ভল্টের টাকায় অবৈধ বাণিজ্য
- আপডেট সময় : ০৬:২৫:৩৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৪৮ বার পড়া হয়েছে
রাজধানীর উত্তরার তরুণ ব্যবসায়ী সুজা উদ্দিন। হঠাৎ তার ব্যবসায় পুঁজির সংকট দেখা দেয়। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে মেলে ঝটপট সমাধান। দৃশ্যপটে আসেন সোনালী ব্যাংক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম হাউজ শাখার এক কর্মকর্তা।
তিনি ব্যাংকের সুরক্ষিত ভল্ট থেকে অতিগোপনে বেআইনিভাবে ৫৫ লাখ টাকা বের করে তুলে দেন সুজার হাতে। শর্ত-এক মাস পর সুদ-আসল মিলিয়ে ৭০ লাখ টাকা ফেরত দিতে হবে। কোনো উপায় না থাকায় ভবিষ্যৎ চিন্তা না করেই অস্বাভাবিক চড়া সুদে এই টাকা নেন সুজা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে টাকা ফেরত দিতে না পারায় তাকে নানাভাবে হয়রানির কবলে পড়তে হয়। ফলে ফাঁস করে দেন সোনালী ব্যাংক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম হাউজ শাখায় কর্মরত অসৎ কর্তাদের ভল্টের টাকায় অবৈধ বাণিজ্যের তথ্য।
অভিযোগ আছে-শুধু সোনালী ব্যাংকের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম হাউজ শাখায় নয়, অসৎ কর্মকর্তাদের ভয়ংকর সিন্ডিকেট আছে বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায়। তারা দীর্ঘদিন ধরেই বেআইনিভাবে ভল্টের টাকায় জমজমাট কারবার চালিয়ে আসছে। একাধিক ব্যাংকে এমন জালিয়াতি ও ভল্টের টাকা উধাও হওয়ার ঘটনার তদন্ত চলছে। একটি ঘটনায় মামলাও করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মনিটরিংয়ের অভাবে অবৈধ এ কারবার বন্ধ করা যাচ্ছে না। যুগান্তরের অনুসন্ধানে উল্লিখিত তথ্য পাওয়া গেছে।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মো. সুজা উদ্দিন বলেন, ব্যবসায় মন্দার কারণে সময়মতো টাকা দিতে পারিনি। এখন প্রতিদিন চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ যোগ করা হচ্ছে। এ হারে সুদ দিয়ে টাকা পরিশোধে অপারগতা জানালে আমাকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। সরকার পতনের আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী দিয়ে আমার বাড়ি ও অফিস ঘেরাও করা হয়। দেওয়া হয় হুমকি-ধমকি। তখন আমি প্রাণভয়েও ছিলাম। আমি টাকা যেহেতু নিয়েছি, ফেরত দেব। এজন্য একটু সময় লাগবে। তবে আমার মতো কেউ যেন এই ফাঁদে পা না দেয়। আর ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারা যেন এ অবৈধ ব্যবসা করতে না পারে, সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংকের ভল্টকে বলা হয় মহানিরাপত্তা এলাকা। জনগণের আমানতের একটি অংশ নগদ লেনদেনের জন্য ভল্টে সুরক্ষিত থাকে। তিনজন একত্রিত হয়ে ভল্ট খুলে টাকা বের করতে হয়। আবার তিনজন একত্রিত হয়ে টাকা জমা করতে হয়। ভল্ট থেকে টাকা বের করে কেবল গ্রাহকের সঙ্গে লেনদেন করতে হবে। প্রয়োজনে এক শাখা থেকে অন্য শাখায় স্থানান্তর করা যাবে। কিন্তু ভল্টের টাকা কোনোভাবেই অন্য কাউকে দেওয়ার সুযোগ নেই। সেই সুরক্ষিত ভল্টের টাকা দিয়েই কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে অবৈধ ব্যবসা করছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে এমন অনেক ঘটনা ধরাও পড়েছে।
জানা যায়, সোনালী ব্যাংকের বিমানবন্দর কাস্টম হাউজ শাখার ব্যবস্থাপক নাজমুল আজমের নেতৃত্বে পাঁচ কর্মকর্তার একটি সিন্ডিকেট এ অনৈতিক বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ব্যাংকের অপারেশন অফিসার, দুইজন অফিসার এবং একজন অফিস সহকারী চক্রে জড়িত। এ চক্রের হাতে অর্ধশতাধিক গ্রাহক আছে। যাদের বেশির ভাগ সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী। তারা কাস্টমস থেকে মালামাল ছাড়াতে টাকার সংকটে পড়লে এ চক্রের সদস্যদের দ্বারস্থ হন। ৩ থেকে ৫ দিনের চুক্তিতে দ্বিগুণ হারে সুদ দেওয়ার শর্তে ব্যাংকের ভল্ট থেকে টাকা বের করে দেন চক্রের সদস্যরা। একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপকালে বলেন, অনেক সময় বিমানবন্দরে মালামাল আসার পর তা ছাড় করাতে জরুরি নির্দেশ দেয় কাস্টমস। নির্ধারিত সময়ে মাল ছাড় করাতে না পারলে বড় অঙ্কের জরিমানা গুণতে হয় সিএন্ডএফ এজেন্টদের। প্রতিদিনই বাড়তে থাকে জরিমানার অঙ্ক। ফলে সোনালী ব্যাংকের ওই চক্রের কাছ থেকে দ্বিগুণ হারে সুদে (লাখে লাখ টাকা সুদ) টাকা সংগ্রহ করেন তারা। ব্যাংকের অপারেশন অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন নিজেই ভল্ট থেকে টাকা বের করে দেন। এক্ষেত্রে ভল্ট খোলার নিয়মও মানা হচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিমানবন্দরের সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশন (এসি) সার্ভিসিংয়ের কাজ করেন উত্তরার একজন ব্যবসায়ী। তিনি দীর্ঘদিন এই চক্রের সঙ্গে অবৈধ লেনদেনে জড়িত। সব মিলিয়ে তার লেনদেনের অঙ্ক ৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই ঠিকাদারের মাধ্যমেই উত্তরার তরুণ ব্যবসায়ী সুজা উদ্দিন চক্রের জালে আটকা পড়েন। ৫৫ লাখ টাকা নিয়ে ফেঁসে গেছেন। এক মাসের জন্য ২০ লাখ টাকা সুদ দেওয়ার শর্তে ৫৫ লাখ টাকা নেন তিনি। কিন্তু ব্যবসায় মার খাওয়ায় নির্ধারিত সময়ে টাকা ফেরত দিতে না পারায় চক্রের সেকেন্ড ইন কমান্ড জাহাঙ্গীর হোসেন তার অফিসে গিয়ে হুমকি-ধমকি দেন। একই সঙ্গে তাকে সাফ জানিয়ে দেন টাকা পরিশোধ না করা পর্যন্ত দিনে ৪০ হাজার টাকা সুদ যোগ হবে আসলের সঙ্গে। এ অবস্থায় উপায় না দেখে ব্যাংক কর্মকর্তাদের এ অনৈতিক বাণিজ্যের তথ্য ফাঁস করে দেন। তিনি জানান, প্রতি বৃহস্পতিবার তাদের এ বাণিজ্য বেশি জমজমাট হয়। এদিন অন্তত ৩০-৪০ লাখ টাকা এই ব্যাংকের ভল্ট থেকে অবৈধ উপায়ে বের করে দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংক হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টম হাউজ শাখার ব্যবস্থাপক নাজমুল আজম যুগান্তরকে বলেন, ‘ভল্টের রক্ষিত টাকায় এ ধরনের অনৈতিক ব্যবসার কোনো সুযোগ নেই। কোনো কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যবসা করে থাকলে তার সঙ্গে ব্যাংকের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। কেউ যদি আমার সম্পর্কে এ ধরনের কোনো অভিযোগ করে থাকে, সেটা সত্য নয়।’
একই শাখার অপারেশন অফিসার জাহাঙ্গীর হোসেন এ ধরনের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘প্রতিদিন কর্মঘণ্টার মধ্যেই ভল্টের টাকা মিলিয়ে আমাদের ব্যাংক থেকে বের হতে হয়। এক টাকা গরমিল থাকলে আমরা হিসাব ক্লোজ করতে পারি না। ভল্টের টাকা বের করে কাউকে দেওয়ার সুযোগ নেই।’ তিনদিনের মধ্যে ফেরতের চুক্তিতে বৃহস্পতিবার আপনারা ভল্টের বিপুল টাকা বের করে সিএন্ডএফ এজেন্টদের দেন-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ধরনের অভিযোগ ঠিক নয়।
জানা যায়, চলতি বছরের মার্চে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার তামাই শাখার ভল্টের ৫ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকার গরমিল পাওয়া যায়। ব্যাংকের ম্যানেজারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা চক্র বিপুল টাকা সরিয়ে চাকরির আড়ালে ব্যবসা ফাঁদে। এ কাজে নেতৃত্ব দেন ম্যানেজার আল-আমিন। ভল্টের টাকায় তিনি ঠিকাদারিসহ পার্টনারশিপে ব্যবসা করেন। বিষয়টি নিয়ে জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের উদ্যোগে তদন্ত চলছে।
৩ মার্চ ব্যাংকের ভল্ট থেকে ২৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখার ক্যাশিয়ার ঝন্টু লাল দাশের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। সংস্থাটির হবিগঞ্জ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শোয়ায়েব হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মামলায় ঝন্টু লাল দাশের বিরুদ্ধে ব্যাংকের ভল্ট থেকে দায়িত্ব পালনকালে ২৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, ব্যাংকে কর্মরত থাকা অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এর আগে ২০২১ সালে ইসলামি ধারায় পরিচালিত বেসরকারি খাতের ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখার ভল্টের টাকার হিসাবে গরমিল পাওয়া যায়। কাগজপত্রে ওই শাখার ভল্টে যে পরিমাণ টাকা থাকার তথ্য রয়েছে, বাস্তবে এর চেয়ে প্রায় ১৯ কোটি টাকা কম পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ওই শাখা পরিদর্শনে গিয়ে ভল্ট খুলে টাকা গুনে কাগজপত্রের সঙ্গে বাস্তবে বড় ধরনের গরমিল পান। শাখাটির নথিপত্রে দেখানো হয়, ভল্টে ৩১ কোটি টাকা রয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা গুনে পান ১২ কোটি টাকা। বাকি ১৯ কোটি টাকার ঘাটতি সম্পর্কে শাখাটির কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলকে যথাযথ কোনো জবাব দিতে পারেননি। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ টাকা অবৈধ কারবারে গ্রাহকের হতে তুলে দেয় অসৎ কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী ভল্টের টাকার গরমিল থাকলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হয়। কিন্তু গত ১৬ বছর ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যে যার ইচ্ছামতো চলেছে। নিয়মিত ব্যাংকের ভল্ট পরিদর্শনও করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক কয়েকজন গভর্নরও লুটপাটে মত্ত ছিলেন। তাই কোনো কিছুই কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ছিল না। ব্যাংকের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, ভল্টে ঘোষণার চেয়ে কম টাকা পাওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে খুব বেশি শোনা যায়নি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে জোর দিয়েছে। তাই সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সব শাখায় একযোগে ভল্টের টাকা মিলিয়ে দেখা উচিত।
জানা যায়, সবশেষ ২৯ আগস্ট চাঁদপুরের মতলব উত্তরে অগ্রণী ব্যাংকের ছেংগারচর বাজার শাখার ভল্টে টাকা মেলাতে গেলে ৭৫ লাখ ২০ হাজার টাকা গরমিল পাওয়া যায়। এরপর থেকেই আত্মগোপনে আছেন ব্যাংকটির ক্যাশ কর্মকর্তা দীপঙ্কর ঘোষ। এ ঘটনায় মতলব উত্তর থানায় মামলা করেছেন ব্যাংকের ব্যবস্থাপক মো. ইউসুফ মিয়া। অভিযুক্ত ব্যাংক কর্মকর্তা দীপঙ্কর ঘোষ ২০১৯ সালে অগ্রণী ব্যাংকের মতলব উত্তর থানার ছেংগারচর বাজার শাখায় যোগ দেন। তিনি উপজেলার ছেংগারচর এলাকায় ছেংগারচর সরকারি ডিগ্রি কলেজের পাশে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। বাসাটি তালাবদ্ধ। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ। এর আগে জনতা ব্যাংকের ইমামগঞ্জ শাখা পরিদর্শনে গিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা ভল্টের টাকা গুনে ৩৪ লাখ টাকা কম পান। ওই ঘটনায় চার কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ওইসব টাকা দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হতো। ব্যবসা করে তারা টাকা ফেরত দিতেন।