বাশার ক্ষমতায় টিকলেন দুই যুগ

- আপডেট সময় : ১২:১৪:১১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
- / 101
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়া। ধন-মান-ঐতিহাসিক পুরাকীর্তিতে একসময়ের বেশ সমৃদ্ধ দেশটি এখন রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে চলছে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। ১৩ বছর পরও লড়াই-রক্তপাত থামেনি। এরই মধ্যে ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে সিরিয়া। গাজা, লেবানন আর ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ববাসী যখন সরব, ভুগছেন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়; তখন নতুন করে আলোচনায় সিরিয়া।
সিরিয়ার কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবে আসবে আল-আসাদ পরিবারের কথা। কেননা, টানা পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে সিরিয়া শাসন করছে পরিবারটি। এর মধ্যে ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন হাফিজ আল-আসাদ। ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপর ওই বছরই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তাঁর ছেলে বাশার আল-আসাদ। টানা দুই যুগ (২৪ বছর) ধরে তিনি প্রেসিডেন্ট পদে আছেন।
সম্প্রতি সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের (আলেপ্পো ও হামা) নিয়ন্ত্রণ নেন বিদ্রোহী যোদ্ধারা। এরপর হোমসসহ অন্যান্য শহরের নিয়ন্ত্রণ নেন তাঁরা। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নেতৃত্বে থাকা হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করা তাঁদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
এখন যে গৃহযুদ্ধ চলছে, সেটা শুরু হয়েছিল বাশার আল-আসাদের শাসনকাঠামোর বিরুদ্ধে জনগণ, বিশেষ করে দেশের বেকার তরুণদের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ থেকে। তারুণ্যের সেই প্রতিবাদ দমাতে খড়্গ হাতে তুলে নেন বাশার। এতে রাজপথে রক্ত ঝরে, অশান্তি ও সংঘাত ছড়ায় দেশজুড়ে। এরপর সিরিয়া সংকটে একে একে জড়িয়ে পড়ে আঞ্চলিক শক্তি থেকে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলো।
অতিসম্প্রতি সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের (আলেপ্পো ও হামা) নিয়ন্ত্রণ নেন বিদ্রোহীরা। পরে কৌশলগত হোমসসহ অন্যান্য শহরের নিয়ন্ত্রণ নেন। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নেতৃত্বে থাকা হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে উৎখাত করা তাঁদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট আসাদ উড়োজাহাজে করে রাজধানী দামেস্ক ছেড়েছেন বলে আজ রোববার জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। তবে তিনি কোথায় গেছেন, সেটা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
হাফিজ আল-আসাদকে ‘আধুনিক সিরিয়া’র রূপকার বলা হয়। ১৯৩০ সালে সিরিয়ায় তাঁর জন্ম। ছিলেন আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টির নেতা। ১৯৪৬ সালে দলটির রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি। ১৯৫৫ সালে হাফিজ বিমানবাহিনীর পাইলট হিসেবে যোগ দেন।
সিরিয়ায় বাথ পার্টিকে শক্তিশালী করতে হাফিজের ভূমিকা ছিল। ১৯৬৬ সালে দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন হাফিজ। রাজনৈতিকভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে নিজ রাজনৈতিক গুরু ও সিরীয় নেতা সালাহ আল-জাদিদকে সরাতে অভ্যুত্থান ঘটান হাফিজ। পরের বছরই সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বরাবর ‘খেলুড়ে’ নেতা ছিলেন হাফিজ আল-আসাদ। ১৯৭৩ সালে মিসর-ইসরায়েল যুদ্ধে তিনি মুসলিম মিত্র কায়রোর পক্ষে অবস্থান নেন। প্রায় দুই দশক পর ১৯৯১ সালে তিনিই আবার ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। ইসরায়েলের দখলে থাকা গোলান মালভূমি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় ভূমিকা রাখেন।
ইরাকের নেতা সাদ্দাম হোসেনকে ‘দীর্ঘদিনের শত্রু’ মনে করতেন হাফিজ। ১৯৯০-৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে সিরিয়া বাগদাদের বিপক্ষে ছিল। তিনি এ যুদ্ধে পশ্চিমা জোটকে সমর্থন দিয়েছিলেন।
টানা ২৯ বছর ক্ষমতায় থেকে ২০০০ সালের ১০ জুন দামেস্কে মারা যান হাফিজ। এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের দ্বিতীয় প্রজন্মের শাসনের সূচনা হয়। ওই বছরের ১৭ জুলাই প্রেসিডেন্ট পদে বসেন তাঁর ছেলে বাশার আল-আসাদ।
টানা ১৩ বছর ধরে চলা গৃহযুদ্ধে সিরিয়ায় ৫ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। উদ্বাস্তু হয়েছেন দেশটির প্রায় অর্ধেক মানুষ। ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ মানবিক সংকট শুরু হয় সিরিয়ায়। এত কিছুর পরও আসাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না; বরং নিজের কর্তৃত্ব আরও পাকাপোক্ত করেন।
বাশারের জন্ম ১৯৬৫ সালে, দামেস্কে। শৈশবে দামেস্কে পড়াশোনা শুরু। তিনি দামেস্ক ইউনিভার্সিটি থেকে চক্ষুবিজ্ঞানে পড়েছেন। হতে চেয়েছিলেন চিকিৎসক। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় পারদর্শী তিনি।
হাফিজ আল-আসাদ তাঁর দীর্ঘদিনের শাসনে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিজের পছন্দের ও বিশ্বস্ত লোকদের নিয়োগ দিয়েছিলেন। তাঁদের মাধ্যমে দেশ শাসন করতেন তিনি। বাশার ক্ষমতায় এসে এ পদগুলোয় পরিবর্তন আনতে শুরু করেন। বিশেষ করে নিরাপত্তা সংস্থা ও সামরিক বাহিনীতে রদবদল করেন। নিজের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে বসিয়ে প্রশাসনের লাগাম শুরু থেকেই নিজের হাতে রাখেন বাশার।
নিজের নাম গোপন রাখার শর্তে বাশারের সঙ্গে দেখা করার অভিজ্ঞতা জানিয়ে ওই সাংবাদিক বলেন, ‘প্রতিবারই তাঁকে বেশ শান্ত দেখেছি। এমনকি যুদ্ধের চরম উত্তেজনার সময়ও বেশ শান্ত থাকেন। বাবার কাছ থেকে এ গুণ পেয়েছেন তিনি।’
৩৪ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট
হাফিজ আল-আসাদের উত্তরসূরি হওয়ার কথা ছিল না তাঁর ছোট ছেলে বাশার আল-আসাদের। প্রথা মেনে হাফিজের পর তাঁর বড় ছেলে বাসেল আল-আসাদ ক্ষমতার কেন্দ্রে আসবেন, এটাই ভেবেছিলেন অনেকে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় বাসেলের মৃত্যু হয়। এতে সিরিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যায়।
বাবার উত্তরসূরি হিসেবে দৃশ্যপটে আসেন বাশার আল-আসাদ। তখন বাশার যুক্তরাজ্যের লন্ডনে চক্ষুবিজ্ঞানে উচ্চতর পড়াশোনা করছিলেন। বাবার নির্দেশে দেশে ফেরেন। এরপর সিরিয়ায় সামরিক বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। রাজনৈতিক বিষয়ে হাতে-কলমে জ্ঞানার্জন করতে থাকেন।
কাজেই বলা যায়, বাশারকে তাঁর বাবাই একজন শাসক হিসেবে গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। ২০০০ সালে বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি দেশের শাসনভার নিজের কাঁধে তুলে নেন। ২০০৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাশার পুনর্নির্বাচিত হন।
শাসনামলের শুরুর দিকে বাশার সংস্কারের ভূমিকা রাখেন। প্রশাসনিক-রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলা ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথে হাঁটেন। এ ক্ষেত্রে বাবার আমলের বেশ কিছু কঠোর নিষেধাজ্ঞা শিথিল করেন তিনি। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরোধী তিনি।
প্রেসিডেন্ট হয়েও শুরুর দিকে আসাদকে সাধারণ জীবন কাটাতে দেখা যেত। গাড়ি চালাতেন নিজেই। ব্রিটিশ-সিরীয় স্ত্রী আসমাকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তোরাঁয় নৈশভোজে যেতেন। ওই সময় তরুণ, পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ও আধুনিক মানসিকতার বাশার সিরীয়দের কাছে পছন্দের মানুষ ছিলেন।
তবে পরিস্থিতি ক্রমেই বদলে যায়। সংস্কারকের ভূমিকা থেকে আসাদ কর্তৃত্ববাদী শাসক হয়ে উঠতে শুরু করেন। বিরোধী মত দমনে তাঁর কুখ্যাতি ছড়াতে থাকে। সিরিয়ায় গ্রেপ্তার করা হয় অনেক সরকারবিরোধী শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীকে। তিনি বলেন, ‘পশ্চিমা গণতন্ত্র সিরিয়ার জন্য নয়।’
বাশার ক্ষমতা নেওয়ার আগে থেকেই সিরিয়ার তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও বাক্স্বাধীনতার অভাববোধ থেকে তুমুল হতাশা ছিল, যা উসকে দেয় আরব বসন্ত।
২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার দক্ষিণের শহর দেরাতে প্রথম সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। তবে এর আগে দেশটির বিভিন্ন স্থানে ছোট ও বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ হয়েছিল। বিক্ষোভ দমাতে সরকারি বাহিনীকে মাঠে নামান বাশার। দমন–পীড়নের মুখে বিক্ষোভকারীরা বাশারের পদত্যাগের দাবি তোলেন। এতে বেড়ে যায় দমন–পীড়ন। সেই সঙ্গে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিরিয়ায়।
একপর্যায়ে বাশারবিরোধীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেন। তাঁদের ‘বিদেশি শক্তির মদদে পরিচালিত সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে বাশার সরকার। চলে চরম দমন–পীড়ন। তবে খুব একটা লাভ হয়নি। সিরিয়াজুড়ে শতাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী বাশারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। একের পর এক এলাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দেশটিতে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ।