রিং নিয়ে ‘অস্থিরতা’, টনক নড়ছে না ঔষধ প্রশাসনের
- আপডেট সময় : ০৫:২১:৪৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ জানুয়ারী ২০২৫
- / 40
হার্টের স্টেন্ট (রিং) আমদানি ও সরবরাহকারীদের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। যেখানে ২৭টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ৪৪ ধরনের হার্টের রিংয়ের দাম দুই হাজার থেকে ৫৬ হাজার টাকা পর্যন্ত কমানো হয়েছে। এ দামে মাত্র তিনটি কোম্পানি (আমেরিকান) সন্তুষ্ট থাকলেও দাম নির্ধারণে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে স্টেন্ট আমদানি ও সরবরাহ বন্ধ রেখেছে বাকি ২৪টি কোম্পানি (ইউরোপিয়ান)। এতে ভয়াবহ ভোগান্তিতে পড়েছেন হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীরা।
এদিকে, গত ১০ দিন ধরে কোম্পানিগুলোর নীরব ধর্মঘটেও অনেকটা চুপ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
রোগীরা কেন ভোগান্তিতে
চিকিৎসকদের মতে, দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বছরে হার্টের রিংয়ের প্রয়োজন হয় ৩০ হাজারের বেশি। যার অর্ধেক আসে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, পোল্যান্ড, ইতালি, স্পেনসহ ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে। বাকি অর্ধেক আসে আমেরিকা থেকে।
গত ১৫ ডিসেম্বর হার্টে ব্লক নিয়ে রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আসেন টঙ্গীর কলেজগেট এলাকার বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম। পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, তার হৃদযন্ত্রে ৭০ শতাংশের বেশি ব্লক। এ অবস্থায় দ্রুত হার্টে রিং পরাতে হবে। খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন, তার যে সাইজের (আকার) রিং প্রয়োজন, ধর্মঘটের কারণে কোম্পানিগুলো সেটির সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। বাধ্য হয়ে গত ১৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি মেডট্রোনিকের দুটি রিং দেড় লাখ টাকায় কিনতে হয়েছে তাকে।
আমেরিকার কোম্পানি অ্যাবোট ভাস্কুলারের তৈরি জিয়েন্স অ্যালপাইন রিংয়ের দাম ভারতে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫০ হাজার ৮৯২ টাকা হলেও বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে এক লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকায়। এ রিং বাংলাদেশে আমদানি করছে কার্ডিয়াক কেয়ার লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। একই দেশের তৈরি রিসোলুট অনিক্স ভারতে ৫০ হাজার টাকায় মিললেও বাংলাদেশি কোম্পানি মেডট্রোনিক নিচ্ছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। সিনার্জির দামেও একই চিত্র। ভারতে ৫০ হাজার টাকার রিং বাংলাদেশে হয়ে যাচ্ছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা
এ প্রসঙ্গে সাইদুল ইসলাম বলেন, যেখানে আমার একটি রিং হলেই চলত, সেখানে আমাকে অন্য কোম্পানির ডাবল রিং কিনে ব্যবহার করতে হয়েছে। এটা তো মানুষের জীবন-মরণের সমস্যা। সুতরাং এটা নিয়ে কেন আন্দোলন হবে, কেন সরবরাহ বন্ধ থাকবে? কোম্পানিগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যায় কেন রোগীরা ভোগান্তির শিকার হবে?
হার্টের রিংয়ের সংকটের এ চিত্র শুধু হৃদরোগ হাসপাতালে নয়, সরকারি অন্যান্য হাসপাতালগুলোতেও সংকট শুরু হয়েছে। ঠিক মতো আকার না পাওয়ায় অনেক রোগীকে রিং পরাতে পারছেন না চিকিৎসকরা। আবার অনেক কষ্টে মিললেও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে।
কেন চুপ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর
একদিকে হাসপাতালগুলোতে রোগীদের চরম ভোগান্তি, অন্যদিকে বেশির ভাগ কোম্পানির দীর্ঘ ধর্মঘটেও কোনো সাড়া দিচ্ছে না ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। আমদানি ও সরবরাহ বন্ধ রাখা কোম্পানিগুলো সংকট নিরসনে এগিয়ে আসতে চাইলেও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে না কোনো উদ্যোগ।
ধর্মঘটকারীরা বলছেন, জাতীয় হৃদরোগ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এক সাবেক পরিচালক ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট অনৈতিক সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে আমেরিকার তিনটি উৎপাদনকারী কোম্পানিকে অধিক মুনাফার সুযোগ দিয়ে বাকি কোম্পানিগুলোকে ক্ষতির মুখোমুখি দাঁড় করে দিয়েছে। এ বিষয়ে আমদানিকারক ২৪টি কোম্পানির প্রতিনিধিরা বারবার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের প্রস্তাব দিলেও সাড়া দিচ্ছে না তারা।
আমদানিকারকদের মধ্যে যাদের দাম নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে, তারা সমাধানের জন্য কোর্টে গেছেন। কোর্ট থেকে হয়ত সমাধান আসবে। এর বাইরে যদি আমরা সবাইকে নিয়ে বসতে পারি এবং একটা সমাধান বের করতে পারি, তাহলে হয়ত সংকট নিরসন হবে
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ
মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় হার্টের রিংয়ের (স্টেন্ট) দাম পুনর্নির্ধারণের দাবি নিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আসেন ইউরোপিয়ান ২৪টি কোম্পানির প্রতিনিধি দল। বেলা ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষার পর স্বল্প সময়ের ‘রুদ্ধদ্বার’ সাক্ষাতের সুযোগ মেলে তাদের। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে উপস্থিত হতে চাইলে তাদের ভেতরে ঢুকার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
আরও পড়ুন
‘বিচারহীনতায়’ বাড়ছে চিকিৎসকদের ওপর হামলা-নির্যাতন
আলোচনায় ডেঙ্গু ভ্যাকসিন, কোনটা এগিয়ে?
এ বিষয়ে মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ওয়াসিম আহমদ বলেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর আজ ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালকের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, সমস্যা সমাধানে ব্যক্তিগতভাবে তার আন্তরিকতার অভাব নেই। তবে, টেকনিক্যাল কমিটির বাইরে গিয়ে তিনি কিছুই করতে পারছেন না। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, তিনি এ বিষয়ে ভূমিকা নিতে চাইলেও শক্ত একটা সিন্ডিকেট সেটা হতে দিচ্ছে না।
রিং নিয়ে অস্থিরতার মূলে ৩ চিকিৎসক
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমেরিকার কোম্পানি অ্যাবোট ভাস্কুলারের তৈরি জিয়েন্স অ্যালপাইন রিংয়ের দাম ভারতে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫০ হাজার ৮৯২ টাকা হলেও বাংলাদেশে বিক্রি হচ্ছে এক লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকায়। এ রিং বাংলাদেশে আমদানি করছে কার্ডিয়াক কেয়ার লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। একই দেশের তৈরি রিসোলুট অনিক্স ভারতে ৫০ হাজার টাকায় মিললেও বাংলাদেশি কোম্পানি মেডট্রোনিক নিচ্ছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। সিনার্জির দামেও একই চিত্র। ভারতে ৫০ হাজার টাকার রিং বাংলাদেশে হয়ে যাচ্ছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। এটি আমদানি করছে মেডি গ্রাফিক নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
এক মেয়েকে আইসিইউতে রেখে আরেক মেয়েকে দাফন
অন্যদিকে, ইউরোপীয় ২৪টি কোম্পানিকে সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাতে বিক্রি করলে লাভের বিপরীতে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে বলে দাবি করছেন আমদানিকারকরা। হার্টের রিং নিয়ে এমন অস্থিরতার পেছনে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এক সাবেক পরিচালক ও বর্তমান এক অধ্যাপকসহ তিন চিকিৎসক দায়ী বলে মনে করছেন তারা।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর আজ ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালকের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, সমস্যা সমাধানে ব্যক্তিগতভাবে তার আন্তরিকতার অভাব নেই। তবে, টেকনিক্যাল কমিটির বাইরে গিয়ে তিনি কিছুই করতে পারছেন না। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, তিনি এ বিষয়ে ভূমিকা নিতে চাইলেও শক্ত একটা সিন্ডিকেট সেটা হতে দিচ্ছে না
ওয়াসিম আহমদ, সভাপতি, মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন
ধর্মঘটে যাওয়া আমদানিকারকরা বলছেন, তিনজন চিকিৎসক রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আমেরিকান তিনটি কোম্পানিকে একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। এমনকি যে রিং ভারতে মাত্র ৫০ হাজার টাকায় পাওয়া যায়, সেটি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে প্রভাবিত করে এক লাখ ৪০ হাজার টাকায় মানুষকে কিনতে বাধ্য করছে, যা রীতিমতো অন্যায়।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমদানি বন্ধ রাখার ঘোষণা
ওয়াসিম আহমদ বলেন, ঔষধ প্রশাসনের মহাপরিচালক আমাদের বলছেন, টেকনিক্যাল কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে দামের বিষয়টি আবার পর্যালোচনা করবেন। এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, বর্তমানে রিংয়ের দামে যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তা টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশক্রমে হয়েছে। এখানে কিছু ব্যাপার খুবই স্পষ্ট, স্বাভাবিকভাবে যদি আমি কোনো একটা পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিই, আমিই আবার কিছুক্ষণ পর ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাই তাহলে কেমন হবে?
তিনি বলেন, আমাদের আশঙ্কা, শুধু টেকনিক্যাল কমিটির ওপর দায় ছেড়ে দিলে কখনওই সমস্যার সমাধান হবে না। এ ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। তা না হলে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমদানি ও সরবরাহ বন্ধ রাখব।
সংকট নিরসনে আমরা শিগগিরই বসব : মহাপরিচালক
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা একটা কমিটির মাধ্যমে আলোচনার ভিত্তিতে রিংয়ের দাম পুনর্নির্ধারণ করেছি। আমাদের আলোচনায় আমদানিকারকদের অনেকেই ছিলেন। তাদের সম্মতি নিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেখানে টেকনিক্যাল কমিটির অধিকাংশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
যেখানে আমার একটি রিং হলেই চলত, সেখানে আমাকে অন্য কোম্পানির ডাবল রিং কিনে ব্যবহার করতে হয়েছে। এটা তো মানুষের জীবন-মরণের সমস্যা। সুতরাং এটা নিয়ে কেন আন্দোলন হবে, কেন সরবরাহ বন্ধ থাকবে? কোম্পানিগুলোর অভ্যন্তরীণ সমস্যায় কেন রোগীরা ভোগান্তির শিকার হবে
ভুক্তভোগী সাইদুল ইসলাম
সমাধান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমদানিকারকদের মধ্যে যাদের দাম নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে, তারা সমাধানের জন্য কোর্টে গেছেন। কোর্ট থেকে হয়ত সমাধান আসবে। এর বাইরে যদি আমরা সবাইকে নিয়ে বসতে পারি এবং একটা সমাধান বের করতে পারি, তাহলে হয়ত সংকট নিরসন হবে।
রিং সরবরাহ বন্ধ থাকায় ভয়াবহ ভোগান্তিতে পড়েছেন হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীরা/ ছবি : ঢাকা পোস্ট
মোহাম্মদ ইউসুফ আরও বলেন, আমরা হয়ত শিগগিরই কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশন স্টেক হোল্ডারদের আবার ডাকব। তারা যদি দাম কমাতে বা বাড়াতে চায়, তাহলে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে। এখানে আমার পক্ষে একা কিছু করার ক্ষমতা নেই।
আমাদের আশঙ্কা, শুধু টেকনিক্যাল কমিটির ওপর দায় ছেড়ে দিলে কখনওই সমস্যার সমাধান হবে না। এ ক্ষেত্রে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। তা না হলে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমদানি ও সরবরাহ বন্ধ রাখব
ওয়াসিম আহমদ, সভাপতি, মেডিকেল ডিভাইস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন
প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী দেশ ভারতে সব ধরনের রিং বাংলাদেশি টাকায় ৫০ হাজারের আশপাশে বিক্রি হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশে একই রিং বিক্রি হচ্ছে প্রায় দেড় লাখ টাকায়। যা নির্ধারণ করে দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (ডিজিডিএ)। এর বিরুদ্ধে আদালতে রিট করেছে ১১টি আমদানিকারক কোম্পানি। এ রিটের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা আমদানি বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে।