ঢাকা ০১:৫৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
দুর্গাপূজার ছুটি বাড়ছে একদিন চতুর্থ প্রজন্মের ৬ ব্যাংকে ৬ হাজার কোটি টাকা উদ্ধৃত্ত তারল্য কে এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘মিল্টন’, আঘাত হানবে যেখানে সচিবদের ২৫টি নির্দেশনা প্রধান উপদেষ্টার প্রত্যাশা পূরণে আশাবাদী রাজনৈতিক নেতারা পাঁচ সদস্য নিয়ে পুঁজিবাজার সংস্কারের জন্য টাস্কফোর্স গঠন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে বিশেষ টাস্কফোর্স শেয়ারবাজার সংস্কারে ৫ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন বিশ্বের প্রভাবশালী মুসলিমের তালিকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট ‘একটি তাজা টাইম বোমা’ শেয়ারবাজারে এক সপ্তাহে নেই ১৩ হাজার কোটি টাকা ‘কাউন্টডাউন শুরু’ স্ট্যাটাস দেয়া নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওএসডি নিহত আবু সাঈদকে ‘সন্ত্রাসী’ বললেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঊর্মি নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই, পূজা নির্বিঘ্নে ও শান্তিপূর্ণভাবে হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা চার দেয়ালের মধ্যে কেমন আছেন ভিআইপিরা? দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা ৭ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নয়টি রাজনৈতিক ব্যাংকের অবস্থা নাজুক নতুন কাগুজে নোটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি বাদ বিজয় সরণিতে এআই সিগন্যাল সিস্টেম স্থাপন

যে পাঁচটি সেনা অভ্যুত্থান ও হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের রাজনীতি বদলে দেয়

বিবিসি বাংলা
  • আপডেট সময় : ১২:০২:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ মার্চ ২০২৪ ৩১ বার পড়া হয়েছে
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল তার হাতে ধরে পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থান এবং পাল্টা-অভ্যুত্থান হয়।

এসব অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের কারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাংলাদেশ নিমজ্জিত ছিল সামরিক শাসনের মধ্যে।

প্রতিটি ঘটনার প্রভাব রাজনীতি ও সেনাবাহিনীর উপর ছিল বেশ সুদূরপ্রসারী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ৫০ বছরের মধ্যে ১৮ বছরই কেটেছে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন এবং সেনাবাহিনীর প্রভাবে। ।

স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় এক অভ্যুত্থানে মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে সেটি অনেককে বেশ চমকে দিয়েছিল।

পরবর্তীতে আরো কয়েকটি অভ্যুত্থান এবং পাল্টা-অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। এছাড়া বেশ কিছু অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টাও হয়েছে।

যেসব অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতির খোল-নলচে বদলে দিয়েছিল সেগুলো কিভাবে এবং কোন পরিস্থিতিতে এসব ঘটনা ঘটেছিল?

শেখ মুজিবুর রহমান

ছবির ক্যাপশান,ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়িটিতে হত্যা করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে।

১৯৭৫ সালের ১৫অগাস্ট

উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের ১৫ই অগাস্ট বিয়োগান্ত ঘটনাটি ঘটিয়েছিল সেনাবাহিনীর একদল অফিসার। এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল।

শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবার জন্য ঢাকা সেনানিবাসে কিছু জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা নানা ফন্দি-ফিকির করছিল। কিন্তু কেউ আঁচ করতে পারেনি যে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবে।

উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের সে সময়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্টেশন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন কর্নেল হামিদ। তার লেখা ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান’ বইতে সে সময়ের বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে।

কর্নেল হামিদ লিখেছেন, ” মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে বেশ কিছু তরুণ বিক্ষুব্ধ অফিসার প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিল।”

”অনেকই গোপনে কিছু একটা করার পথ খুঁজছিল, তবে এসব অভ্যুত্থান ঘটনার মতো বড় বিপদ হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি।”

সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে জড়িত ছিল সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা।

সে সময় ঢাকা সেনানিবাসে লেফট্যানেন্ট কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। মি: চৌধুরী ২০১৩ সালে মারা যান।

দু’হাজার দশ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট ভোর পাঁচটার দিকে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত একজন সেনা কর্মকর্তা মেজর রশিদের নেতৃত্বে একদল সেনা তার বাড়ি ঘিরে ফেলে।

শেখ মুজিবুর রহমান

ছবির ক্যাপশান,পরিবারসহ শেখ মুজিবুর রহমান: শেখ হাসিনা (সর্ব ডানে) আর শেখ রেহানা (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়) ছাড়া আর সবাইকে হত্যা করে সৈন্যরা।

মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন আওয়ামীলীগের একজন সিনিয়র নেতা এবং মন্ত্রী পরিষদের সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন।

হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অফিসাররা তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগে থেকেই ভাবছিলেন যে মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে তার পরিবর্তে কাকে ক্ষমতায় বসানো হবে।

সেজন্য তারা গোপনে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার মনোভাব জানার চেষ্টা করেছে কিংবা তাদের সাথে আলাপ-আলোচনার চেষ্টা করেছে।

খন্দকার মোশতাক আহমেদ

ছবির উৎস,ARCHIVE

ছবির ক্যাপশান,খন্দকার মোশতাক আহমেদ

‘পাকিস্তানপন্থী’ মোশতাক আহমেদ

শেখ মুজিবকে হত্যার দুই সপ্তাহ আগে খন্দকার মোশতাক আহমদের সাথে যোগাযোগ করেন সেনা কর্মকর্তা রশিদ।

মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর মি. রশিদ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলেন কর্নেল হামিদের সাথে।

কর্নেল হামিদের বর্ণনা অনুযায়ী, “মোশতাক আহমদ শেখ সাহেবের সর্বশেষ কার্যকলাপে সন্তুষ্ট ছিলেন না। মুক্তির উপায় খুঁজছিলেন। অতএব রশিদ তা সাথে কথাবার্তা বলে সহজেই বুঝতে পারে, প্রয়োজন মুহূর্তে এই বুড়োকে ব্যবহার করা যাবে”

আওয়ামী লীগের ভেতরে অনেকে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে ‘পাকিস্তানপন্থী’ বলে মনে করতেন।

মোশতাক আহমদ ৮৩দিন রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এসময় শেখ মুজিব হত্যাকারীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। তিনি ক্ষমতায় থাকার সময় ‘জয়বাংলার’ পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগান চালু করেন।

প্রয়াত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর লেখা ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইতে উল্লেখ করা হয়েয়ে, খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হাবার পরে বাংলাদেশ-বিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী কিছু ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে বহাল করেন।

জেনারেল চৌধুরী লিখেছেন, এ সময় স্বাধীনতা বিরোধী চক্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে বেশ তৎপর হয়ে উঠলো।

খালেদ মোশারফ
ছবির ক্যাপশান,খালেদ মোশারফ

১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর

মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ঘাতক জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা।

বঙ্গভবন থেকে তারাই সবকিছু পরিচালনা করতেন। এসব কার্যকলাপ সামরিক বাহিনীর অনেক সিনিয়র অফিসার সহ্য করতে পারছিলেন না।

শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে জড়িত জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা তখন এতোটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেন যে তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবার কথা অনেকেই ভাবেনি।

প্রয়াত মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তার বইতে এ সংক্রান্ত একটি উদাহরণ তুলে ধরেন।

জেনারেল চৌধুরী লিখেছেন, রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল এমএজি ওসমানী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তেমন একটা পছন্দ করতেন না।

মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফকে বেশি পছন্দ করতেন জেনারেল ওসমানী।

জেনারেল চৌধুরীর বর্ণনায়, “মেজর ফারুক-রশিদ এবং তাদের সহযোগীদের চাপে খন্দকার মোশতাক মুজিব হত্যার পর জেনারেল জিয়াকে সেনা প্রধান করেন। সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে জেনারেল ওসমানী হয়তো তখন রাষ্ট্রপতির ওপর কোনরূপ প্রভাব খাটাতে পারেন নি।”

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

ছবির ক্যাপশান,জিয়াউর রহমান।

জিয়া আর খালেদ মোশারফের মধ্যে দ্বন্দ্ব

তৎকালীন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ এবং তার অনুগতরা মনে করতেন যে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সমর্থনে হত্যাকারী অফিসাররা এতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

এছাড়া মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফের মধ্যে চলছিল চরম দ্বন্দ্ব।

কারণ, মুজিব হত্যার পর জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ।

এজন্য ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠছিলেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ। সেনানিবাসের ভেতরে যে কোন সময় সংঘর্ষের আশংকা তৈরি হয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে ৩রা নভেম্বর রাতে পাল্টা আঘাত করেন জেনারেল খালেদ মোশারফ। সংগঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেনা অভ্যুত্থান।

শুরুতেই বন্দি করা হয় সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে।

ঢাকায় কখন এক যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলো। বঙ্গভবনের উপর দিয়ে যুদ্ধবিমান চক্কর দিতে লাগলো।

তখনকার পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন লে. কর্নেল এমএ হামিদ।

তিনি লিখেছেন, ” বঙ্গভবন আর ক্যান্টনমেন্ট তখন দুটি পৃথক দেশ। … যে কোন মুহূর্তে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রবল আশংকা দেখা দিল। বঙ্গভবনে অবস্থিতি ফারুক-রশিদের ট্যাংক ও আর্টিলারি বাহিনী, ক্যান্টনমেন্টে রয়েছে খালেদ-শাফায়াতের পদাতিক বাহিনী।”

কারাগারে নিহত চার নেতা। ঘড়ির কাঁটার ক্রমানুসারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান
ছবির ক্যাপশান,কারাগারে নিহত চার নেতা। ঘড়ির কাঁটার ক্রমানুসারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান

কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যাকাণ্ড

তেসরা নভেম্বর খালেদ মোশারফ তিনটি দাবি তুলে ধরেন। এসব দাবি ছিল – ট্যাংক ও কামান বঙ্গভবন থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠানো, জিয়াউর রহমানের সেনাপ্রধান না থাকা এবং বঙ্গভবনে ফারুক-রশিদের কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠানো।

এসব দাবি নিয়ে বঙ্গভবনের সাথে সারাদিনই তাদের আলাপ-আলোচনা চলে। দরকষাকষির একপর্যায়ে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবার প্রস্তাব দেন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ।

