্চিম অংশ বা রাজশাহী বিভাগের বেশিরভাগ এলাকার নদী ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। চলন বিল ছিল রাজশাহী এবং পাবনা জেলার অন্তর্গত একটি বিশাল নিচু এলাকা। উত্তর বঙ্গের বেশ কিছু নদী এবং অন্যান্য ক্ষুদে জলধারার পানি এখানে এসে জমা হতো। গঙ্গার পানিও বড়াল নদীর উপশাখা নন্দকুজো এবং গোরাই নদী হয়ে এই বিলে এসে পড়তো। ১৯৪৫ সালের এক অনুমানে দেখা গেছে, আনুমানিক ৪৭টি নদী এবং অন্যান্য জলধারা আনুমানিক ১,৫৪৭ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে বিস্তৃত জলাশয় চলন বিলে এসে পড়েছে। অসংখ্য নদীপথের সঙ্গম স্থল হওয়ার পাশাপাশি এই বিল আবার বহু নদীর দক্ষিণ এবং পুবে প্রবাহিত হয়ে শেষপর্যন্ত পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হওয়ার এক ধরনের স্প্রিংবোর্ডের কাজ করেছে। এভাবে উত্তর এবং উত্তর-পশ্চিম থেকে এসে মিলিত হওয়া বিভিন্ন জলধারা এবং এখান থেকে দক্ষিণ-পুবে প্রবাহিত নদীনালা নিয়ে চলন বিল সব মিলিয়ে বদ্বীপের প্রায় অর্ধেক পরিমাণ জলধারা প্রথমে সংরক্ষণ এবং পরে মুক্ত করে দেওয়া একটি নদী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল।
নতুন শতকের শুরুতে এই বিল পশ্চিমে ইবিআরের প্রধান লাইন এবং উত্তরে শান্তাহার-বগুড়া শাখা লাইনের মাধ্যমে ঘেরাও হতে শুরু করে। বিলটি যেহেতু উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ পশ্চিম থেকে ভরে উঠত, বগুড়া-শান্তাহার লাইন এবং ইবিআরের প্রধান লাইনের কারণে এই ধারা বাধা পায়। আবার বিলের পানি দক্ষিণ-পুবদিকে প্রধানত ব্রহ্মপুত্রের দিকে প্রবাহিত হতো বলে ইবিআরের সারা-সিরাজগঞ্জ লাইনের কারণে এটিও বাধাগ্রস্ত হয়। এই নিম্নাঞ্চলে রেলওয়ে এম্ব্যাঙ্কমেন্ট নির্মাণে বাধ্য হওয়ায় সক্রিয় বদ্বীপের এই অংশের জল ব্যবস্থার নিষ্কাষণ এভাবে রেলওয়ের তরফে থেকে ভয়ঙ্কর বাধার মুখে পড়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ব্রড গেজ লাইন নির্মাণের ফলে ইবিআরের বিভিন্ন সেতুর স্প্যানের সংখ্যার হ্রাসে জলপথের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতার এই অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। প্রথম লাইন নির্মাণের সময় রেলওয়ের পক্ষে ৯৬৭ ফুটের তুলনায় ১৯২০-র দশকে এই এলাকায় মোট আউটলেট ছিল ৪৪০ ফুট।
উদাহরণস্বরূপ, দেখা গেছে, ইবিআরের দক্ষিণাঞ্চলীয় শাখাগুলোর দিকে নেমে এলে দেখা গেছে যে, খুলনার দাদশি ও পাচুরিয়া রেলওয়ে স্টেশনের মাঝামাঝি জলপথের সম্মিলিত ক্যাচমেন্টর এলাকা ছিল ১.৫ বর্গমাইল। কিন্তু আউটলেট ছিল মাত্র চারটি। সরকারী কর্মকর্তারা এই আউটলেটকে পর্যাপ্ত মনে করলেও চারটি আউটলেটের বাস্তবতা জানায় যে গোটা ১.৫ মাইল ক্যাচমেন্ট এরিয়ার জন্যে দুটো পাইপ কালভার্ট ছিল ১.৬ ফুট ডায়ামিটারের এবং দুটো গার্ডার ব্রিজ ১x১২=১২.০ ফুট ও ১x ২০=২০.০ ফুট ডায়ামিটরের। এই ধরনের অপর্যাপ্ত সংখ্যক আউটলেটের ব্যবস্থা গোটা পূর্ব বাংলা রেলওয়ের প্রতি মাইল এলাকায় ছিল, এমন প্রমাণ আছে।
এম্ব্যাঙ্কমেন্ট নিয়ে রেলওয়ে এভাবে পানির মুক্ত প্রবাহ এবং স্বাভাবিক বিস্তারের ধারার বিরোধিতার জন্যে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এটাই পরে ফসলের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, কোলকাতা-শিলিগুড়ি রেলপথ রাজশাহী হয়ে উত্তর ও দক্ষিণে এগিয়ে বাসুদেবপুর এবং তালাকপুরের মাঝামাঝি নিচু এলাকা দিয়ে গেছে। এর স্বাভাবিক ঢাল ছিল পুবে। রেলওয়ে এম্ব্যাঙ্কমেন্ট এভাবে দেশের স্বাভাবিক জল নিষ্কাশনে বাধা দিয়ে বিপুল পরিমাণ পানির উল্টোযাত্রার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যার প্রভাবে এলাকার একমাত্র ফসল ব্রডকাস্ট আমন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। খুব অল্প সংখ্যক সেতু ও কালভার্টের নিচ দিয়ে পুবে পানি সরে যেতে লম্বা সময় নিয়েছে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রে পড়ার সময় আবারও এই লাইনের সারা-সিরাজগঞ্জ এম্ব্যাঙ্কমেন্টের বাধার মুখে পড়েছে এবং পরিণামে আরও বিশাল এলাকার ফসল ধ্বংস করেছে। এই লাইনের একটা অংশ আবার চলন বিলের বেশ কাছ দিয়ে আকস্মিক জোয়ারের পানির যমুনা/ব্রহ্মপুত্রের দিকে যাওয়ার পথে বাদ সেধেছে। এই বাধার ফল ছিল বিলের পলিমাটির সঞ্চয় এবং পরবর্তীতে জল ধারণের ক্ষমতা হ্রাস। সরকারী পর্যবেক্ষকের চোখে এই হ্রাস সারা-সিরাজগঞ্জ রেলেওয়ে নির্মাণের পর থেকে বারবার বন্যার অন্যতম কারণ ছিল। সারা-সিরাজগঞ্জের উত্তর-পশ্চিমের এই বিশাল এলাকার কৃষকরা পানির স্বাভাবিক ধারায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির ফলে নিষ্কাষণের অবনতিতে চাষের সময় জমিন ঠিকমতো না শুকোতো না বলে প্রয়োজনমতো রবি শস্য উৎপাদন থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। কাদামাটিতেই বীজ বুনতে শুরু করে এরা। ‘কৃষি সম্পর্কে তিলমাত্র ধারণা রাখে, এমন কেউ,’ বলেছেন এই কর্মকর্তা, ‘সরিষা, মুসুরির ডাল, কিংবা বার্লি ফসল এভাবে চাষ করা হলে কেমন ফল দিতে পারে সহজেই কল্পনা করতে পারবেন।’ এই কর্মকর্তা এরপর, অস্বাভাবিক বৃষ্টির বছরের কথা নয়, বরং স্বাভাবিক বছরের কথা বলছেন বলে জানিয়েছেন।
১৯১৮ সালে রাজশাহী ও বগুড়ায় এক প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়েছিল। ২১ শে আগস্ট বগুড়ায় অতিবৃষ্টির ফলে এর শুরু। হিলি এবং নাটোর রেল স্টেশনের দুপাশে এই এলাকার অবস্থান। ইবিআরের পুবে পানি জমে উঠে বগুড়া লাইনের এম্ব্যাঙ্কমেন্টের কারণে প্রবাহে বাধা পায়। এদিকে ২৪ শে আগস্ট রাজশাহীতে তুমুল বৃষ্টি হয়। উত্তরের উঁচু এলাকা বগুড়া ও দিনাজপুর থেকে নেমে আসা বানের পানি এর সাথে মিলে গোটা দেশকেই প্লাবিত করে। এখানেও রেলওয়ে এম্ব্যাঙ্কমেন্ট বন্যার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় ১৩০০ থেকে ১৪০০ বর্গ মাইল এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই এলাকার ২০০ বর্গমাইলেরও বেশি এলাকার ফসল বিনষ্ট হয়।
কৃষিভিত্তিক বদ্বীপের সামাজিক করিডর হয়েও রেলওয়ের কিছু কিছু প্রভাব সরাসরি বিস্তৃত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ইবিআর মূল বাংলায় চালের দাম বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল। ইবিআর চালু হওয়ার আগে বিপুল পরিমাণ চাল মধ্য বাংলার কয়েকটি জেলা হয়ে নৌকায় পূর্ব বাংলা থেকে কোলকাতা ও অন্যান্য বাজারে যেত। অবশ্য এই চলাচলের একটা অংশ নদীয়ার বাজারেও আসতো। এভাবে প্রক্রিয়াটি চালের দাম কমানোর পেছনে অবদান রেখেছে। কিন্তু রেলওয়ের আবির্ভাবের ফলে সমস্ত চালের চালানকেই রেলওয়ে মারফত কুষ্টিয়া হয়ে যেতে হচ্ছিল। এতে আগের সেই প্রভাব আর কার্যকর থাকেনি। নদীয়া জেলা সম্পূর্ণ নিজের সম্পদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় চালের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। রেলওয়ে ক্রমে মূল উৎপাদন এলাকা পূর্ব বাংলায় সম্প্রসারিত হতে শুরু করায় একই ঘটনা সম্ভবত এখানেও ঘটেছে। বিশেষ করে জেলে সম্প্রদায়ই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাছ শিল্পের ক্রমাবনতি ঘটে। ১৯১০ সালের এক প্রতিবেদনে জেলে সম্প্রদায়ের অবস্থায় আগের বিশ বছরের চেয়ে ভীষণ অবনতি ঘটার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই অবনতির পেছনে মূলত মাছ সরবরাহে ঘাটতিকে দায়ী করা হয়, কারণ রেলওয়ে ও স্টিমারের আবির্ভাবের ফলে জেলেরা মাছের পরিবহনকারী এবং মাছের তেলের উৎপাদকের বাড়তি পেশা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
গোয়ালন্দ বা দেমুকদিয়া স্টেশনে টন টন মাছ নিয়ে আসতে দেখা যেত। এখানে যে কেউ চেয়েচিন্তে মাছ নিতে পারলেও কেনার উপায় ছিল না। সন্দেহ নেই, রেলওয়ে লাইন এবং স্টিমার রুট বরাবর সুদূর বাজারে বেশি দাম পাওয়ার কারণে স্থানীয় বাজারগুলো বঞ্চিত হচ্ছিল। বিভিন্ন শহরে অতিরিক্ত মানষের আগমন চাহিদা বাড়িয়েছে এবং এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ এলাকা স্থানীয় যোগান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। (কিরণ চন্দ্র দে, রিপোর্ট অন দ্য ফিশারিজ অভ ই্স্টার্ন বেঙ্গল অ্যান্ড আসাম, পৃ: ৭০)
স্থানীয়, আধুনিক লোকজন এবং রাজনীতি
নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অন্যান্য বিভাগের তুলনায় রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টের কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত ক্ষমতা রয়েছে বলে মনে হয়। ১৯২০-র দশকের গোড়ার দিকে ভারত সরকার বাংলার সরকারকে জনস্বাস্থ্যে রেলওয়ে নির্মাণের প্রভাব জানিয়ে যেকোনও ধরনের লাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে জল নিষ্কাষণের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে একটি কমিটি গঠনের পরামর্শ দেয়। একটি বিজ্ঞপ্তি মারফত রেলওয়ের কর্তৃপক্ষকে যেকোনও রেললাইন নির্মাণের প্রস্তাবিত সময় সম্পর্কে সরকারকে অবহিত রাখারও নির্দেশনা দেয়। একই সময়ে চলমান লাইনের ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শে জানস্বাস্থ্য বিভাগের মূখ্য প্রকৌশলীর নির্দেশনায় ১০জন সার্ভেয়র নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। ভারত সরকার এবং রেলওয়ে বোর্ডকে প্রস্তাবিত জরিপের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু প্রস্তাবিত জরিপ এবং সার্ভেয়রদের নিয়োগের অনুমতি দেওয়ার আগে সেচ সচিব এবং উপনিবেশিক ভারতের অনতম নেতৃস্থানীয় সেচ বিশারদ মিস্টার অ্যডামস উইলিয়ামস রেলওয়েকে অবশ্যই নির্দিষ্ট মাত্রায় নিশ্চিতভাবে স্বাভাবিক নিষ্কাষণে বাধা সৃষ্টিকারী এম্ব্যাঙ্কমেন্টের কাজ নিয়ে আগে বাড়তে হবে বলে প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। রেলওয়ে লাইনের পাশের নালা ভরাটের জন্যে নতুন করে নালা খুড়তে হবে, এবং সবচেয়ে কাছের নদীর সাথে সংযুক্ত করে দেওয়াই এসব নালার পানি নিষ্কাষণের একমাত্র উপায় হবে বলে তাদের ধারণা ছিল। এই ধরনের নালা বেশি গভীর হলে ‘লাইনের পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে’ দাঁড়াবে। এই ফাইল এরপর জনস্বাস্থ্য বিভাগে পাঠানো হলে এবার একটি নতুন প্রস্তাব খাড়া করে তারা। কিন্তু এটিও সেচ বিভাগ নাকচ করে দেয়। আরও কিছু আমলাতান্ত্রিক তৎপরতা শেষে গোটা প্রকল্পই ভেস্তে যায়।
রেলওয়ে লাইনকে প্রবল স্রোত বা অন্য যেকোনও ধরনের হুমকি থেকে ‘রক্ষার’ ধারণা আধুনিক প্রকৌশলীদের আকৃষ্টকারী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হওয়ার বিষয়টি খানিকটা সত্যি হয়ে আছে। ১৯৩৪ সাল থেকে মুর্শিদাবাদ-রাজশাহী সীমান্তের কাছে ধুলিয়ান মিউনিসিপালিটি এলাকায় এক বছর অন্তর বন্যা হচ্ছিল। ম্যালেরিয়া প্রকৌশলী লক্ষ করেন, পশ্চিমে বৃষ্টিপাত বা পশ্চিমে গঙ্গার উপচে আসা পানি, অথবা দুকারণেই এমন হচ্ছে। প্লাবনের গতিপথ হিসাবে নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে একমত হয়ে নতুন আউটলেট প্লাবনের পানি হ্রাসে তেমন প্রভাব সৃষ্টি করবে না বলে সিদ্ধান্তে পৌঁছান তিনি। রেলওয়ের এম্ব্যাঙ্কমেন্ট হয়ে পানি প্রবাহের জন্যে নতুন আউটলেট খোলার বিষয়টি নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি প্রকৌশলী অবশ্য রেলওয়ে বরাবর নালায় পানি জমা হওয়ার কথা স্বীকার করে বন্ধ্যা পানির অবস্থার উন্নতির জন্যে ‘লাইনের ক্ষতি এড়াতে’ জমা পানি ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার কথা ভেবেছেন। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় আউটলেট খোলা হলেও এবং রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তরফে যোগানো আউটলেটের ‘পর্যাপ্ততা’র পক্ষে তাত্ত্বিক সাফাই গাওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় লোকজন সবসময় এম্ব্যাঙ্কমেন্টের ব্যাপারে অস্বস্তিতে ভুগেছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৩৮ সালে খোদ ধুলিয়াতেই স্থানীয় লোকজন এক হয়ে লাইনের ভেতর দিয়ে পশ্চিমে পানি নিষ্কাষণের জন্যে এম্ব্যাঙ্কমেন্ট কাটার আবেদন জানালে এমন ঘটেছিল। জন স্বাস্থ্যের পরিচালকের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে কর্তৃপক্ষ নিজেদের ‘আধুনিক’ জ্ঞানের উপর জোর দিয়েছে: ‘এলাকার প্রাচীন লোকজন যাই বিশ্বাস করুক না কেন, আরও বেশি রেলওয়ের আউটলেট সমাধান হতে পারে না।’ শেষপর্যন্ত রেলওয়ের সাথে সম্পর্কিত নির্মাণ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয় পরিবেশ বা কৃষি নয় বরং আর্থিক যৌক্তিকতার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। স্থানীয় বা তথাকথিত শিক্ষিত গোষ্ঠী বা রেলওয়ে বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করেন না এমন একজন সরকারী নির্বাহী প্রকৌশলী মন্তব্য করেছেন:
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দারা সঠিক বা নিবিড় পর্যবেক্ষকের কোনওটাই নয়, আর পূর্ব ধারণার কারণে শিক্ষিত শ্রেণীগুলো এতটাই পক্ষপাতপূর্ণ যে তাদের মত সরাসরি গ্রহণ করা সম্ভব নয়। প্লাবনের সময় উপস্থিত একমাত্র প্রশিক্ষিত জরিপকারী হচ্ছে রেলওয়ের কর্মকর্তারা। এমনকি তাদের সাক্ষীও চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়া যাবে না, কারণ তাদের প্রধান উদ্দেশ্য রেলওয়ের পক্ষাবলম্বন করা। (রিপোর্ট অন দ্য হাউড্রলিক কন্ডিশন অভ এরিয়া অ্যাফেক্টিড বাই দ্য নর্থ বেঙ্গল ফ্লাডস, পৃ: ৭)
উপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় তৈরি হওয়া প্রকৌশলীরা পরিস্থিতি সম্পর্কে পল্লী এলাকার প্রচলিত ধ্যানধারণা থেকে বহুদূরস্ত পরিবেশে প্রশিক্ষণ পাওয়ার বাস্তবতায় ‘স্থানীয়’ বিষয়আশয়ের প্রতি এমনি বৈরী মন্তব্য অবশ্য বিস্ময়কর ছিল না। পাশাপাশি সম্ভাবনাময় প্রকৌশলীদের সম্পর্কিত প্রচুর কোর্স নিয়ে পড়ার কথা থাকলেও দেখা গেছে যে, যেকোনও বিষয়ে প্রয়োগিক পরীক্ষার নিয়ম স্পষ্টতই বাদ দেওয়া হয়েছিল।
দ্য রয়্যাল কমিশন অন এগ্রিকালচার ইন ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন বাংলার জলপথের প্রশ্নে কিছুটা মনোযোগ দিয়ে বিভিন্ন এম্ব্যাঙ্কমেন্ট বিভিন্ন নদীর তলদেশ উঁচু করে সেগুলোর অবনতি ঘটানোর কথা উল্লেখ করে। প্রতিবেদনটি এরপর সরকারকে বাংলার জন্যে একটি প্রাদেশিক ওয়াটারওয়েজ বোর্ড প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেয়। ১৯৩২ সালে বাংলার সরকার এমনি একটি বোর্ড গঠনের ঘোষণা দেয়। কিন্তু সমসাময়িক সমালোচক যেমন উল্লেখ করেছেন, প্রস্তাবিত ওয়াটারওয়েজ বোর্ড কেবল বাণিজ্যিক স্বার্থই তুলে ধরেছে এবং জনস্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিনিধিত্বের বিধান রাখেনি।
সমাজের অভ্যন্তর থেকে প্রতিক্রিয়া
উপনিবেশিক শক্তি কেন্দ্র, সমকালীন প্রযুক্তিগত সাফল্য এবং সামরিক বিবেচনার মিশেল বাংলায় রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করলেও একথা মনে রাখতে হবে যে রেলওয়ে বরাবর একতরফাভাবে উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া উপনিবেশিক প্রকল্প নয়। এটা প্রায়ই স্থানীয় ভূস্বামী অভিজাত গোষ্ঠী, মহাজন এবং তথাকথিত ভদ্রলোক সমাজের দাবী হয়ে থাকে। এরা তাদের স্বার্থ, অনুভূতির সাথে বিপুলভাবে মানানসই মনে হওয়ায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে রেল লাইনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকে। ভদ্রলোকের দীর্ঘদিনের পুরোনো সাহিত্যে রেলওয়েকে তাই এক বিপুল বিস্ময়ের বস্তু এবং অনুমোদনযোগ্য পৌরুষ হিসাবে দেখা হয়েছে। ভদ্রলোকদের সাথে রেলওয়ে সংক্রান্ত কোনো বিরোধ থাকলেও সেটা খোদ রেলওয়ের বিরুদ্ধে নয়, বরং ভদ্রলোক এবং শ্বেতাঙ্গ যাত্রীদের ভেতর সামাজিক বৈষম্যের বিরোধ ছিল। স্থানীয় জল নিষ্কাষণ ও জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর বিবেচনায় ঢাকা এবং পদ্মার আরিচা স্টিমার স্টেশনকে সংযুক্ত করার লক্ষ্যে উঁচু এম্ব্যাঙ্কমেন্ট রেলরোড নির্মাণে অনুমোদন না দেওয়ার সরকারী সিদ্ধান্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অমৃতবাজার পত্রিকা প্রবলভাবে প্রকল্পকে অবহেলা করায় প্রস্তাবের পক্ষে উপনিবেশিক সরকারকে আক্রমণ করে দেশ যতদিন পরাধীন থাকছে ততদিন এই ধরনের অন্যায় মেনে নেওয়া ছাড়া কিছুই করার নেই বলে মন্তব্য করে।
রেলওয়ে এবং এর আনুষঙ্গিক বিভিন্ন দিক এমনকি বিচ্ছিন্ন ও পরোক্ষে কিভাবে কৃষি ভিত্তিক সমাজে ভাঙন সৃষ্টি করে একটি খাল, স্থানীয় বনেদী সমাজ এবং দরিদ্র কৃষক সম্প্রদায়ের এক ধরনের জটিল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাকে তার নজীর হিসাবে দেখানো যায়। ১৯০৯ সালে পাবনার উল্লাহপাড়া পুলিস স্টেশনের ‘৪৭ গ্রামের বাসিন্দা’ সরকারের কাছে গাতিনা খাল পুনর্খননের আবেদন জানায়। আবেদনপত্র মোতাবেক বর্ষাকালে বন্যার পানি এই অঞ্চলের উপর দিয়ে গাতিনা নামে এক জায়গায় ফুলঝুড়ি নদীতে পড়া গাতিনা খাল দিয়ে প্রবাহিত হতো। বন্যার পানি ক্ষেতে উর্বর পলিমাটির স্তর ফেলে যাওয়ায় খালটিকে এলাকার পক্ষে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হতো। কিন্তু সম্প্রতি খালটি বুজে যাওয়ায় এবং খালের পানিতে পাট জাগ দেওয়ার কারণে অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করেছে। পাট জাগের কারণে বন্ধ্যা পানি দুর্গন্ধময় এবং ‘ম্যালেরিায়ার আতুড়ঘর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য পাটের অন্যতম উৎপাদনকারী দেশ হওয়ায় পাট জাগ বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। এই গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে যতদিন পানির মুক্ত প্রবাহে বাধা ছিল না, ততদিন পাট জাগের কারণে দূষিত পানি আটকাতো না, গ্রামের লোকজন ম্যালেরিয়া কি তাও জানতো না। সুতরাং খালে মুক্ত প্রবাহ সৃষ্টিই এর সমাধান। জনস্বাস্থ্য বিষয়ের পাশাপাশি এই আবেদনে খালটির ক্রমে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নৌ-চলাচলের সমস্যার কথাও বলা হয়েছে। আশপাশের গ্রামবাসীরা তাদের পাট নিকটতম বাজারে নিতে পারছে না। পাট ব্যবসায়ীরাও সুবিধাজনকভাবে এইসব গ্রামে আসতে পারছে না। ফলে গ্রামবাসীরা আশপাশের পাট বাজারের তুলনায় মণ প্রতি আট আনা বা তারও চেয়ে কম দামে পাট বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছে।
এমনি অবস্থায় গ্রামবাসীরা সরকারের কাছে খাল পুনঃখননের জন্যে ৩ হাজার রূপি বরাদ্দের আবেদন জানায়। সরকার অবশ্য এই অর্থ বরাদ্দে তৈরি ছিল না, তবে আবেদনকারীদের ‘ভূমি উন্নয়ন ঋণ’ নামে একটি ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু আবেদনের নেপথ্যে যারা ছিলেন, অর্থৎ, সালাপের জমিদাররা এই ধরনের ঋণ নিতে রাজি হননি। আবেদনের পর কোনও উন্নতি না ঘটায় আনুমানিক ১২ বছর পর, ১৯২৩ সালে সালাপের জমিদারদের তরফে আরেক দফা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এলাকার জনগণ খননের জন্যে ৭৫০ রূপি যোগাড় করতে পারলে কাজটি হাতে নেওয়ার প্রস্তাব রাখে। অবশ্য, ১৯২৪ সালের জানুয়ারিতে চাঁদা তুলে এই টাকা যোগাড় হলেও ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান আবেদনকারীদের খাল পুনঃখননের বিরুদ্ধে কিছু লোকের আপত্তি উত্থাপন করার কথা জানান। আপত্তি মেটানোর পরেই কাজে হাত দেওয়া যেতে পারে। পাল্টা এই আবেদন গোটা ঘটনাকে ভিন্ন আলোয় নিয়ে আসে।
জমিদার এবং অন্য আবেদনকারীদের প্রসঙ্গ তুলে নতুন পাল্টা আবেদনকারীরা খাল পুনঃখননের বিরুদ্ধে আপত্তির পক্ষে বেশ কয়েটি বিষয় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের কাছে দাখিল করে। নিজেদের সামান্য জমির মালিক দরিদ্র কৃষক উল্লেখ করে তারা কর্তৃপক্ষকে সশরীরে এলাকা পরিদর্শন শেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আবেদন জানায়। আবেদনে উল্লেখ করা হয় যে সারা-সিরাজগঞ্জ রেলওয়ে নির্মাণের সময় তাদের বিপুল পরিমাণ জমি রেলওয়ে বোর্ড অধিগ্রহণ করলে তারা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অবশিষ্ট সামান্য জমিও করোতোয়া নদীতে বিলীন হয়ে গেছে এবং নদীর উপর গাদিনা সেতু নির্মাণের পর থেকে এখনও নদীর মূলস্রোতধারা গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জমি হারিয়ে যাচ্ছে। খাল পুনঃখনন করা হলে দরিদ্র এই কৃষকদের অবশিষ্ট জমিও হারানোর শঙ্কা প্রকাশ করে আবেদনকারীরা। করোতোয়া নদীর প্রবাহ তাদের গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ফলে এক সময়ে প্রস্তাবিত খালই খোদ করোতোয়া নদীতে পরিণত হতে পারে। এই অবস্থায় আবেদনকারীরা এমনকি বাস্তুভিটা হারিয়ে ভিখেরিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করে। এলাকার জমির দাম বেশ চড়া ও দুষ্প্রাপ্য উল্লেখ করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও ‘জমি একটা বিরাট সমস্যার ব্যাপার’ হওয়ায় তাদের কোনও উপকার হবে না উল্লেখ করে এই আবেদনকারীরা। এইসব কারণে আবেদনকারীরা খাল পুনঃখননের বিরুদ্ধে ছিল।
১৯২৪ সালের ২৪ শে মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড বেঙ্গল এগ্রিকালচার অ্যান্ড স্যানিটারি ইম্প্রুভমেন্ট অ্যাক্টের অধীনে খনন কাজ হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ১১ই আগস্ট ১৯২৬ পর্যন্ত কোনও ধরনের খনন কাজ হয়নি। মহাফেজখানায় দলিল নেই বলে শেষতক খাল খনন করা হয়েছিল কিনা জানার উপায় নেই। অবশ্য, আবেদন এবং পাল্টা আবেদনের বাস্তবতা প্রকৃত উৎপাদকদের ক্ষেত্রে রেলওয়ে প্রতিষ্ঠার হুমকি এবং তার বিরুদ্ধে উৎপাদকদের প্রতিক্রিয়ার মাত্রাও তুলে ধরেছে। খোদ উপনিবেশিক প্রশাসনের প্রতিষ্ঠিত প্রাতিষ্ঠানিক ধারায় উপরে উল্লেখিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হলেও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভিন্ন ধারণা পোষণ করার মতো কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের সদস্যও ছিল বৈকি। যেমন, ১৯৩৮-৯ সালে ৩৬জন লোককে ১৯৩৯ সালের বন্যার সময় ইবিআরের কালুখালি-ভাটিপাড়া এবং মধুখালি-কামারখালি শাখা লাইনের এম্ব্যাঙ্কমেন্টে ফাটল ধরানোর দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। রেললাইন ধ্বংস করার ইচ্ছা না থাকলেও পানির মুক্ত প্রবাহে বাধা দিয়ে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করায় ‘এম্ব্যাঙ্কমেন্টর ভাঙার অধিকার তাদের আছে’ বলে দাবী করে অভিযুক্তরা।
উপসংহার
পূর্ব বাংলার বদ্বীপ এবং রেলওয়ের সংযোগের প্রভাব বিশ্লেষণের লক্ষ্যে এই নিবন্ধটি উপনিবেশিক প্রশাসন এবং কিছু মাত্রায় স্থানীয় অভিজাত গোষ্ঠীর পক্ষে অঞ্চলের নদী ব্যবস্থার প্রতি রেলওয়ের হুমকির মাত্রা উপলব্ধিতে ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পানির মুক্ত প্রবাহের জন্য যথেষ্ট পথ না রেখে নির্মিত রেলওয়ে এম্ব্যাঙ্কমেন্ট জলাবদ্ধতা তৈরি করে ফসল এবং চাষাবাদের ধরন ধ্বংস করেছে। তাছাড়া, রেলওয়ে প্রায়ই অপ্রত্যাশিত এলাকায় জলধারার অবনতি বা গতিপথ পাল্টানোর কারণ হয়েছে। শহরাঞ্চলে মুনাফা বেশি হওয়ায় ট্রেন চাল এবং মাছের মতো খাদ্য ও পুষ্টির প্রচলিত উৎসকে বিভিন্ন শহরে নিয়ে গেছে, তাতে গ্রামাঞ্চলে দেখা দিয়েছে ঘাটতি। তাছাড়া, পরিসংখ্যানের মাধ্যমে এটা এখন প্রমাণিত যে বিশ শতকের প্রথম কয়েক দশকে বঙ্গীয় বদ্বীপের ডেল্টার চাষযোগ্য জমি বেড়েছে। এখানেই পশ্চিম ও মধ্য বাংলার ক্ষেত্রে এলাকার মূমুর্ষূ অবস্থা ও ম্যালেরিয়ার বিস্তারের ব্যাখ্যা মিলতে পারে। অবশ্য, হরবছর জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জমি এখনও বিপুলভাবে উর্বর থাকা সত্ত্বেও পূর্ব বাংলা বদ্বীপে চাষযোগ্য জমি পতিত থাকার কারণ স্পষ্ট নয়। সুতরাং, এম্ব্যাঙ্কমেন্টের দীর্ঘ হওয়াতে রেলওয়ে অংশত হলেও এর জন্যে দায়ী কিনা, এই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।
এই নিবন্ধটি কিঞ্চিৎ বিষন্ন ছবি তুলে ধরলেও একে রেলওয়ের বয়ে আনা আধুনিক পরিবহন ‘বিপ্লব’ অর্থনৈতিক উন্নতিতে গতি সঞ্চারের বিষয়ে ঐতিহাসিক বিতর্কের প্রেক্ষাপটে এক ধরনের নতুন ভিন্নমত হিসাবে নেওয়া যেতে পারে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে এই বিতর্কের সম্পর্ক যাই হোক না কেন, রেলওয়ের কারণে কৃষিভিত্তিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার মৌলিক পরিবেশগত উপাদানের স্থানচ্যুতির সম্ভাবনাটি বিশেষত পূর্ববঙ্গের নদীবহুল অঞ্চল এবং অন্যান্য নদীপ্রধান এলাকায় রেলওয়ে পরিচালনা সম্পর্কে আরও পর্যালোচনার কথাই বলে।