রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে কি?
- আপডেট সময় : ০৩:৪৭:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪ ৬০ বার পড়া হয়েছে
এসব নিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজ্ঞ কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। তারা বর্তমান সংবিধানের এ সংক্রান্ত ধারাগুলোর কথা তুলে ধরেছেন। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে এরপর করণীয় কী, সে বিষয়েও কথা বলেন তারা।
দৈনিক মানবজমিনের মাসিক ম্যাগাজিন ‘জনতার চোখে’ প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর একটি প্রতিবেদন থেকে সূত্রপাত বিতর্কের। ওই প্রতিবেদনে মতিউর রহমান চৌধুরী দাবি লিখেছেন, রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে শুরু করে সরকারের কোনো দফতরেই শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নেই। খোদ রাষ্ট্রপতি তাকে বলেছেন, তার কাছেও পদত্যাগপত্র বা এর অনুলিপি নেই, নেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও।
এর আগে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করেন। ওই দিনই বিকেলে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ঘোষণা দেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। পরে রাষ্ট্রপতি নিজেও জনগণের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে একই তথ্য জানান।
এর দুয়েক দিন পরই শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় এক গণমাধ্যমকে বলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে। ফলে সাংবিধানিকভাবে তিনিই এখনো বাংলাদশের প্রধানমন্ত্রী। একই দাবি পরে আওয়ামী লীগের অন্য নেতারাও করেছেন। এমনকি শেখ হাসিনার দুয়েকটি ফোনকল রেকর্ড ফাঁস হলে সেখানেও তাকে বলতে শোনা যায়, তিনি পদত্যাগ করেননি। মানবজমিন সম্পাদককে দেওয়া রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের পর এই বিতর্ক আবার তুঙ্গে ওঠে।
সরকারের তরফ থেকে রাষ্ট্রপতির এমন বক্তবের সমালোচনা করে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সোমবার (২১ সেপ্টেম্বর) গণমাধ্যমকে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, রাষ্ট্রপতি আগ ই বলেছেন যে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। এরপর তার দেওয়া বক্তব্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করেছেন, শপথ ভঙ্গ করেছেন। এর ফলে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে থাকার যোগ্য কি না, সেটি উপদেষ্টা পরিষদ খতিয়ে দেখবে।
বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে যদি রাষ্ট্রপতি কোনো না কোনোভাবে পদত্যাগ করে বসেন, তাহণেল তার অবর্তমানে বা অনুপস্থিতিতে কে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করবেন? অনলাইন-অফলাইনে এখন এ প্রশ্নটিও ঘুরপাক খাচ্ছে।
জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ আহসানুল করিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কোনো সাংবিধানিক সংকট বা শূন্যতা তৈরি হবে না। কারণ এ বিষয়ে সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতির প্রসঙ্গ পুরোটাই উল্লেখ আছে।’
সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করিবেন।’
গত সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীও কিছুদিন আগে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। ফলে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে তার জায়গায় স্পিকারেরও দায়িত্ব পালনের সুযোগ নেই। তাহলে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কী হবে?
এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অনুপস্থিতিতে সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদের পাশাপাশি ৭৪(২) ও ৭৪(৬) অনুচ্ছেদ মিলিয়ে পড়তে হবে।’ এই দুটি অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার সংক্রান্ত বিধান উল্লেখ করা হয়েছে।
৭৪ (১) ধারায় বলা আছে, জাতীয় নির্বাচনের পর সংসদের প্রথম বৈঠকে সংসদ সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে সংসদ একজন স্পিকার ও একজন ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করবেন। এই দুই পদের যেকোনোটি শূন্য হলে সাত দিনের মধ্যে কিংবা ওই সময়ে সংসদ বৈঠকরত না থাকলে পরবর্তী প্রথম বৈঠকেই ওই পদ পূর্ণ করতে বলা হয়েছে।
৭৪ (২) অনুচ্ছেদে স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারের পদ শূন্য হওয়র শর্তগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। আর সংবিধানের ৭৪ (৬) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— ৭৪(২) অনুচ্ছেদে যাই বলা থাকুক না কেন, ক্ষেত্রমতো স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তাদের উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত নিজ পদে বহাল থাকছেন বলে বিবেচনা করা হবে।
এই ধারার প্রসঙ্গ টেনে সংবিধান বিশেষজ্ঞ আহসানুল করিম বলেন, ‘অনেকেই এ বিষয়ে ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার পদত্যাগ করেলেও তাদের উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা নিজ নিজ পদে বহাল রয়েছেন।’
তবে বাস্তবতা হলো, ৫ আগস্টের পর থেকে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর কোনো খোঁজ মেলেনি। ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু হত্যা মামলার আসামি হিসেবে কারাগারে বন্দি। শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য যেমন আপিল বিভাগের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলেও একই পথে সমাধান খুঁজতে হবে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারের অবর্তমানে কে দায়িত্ব পালন করবেন, তা সংবিধানের ৫৪ ও ৭৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে। তবে এ বিষয়ে যদি আরও কোনো ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হয়, তাহলে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে মতামত চাওয়া যেতে পারে।’
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আইনজীবী ইউনুস আলী আকন্দ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী নতুন সংসদ ছাড়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করার সুযোগ নেই। তবে সবকিছু পুরোপুরি সংবিধান বা আইন অনুযায়ী হচ্ছে, এ কথাও বলা যাবে না। আমি মনে করি, রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারের পদত্যাগ ও অনুপস্থিতির প্রসঙ্গে আপিল বিভাগের কাছ থেকে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরামর্শ বা মতামত নেওয়া প্রয়োজন।’
সরকারও যে একই পথে ভাবছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দুই উপদেষ্টার সাক্ষাতের ঘটনায়। এ দিন বিকেলে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম প্রধান বিচারপতির দফতরে গিয়ে তার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ এবং তিনি পদত্যাগ করলে কে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হবেন, সে বিষয়েও আলোচনা হয়।
এদিকে সোমবার দিনভর বিতর্কের পর রাতে রাষ্ট্রপতির প্রেসউইং থেকে একটি ‘সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা’ পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। তাতে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের ইস্যুটি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মাধ্যমে সংবিধানের ১০৬ নম্বর ধারার প্রয়োগের মাধ্যমে মীমাংসিত। এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক তৈরি করে সরকারকে অস্থিতিশীল বা বিব্রত করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেন রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতির এই ‘সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা’ অবশ্য সন্তুষ্ট করতে পারেনি ছাত্র-জনতাকে। মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সমাবেশ থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ বা অপসারণ দাবি করা হয়েছে এ সপ্তাহের মধ্যে।
এ দিন সন্ধ্যায় ছাত্র-জনতা রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবন বঙ্গভবন অভিমুকে যাত্রা করে। বঙ্গভবনের সামনে দীর্ঘ সময় বিক্ষোভ করে। পরে বঙ্গভবনে ঢুকতে চাইলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাধা দিলে সংঘর্ষে কমপক্ষে পাঁচজন আহত হয়েছেন। বুধবার বিকেলে ফের বঙ্গভবনের সামনে জমায়েতের ঘোষণা দিয়ে মধ্যরাতে এ দিনের মতো আন্দোলন স্থগিত করেছে শিক্ষার্থীরা