সাবেক তথ্য সচিব মকবুল হোসেন সাহেবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর চেয়ে, যেটি অধিক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, তা হলো- তার বিরুদ্ধে এমন কী ছিল? মকবুল সাহেব নিজেই একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন যেটি হলো তিনি লন্ডনে তারেক জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন কি না? তিনি অবশ্য দেখা করেননি বলে দাবি করেছেন। তারেক জিয়ার সঙ্গে তার দেখা করার প্রশ্নে বেশ কয়েকজন তথাকথিত বিশেষজ্ঞের দাবিদার বলে ফেললেন, দেখা করলে তাতে কী হয়। তাদের মধ্যে একজন অতি পরিচিত, অতি অভিজ্ঞ সাবেক সিনিয়র সচিবও রয়েছেন। পরবর্তীতে অভিযোগটি অস্বীকার করলেও কথাটি প্রথম তার মুখ থেকেই উচ্চারিত হয়েছে। যারা বলে বেড়াচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাতে দোষ কী, তারা বেমালুম ভুলে যাচ্ছেন যে তারেক জিয়া বিদেশে পালিয়ে থাকা, আদালতের রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত একজন ফেরারি আসামি। তার সঙ্গে শুধু সচিবই নয়, অন্য কোনো সরকারি চাকরিজীবীর সাক্ষাৎই এমন মারাত্মক ধরনের বেআইনি কাজ যার জন্য তাকে চাকরিচ্যুত করা যায়। শুধু সরকারি চাকরিজীবী নয়, যে-কোনো ব্যক্তি একজন দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে আসামিকে সহায়তা প্রদানের অপরাধে তার সাজাও হতে পারে। এমনকি তারেক জিয়া দণ্ডিত আসামি না হলেও তার সঙ্গে কোনো সরকারি চাকরিজীবীর সাক্ষাৎ নিশ্চয়ই চরম আপত্তিকর হতো, কেননা সে যে লন্ডনে বসে প্রতিনিয়ত কুখ্যাত জঙ্গি দাউদ ইব্রাহিম এবং পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করছে, তা-ও কারও অজানা নয়। সে অবস্থায় কোনো চাকরিজীবী তার সঙ্গে দেশের বাইরে গোপন ‘অভিসারে’ মিলিত হলে, সন্দেহের তীর তার দিকে যেতে বাধ্য। তদুপরি মকবুল সাহেব পল্টনে বিএনপি অফিসের উল্টো দিকে জনৈক বিএনপি নেতার অফিসে প্রায়ই যেতেন বলে অভিযোগটি স্বীকৃত। বিএনপির কর্মকাণ্ড সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকলে, কোনো চাকরিজীবী তাদের সঙ্গে দেখা করলে প্রশ্ন উঠত না, কিন্তু বিএনপির রাজনীতি তো ষড়যন্ত্র এবং জ্বালাও-পোড়াওভিত্তিক, আর সেখানেই আপত্তি।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে গণতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতা লাভের পর বহু কর্মকর্তাকেই অবসরে পাঠানো উচিত ছিল, যা তারা করেনি, যার উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ বিমানের সাবেক প্রধান ড. মোমেন, যিনি উত্তরা ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকাকালে হাতেনাতে ধরা পড়েছিলেন। বহু বছর পরে অবশ্য তাকে অবসরে পাঠানো হয়েছিল। যে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানো হলো, দেখা যায় বিএনপির শাসনামলে তারা গুরুত্বপূর্ণ জেলায় এসপি পদে কর্মরত ছিলেন। উল্লেখ্য, গুরুত্বপূর্ণ জেলায় এসপি পদে তাদেরই নিয়োগ দেওয়া হয় যারা সরকারের অতি বাধ্য। এটা কারোরই অজানা নয় যে, বিএনপি রাজত্বকালে বিভিন্ন জেলার এসপিরা কী ধরনের অরাজকতা চালিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে কোহিনুর নামক সাবেক এসপি অন্যতম।
