মাওলানা ভাসানীর সংক্ষিপ্ত জীবনী
- আপডেট সময় : ০৮:৩৮:৪৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪ ৮০ বার পড়া হয়েছে
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিদের মধ্যে অন্যতম নেতা হলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। ছয় দশক ধরে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলার মানুষের মন জয় করেছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। তার আন্দোলন ছিল সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে। তার রাজনৈতিক দীক্ষা হয়েছিল ব্রিটিশ বিরুধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের কাছে। যিনি জীবদ্দশায় ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। আর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বহু ঘটনার কেন্দ্রেই ছিলেন মাওলানা ভাসানী, যাকে তার বক্তব্য “মজলুম জননেতা ” বলে সম্বোধন করেছেন।
জন্ম
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সিরাজগঞ্জে ধানগড়া পল্লীতে জন্ম গ্রহন করেন। মাওলানা ভাসানীর পিতা হাজী শারাফত আলী ও মাতা বেগম শারাফত আলী। তাদের চারটি সন্তানের মধ্যে এক মেয়ে ও তিন ছেলে, মাওলানা ভাসানী ছিলেন সবার ছোট। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ডাক নাম ছিল চেগা মিয়া।
মাওলানা ভাসানীর জীবনী
১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের ধানগড়া পল্লীতে এই দেশ বরেণ্য নেতা জন্ম গ্রহন করেন। তার পিতা হাজী শারাফত আলী ও মাতা বেগম শারাফত আলী। পিতা মাতা সহ পরিবারে তিন ভাই ও এক বোন ছিলেন। তিনি অল্প বয়সে পিতাকে হারিয়েছেন। তাঁর কিছুদিন পর এক মহামারীতে মাতা বেগম শারাফত আলী ও দুই ভাই মারা যান। বেঁচে থাকেন ছোট শিশু আব্দুল হামিদ খান।
পিতা মাতার মৃত্যুর পর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রথমে কিছুদিন চাচা ইব্রাহিমের আশ্রয়ে ছিলেন। এই সময়ে ইরাকের এক আলেম ও ধর্ম প্রচারক নাসিরুদ্দিন বোগদাদী সিরাজগঞ্জে আসেন। হামিদ তার আশ্রয়ে কিছুদিন কাটান। স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসায় কয়েক বছর অধ্যায়ন ছাড়া তাঁর বিশেষ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তিনি টাঙ্গাইলের কাগমারিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট এলাকায় কালা গ্রামে একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
১৯৯১ সালে ব্রিটিশ বিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়। পরে কংগ্রেসে যোগদান করে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করে। মওলানা ভাসানী ১৯২৫ সালে জয়পুরহাটের পাচঁবিবি উপজেলার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে আলেমা খাতুনকে বিবাহ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি তাঁর সহধর্মিণী আলেমা খাতুন কে নিয়ে আসাম গমন করেন এবং আসামে প্রথম কৃষক প্রজা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। ১৯২৯-এ আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসানচরে প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন।এখান থেকে তার নাম রাখা হয় “ভাসানীর মাওলানা ”এরপর থেকে তার নামের শেষে “ভাসানী” শব্দ যুক্ত হয়।
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৩১-এ সন্তোষের কাগমারীতে, ১৯৩২-এ সিরাজগঞ্জের কাওরাখোলায় ও ১৯৩৩-এ প্রথম কৃষক আন্দোলন সম্মেলন করেন। তারপর ১৯৩৭ সালে ভাসানী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবংঅচিরেই দলের আসাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ভারত বিভাগের সময় ভাসানী আসামের গোয়ালপাড়া জেলায় এ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আসাম সরকার তাকে গ্রেপ্তার করে এবং ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে এ শর্তে মুক্তি দেয় যে, তিনি আসাম ছেড়ে চলে যাবেন। ১৯৪৮ এ মুক্তি পান।
তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হন। ভাসানী এর কড়া প্রতিবাদ করেন এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি তাঁকে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। ১৯৫৭ সালে কাগমারিতে আওয়ামী লীগের এক সম্মেলন আহবান করেন। তিনি এ দলের সভাপতি হন এবং এর সেক্রেটারি জেনারেল হন পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানীর। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন। ২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী সন্তোষে তার গৃহে অবস্থান করেন।
ভাষা আন্দোলনে মাওলানা ভাসানীর অবদান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যদি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখা যাবে, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রথম তাঁর বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্বায়ত্তশাসন, এমনকি স্বাধীনতার ইস্যুকে সামনে নিয়ে আসছেন। মাওলানা ভাসানী ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ভাষার অধিকার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এর গোলাম?’ পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকেই মাওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন স্বাধীকার এসব বিষয় জাতীয় রাজনীতির সামনে তুলে ধরেন।কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হয়ে মাওলানা ভাসানীকে খন্ডন করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ৯৮ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়ে গেছে’।
একইভাবে তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের আগে যে ২১ দফা ঘোষণা করেছেন, সেখানে ১৯ দফায় তিনি বলেছেন, ‘লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনর প্রদান ও সার্বভৌমিক করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে’। বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে চিহ্নিত ১৯৬৬ সালে ছয় দফার মূল বক্তব্যে কিন্তু ভাসানীর যুক্তফ্রন্টের ১৯ দফারই প্রতিফলন।
স্বাধীনতার পথ রচনায় মাওলানা ভাসানীর অবদান
১৯৭১-এর ৯ জানুয়ারি সন্তোষের দরবার হলে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সর্বদলীয় অনুষ্ঠানের পর মাওলানা ভাসানী শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে উল্কারগতিতে ছুটে বেড়ালেন। তাঁর কথা একটাই, স্বাধীনতা চাই। তাই মওলানা ভাসানী সেই সময় স্বাধীনতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিলেন। ছাত্রনেতারা স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার করার সুযোগ পেলেন। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার অগ্রদূত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা দিলেন, ‘ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ৭ মার্চের ভাষণ শুনে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। তিনি এতদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে মনে মনে এটাই চেয়েছিলে।
১৯৭১ সালের ৯ মার্চ পল্টনে মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তিনি সেখানে বললেন,‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে ।’ তিনি এও বললেন, ‘ শান্তিপূর্ণ ভাবে আমরা স্বাধীনতা পেলে ১৯৪০ এর লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে। ইংরেজরা স্বাধীনতার দিয়েও যেমন কমনওয়েলথ রেখেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সে সম্পর্ক থাকবে।’ জনসভায় মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর তুমুল করতালির মাধ্যমে বলেন, ‘মুজিবের নির্দেশমতো আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কিছু না হলে আমি শেখ মুজিবের সাথে মিলে ১৯৫২ সালের মতো তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলব।’ পল্টনের সেই বিশাল জনসভায় মজলুম জননেতা দৃঢ় কন্ঠে আরও বলেন, অচিরেই পূর্ব বাংলার স্বাধীন হবে।’ তিনি সবাইকে শেখ মুজিবের উপর আস্থা রাখতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘শেখ মুজিব আমার ছেলের মতো, সে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না; বাঙ্গালীরা মুজিবের ওপর আস্থা রাখেন, কারণ আমি তাকে ভালভাবে চিনি।’ এই দিন তিনি ১৪ দফা দাবিও পেশ করেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে পূর্ণ আস্থা প্রকাশ করেন। তখন স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আর কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। ঠিক এমনটি ঘটেছিল বাঙালির জীবনে।
সমাজ সংস্কার
মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী রাজনীতির পাশাপাশি তিনি সমাজ সংস্কার মূলক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন। তিনি জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে মহিদপুর হক্কুল এবাদ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন তার অধীনে ডিগ্রি মেডিকেল টেকনিক্যাল স্কুল, হাজী মহসিন কলেজ ( প্রস্তাবিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেন,পরে সেটি জাতীয়করণ করা হয়। তিনি কারিগরি শিক্ষা কলেজ ও শিশু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন সন্তোষে। আসামে মাওলানা ভাসানী ত্রিশটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও কাগমারিতে মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ সন্তোষে (সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়) যা কিনা “মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববদ্যালয়”২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেটি প্রকৃতি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২য় স্থানে আছে।
মাওলানা ভাসানীর প্রকাশিত গ্রন্থ
দেশের সমস্যা ও সমাধান (১৯৬২)
মাও সে তুং-এর দেশে (১৯৬৩)
মৃত্যু
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাঙ্গাইল জেলার সদর উপজেলার উত্তর-পশ্চিমে নামক স্থানে পীর শাহ জামান দিঘির পাশে সমাহিত করা হয়। সারা দেশ থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তার জানাজায় অংশগ্রহণ করেন।