ভাসানী আমাদের সঙ্গে নাই ৪৮ বছর।
- আপডেট সময় : ০৮:০৮:৩৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ ৬৪ বার পড়া হয়েছে
ভাসানী আমাদের সঙ্গে নাই ৪৮ বছর।
গণঅভ্যুত্থানের ইমাম তিনি, মজলুমের সেনাপতি। তাঁর মতো ‘খামোশ’ বলে হুংকার দেবার কেউ না থাকলেও ২০২৪-এ জনগণ শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে। এটা অভূতপূর্ব ঘটনা। কিন্তু ফ্যাসিস্ট শক্তিকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করা এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করে গণক্ষমতাকে গাঠনিক ক্ষমতায় (Constituent Power) রূপান্তর এবং নতুন ভাবে বাংলাদেশ ‘গঠন’ করবার তরিকা জনগণ এখনও আবিষ্কার করতে পারে নি। এর নানান কারন আছে।
বুদ্ধিবৃত্তিক পশাচাৎপদতা প্রধান একটি কারণ। ক্ষমতা কি, রাষ্ট্র কি, কিভাবে জনগণের ক্ষমতা পয়দা হয় এবং কিভাবে জনগণ তাদের সামষ্টিক ক্ষমতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজেদের নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিশাবে ‘গঠন’ (Constitute) করে সেই সকল আলোচনা আমরা সবে করতে শুরু করেছি। আমরা শিখছি, আবিষ্কার করছি, জিতেছি, আবার হেরেছি, পিছু হটেছি, আবার সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। এতে হতাশ হবার কিছু নাই।
বাংলাদেশ একটি উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশ; আমরা বাস করছি পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় যেখানে ‘রাষ্ট্র’ নামে যা আছে তা পুঁজির আত্মস্ফীতি ও পুঞ্জিভবনের হাতিয়ার মাত্র। আসলে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ‘রাষ্ট্র’ বলতে আমরা আসলে কি বুঝি সেটা আমাদের কাছে পরিষ্কার কি? না পরিষ্কার নয়।
পাশ্চাত্যের গ্রিক-খ্রিস্টীয় আধুনিক রাষ্ট্র জনগণের মুক্তি দিতে পারে ভাসানী সেটা বিশ্বাস করতেন না, অতএব টমাস হবসের লেভিয়াথান তত্ত্বে তাঁর মোটেও আস্থা ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন ‘রবুবিয়াত’ বা পালনবাদে, শাসনবাদে না। শাসনের নামে বিশাল জন্তুর রূপ নিয়ে জনগণের ঘাড়ের ওপর যে দানব চেপে বসে সেই দানবকে ঘাড় থেকে নামানো ছাড়া মজলুমের মুক্তি নাই — এই হোলো সংক্ষেপে মওলানা ভাসানীর রাজনীতি। একালে সে লড়াই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের নামে যে সিকিউরিটি স্টেইট হয়ে দেশে দেশে গড়ে উঠেছে। তার বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া মজলুমের মুক্তি নাই।
মওলানা ভাসানী মনে করতেন একালে আমাদের দেশে জনগণের দুষমণ দুই প্রকার। এক প্রকারের নাম তথাকথিত ‘কমিউনিস্ট’ — যারা সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার বিরোধিতা করে, কিন্তু জনগণকে বঞ্চিত করে নিজেরাই খোদ রাষ্ট্রের মালিক হয়ে বসে। এদের দিন শেষ হয়ে গিয়েছে। আর আরেক প্রকারের গণদুষমণ আছে, তারা মৌলভি-মওলানা আলেম-হুজুরের ভেক ধরে পরকালের ব্যবসা করে। এরা দাবি করে দুনিয়ায় গরিব আর মজলুমের কিছুই পাবার নাই, যা তারা পাবার সেটা তারা পাবে মইরা গেলে, মৃত্যুর পরে। যা পাবার পরকালেই শুধু পাওয়া যাবে, জীবিত জীবনে তাগোরে মজলুম ও বঞ্চিত হৈয়াই বেঁচে থাকতে হবে। । এই সকল পরকালবাদী মওলানা-মৌলভি-আলেম গণ ইহলৌকিক জীবন অস্বীকার করে, মজলুম, শোষিত ও বঞ্চিতকে তারা ইহলোকের বিপরীতে পরকাল দেখায়। পরকালের লোভ কিম্বা ভয় দেখিয়ে তাদের টুঁটির ওপর চেপে বসে।
তাদের খোদার ওপর খোদকারি বোঝা কঠিন কিছুই না। তারা মুখে বলে আল্লা সব কিছুর ‘মালিক’, কিন্তু নিজেরা জমি-জমা সয়-সম্পত্তি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করে নিতে ভোলে না। অর্থাৎ আল্লা সব কিছুর মালিক দাবি করলেও নিজে খোদ মালিক হয়।
অর্থাৎ মওলানা ভাসানীর কাছে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার প্রশ্ন ছিল গুরুতর আইনী, রাষ্ট্রীয় এবং রুহানি তর্কের বিষয়। কেউ যদি কমিউনিস্ট হয় তাহলে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানার বিষয় অবশ্যই ফয়সালা করতে হবে। আর যদি মোমিন হয়, তাকে বুঝতে হবে ইসলাম স্রষ্টার সৃষ্টির ওপর আদম সন্তানদের ভোগের অধিকার স্বীকার করে, কিন্তু আল্লার সৃষ্টির ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা ব্যবস্থা স্বীকার করে না।
আল্লাহু আকবর।
এই ভাসানীকে আমরা এখনও পুরাপুরি বুঝে উঠতে পারি নাই। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যে আমাদের ভাবের ঘরের ফাঁকি বা চিন্তাশীলতার মারাত্মক অভাবগুলো যদি আমরা শনাক্ত করতে ও শোধরাতে পারি, তাহলে বিশাল উল্লম্ফনের জন্য বাংলাদেশে তৈরি। এই অভাব কাটয়ে তোলাই হবে তাঁর ওফাত দিবসে আমাদের প্রধান অঙ্গীকার।
ইনকিলাব জিন্দাবাদ।