অনেকে মনে করেন বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ক্ষমতা সরকারের থাকা উচিত নয়। যারা বলেন সরকারি চাকরিজীবীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, তারা বিস্ময়করভাবে ভুলে যান যে সরকারের নীতি বাস্তবায়ন করাই চাকরিজীবীদের দায়িত্ব, তারা নীতি প্রণয়নকারী নন। সরকারের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যের বিকল্প তাদের নেই। তাই সরকারের হাতে এহেন ক্ষমতা অপরিহার্য, যাতে সরকারি চাকরিজীবীরা সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধ্য থাকে। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের হাতে একই ক্ষমতা রয়েছে। যুক্তরাজ্যে এ ক্ষমতা আরও কঠোর, যেখানে সরকারি চাকরিজীবীদের চাকরিসংশ্লিষ্ট স্টেচুটারি বিধান সাপেক্ষে, সরকারি চাকরি রানির প্রোগেটিভ, যা সরকার প্রয়োগ করে থাকেন, ক্ষমতাধীন, যাকে বলা হয়- ‘প্রিন্সিপাল অব সেটিসফেকশন’ভিত্তিক। অর্থাৎ সরকার চাইলেই, স্টেটুচারি বিধানের নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে, কোনো চাকরিজীবীকে অপসারণ করতে পারে, যদিও এ ধরনের ঘটনা যুক্তরাজ্যে খুবই বিরল, কেননা সেখানকার সরকারি চাকরিজীবীরা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সর্বদা সচেতন থাকেন। ভারতেও একই ধরনের আইন রয়েছে, পাকিস্তান এবং ব্রিটিশ যুগেও এ ধরনের আইন ছিল। এ ব্যাপারে আমাদের আপিল বিভাগ বলেছেন, ‘এটা ঠিক যে আপিলকারীর (মানে সরকারের) ক্ষমতা থাকা উচিত কোনো অবাঞ্ছনীয়, অদক্ষ, দুর্নীতিপরায়ণ, বেআদব এবং অবাধ্য সরকারি কর্মকর্তাদের অপসারণের। তবে সে ক্ষমতা ন্যায়সংগতভাবে ব্যবহার করতে হবে’ (বিএডিসি বনাম শামসুল হক, ৬০ নম্বর ডিএলআর)। অনেকে বলছেন, কোনো সরকারি চাকরিজীবী বিধান ভঙ্গ করলে তাকে তো আইন মোতাবেকই প্রয়োজনে চাকরিচ্যুত করা যায়। কথাটি আক্ষরিক অর্থে ঠিক হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ অত সহজ নয়। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী, জটিল প্রক্রিয়া, অর্থাৎ তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হলে সেই দীর্ঘস্থায়ী জটিল প্রক্রিয়া অচল। তদুপরি পুরো প্রক্রিয়ার সময়ই সংশ্লিষ্টকে অবশ্য বেতন দিতে হয় এবং ওএসডি করা হলে তার জন্য দফতরে স্থান রাখতে হয়, সহকারী কর্মচারী রাখতে হয় ইত্যাদি। বাধ্যতামূলক অবসরের পন্থা চাকরিজীবীর জন্যও মঙ্গলকর, কেননা তিনি তার পেনশন সুবিধা পুরো পেয়ে থাকেন, যা চাকরিচ্যুত হলে পাবেন না। মকবুল সাহেব একজন বহু বছর চাকরি করা সরকারি কর্মকর্তা হয়েও একটি অর্বাচীনসুলভ কথা বলে নিজের প্রজ্ঞা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন ফাঁসির আসামিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়, যা তাকে দেওয়া হয়নি।
এক টকশোয় সেই অতি পরিচিত সাবেক সচিব সাহেবও একই কথা বলেছেন। একজন সচিব হিসেবে তার জানা উচিত ছিল বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয় বলে আমাদের উচ্চ আদালত বহুবার রায় দিয়েছেন। জনস্বার্থে কোনো চাকরিজীবীকে অপসারণের জন্য সরকারের হাতে এটি একটি অতি প্রয়োজনীয় বিশেষ ক্ষমতা, যার জন্য কোনো কারণ দেখাতে হয় না। তবে সরকারকে এ ক্ষমতা ন্যায্যভাবে প্রয়োগ করতে হয়। রিট মামলা হলে চাকরিজীবী তবেই সফল হন, যদি সরকার জনস্বার্থে বিষয়টি প্রমাণে ব্যর্থ হয়।
অথবা দেখা যায় জিঘাংসামূলক বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সরকার তার ডিক্রেশন প্রয়োগ না করে বরং ‘যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’ নীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তা না হলে চাকরিজীবী রিট করে কোনো ফল পাবেন না। এক টকশোয় প্রশ্ন করা হয়েছে- এ অবসরে পাঠানোর ঘটনাগুলো প্রশাসনে কী বার্তা দেবে? অনেকেরই ধারণা, এটি প্রশাসনে এমন প্রয়োজনীয় বার্তা দেবে যাতে বিপথগামীরা সতর্ক হয়ে বিধিবহির্র্ভূত বা অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকেন।
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি