ঢাকা ০৫:৫১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
ড: মুহাম্মদ ইউনুস ইন্ডিয়ার জায়গামত আঘাত করেছে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রাজনৈতিক দলের ঐক্য ভারত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরে বাধ্য: ড. ইউনূস মুন্নী সাহা সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে বেতনের বাইরে জমা হয় ১৩৪ কোটি জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে আ. লীগের দৃষ্টিতে দেখা বন্ধ করতে হবে : ভারতকে নাহিদ ইসলাম “ছাত্রদের ভূমিকা ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বার্তা” অশান্তির জন্য মহম্মদ ইউনূসকেই দায়ী করলেন শেখ হাসিনা৷ ফেরত চাওয়া হবে শেখ হাসিনাকে, মানতে বাধ্য ভারত: ড. ইউনূস আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার: শ্বেতপত্রে উন্মোচিত সাংবাদিক মুন্নী সাহা গ্রেপ্তার অচিরেই কুমিল্লাকে বিভাগ ঘোষণা: উপদেষ্টা আসিফ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত কেন তথ্যযুদ্ধে নেমেছে? ভারতের দ্বিচারিতা নিন্দনীয় ও আপত্তিকর: আসিফ নজরুল কোটি টাকার বাস ৯০ লাখে বানাবে বিআরটিসি ভয়েস অব আমেরিকার জরিপ: সংখ্যালঘুরা ‘আগের তুলনায় বেশি নিরাপত্তা পাচ্ছে’ বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল বন্ধের খবর ভুয়া ধানমন্ডি লেকে হবে ‘বিদ্রোহী চত্বর’ সারজি এবং হাসনাতের গাড়ি চাপা দেয়া ট্রাক ও ট্রাকের ড্রাইভার আটক রাষ্ট্রের যেসব বিষয়ে বড়সড় পরিবর্তনের কথা ভাবছে সংস্কার কমিশনগুলো

শহীদ গোলাম নাফিজ

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ১২:৪৭:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ ২৯ বার পড়া হয়েছে
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
গোলাম নাফিজ
মৃত্যু ৪ আগস্ট ২০২৪ (বয়স ১৬–১৭)

ফার্মগেট, ঢাকা, বাংলাদেশ
মৃত্যুর কারণ গুলিতে নিহত
শিক্ষা বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
নৌবাহিনী কলেজ, ঢাকা (কখনো গমন করে নি)
পরিচিতির কারণ ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব
আন্দোলন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান

  • ২০২৪-এ বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন
  • অসহযোগ আন্দোলন
পিতা-মাতা গোলাম আহমেদ (পিতা)
নাসিমা আক্তার (মাতা)

ব্যক্তিগত জীবন

নাফিজ গোলাম আহমেদ ও নাসিমা আক্তার দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান ছিল। সে তাঁর দুই ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিল। সে তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মহাখালীতে বসবাস করত। নাফিজ বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে তাঁর সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়। এরপর সে নৌবাহিনী কলেজ, ঢাকায় একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়, কিন্তু কোনোদিন কলেজে যেতে পারে নি।

অসহযোগ আন্দোলন ও মৃত্যু

বহিঃস্থ ভিডিও
৪ আগস্টে ফার্মগেট এলাকার সংঘর্ষ নিয়ে আল জাজিরার একটি চিত্র-প্রামাণ্যচিত্র যার শেষের দিকে নাফিজকে রিকশায় নিয়ে যাওয়া অবস্থায় দেখানো হয়
video icon Covering the deadliest day of the protests in Bangladesh – 35th July (ইংরেজি ভাষায়)

নাফিজ ২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। অসহযোগ আন্দোলনের প্রথমদিন, আন্দোলনে অংশ নিতে নাফিজ তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ফার্মগেট–খামারবাড়ি এলাকায় যায়। স্থানীয় সময় বিকাল ৪.৩০ টার দিকে, ফার্মগেট চৌরাস্তায় সে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর, তাঁর সহ-আন্দোলনকারীরা তাঁকে একটি রিকশায় তুলে দেয় যেটি তাঁকে নিকটতম হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করে। রিকশাচালক নূর মোহাম্মদের মতে, সে তখন অচেতন ছিল এবং তখনও জীবিত ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রিকশাটিকে রাস্তায় বাঁধা দেয়, যার ফলে তাঁকে হাসপাতালে নিতে বিলম্ব হয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর চিকিৎসক নাফিজকে মৃত ঘোষণা করেন।[][] হাসপাতালে যাওয়ার পথে, দৈনিক মানবজমিনের চিত্রসাংবাদিক জীবন আহমেদ নাফিজের একটি স্মরণীয় ছবি ধারণ করেন, যেখানে তাঁকে বাংলাদেশের পতাকা মাথার চারপাশে বাঁধা, রিকশার পাদানিতে শোয়া এবং বাহু ও পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখা যায়। ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয় এবং পরদিন মানবজমিনের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়।তাঁর পিতা সারারাত ধরে তাঁকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে খুঁজে বেড়ান, কেবলমাত্র পরদিনই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তাঁর ছেলের মরদেহ খুঁজে পান।

স্মৃতি

রিকশায় বহনরত নাফিজের একটি 

১৯ আগস্ট ২০২৪ তারিখে, অন্তর্বর্তী সরকারের দুইজন উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম দুইজন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নাফিজের বাড়ি পরিদর্শন করেন এবং নাফিজের পিতামাতার প্রতি সান্ত্বনা জানান। বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ তাঁদের একটি ভবনের নাম নাফিজের নামে নামকরণ করেছে।নাফিজকে বহন করা রিকশাটি পরবর্তীতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে দান করা হয় এবং রিকশাচালক নূর মোহাম্মদকে তাঁর দুঃসাহসিক ভূমিকার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক অর্থনৈতিক সহায়তার আশ্বাস প্রদান করা হয়।

উৎস

 

 

 

 

 

 

prothomalo-bangla

গুলিবিদ্ধ নাফিজকে রিকশার পাদানিতে তুলে দেওয়া হয়। তখনো রড ধরে রেখেছিল নাফিজ। দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের তোলা এই ছবি দেখেই মা-বাবা হাসপাতালের মর্গে খুঁজে পান ছেলের মরদেহগুলিবিদ্ধ নাফিজকে রিকশার পাদানিতে তুলে দেওয়া হয়। তখনো রড ধরে রেখেছিল নাফিজ। দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের তোলা এই ছবি দেখেই মা-বাবা হাসপাতালের মর্গে খুঁজে পান ছেলের মরদেহ
বাংলাদেশ
পাদানিতে ঝুলতে থাকা গুলিবিদ্ধ নাফিজ তখনো রিকশার রড ধরে ছিল
মানসুরা হোসাইনঢাকা
Published: 12 Aug 2024, 12:27
গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজকে পুলিশ যখন রিকশার পাদানিতে তুলে দেয়, তখনো সে রিকশার রডটি হাত দিয়ে ধরে রেখেছিল। রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ তাকে নিয়ে রাজধানীর ফার্মগেটের একটি হাসপাতালে ঢুকতে গেলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বাধা দেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক। পরে ১৭ বছরের গোলাম নাফিজকে নিয়ে রিকশাচালক খামারবাড়ির দিকে চলে যান।

দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বাধার পরও রিকশার পাদানিতে ঝুলতে থাকা নাফিজের কয়েকটি ছবি তুলতে পেরেছিলেন। ৪ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টার পর পত্রিকাটির প্রথম পাতায় ছাপা নাফিজের একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ছবি দেখেই নাফিজের মা-বাবা সন্তানের খোঁজ পান।

ওই যে দেখেন, ছেলেটা রিকশার রডটা ধইরা রাখছিল। কত খুঁজলাম, তখন যদি ছেলেটারে পাইতাম, বাঁচানোর জন্য একটু চেষ্টা করতে পারতাম। ছেলের বুকের মধ্যে লাগা গুলি পিঠের দিক দিয়া বাইর হইয়া যায়। পরে তো শুনি আমার চাঁদের মতো ছেলেটা মর্গে আছে।
গোলাম রহমান, নিহত গোলাম নাফিজের বাবা।

এখন মা–বাবা আর ওই ফটোসাংবাদিকের আক্ষেপ, যদি দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যেত আর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো ছেলেটিকে বাঁচানো সম্ভব হতো।

গোলাম নাফিজ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে গুলিতে মারা যায়। সে রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করে কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। পরিবারসহ থাকত মহাখালীতে। দুই ভাই তারা। নাফিজ ছোট।

বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে ইউনিফর্ম পরা গোলাম নাফিজছবি: পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া
গত শনিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, বাসায় নাফিজের ঘরে একটি বড় ব্যানার টানানো আছে। বনানী বিদ্যানিকেতনের বানানো এই ব্যানারে রিকশার পাদানিতে মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা রক্তাক্ত নাফিজের ছবির পাশেই তার আগের একটি হাসিমুখের ছবি দেওয়া আছে।

নাফিজের বড় ভাইয়ের নাম গোলাম রাসেল। এইচএসসি পাস করে এখন তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। নাফিজ বড় ভাইয়ের বই দিয়ে নিজের পড়ার টেবিলটি সাজিয়ে রেখেছিল। কলেজের নতুন পোশাক (ইউনিফর্ম) বানানোর পাশাপাশি শীতের সময় পরার জন্য পছন্দ করে সোয়েটার কিনেছিল। এখন সেসব ঘরে পড়ে আছে।

বিজ্ঞাপন

নাফিজের বাবা গোলাম রহমান ও মা নাজমা আক্তার। নাফিজের ঘরে বসে তাঁরা একটি প্যাকেট থেকে একে একে ছেলের কলেজের নতুন পোশাক, ছোটবেলার নীল রঙের একটি বল আর রিমোটচালিত খেলনা গাড়ি বের করে দেখালেন। বললেন, ‘ছেলে কলেজে পড়লেও এগুলো দিয়ে খেলত। স্কুলে বিতর্ক করত।’

রিকশার পাদানিতে সন্তানের রক্তাক্ত শরীরের ছবি দেখিয়ে পেশায় ব্যবসায়ী গোলাম রহমান বলেন, ‘ওই যে দেখেন, ছেলেটা রিকশার রডটা ধইরা রাখছিল। কত খুঁজলাম, তখন যদি ছেলেটারে পাইতাম, বাঁচানোর জন্য একটু চেষ্টা করতে পারতাম। ছেলের বুকের মধ্যে লাগা গুলি পিঠের দিক দিয়া বাইর হইয়া যায়। পরে তো শুনি আমার চাঁদের মতো ছেলেটা মর্গে আছে।’

নাফিজের পরিবারের সদস্য, বন্ধুসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্দোলন করতে গিয়ে ৪ আগস্ট বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফার্মগেটের পদচারী–সেতুর নিচে নাফিজ গুলিবিদ্ধ হয়। নাফিজ নিজের মুঠোফোন বাসায় রেখে গিয়েছিল। তিনটার দিকে এক বন্ধুর মুঠোফোন থেকে মাকে ফোন করে বলেছিল, ফার্মগেটের দিকে আছে সে। ভালো আছে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে।

ইউনিফর্ম আর শখের জিনিসেই ছেলে নাফিজকে খোঁজেন মা–বাবাছবি: প্রথম আলো
বিজ্ঞাপন

গোলাম রহমান জানান, ওই দিন রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ছেলেকে খুঁজতে বের হয়েছিলেন তিনি। কয়েকবার পুলিশি বাধার মুখেও পড়েন। ফার্মগেট আর সোনারগাঁও মোড়ে কয়েকবার ঘুরে আসেন। বিভিন্ন থানায় খোঁজ নেন। ভেবেছিলেন, ছেলেকে হয়তো আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে। না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও খুঁজতে যান।

নিজেই চাইতাম আন্দোলনে ছাত্ররা জিতুক। নামাজ পড়ে দোয়া করতাম আর কোনো মায়ের বুক যাতে খালি না হয়। ছেলের মোবাইলে আন্দোলনের অনেক ছবি ছিল। নিরাপত্তার জন্য ছবি ডিলিট করতে বলায় ছেলে আমার সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই ছেলে আমারে দেশ দিয়ে গেছে। আমি আওয়ামী লীগ-বিএনপি বুঝি না, আমি শুধু চাই দেশে শান্তি আসুক।
নাজমা আক্তার, নিহত গোলাম নাফিজের মা।
গোলাম রহমান বলেন, ‘কোথাও না পেয়ে রাত ১২টা নাগাদ বাসায় ফিরি। এরপরই বড় ছেলে মানবজমিনে ছাপা হওয়া ছবিটা দেখায়। বুঝতে পারি, ছেলেটা হয়তো ততক্ষণে আর বেঁচে নাই। বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলেকে খুঁজতে শুরু করি।’

গোলাম রহমান বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ২৭টি লাশ। আমরা তো লাশ দেইখ্যা অভ্যস্ত না। তারপরও দেখি যদি ছেলেরে পাই। মানবজমিনের ছবিটা দেখার পর বুঝতে পারি ছেলে মারা গেছে। তবে যে করেই হোক ছেলের লাশটা পাইতে হবে। মন তো মানে না।’

ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার ঘরে। নাফিসের মামা আবুল হাসেম ফোন করে গোলাম রহমানকে জানান, নাফিজের লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আছে। লাশ আনার পর নিজেই ছেলেকে গোসল করান তিনি। বলেন, ‘ছেলের লাশ নিজেই গোসল করাই। কী যে কষ্ট।’

গোলাম রহমানের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন নাফিজের কয়েকজন বন্ধু সেখানে ছিল। ওরা নাফিজের সঙ্গে ৪ আগস্ট ঘটনাস্থলে ছিল। জানাল, গোলাগুলি শুরু হলে তারা বাসায় চলে যেতে পারলেও নাফিজ আর যেতে পারেনি। গোলাম রহমান খাতা–কলম নিয়ে সময় ধরে ধরে সেদিনের ঘটনার কথা জানতে চাচ্ছিলেন ছেলের বন্ধুদের কাছে। বললেন, ছক করে দেখতে চাচ্ছেন আসলে তিনি কোনোভাবে ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারতেন কি না।

৪-৬ আগস্ট: তিন দিনেই নিহত ৩২৬ জন
এখন ছেলে হত্যার বিচার চান শোকার্ত এই বাবা। তিনি চান, ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, তাই সে যেন জাতীয় বীরের সম্মান পায়।

ছেলে পেছন থেকে এসে আর জড়িয়ে ধরবে না—এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নাফিজের মা নাজমা আক্তার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, নাফিজ বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে যাচ্ছে এটা পরিবারের সবাই জানতেন। তবে ৪ আগস্ট পরিস্থিতি খারাপ বলে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু ছেলে যখন যাবেই, তখন সাবধানে থাকতে বলেছিলেন।

নিজের ঘরে গোলাম নাফিজের বিছানা-পড়ার টেবিল। দেয়ালে ঝুলছে নাফিজকে নিয়ে বানানো স্কুলের ব্যানারছবি: প্রথম আলো
একটু সামলে নিয়ে নাজমা আক্তার বলেন, ‘নিজেই চাইতাম আন্দোলনে ছাত্ররা জিতুক। নামাজ পড়ে দোয়া করতাম আর কোনো মায়ের বুক যাতে খালি না হয়। ছেলের মোবাইলে আন্দোলনের অনেক ছবি ছিল। নিরাপত্তার জন্য ছবি ডিলিট করতে বলায় ছেলে আমার সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই ছেলে আমারে দেশ দিয়ে গেছে। আমি আওয়ামী লীগ-বিএনপি বুঝি না, আমি শুধু চাই, দেশে শান্তি আসুক।’

কথা হলো ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের সঙ্গেও। তিনি বললেন, ছেলেটাকে যদি হাসপাতাল পর্যন্ত নিতে পারতেন, তাহলে হয়তো বাঁচত—এটাই তাঁর আক্ষেপ। তবে তাঁর তোলা ছবি দেখে মা–বাবা তাঁদের সন্তানের লাশ খুঁজে পেয়েছেন, এটা ভেবে একটু সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাধার মুখে নাফিজকে ফার্মগেটের হাসপাতালে নিতে পারেননি বলে জানান তিনি।

Also read:
নরসিংদীতে গুলিতে নিহত ১৪ জনের ৯ জনই কিশোর–তরুণ
জীবন আহমেদের তোলা সেই ছবিতে রিকশার পেছনে একটি মুঠোফোন নম্বর দেখা গেছে। ওই নম্বরে ফোন দিয়ে রিকশাচালক নূর মোহাম্মদকে খুঁজে বের করেন নাফিজের পরিবারের সদস্যরা।

রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, রিকশা তাঁর নিজের। ওই দিন ফার্মগেটে ‘গ্যাঞ্জামের’ মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন এক পুলিশ তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলে অন্যরা তাঁর রিকশায় একজনকে তুলে দেন। তিনি প্রথমে ফার্মগেটের একটি হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে বাধার মুখে সেখানে ঢুকতে পারেননি। পরে খামারবাড়িতে গেলে কয়েকজন নাফিজকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে বলে একটি অটোরিকশায় তুলে নিয়ে চলে যান।

রিকশার পাদানিতে থাকা গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজের ছবি ছাপা হয় মানবজমিন পত্রিকার প্রথম পাতায়। এই ছবি দেখেই মা-বাবা খুঁজে পান নাফিজকে।ছবি: প্রথম আলো
৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরখানে নাফিজকে কবর দেওয়া হয়। সে ছোটবেলা থেকেই স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি স্কাউট, বিএনসিসি কার্যক্রমে সক্রিয় ছিল। নাফিজ শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছিল। সে ক্রেস্ট, সনদ আর নাফিজের পছন্দের ঘড়িসহ অন্যান্য জিনিসে হাত বুলিয়ে দেখছিলেন মা–বাবা।

বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ জানালেন, বিদ্যালয়ের মিলনায়তনের নাম নাফিজের নামে রাখার প্রস্তাব করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

নাফিজের বড় ভাই গোলাম রাসেল বললেন, ‘টিকটক জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়েছে। তারা ঠিক যে রকম একটি দেশ চেয়েছিল, ঠিক সেই রকম একটি দেশ চাই।’

Also read:
নিহত ১১৩ জন কম বয়সী, শিক্ষার্থী ৪৫

আরও পড়ুন
ইউক্রেনের জন্য দূরপাল্লার এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র
রাশিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা, পরমাণু যুদ্ধের শঙ্কা
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা ও জনসম্পৃক্তি’ শীর্ষক কর্মশালায় ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তৃতা করেন
কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে: তারেক রহমান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ
বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ কিন্তু সফল হয়নি: হাসনাত আবদুল্লাহ
টেক্সাসে ট্রাম্পকে স্বাগত জানাচ্ছেন ইলন মাস্ক
ট্রাম্পের উপস্থিতিতে স্টারশিপ রকেট উৎক্ষেপণ স্পেস এক্সের
আফসানা করিম রাচি
অটোরিকশার ধাক্কায় ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় চারজন বরখাস্ত

স্বত্ব © ২০২৪ প্রথম আলো

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

শহীদ গোলাম নাফিজ

আপডেট সময় : ১২:৪৭:১৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
গোলাম নাফিজ
মৃত্যু ৪ আগস্ট ২০২৪ (বয়স ১৬–১৭)

ফার্মগেট, ঢাকা, বাংলাদেশ
মৃত্যুর কারণ গুলিতে নিহত
শিক্ষা বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ
নৌবাহিনী কলেজ, ঢাকা (কখনো গমন করে নি)
পরিচিতির কারণ ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব
আন্দোলন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান

  • ২০২৪-এ বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন
  • অসহযোগ আন্দোলন
পিতা-মাতা গোলাম আহমেদ (পিতা)
নাসিমা আক্তার (মাতা)

ব্যক্তিগত জীবন

নাফিজ গোলাম আহমেদ ও নাসিমা আক্তার দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান ছিল। সে তাঁর দুই ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠতম ছিল। সে তাঁর পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মহাখালীতে বসবাস করত। নাফিজ বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে তাঁর সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়। এরপর সে নৌবাহিনী কলেজ, ঢাকায় একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়, কিন্তু কোনোদিন কলেজে যেতে পারে নি।

অসহযোগ আন্দোলন ও মৃত্যু

বহিঃস্থ ভিডিও
৪ আগস্টে ফার্মগেট এলাকার সংঘর্ষ নিয়ে আল জাজিরার একটি চিত্র-প্রামাণ্যচিত্র যার শেষের দিকে নাফিজকে রিকশায় নিয়ে যাওয়া অবস্থায় দেখানো হয়
video icon Covering the deadliest day of the protests in Bangladesh – 35th July (ইংরেজি ভাষায়)

নাফিজ ২০২৪-এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। অসহযোগ আন্দোলনের প্রথমদিন, আন্দোলনে অংশ নিতে নাফিজ তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ফার্মগেট–খামারবাড়ি এলাকায় যায়। স্থানীয় সময় বিকাল ৪.৩০ টার দিকে, ফার্মগেট চৌরাস্তায় সে পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর, তাঁর সহ-আন্দোলনকারীরা তাঁকে একটি রিকশায় তুলে দেয় যেটি তাঁকে নিকটতম হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করে। রিকশাচালক নূর মোহাম্মদের মতে, সে তখন অচেতন ছিল এবং তখনও জীবিত ছিল। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা রিকশাটিকে রাস্তায় বাঁধা দেয়, যার ফলে তাঁকে হাসপাতালে নিতে বিলম্ব হয়। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর চিকিৎসক নাফিজকে মৃত ঘোষণা করেন।[][] হাসপাতালে যাওয়ার পথে, দৈনিক মানবজমিনের চিত্রসাংবাদিক জীবন আহমেদ নাফিজের একটি স্মরণীয় ছবি ধারণ করেন, যেখানে তাঁকে বাংলাদেশের পতাকা মাথার চারপাশে বাঁধা, রিকশার পাদানিতে শোয়া এবং বাহু ও পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা অবস্থায় দেখা যায়। ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ভাইরাল হয় এবং পরদিন মানবজমিনের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়।তাঁর পিতা সারারাত ধরে তাঁকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে খুঁজে বেড়ান, কেবলমাত্র পরদিনই শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে তাঁর ছেলের মরদেহ খুঁজে পান।

স্মৃতি

রিকশায় বহনরত নাফিজের একটি 

১৯ আগস্ট ২০২৪ তারিখে, অন্তর্বর্তী সরকারের দুইজন উপদেষ্টা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম দুইজন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া নাফিজের বাড়ি পরিদর্শন করেন এবং নাফিজের পিতামাতার প্রতি সান্ত্বনা জানান। বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ তাঁদের একটি ভবনের নাম নাফিজের নামে নামকরণ করেছে।নাফিজকে বহন করা রিকশাটি পরবর্তীতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘরে দান করা হয় এবং রিকশাচালক নূর মোহাম্মদকে তাঁর দুঃসাহসিক ভূমিকার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক অর্থনৈতিক সহায়তার আশ্বাস প্রদান করা হয়।

উৎস

 

 

 

 

 

 

prothomalo-bangla

গুলিবিদ্ধ নাফিজকে রিকশার পাদানিতে তুলে দেওয়া হয়। তখনো রড ধরে রেখেছিল নাফিজ। দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের তোলা এই ছবি দেখেই মা-বাবা হাসপাতালের মর্গে খুঁজে পান ছেলের মরদেহগুলিবিদ্ধ নাফিজকে রিকশার পাদানিতে তুলে দেওয়া হয়। তখনো রড ধরে রেখেছিল নাফিজ। দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের তোলা এই ছবি দেখেই মা-বাবা হাসপাতালের মর্গে খুঁজে পান ছেলের মরদেহ
বাংলাদেশ
পাদানিতে ঝুলতে থাকা গুলিবিদ্ধ নাফিজ তখনো রিকশার রড ধরে ছিল
মানসুরা হোসাইনঢাকা
Published: 12 Aug 2024, 12:27
গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজকে পুলিশ যখন রিকশার পাদানিতে তুলে দেয়, তখনো সে রিকশার রডটি হাত দিয়ে ধরে রেখেছিল। রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ তাকে নিয়ে রাজধানীর ফার্মগেটের একটি হাসপাতালে ঢুকতে গেলে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বাধা দেন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক। পরে ১৭ বছরের গোলাম নাফিজকে নিয়ে রিকশাচালক খামারবাড়ির দিকে চলে যান।

দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বাধার পরও রিকশার পাদানিতে ঝুলতে থাকা নাফিজের কয়েকটি ছবি তুলতে পেরেছিলেন। ৪ আগস্ট দিবাগত রাত ১২টার পর পত্রিকাটির প্রথম পাতায় ছাপা নাফিজের একটি ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই ছবি দেখেই নাফিজের মা-বাবা সন্তানের খোঁজ পান।

ওই যে দেখেন, ছেলেটা রিকশার রডটা ধইরা রাখছিল। কত খুঁজলাম, তখন যদি ছেলেটারে পাইতাম, বাঁচানোর জন্য একটু চেষ্টা করতে পারতাম। ছেলের বুকের মধ্যে লাগা গুলি পিঠের দিক দিয়া বাইর হইয়া যায়। পরে তো শুনি আমার চাঁদের মতো ছেলেটা মর্গে আছে।
গোলাম রহমান, নিহত গোলাম নাফিজের বাবা।

এখন মা–বাবা আর ওই ফটোসাংবাদিকের আক্ষেপ, যদি দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া যেত আর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া যেত, তাহলে হয়তো ছেলেটিকে বাঁচানো সম্ভব হতো।

গোলাম নাফিজ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষে গুলিতে মারা যায়। সে রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করে কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল। পরিবারসহ থাকত মহাখালীতে। দুই ভাই তারা। নাফিজ ছোট।

বিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে ইউনিফর্ম পরা গোলাম নাফিজছবি: পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া
গত শনিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, বাসায় নাফিজের ঘরে একটি বড় ব্যানার টানানো আছে। বনানী বিদ্যানিকেতনের বানানো এই ব্যানারে রিকশার পাদানিতে মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা রক্তাক্ত নাফিজের ছবির পাশেই তার আগের একটি হাসিমুখের ছবি দেওয়া আছে।

নাফিজের বড় ভাইয়ের নাম গোলাম রাসেল। এইচএসসি পাস করে এখন তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। নাফিজ বড় ভাইয়ের বই দিয়ে নিজের পড়ার টেবিলটি সাজিয়ে রেখেছিল। কলেজের নতুন পোশাক (ইউনিফর্ম) বানানোর পাশাপাশি শীতের সময় পরার জন্য পছন্দ করে সোয়েটার কিনেছিল। এখন সেসব ঘরে পড়ে আছে।

বিজ্ঞাপন

নাফিজের বাবা গোলাম রহমান ও মা নাজমা আক্তার। নাফিজের ঘরে বসে তাঁরা একটি প্যাকেট থেকে একে একে ছেলের কলেজের নতুন পোশাক, ছোটবেলার নীল রঙের একটি বল আর রিমোটচালিত খেলনা গাড়ি বের করে দেখালেন। বললেন, ‘ছেলে কলেজে পড়লেও এগুলো দিয়ে খেলত। স্কুলে বিতর্ক করত।’

রিকশার পাদানিতে সন্তানের রক্তাক্ত শরীরের ছবি দেখিয়ে পেশায় ব্যবসায়ী গোলাম রহমান বলেন, ‘ওই যে দেখেন, ছেলেটা রিকশার রডটা ধইরা রাখছিল। কত খুঁজলাম, তখন যদি ছেলেটারে পাইতাম, বাঁচানোর জন্য একটু চেষ্টা করতে পারতাম। ছেলের বুকের মধ্যে লাগা গুলি পিঠের দিক দিয়া বাইর হইয়া যায়। পরে তো শুনি আমার চাঁদের মতো ছেলেটা মর্গে আছে।’

নাফিজের পরিবারের সদস্য, বন্ধুসহ আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আন্দোলন করতে গিয়ে ৪ আগস্ট বিকেল সাড়ে চারটার দিকে ফার্মগেটের পদচারী–সেতুর নিচে নাফিজ গুলিবিদ্ধ হয়। নাফিজ নিজের মুঠোফোন বাসায় রেখে গিয়েছিল। তিনটার দিকে এক বন্ধুর মুঠোফোন থেকে মাকে ফোন করে বলেছিল, ফার্মগেটের দিকে আছে সে। ভালো আছে। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে।

ইউনিফর্ম আর শখের জিনিসেই ছেলে নাফিজকে খোঁজেন মা–বাবাছবি: প্রথম আলো
বিজ্ঞাপন

গোলাম রহমান জানান, ওই দিন রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ছেলেকে খুঁজতে বের হয়েছিলেন তিনি। কয়েকবার পুলিশি বাধার মুখেও পড়েন। ফার্মগেট আর সোনারগাঁও মোড়ে কয়েকবার ঘুরে আসেন। বিভিন্ন থানায় খোঁজ নেন। ভেবেছিলেন, ছেলেকে হয়তো আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে। না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়েও খুঁজতে যান।

নিজেই চাইতাম আন্দোলনে ছাত্ররা জিতুক। নামাজ পড়ে দোয়া করতাম আর কোনো মায়ের বুক যাতে খালি না হয়। ছেলের মোবাইলে আন্দোলনের অনেক ছবি ছিল। নিরাপত্তার জন্য ছবি ডিলিট করতে বলায় ছেলে আমার সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই ছেলে আমারে দেশ দিয়ে গেছে। আমি আওয়ামী লীগ-বিএনপি বুঝি না, আমি শুধু চাই দেশে শান্তি আসুক।
নাজমা আক্তার, নিহত গোলাম নাফিজের মা।
গোলাম রহমান বলেন, ‘কোথাও না পেয়ে রাত ১২টা নাগাদ বাসায় ফিরি। এরপরই বড় ছেলে মানবজমিনে ছাপা হওয়া ছবিটা দেখায়। বুঝতে পারি, ছেলেটা হয়তো ততক্ষণে আর বেঁচে নাই। বিভিন্ন হাসপাতালে ছেলেকে খুঁজতে শুরু করি।’

গোলাম রহমান বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ২৭টি লাশ। আমরা তো লাশ দেইখ্যা অভ্যস্ত না। তারপরও দেখি যদি ছেলেরে পাই। মানবজমিনের ছবিটা দেখার পর বুঝতে পারি ছেলে মারা গেছে। তবে যে করেই হোক ছেলের লাশটা পাইতে হবে। মন তো মানে না।’

ঘড়ির কাঁটা ততক্ষণে দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার ঘরে। নাফিসের মামা আবুল হাসেম ফোন করে গোলাম রহমানকে জানান, নাফিজের লাশ শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আছে। লাশ আনার পর নিজেই ছেলেকে গোসল করান তিনি। বলেন, ‘ছেলের লাশ নিজেই গোসল করাই। কী যে কষ্ট।’

গোলাম রহমানের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন নাফিজের কয়েকজন বন্ধু সেখানে ছিল। ওরা নাফিজের সঙ্গে ৪ আগস্ট ঘটনাস্থলে ছিল। জানাল, গোলাগুলি শুরু হলে তারা বাসায় চলে যেতে পারলেও নাফিজ আর যেতে পারেনি। গোলাম রহমান খাতা–কলম নিয়ে সময় ধরে ধরে সেদিনের ঘটনার কথা জানতে চাচ্ছিলেন ছেলের বন্ধুদের কাছে। বললেন, ছক করে দেখতে চাচ্ছেন আসলে তিনি কোনোভাবে ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারতেন কি না।

৪-৬ আগস্ট: তিন দিনেই নিহত ৩২৬ জন
এখন ছেলে হত্যার বিচার চান শোকার্ত এই বাবা। তিনি চান, ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, তাই সে যেন জাতীয় বীরের সম্মান পায়।

ছেলে পেছন থেকে এসে আর জড়িয়ে ধরবে না—এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নাফিজের মা নাজমা আক্তার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, নাফিজ বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনে যাচ্ছে এটা পরিবারের সবাই জানতেন। তবে ৪ আগস্ট পরিস্থিতি খারাপ বলে যেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু ছেলে যখন যাবেই, তখন সাবধানে থাকতে বলেছিলেন।

নিজের ঘরে গোলাম নাফিজের বিছানা-পড়ার টেবিল। দেয়ালে ঝুলছে নাফিজকে নিয়ে বানানো স্কুলের ব্যানারছবি: প্রথম আলো
একটু সামলে নিয়ে নাজমা আক্তার বলেন, ‘নিজেই চাইতাম আন্দোলনে ছাত্ররা জিতুক। নামাজ পড়ে দোয়া করতাম আর কোনো মায়ের বুক যাতে খালি না হয়। ছেলের মোবাইলে আন্দোলনের অনেক ছবি ছিল। নিরাপত্তার জন্য ছবি ডিলিট করতে বলায় ছেলে আমার সঙ্গে কথা বলাও বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই ছেলে আমারে দেশ দিয়ে গেছে। আমি আওয়ামী লীগ-বিএনপি বুঝি না, আমি শুধু চাই, দেশে শান্তি আসুক।’

কথা হলো ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদের সঙ্গেও। তিনি বললেন, ছেলেটাকে যদি হাসপাতাল পর্যন্ত নিতে পারতেন, তাহলে হয়তো বাঁচত—এটাই তাঁর আক্ষেপ। তবে তাঁর তোলা ছবি দেখে মা–বাবা তাঁদের সন্তানের লাশ খুঁজে পেয়েছেন, এটা ভেবে একটু সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের বাধার মুখে নাফিজকে ফার্মগেটের হাসপাতালে নিতে পারেননি বলে জানান তিনি।

Also read:
নরসিংদীতে গুলিতে নিহত ১৪ জনের ৯ জনই কিশোর–তরুণ
জীবন আহমেদের তোলা সেই ছবিতে রিকশার পেছনে একটি মুঠোফোন নম্বর দেখা গেছে। ওই নম্বরে ফোন দিয়ে রিকশাচালক নূর মোহাম্মদকে খুঁজে বের করেন নাফিজের পরিবারের সদস্যরা।

রিকশাচালক নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, রিকশা তাঁর নিজের। ওই দিন ফার্মগেটে ‘গ্যাঞ্জামের’ মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন। তখন এক পুলিশ তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলে অন্যরা তাঁর রিকশায় একজনকে তুলে দেন। তিনি প্রথমে ফার্মগেটের একটি হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইলে বাধার মুখে সেখানে ঢুকতে পারেননি। পরে খামারবাড়িতে গেলে কয়েকজন নাফিজকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে বলে একটি অটোরিকশায় তুলে নিয়ে চলে যান।

রিকশার পাদানিতে থাকা গুলিবিদ্ধ গোলাম নাফিজের ছবি ছাপা হয় মানবজমিন পত্রিকার প্রথম পাতায়। এই ছবি দেখেই মা-বাবা খুঁজে পান নাফিজকে।ছবি: প্রথম আলো
৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরখানে নাফিজকে কবর দেওয়া হয়। সে ছোটবেলা থেকেই স্কুলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি স্কাউট, বিএনসিসি কার্যক্রমে সক্রিয় ছিল। নাফিজ শিখো-প্রথম আলো জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছিল। সে ক্রেস্ট, সনদ আর নাফিজের পছন্দের ঘড়িসহ অন্যান্য জিনিসে হাত বুলিয়ে দেখছিলেন মা–বাবা।

বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মাসুম বিল্লাহ জানালেন, বিদ্যালয়ের মিলনায়তনের নাম নাফিজের নামে রাখার প্রস্তাব করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

নাফিজের বড় ভাই গোলাম রাসেল বললেন, ‘টিকটক জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা আন্দোলন করেছে, জীবন দিয়েছে। তারা ঠিক যে রকম একটি দেশ চেয়েছিল, ঠিক সেই রকম একটি দেশ চাই।’

Also read:
নিহত ১১৩ জন কম বয়সী, শিক্ষার্থী ৪৫

আরও পড়ুন
ইউক্রেনের জন্য দূরপাল্লার এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র
রাশিয়ায় মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা, পরমাণু যুদ্ধের শঙ্কা
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা ও জনসম্পৃক্তি’ শীর্ষক কর্মশালায় ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তৃতা করেন
কোথাও কিছু একটা ষড়যন্ত্র চলছে: তারেক রহমান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ
বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ কিন্তু সফল হয়নি: হাসনাত আবদুল্লাহ
টেক্সাসে ট্রাম্পকে স্বাগত জানাচ্ছেন ইলন মাস্ক
ট্রাম্পের উপস্থিতিতে স্টারশিপ রকেট উৎক্ষেপণ স্পেস এক্সের
আফসানা করিম রাচি
অটোরিকশার ধাক্কায় ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় চারজন বরখাস্ত

স্বত্ব © ২০২৪ প্রথম আলো