তেসরা নভেম্বর সন্ধ্যার পরে ফারুক-রশিদসহ ১৭জন বাংলাদেশে বিমানের একটি ফ্লাইটে করে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন।

এদিকে খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থান যখন সংগঠিত হচ্ছিল, তখন রাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আট থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের চার সিনিয়র নেতা – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

বাম থেকে- খালেদ মোশারফ, কর্নেল তাহের এবং জিয়াউর রহমান।
ছবির ক্যাপশান,বাম থেকে- খালেদ মোশারফ, কর্নেল তাহের এবং জিয়াউর রহমান।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর

খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে এই অভ্যুত্থান ছিল ক্ষণস্থায়ী। এটি টিকে ছিল মাত্র চারদিন।

তখনকার সেনা কর্মকর্তাদের লেখা বিভিন্ন বই থেকে এ ধারণা পাওয়া যায়, ৩রা নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর খালেদ মোশারফ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চাননি।

খালেদ মোশারফের প্রধান লক্ষ্য ছিল, জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে সেনাপ্রধান হওয়া।

লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, “বঙ্গভবনে খালেদ মোশারফ যখন প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সাথে দরকষাকষিতে ব্যস্ত, তখন তার অজান্তেই ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকবৃন্দ এবং জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা আঘাত আনার গোপন প্রস্তুতি শুরু করে। “

ছয়ই নভেম্বর সন্ধ্যার সময় ঢাকা সেনানিবাসে কিছু লিফলেট বিতরণ করা হয়।

ঢাকা সেনানিবাসে তখন মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ একটি লিফলেট তার হাতে পৗঁছায়। সে লিফলেটে সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যার ইংগিত ছিল পরিষ্কার।

জিয়াউর রহমান
ছবির ক্যাপশান,জিয়াউর রহমান

দু’হাজার সতেরো সালে  কাছে এক সাক্ষাৎকারে মি: ইব্রাহিম সে ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন এভাবে, ” সে লিফলেটে লেখা ছিল , সৈনিক-সৈনিক ভাই-ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই। এ থেকে আমি বুঝলাম রাতে কিছু একটা হবেই হবে। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমত নিজেকে বেঁচে থাকতে হবে, দ্বিতীয়ত: সেনাবাহিনীকে বাঁচাতে হবে। “

রাত ১২টা বাজতেই গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠে ঢাকা সেনানিবাস। ব্যারাক ছেড়ে সৈন্যরা দলে-দলে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে রাস্তায় নেমে আসে।

সাতই নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনা করেছিলেন সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়া কর্নেল মো: আবু তাহের। সাথে ছিল বামপন্থী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ।

সে সময় কর্নেল তাহেরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তার ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন, যিনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন।

উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের সে সময়টিতে আনোয়ার হোসেন ঢাকায় জাসদের গণবাহিনীর প্রধান ছিলেন।

মি: হোসেনের বর্ণনায় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চিন্তা ছিল তাদের।

বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মি: হোসেন জানিয়েছেন, ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর থেকে ৬ই নভেম্বর রাত পর্যন্ত অসংখ্য সভা হয়েছে। মূলত; সেনাবাহিনীর সৈনিকদের সাথে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সেসব সভা অনুষ্ঠিত হয়।

অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ছিলেন গণবাহিনীর ঢাকা মহানগর প্রধান।
ছবির ক্যাপশান,অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ছিলেন গণবাহিনীর ঢাকা মহানগর প্রধান।

এর মাধ্যমে সৈন্যরা একটি ১২ দফা দাবী প্রস্তুত করে। তাদের লক্ষ্য ছিল খালেদ মোশারফকে পদচ্যুত করা।

সাতই নভেম্বর প্রথম প্রহরে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হলেও বেলা ১১টার দিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফকে তার দুই সহযোগী কর্নেল নাজমুল হুদা এবং লে. কর্নেল এটিএম হায়দারসহ হত্যা করা হয়।

কিন্তু জিয়াউর রহমান মুক্ত হবার পর পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।

দৃশ্যপটের সামনে চলে আসেন জিয়াউর রহমান এবং আড়ালে যেতে থাকেন কর্নেল তাহের।

জিয়াউর রহমানের সে আচরণকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে মনে করে জাসদ।

সাতই নভেম্বরকে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল ভিন্ন-ভিন্ন নামে পালন করে।

বিএনপি’র মতে এটি ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ আওয়ামী লীগ মনে করে এটি ‘মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’।

এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ

উনিশ’শ একাশি সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর উপরাষ্ট্রপতি আব্দুর সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন। তখনো বিএনপি সরকারই ক্ষমতায় ছিল।

সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানের উপর রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের কোন প্রভাব ছিলনা।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, তখন থেকে বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল এবং রাজনীতিতে আসার বাসনা প্রকাশ পেতে থাকে।

কিন্তু এরশাদ এই কাজটি একেবারে তড়িঘড়ি করে সম্পন্ন করেন নি। তিনি সময় নিয়ে ধাপে-ধাপে এগিয়েছেন।

ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিক পরিবেষ্টিত জেনারেল এরশাদ।

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিক পরিবেষ্টিত জেনারেল এরশাদ।

জেনারেল এরশাদের জন্য ভালো সুযোগ

রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে নানা দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ পেতে থাকে বিভিন্ন সংবাদপত্রে।

প্রেসিডেন্ট সাত্তার সরকারের এই দুর্নীতির খবর জেনারেল এরশাদের জন্য আরো ভালো সুযোগ তৈরি করে দেয়।

নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়, ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাপ্রধান জেনারেল এইচএম এরশাদ দেখা করেন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের সাথে।

সে বৈঠকে মন্ত্রীসভার আকার ছোট করা এবং ‘দুর্নীতিবাজ’ মন্ত্রীদের বাদ দেবার দাবি করেন সেনাপ্রধান।

তখনই সবাই বুঝেতে পারেন যে জেনারেল এরশাদ যে কোন সময় ক্ষমতা দখল করতে পারেন।

উনিশ’শ বিরাশি সালের ২৪শে মার্চ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনা প্রধান ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

এ সময় তিনি সামরিক আইন জারি করেন। তিনি নিজেকে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন।

সাতাশে মার্চ বিচারপতি আহসানউদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন।

প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক

কিন্তু প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে সব ক্ষমতা ছিল জেনারেল এরশাদের হাতে।

কারণ সামরিক আইন অনুযায়ী প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারতেন না।

মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর মতে, জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ অপ্রত্যাশিত ছিলনা।

“জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া বস্তুতপক্ষে শুরু হয় জেনারেল জিয়া হত্যার পর এবং এর ধারাবাহিকতা চূড়ান্ত রূপ পায় ২৪শে মার্চ,” লিখেছেন জেনারেল চৌধুরী।

তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী এটা প্রতীয়মান হয় যে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের পেছনে আমেরিকার নীরব সমর্থন ছিল।

তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রোনাল্ড রেগান।

জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের এক সপ্তাহ পরে নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের নিয়ে রেগান প্রশাসন কোন সমস্যা দেখছে না।

এছাড়া রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত।

নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

ক্ষমতা দখল করে জেনারেল এরশাদ নয় বছর টিকে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি জাতীয় পার্টি গঠন করেন।

এই রাজনৈতিক দল পরবর্তীতে বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোতে ভোটের হিসেব-নিকেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

২০০৭ সালের সেনা হস্তক্ষেপ

জেনারেল এরশাদের পতনের পরে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে একটি অবাধ সাধারণ নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরায় চালু হয়।

এরপর বাংলাদেশে আরো তিনটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

অবশ্য ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখে বিতর্কিত একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

ইয়াজউদ্দিন আহমেদ

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,২০০৬ সালের ২৯শে অক্টোবর প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের জন্য শপথ নেন প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহমেদ।

ওয়ান-ইলেভেন

সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করার পর অনেকে ভেবেছিলেন যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ হয়তো আর থাকবে না। কিন্তু বেশি সময় গড়ায়নি।

দু’হাজার চার সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় সংবিধান সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স সীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়।

আওয়ামী লীগ অভিযোগ তুলেছিল যে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তি বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে পাবার জন্য এই সংশোধনী করা হয়েছিল।

এনিয়ে শুরু হয় রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাত। প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখে একতরফা একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে তৎকালীন বিএনপি সরকার। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা ছড়িয়ে যায়।

এক পর্যায়ে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। স্থগিত করা হয় বিএনপির সরকারের আয়োজন করা সে নির্বাচন।

তবে সেনাবাহিনীর এই হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছিল বেশ অভিনব।

সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল না করেও তাদের পছন্দসই বেসামরিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে।

মইন ইউ আহমেদ
ছবির ক্যাপশান,মইন ইউ আহমেদের লেখা এই বইটি প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে।

মইন আহমদ-এর ‘শান্তির স্বপ্নে’

তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদ সে সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখেছেন।

‘শান্তির স্বপ্নে’ বইতে জেনারেল আহমেদ লিখেছেন, রাজনীতিতে কোনভাবেই সেনাবাহিনীকে জড়াতে চাননি।

কিন্তু দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেনা কর্মকর্তারা তার উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন বলে জেনারেল আহমেদ উল্লেখ করেন।

দু’হাজার সাত সালের ১১ই জানুয়ারি জেনারেল মইন ইউ আহমেদ এবং সশস্ত্র বাহিনীর অন্যান্য প্রধান ও ডিজিএফআইয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্তা সেদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন।

তারা আড়াইটার সময় বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন। ভেতরে গিয়ে শোনেন, প্রেসিডেন্ট মধ্যাহ্নভোজন করছেন।

জেনারেল আহমেদ লিখেছেন, তাদের একটি কামরায় অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়। ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষা করবার পর প্রেসিডেন্টের দেখা মেলে। প্রেসিডেন্টকে তারা ‘মহা-সংকটময় পরিস্থিতি’ থেকে দেশকে উদ্ধার করার অণুরোধ জানান। প্রেসিডেন্ট বিষয়টি ভেবে দেখার সময় নেন।

জরুরী অবস্থা জারি

দীর্ঘ নীরবতার পর প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা জারির পক্ষে মত দেন।

সেই সাথে তিনি নিজে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দেবেন বলে জানান।

প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সরে দাঁড়ান এবং জারী করা হয় জরুরী অবস্থা।

এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।

দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

যে পাঁচটি সেনা অভ্যুত্থান ও হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের রাজনীতি বদলে দেয়

আপডেট সময় : ১২:০২:২৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ মার্চ ২০২৪

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল তার হাতে ধরে পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থান এবং পাল্টা-অভ্যুত্থান হয়।

এসব অভ্যুত্থান এবং পাল্টা অভ্যুত্থানের কারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য বাংলাদেশ নিমজ্জিত ছিল সামরিক শাসনের মধ্যে।

প্রতিটি ঘটনার প্রভাব রাজনীতি ও সেনাবাহিনীর উপর ছিল বেশ সুদূরপ্রসারী।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ৫০ বছরের মধ্যে ১৮ বছরই কেটেছে প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন এবং সেনাবাহিনীর প্রভাবে। ।

স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় এক অভ্যুত্থানে মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে সেটি অনেককে বেশ চমকে দিয়েছিল।

পরবর্তীতে আরো কয়েকটি অভ্যুত্থান এবং পাল্টা-অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। এছাড়া বেশ কিছু অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টাও হয়েছে।

যেসব অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতির খোল-নলচে বদলে দিয়েছিল সেগুলো কিভাবে এবং কোন পরিস্থিতিতে এসব ঘটনা ঘটেছিল?

শেখ মুজিবুর রহমান

ছবির ক্যাপশান,ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়িটিতে হত্যা করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে।

১৯৭৫ সালের ১৫অগাস্ট

উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের ১৫ই অগাস্ট বিয়োগান্ত ঘটনাটি ঘটিয়েছিল সেনাবাহিনীর একদল অফিসার। এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল।

শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবার জন্য ঢাকা সেনানিবাসে কিছু জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা নানা ফন্দি-ফিকির করছিল। কিন্তু কেউ আঁচ করতে পারেনি যে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাবে।

উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের সে সময়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে স্টেশন অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন কর্নেল হামিদ। তার লেখা ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান’ বইতে সে সময়ের বিস্তারিত বিবরণ উঠে এসেছে।

কর্নেল হামিদ লিখেছেন, ” মুক্তিযোদ্ধা জুনিয়র অফিসারদের মধ্যে বেশ কিছু তরুণ বিক্ষুব্ধ অফিসার প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনায় মুখর ছিল।”

”অনেকই গোপনে কিছু একটা করার পথ খুঁজছিল, তবে এসব অভ্যুত্থান ঘটনার মতো বড় বিপদ হিসেবে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি।”

সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে জড়িত ছিল সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা।

সে সময় ঢাকা সেনানিবাসে লেফট্যানেন্ট কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। মি: চৌধুরী ২০১৩ সালে মারা যান।

দু’হাজার দশ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি জানিয়েছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্ট ভোর পাঁচটার দিকে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত একজন সেনা কর্মকর্তা মেজর রশিদের নেতৃত্বে একদল সেনা তার বাড়ি ঘিরে ফেলে।

শেখ মুজিবুর রহমান

ছবির ক্যাপশান,পরিবারসহ শেখ মুজিবুর রহমান: শেখ হাসিনা (সর্ব ডানে) আর শেখ রেহানা (বাঁ দিক থেকে দ্বিতীয়) ছাড়া আর সবাইকে হত্যা করে সৈন্যরা।

মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন আওয়ামীলীগের একজন সিনিয়র নেতা এবং মন্ত্রী পরিষদের সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন।

হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অফিসাররা তাদের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আগে থেকেই ভাবছিলেন যে মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে তার পরিবর্তে কাকে ক্ষমতায় বসানো হবে।

সেজন্য তারা গোপনে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার মনোভাব জানার চেষ্টা করেছে কিংবা তাদের সাথে আলাপ-আলোচনার চেষ্টা করেছে।

খন্দকার মোশতাক আহমেদ

ছবির উৎস,ARCHIVE

ছবির ক্যাপশান,খন্দকার মোশতাক আহমেদ

‘পাকিস্তানপন্থী’ মোশতাক আহমেদ

শেখ মুজিবকে হত্যার দুই সপ্তাহ আগে খন্দকার মোশতাক আহমদের সাথে যোগাযোগ করেন সেনা কর্মকর্তা রশিদ।

মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর মি. রশিদ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলেন কর্নেল হামিদের সাথে।

কর্নেল হামিদের বর্ণনা অনুযায়ী, “মোশতাক আহমদ শেখ সাহেবের সর্বশেষ কার্যকলাপে সন্তুষ্ট ছিলেন না। মুক্তির উপায় খুঁজছিলেন। অতএব রশিদ তা সাথে কথাবার্তা বলে সহজেই বুঝতে পারে, প্রয়োজন মুহূর্তে এই বুড়োকে ব্যবহার করা যাবে”

আওয়ামী লীগের ভেতরে অনেকে খন্দকার মোশতাক আহমেদকে ‘পাকিস্তানপন্থী’ বলে মনে করতেন।

মোশতাক আহমদ ৮৩দিন রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এসময় শেখ মুজিব হত্যাকারীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়ে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। তিনি ক্ষমতায় থাকার সময় ‘জয়বাংলার’ পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ শ্লোগান চালু করেন।

প্রয়াত সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর লেখা ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইতে উল্লেখ করা হয়েয়ে, খন্দকার মোশতাক আহমদ রাষ্ট্রপতি হাবার পরে বাংলাদেশ-বিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী কিছু ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে বহাল করেন।

জেনারেল চৌধুরী লিখেছেন, এ সময় স্বাধীনতা বিরোধী চক্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে বেশ তৎপর হয়ে উঠলো।

খালেদ মোশারফ
ছবির ক্যাপশান,খালেদ মোশারফ

১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর

মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ঘাতক জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা।

বঙ্গভবন থেকে তারাই সবকিছু পরিচালনা করতেন। এসব কার্যকলাপ সামরিক বাহিনীর অনেক সিনিয়র অফিসার সহ্য করতে পারছিলেন না।

শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে জড়িত জুনিয়র সেনা কর্মকর্তারা তখন এতোটাই প্রভাবশালী হয়ে উঠেন যে তাদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবার কথা অনেকেই ভাবেনি।

প্রয়াত মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তার বইতে এ সংক্রান্ত একটি উদাহরণ তুলে ধরেন।

জেনারেল চৌধুরী লিখেছেন, রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল এমএজি ওসমানী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তেমন একটা পছন্দ করতেন না।

মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফকে বেশি পছন্দ করতেন জেনারেল ওসমানী।

জেনারেল চৌধুরীর বর্ণনায়, “মেজর ফারুক-রশিদ এবং তাদের সহযোগীদের চাপে খন্দকার মোশতাক মুজিব হত্যার পর জেনারেল জিয়াকে সেনা প্রধান করেন। সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে জেনারেল ওসমানী হয়তো তখন রাষ্ট্রপতির ওপর কোনরূপ প্রভাব খাটাতে পারেন নি।”

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।

ছবির ক্যাপশান,জিয়াউর রহমান।

জিয়া আর খালেদ মোশারফের মধ্যে দ্বন্দ্ব

তৎকালীন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ এবং তার অনুগতরা মনে করতেন যে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের সমর্থনে হত্যাকারী অফিসাররা এতোটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

এছাড়া মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফের মধ্যে চলছিল চরম দ্বন্দ্ব।

কারণ, মুজিব হত্যার পর জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ।

এজন্য ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠছিলেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফ। সেনানিবাসের ভেতরে যে কোন সময় সংঘর্ষের আশংকা তৈরি হয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত ১৯৭৫ সালে ৩রা নভেম্বর রাতে পাল্টা আঘাত করেন জেনারেল খালেদ মোশারফ। সংগঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় সেনা অভ্যুত্থান।

শুরুতেই বন্দি করা হয় সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে।

ঢাকায় কখন এক যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলো। বঙ্গভবনের উপর দিয়ে যুদ্ধবিমান চক্কর দিতে লাগলো।

তখনকার পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন লে. কর্নেল এমএ হামিদ।

তিনি লিখেছেন, ” বঙ্গভবন আর ক্যান্টনমেন্ট তখন দুটি পৃথক দেশ। … যে কোন মুহূর্তে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্রবল আশংকা দেখা দিল। বঙ্গভবনে অবস্থিতি ফারুক-রশিদের ট্যাংক ও আর্টিলারি বাহিনী, ক্যান্টনমেন্টে রয়েছে খালেদ-শাফায়াতের পদাতিক বাহিনী।”

কারাগারে নিহত চার নেতা। ঘড়ির কাঁটার ক্রমানুসারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান
ছবির ক্যাপশান,কারাগারে নিহত চার নেতা। ঘড়ির কাঁটার ক্রমানুসারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামান

কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যাকাণ্ড

তেসরা নভেম্বর খালেদ মোশারফ তিনটি দাবি তুলে ধরেন। এসব দাবি ছিল – ট্যাংক ও কামান বঙ্গভবন থেকে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠানো, জিয়াউর রহমানের সেনাপ্রধান না থাকা এবং বঙ্গভবনে ফারুক-রশিদের কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠানো।

এসব দাবি নিয়ে বঙ্গভবনের সাথে সারাদিনই তাদের আলাপ-আলোচনা চলে। দরকষাকষির একপর্যায়ে শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবার প্রস্তাব দেন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ।

তেসরা নভেম্বর সন্ধ্যার পরে ফারুক-রশিদসহ ১৭জন বাংলাদেশে বিমানের একটি ফ্লাইটে করে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন।

এদিকে খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থান যখন সংগঠিত হচ্ছিল, তখন রাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আট থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের চার সিনিয়র নেতা – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

বাম থেকে- খালেদ মোশারফ, কর্নেল তাহের এবং জিয়াউর রহমান।
ছবির ক্যাপশান,বাম থেকে- খালেদ মোশারফ, কর্নেল তাহের এবং জিয়াউর রহমান।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর

খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে এই অভ্যুত্থান ছিল ক্ষণস্থায়ী। এটি টিকে ছিল মাত্র চারদিন।

তখনকার সেনা কর্মকর্তাদের লেখা বিভিন্ন বই থেকে এ ধারণা পাওয়া যায়, ৩রা নভেম্বর অভ্যুত্থানের পর খালেদ মোশারফ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে চাননি।

খালেদ মোশারফের প্রধান লক্ষ্য ছিল, জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে সেনাপ্রধান হওয়া।

লে. কর্নেল হামিদ লিখেছেন, “বঙ্গভবনে খালেদ মোশারফ যখন প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সাথে দরকষাকষিতে ব্যস্ত, তখন তার অজান্তেই ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকবৃন্দ এবং জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা আঘাত আনার গোপন প্রস্তুতি শুরু করে। “

ছয়ই নভেম্বর সন্ধ্যার সময় ঢাকা সেনানিবাসে কিছু লিফলেট বিতরণ করা হয়।

ঢাকা সেনানিবাসে তখন মেজর হিসেবে কর্মরত ছিলেন সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ একটি লিফলেট তার হাতে পৗঁছায়। সে লিফলেটে সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যার ইংগিত ছিল পরিষ্কার।

জিয়াউর রহমান
ছবির ক্যাপশান,জিয়াউর রহমান

দু’হাজার সতেরো সালে  কাছে এক সাক্ষাৎকারে মি: ইব্রাহিম সে ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন এভাবে, ” সে লিফলেটে লেখা ছিল , সৈনিক-সৈনিক ভাই-ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই। এ থেকে আমি বুঝলাম রাতে কিছু একটা হবেই হবে। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমত নিজেকে বেঁচে থাকতে হবে, দ্বিতীয়ত: সেনাবাহিনীকে বাঁচাতে হবে। “

রাত ১২টা বাজতেই গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠে ঢাকা সেনানিবাস। ব্যারাক ছেড়ে সৈন্যরা দলে-দলে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে রাস্তায় নেমে আসে।

সাতই নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনা করেছিলেন সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়া কর্নেল মো: আবু তাহের। সাথে ছিল বামপন্থী জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ।

সে সময় কর্নেল তাহেরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন তার ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন, যিনি পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন।

উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের সে সময়টিতে আনোয়ার হোসেন ঢাকায় জাসদের গণবাহিনীর প্রধান ছিলেন।

মি: হোসেনের বর্ণনায় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চিন্তা ছিল তাদের।

বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মি: হোসেন জানিয়েছেন, ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর থেকে ৬ই নভেম্বর রাত পর্যন্ত অসংখ্য সভা হয়েছে। মূলত; সেনাবাহিনীর সৈনিকদের সাথে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সেসব সভা অনুষ্ঠিত হয়।

অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ছিলেন গণবাহিনীর ঢাকা মহানগর প্রধান।
ছবির ক্যাপশান,অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ছিলেন গণবাহিনীর ঢাকা মহানগর প্রধান।

এর মাধ্যমে সৈন্যরা একটি ১২ দফা দাবী প্রস্তুত করে। তাদের লক্ষ্য ছিল খালেদ মোশারফকে পদচ্যুত করা।

সাতই নভেম্বর প্রথম প্রহরে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হলেও বেলা ১১টার দিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশারফকে তার দুই সহযোগী কর্নেল নাজমুল হুদা এবং লে. কর্নেল এটিএম হায়দারসহ হত্যা করা হয়।

কিন্তু জিয়াউর রহমান মুক্ত হবার পর পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়।

দৃশ্যপটের সামনে চলে আসেন জিয়াউর রহমান এবং আড়ালে যেতে থাকেন কর্নেল তাহের।

জিয়াউর রহমানের সে আচরণকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে মনে করে জাসদ।

সাতই নভেম্বরকে বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল ভিন্ন-ভিন্ন নামে পালন করে।

বিএনপি’র মতে এটি ‘সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ আওয়ামী লীগ মনে করে এটি ‘মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস’।

এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ

উনিশ’শ একাশি সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর উপরাষ্ট্রপতি আব্দুর সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন। তখনো বিএনপি সরকারই ক্ষমতায় ছিল।

সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানের উপর রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের কোন প্রভাব ছিলনা।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, তখন থেকে বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল এবং রাজনীতিতে আসার বাসনা প্রকাশ পেতে থাকে।

কিন্তু এরশাদ এই কাজটি একেবারে তড়িঘড়ি করে সম্পন্ন করেন নি। তিনি সময় নিয়ে ধাপে-ধাপে এগিয়েছেন।

ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিক পরিবেষ্টিত জেনারেল এরশাদ।

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,ঢাকায় বিদেশি সাংবাদিক পরিবেষ্টিত জেনারেল এরশাদ।

জেনারেল এরশাদের জন্য ভালো সুযোগ

রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে নানা দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ পেতে থাকে বিভিন্ন সংবাদপত্রে।

প্রেসিডেন্ট সাত্তার সরকারের এই দুর্নীতির খবর জেনারেল এরশাদের জন্য আরো ভালো সুযোগ তৈরি করে দেয়।

নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়, ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাপ্রধান জেনারেল এইচএম এরশাদ দেখা করেন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের সাথে।

সে বৈঠকে মন্ত্রীসভার আকার ছোট করা এবং ‘দুর্নীতিবাজ’ মন্ত্রীদের বাদ দেবার দাবি করেন সেনাপ্রধান।

তখনই সবাই বুঝেতে পারেন যে জেনারেল এরশাদ যে কোন সময় ক্ষমতা দখল করতে পারেন।

উনিশ’শ বিরাশি সালের ২৪শে মার্চ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন তৎকালীন সেনা প্রধান ল্যাফটেনেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

এ সময় তিনি সামরিক আইন জারি করেন। তিনি নিজেকে দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেন।

সাতাশে মার্চ বিচারপতি আহসানউদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত করেন।

প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক

কিন্তু প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে সব ক্ষমতা ছিল জেনারেল এরশাদের হাতে।

কারণ সামরিক আইন অনুযায়ী প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্রপতি কোন ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারতেন না।

মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর মতে, জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ অপ্রত্যাশিত ছিলনা।

“জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া বস্তুতপক্ষে শুরু হয় জেনারেল জিয়া হত্যার পর এবং এর ধারাবাহিকতা চূড়ান্ত রূপ পায় ২৪শে মার্চ,” লিখেছেন জেনারেল চৌধুরী।

তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী এটা প্রতীয়মান হয় যে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলের পেছনে আমেরিকার নীরব সমর্থন ছিল।

তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রোনাল্ড রেগান।

জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের এক সপ্তাহ পরে নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের নিয়ে রেগান প্রশাসন কোন সমস্যা দেখছে না।

এছাড়া রাষ্ট্রপতি আহসানউদ্দিনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত।

নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

ক্ষমতা দখল করে জেনারেল এরশাদ নয় বছর টিকে ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি জাতীয় পার্টি গঠন করেন।

এই রাজনৈতিক দল পরবর্তীতে বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোতে ভোটের হিসেব-নিকেশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

২০০৭ সালের সেনা হস্তক্ষেপ

জেনারেল এরশাদের পতনের পরে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে একটি অবাধ সাধারণ নির্বাচনের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনরায় চালু হয়।

এরপর বাংলাদেশে আরো তিনটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

অবশ্য ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখে বিতর্কিত একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

ইয়াজউদ্দিন আহমেদ

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,২০০৬ সালের ২৯শে অক্টোবর প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের জন্য শপথ নেন প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহমেদ।

ওয়ান-ইলেভেন

সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করার পর অনেকে ভেবেছিলেন যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ হয়তো আর থাকবে না। কিন্তু বেশি সময় গড়ায়নি।

দু’হাজার চার সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় সংবিধান সংশোধন করে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়স সীমা বাড়িয়ে দেয়া হয়।

আওয়ামী লীগ অভিযোগ তুলেছিল যে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তি বিচারপতি কেএম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হিসেবে পাবার জন্য এই সংশোধনী করা হয়েছিল।

এনিয়ে শুরু হয় রাজনৈতিক সংকট ও সংঘাত। প্রধান বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মুখে একতরফা একটি নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে তৎকালীন বিএনপি সরকার। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা ছড়িয়ে যায়।

এক পর্যায়ে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। স্থগিত করা হয় বিএনপির সরকারের আয়োজন করা সে নির্বাচন।

তবে সেনাবাহিনীর এই হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছিল বেশ অভিনব।

সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল না করেও তাদের পছন্দসই বেসামরিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে।

মইন ইউ আহমেদ
ছবির ক্যাপশান,মইন ইউ আহমেদের লেখা এই বইটি প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে।

মইন আহমদ-এর ‘শান্তির স্বপ্নে’

তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদ সে সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখেছেন।

‘শান্তির স্বপ্নে’ বইতে জেনারেল আহমেদ লিখেছেন, রাজনীতিতে কোনভাবেই সেনাবাহিনীকে জড়াতে চাননি।

কিন্তু দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে সেনা কর্মকর্তারা তার উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন বলে জেনারেল আহমেদ উল্লেখ করেন।

দু’হাজার সাত সালের ১১ই জানুয়ারি জেনারেল মইন ইউ আহমেদ এবং সশস্ত্র বাহিনীর অন্যান্য প্রধান ও ডিজিএফআইয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্তা সেদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন।

তারা আড়াইটার সময় বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন। ভেতরে গিয়ে শোনেন, প্রেসিডেন্ট মধ্যাহ্নভোজন করছেন।

জেনারেল আহমেদ লিখেছেন, তাদের একটি কামরায় অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়। ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষা করবার পর প্রেসিডেন্টের দেখা মেলে। প্রেসিডেন্টকে তারা ‘মহা-সংকটময় পরিস্থিতি’ থেকে দেশকে উদ্ধার করার অণুরোধ জানান। প্রেসিডেন্ট বিষয়টি ভেবে দেখার সময় নেন।

জরুরী অবস্থা জারি

দীর্ঘ নীরবতার পর প্রেসিডেন্ট জরুরি অবস্থা জারির পক্ষে মত দেন।

সেই সাথে তিনি নিজে প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়িয়ে উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দেবেন বলে জানান।

প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সরে দাঁড়ান এবং জারী করা হয় জরুরী অবস্থা।

এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে আরেকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।

দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসে।