বাঙালি মুসলমানের হজের স্বপ্ন এবং আমার কিছু কথা
- আপডেট সময় : ০৮:০৩:২৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ৪ জুন ২০২২ ২০ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ সৌদি আরবে হজ পালন করতে যান, তাদের একটি বিরাট অংশই অবসরভাতার টাকায় বা সারাজীবনের উপার্জন থেকে অল্প অল্প করে সঞ্চয় করা অর্থে হজ পালন করেন৷
বেশিরভাগেরই থাকে না বিদেশে ভ্রমণের পূর্ব অভিজ্ঞতা৷ জীবনের শেষ বেলায় শারীরিক সামর্থ্যও অনেক কমে আসে৷ ফলে হজের শ্রমসাধ্য সব নিয়ম পালন তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে ওঠে
মুসলমান বাঙালি মাত্রই মনের কোণে হজের স্বপ্ন লালন করেন৷ ইসলাম ধর্মের যে পাঁচটি স্তম্ভ, যা অবশ্যই পালন করতে হবে, তার একটি হজ৷ তবে হজ সবার জন্য নয়, বরং সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্যই হজ পালন ফরজ৷
অনেক বাঙালির এই সামর্থ্যবান হয়ে উঠতে জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়৷ নানা উপায়ে তারা হজে যাওয়ার অর্থ জোগাড় করেন৷ বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নে মসজিদভিত্তিক মক্তবের শিক্ষক আয়ুব আলী৷ পাথরঘাটা আমার নানা শ্বশুরবাড়ি৷ সেখানে কথা হয় আইয়ুব আলীর সঙ্গে৷ নিম্নমধ্যবিত্ত এই শিক্ষক মক্তবে পড়িয়ে মাত্র চার হাজার টাকা পান৷ সামান্য ওই বেতন থেকেই তিনি হজের জন্য টাকা জমাতে শুরু করেন৷ সঙ্গে বাড়ির পাশে জমিতে আগেই কিছু গাছ লাগিয়েছিলেন৷
হজ ফরজ
বদলি হজ
তবে…
বদলি হজের খরচ
মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ
হারাম সম্পদ দিয়ে হজ সংক্রান্ত হাদিস
সরকারের টাকায় হজ বৈধ
‘‘আমি ২০১১ সাল থেকে হজের জন্য টাকা জমাতে শুরু করি৷ যে টাকা জমাতাম, তা নিজের কাছে না রেখে ব্যাংকে রাখতাম যাতে ঠেকে (বিপদে পড়লে) গেলেও ওই টাকা খরচ করতে না পারি৷ ব্যাংক থেকে আমি কোনো সুদ নেই নাই৷ যা টাকা রাখছি, সেটাই তুলছি৷ আর গাছ লাগানোর সময় আল্লাহকে বলেছিলাম গাছগুলো যেন তাড়াতাড়ি বড় হয়৷ মরার আগে সেগুলো বিক্রি করে হজে যেতে চাই৷’’
‘‘আল্লাহ আমার ইচ্ছা পূরণ করেছেন৷ জমানো টাকা আর গাছ বিক্রির টাকা মিলিয়ে ২০১৯ সালে আমি হজ করে এসেছি৷’’
আইয়ুব মামার হজের স্বপ্ন পূরণ হলেও সবার ভাগ্যে তা হয় না৷ আমার দাদার বাবা (বড়আব্বা বলি আমরা) মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে নিহত হন৷ ছোট বেলায় দাদার কাছে শুনেছি ওনার বাবার খুব হজে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, এজন্য কোরআন শরীফের ভেতর টাকা জমাতেন, গ্রামের মানুষ তার সেই ইচ্ছার কথা জানতেন৷ নিজের বাড়ির উঠানে যেদিন ওনাকে গুলি করা হয়, তখন তিনি কোরআন পড়ছিলেন৷ দাদারা বাড়িতে ফিরে ওনার রক্তাক্ত মৃতদেহ পান, কোরআন শরীফের ভেতর টাকা ছিল না!
নিজের বাবার অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করতে দাদা হজে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নানা কারণে তিনিও যেতে পারেননি৷
বাংলাদেশে অনেকেই এভাবে বাবা-মা’র অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করতে হজে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন৷
যেমনটা করেছেন ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা শাহনাজ চৌধুরী৷ তিনি ২০১৬ সালে মা-কে নিয়ে হজে যান৷ তিনি বলেন, ‘‘আব্বা মারা যাওয়ার পর প্রায়ই আম্মা বলতেন, তোমার আব্বার খুব হজ করার ইচ্ছা ছিল৷ আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি৷ সেখানেও দেখতাম কেউ কেউ হজে যাচ্ছেন৷ সেই দেখে আমারও ইচ্ছা হলো৷ আমার স্বামীর সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বললাম৷ ও ওর মা-সহ যেতে চায়৷ আমি বললাম, তাহলে আমিও আম্মাকে নিয়ে যাই৷’’
‘‘মা ও শাশুড়ীকে নিয়ে আমরা হজে যাই৷ ওনারা দুইজনই বেশ বয়স্ক মানুষ৷ ফলে ওনাদের নিয়ে চলাফেরায় বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল, হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হয়েছে৷ ওখানে গিয়ে মনে হয়েছে, আরেকটু আগে এলেই পারতাম৷’’
বেশির ভাগের বেলায় এই ‘আরেকটু আগে’ আর হয়ে ওঠে না৷ বরগুনা জেলার আমতলী উপজেলা আমতলী সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রেহানা বেগম৷ অবসরের পর অবসরভাতার টাকায় ২০১৯ সালে স্বামীসহ হজে যান৷ তিনি জানান, হজে যাওয়ার পর তার স্বামী মাহাবুবুর রহমান বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন৷
অনেকদিন ধরে অধ্যাপক রেহানা হজের পরিকল্পনা করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানদের তো আর হঠাৎ করে হজে যাওয়ার সুযোগ নেই, তাদের সেই সামর্থ্য থাকে না৷”
‘‘কিন্তু একটা বয়সের পর তাদের মনে নবীর দেশে যাওয়ার, কাবা দর্শণের ইচ্ছা জাগে৷ আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় অনেকে সেটা পারেন না৷ কেউ কেউ সারা জীবন ধরে সঞ্চয় করে হজে যান, কেউ অবসরভাতা পাওয়ার পর৷ যেমনটা আমরা গিয়েছি৷’’
হজে যাওয়ার পর সেখানকার সেবার মান নিয়ে খানিকটা অভিযোগ করলেন রেহানা বেগম৷ এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে আরো উদ্যোগী হওয়ার অনুরোধ করেছেন তিনি৷
করোনা মহামারির আগে সারাবিশ্ব থেকে প্রতিবছর গড়ে ২৫ লক্ষ মানুষ হজ করতে সৌদি আরব যেতেন৷ ২০১৯ সালে করোনার আগের সর্বশেষ হজটি হয়েছে৷ মহামারির কারণে দুই বছর সীমিত পরিসরে হবার পর এবছর সৌদি আরব সরকার ১০ লাখ মানুষকে হজ করার সুযোগ দিয়েছে৷ কোন দেশের কতজন হজ করার সুযোগ পাবেন সেই কোটাও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে৷
এবার যেহেতু মানুষের সংখ্যা অনেক কম (যদিও হজের খরচ ৫৯ হাজার টাকা বেড়ে গেছে) তাই যারা যাচ্ছেন তারা হয়ত খানিকটা স্বস্তিতে হজ পালন করতে পারবেন৷ না হলে এক সময়ে এত মানুষের উপস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়৷ যার বড় প্রমাণ আমরা দেখেছি ২০১৫ সালে৷ সেবার মারাত্মক ভিড়ে হুড়োহুড়িতে পদদলিত হয়ে সাতশ’র বেশি মানুষের মৃত্যু হয়৷
সৌদি আরবের প্রচণ্ড গরমের মধ্যে ভিড় ঠেলে হাঁটা, ছাফা-মারওয়া পাহাড় দৌড়ানোসহ হজের সময় যেসব নিয়ম পালন করতে হয়, তার জন্য শারীরিকভাব শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন৷ ইসলামেও সামর্থ্য থাকলে তরুণ বয়সে হজ করতে বলা হয়েছে৷ কিন্তু আমাদের তো হজের অর্থ জোগাড় করতেই অনেক বছর পেরিয়ে যায়৷ শেষ বয়সে এসে ধর্ম পালনের প্রতি আগ্রহও বাড়ে৷ বাংলাদেশের হজযাত্রীদের লাইনে তাই বয়স্ক মানুষের প্রাধান্য৷ হজ করে এসেছেন কিন্তু শরীর দুর্বল হয়ে পড়ায় সব নিয়ম ঠিকমতো পালন করতে না পারার আফসোস আমি আমার চেনা-জানা অনেককেই করতে দেখেছি৷
মানুষ তার তিল তিল করে জমানো টাকায় হজে যান৷ বৃদ্ধ বয়সে সব নিয়ম পালন করতে না পারায় আফসোসও করেন৷ আবার এই বাংলাদেশেরই কিছু মানুষ আছেন যারা বার বার হজে যান, বছরে একাধিকবার ওমরাহ পালন করেন এবং বেশ গর্বের সঙ্গে সেগুলো অন্যদের বলে বেড়ান৷ তাদের অনেকেই দুর্নীতির টাকায়, মানুষ ঠকিয়ে, ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম উপার্জনে হজে যান৷ এভাবে তারা হয়ত পাপমোচনের চেষ্টা করেন৷ জানি না তাদের পাপ এতে কতটা কমে বা আদৌ কমে কিনা৷
ইসলাম আমাদের যেমন নামাজ, রোজা ও হজ করতে বলেছে, তেমনি যাকাতও দিতে বলেছে৷ যাকাত গরিবের হক৷ আপনার সম্পদের ঠিক কী পরিমাণ অংশ যাকাত দিতে হবে, সেটা কোরআনে স্পষ্ট করে বলা আছে৷ বারবার হজ করতে যাচ্ছেন, কিন্তু যাকাত ঠিকমতো আদায় করছেন তো? আপনার প্রতিবেশী না খেয়ে আছে কিনা তার খোঁজ কি নিয়েছেন? গরিব আত্মীয়-প্রতিবেশীর খোঁজ রাখা, তাদের সাহায্য করাও ফরজ ও ওয়াজিব ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত৷
হজ শব্দের অর্থ ইচ্ছা করা, সংকল্প করা৷ হজ পালনের সংকল্প করার সঙ্গে সঙ্গে যদি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সংকল্প আমরা করতে পারি, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত আরো অধিক পরিমাণে লাভ করতে পারবো৷