গত শুক্রবার দেশব্যাপী ৮২টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে সিনেমা ‘দরদ’। অনন্য মামুন পরিচালিত ও বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় তারকা শাকিব খান অভিনীত এ সিনেমাটিকে প্যান ইন্ডিয়ান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলেও সপ্তাহ দুয়েক পরে মুক্তি পাবে ভারতে।
চলতি বছরের ভালোবাসা দিবসেই মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল, তবে সেসময় সিনেমা মুক্তির সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে ‘ফার্স্ট লুক পোস্টার’ প্রকাশ করেন পরিচালক। পরবর্তী সময়ে কয়েক দফা মুক্তির তারিখ পিছিয়ে অবশেষে গত ১৫ নভেম্বর বড় পর্দায় মুক্তি পায় দরদ। আর এর মধ্য দিয়ে চার বছরের বেশি সময় পর ঈদ ছাড়া নতুন সিনেমা এল শাকিবের।
গত জুনে দরদের প্রথম টিজার দিয়ে সিনেমা সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন পরিচালক। এরপর অক্টোবরে মুক্তি দেন দ্বিতীয় টিজার। সে টিজারের প্রথম সংলাপটা ছিল এমন, ‘আমি দুলু মিয়া, আমার বউয়ের মুখে হাসি দেখার জন্য আমি হাজারটা খুন করতে পারি…’।
আলাদা করে বলার দরকার নেই, দুলু মিয়া ওরফে দুলাল-ই সিনেমার মূল চরিত্র। আর ‘রহস্যময়’ এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন শাকিব খান। পেশায় অটো রিকশাচালক দুলু মিয়া যে প্রচণ্ড বউ পাগল, সেটা টিজারের ওই সংলাপেই স্পষ্ট। আর দুলু মিয়ার বউ ফাতেমার চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলিউডের সোনাল চৌহান।
রাজধানীর মধুমিতা সিনেমা হলের সন্ধ্যা। মুক্তির প্রথম দিন হলভর্তি দর্শক। ছবি শুরু হতে তখনো কিছু সময় বাকি। শাকিব ভক্তরা কিছুক্ষণ পরপরই শিস বাজিয়ে, উচ্চস্বরে চিৎকার করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছিলেন। আর সিনেমা শুরু হতেই পর্দায় শাকিবের নামের আগে ট্যাগলাইন ‘মেগাস্টার’ দেখতে পেয়ে ভক্তদের সে উচ্ছ্বাস বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
সিনেমা শুরু হয় ডাক্তার বংশীধরের হত্যাকাণ্ড দিয়ে। যদিও কেন এ হত্যাকাণ্ড, কিংবা এর পেছনে কারা জড়িত—তার কিছুই দেখানো হয় না তখন। তবে দর্শকের বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়, অটো চালিয়ে দুলু মিয়াই বংশীধরকে মেরেছেন! পরের দৃশ্যেই পর্দায় প্রথমবার দেখা মেলে দুই প্রধান চরিত্র দুলু মিয়া ও ফাতেমার।
ফাতেমার জীবনের পুরোটা জুড়েই সরফরাজ খান। ছোট থেকেই টেলিভিশনের পর্দায় সরফরাজের সিনেমা দেখছেন। এবং বাবার আদুরে ‘ফাতেমা পাগলি’র সব পাগলামো সরফরাজকে ঘিরেই। নিজের স্বামী দুলু মিয়ার মধ্যেও পর্দার সরফরাজের সব বৈশিষ্ট্য দেখতে চায়। স্বামী দুলুর কাছে আবদার করে, জীবনে একবার হলেও সরফরাজকে সামনাসামনি দেখতে চাওয়ার।
ফাতেমার অতিরিক্ত সরফরাজপ্রীতিই নতুন মোড় নিয়ে আসে ফাতেমা-দুলুর সংসারে। বউকে দেওয়া কথা রাখতে একবার ফাতেমাকে নিয়ে সরফরাজের শুটিং দেখতে যায় দুলু। ভাগ্যক্রমে বউয়ের হাতে বানানো মিষ্টি সুপারস্টার সরফরাজকে খাওয়ানোর সুযোগ মেলে। আর সেই মিষ্টি দিয়েই শুরু হয় মৃত্যুর মিছিল।
এসব মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনে পর্দায় হাজির হয় পুলিশ অফিসার অগ্নি (ওপার বাংলার পায়েল)। দুই সহযোগী আকাশ ও বন্যাকে নিয়ে তদন্তে নামে অগ্নি। সামনে বেরিয়ে আসে শুটিংয়ে সিনেমার নায়িকা তৃণাকে নিয়ে পরিচালক লিয়াকত ও নায়ক সফরাজের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে আরও দুটি খুন হয় শহরে।
বউয়ের মুখে হাসি দেখার জন্য দুলু হাজারটা খুন করতে পারে। কিন্তু যে সরফরাজ তার বউয়ের ভালোবাসা, আবেগ কিংবা আনন্দে থাকার উপাদান- তাকে কি খুন করবে অটো ড্রাইভার দুলু?
এ রহস্য উন্মোচনেই এগিয়েছে সিনেমার গল্প। আর সময় গড়ানোর সঙ্গে সিনেমাও গড়াবে মন খারাপের দিকে। আর যে গল্পটা পুরোটা টেনে নিয়ে গিয়েছেন দুলু মিয়া ওরফে শাকিব খান। তবে রহস্যটাও তো অনুমিত। সেই পালে হাওয়া দেয় একটি সংলাপ। ‘যে আমার ভালোবাসার মুখে হাসি ফুটাইব, সে আমার দোস্ত। আর যে হাসি কাইড়া নিব, সে আমার জানে দুশমন।’
অভিনয়ের কথা এলে, শাকিবের কথাই বলতে হয়। দুলু মিয়া চরিত্রে যেভাবে মিশে গিয়েছেন, বিভিন্ন দৃশ্যে মুহূর্তের মধ্যে এক্সপ্রেশন পরিবর্তনের যে কারিশমা দেখিয়েছেন শাকিব, এতে দরদ এ নায়কের ক্যারিয়ারে অন্যতম অভিনয়সমৃদ্ধ সিনেমা হিসেবে সংযুক্ত হলো।
ফাতেমা চরিত্রে সোনালের অভিনয় ছিল ঠিকঠাক। দুলু-ফাতেমার সংসার জীবনের খুনসুটি, তাঁদের রসায়ন দেখে মনেই হয়নি, এটি এ জুটির প্রথম সিনেমা। তবে কানে লেগেছে সোনালের ডাবিং। সোনালের বাংলা ভয়েস যিনি দিয়েছেন, তা কিছুটা খাপছাড়া মনে হচ্ছিল।
সুপারস্টার সরফরাজ চরিত্রে রাহুল দেব ছিলেন দারুণ বাছাই। তবে অভিনেত্রী তৃণা হিসেবে সাফা মারুয়াকে কিছুটা যান্ত্রিক মনে হয়েছে। পুলিশ অফিসার চরিত্রে পায়েলকে ঠিক কী কারণে সন্তানসম্ভবা দেখিয়েছেন পরিচালক, এটার কোনো ব্যাখ্যা নেই পুরো সিনেমায়। আর সন্তান পেটে নিয়ে অগ্নির তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যাঘাত দর্শকদের মনেও মাঝে মাঝে বিরক্তির উদ্রেক করেছে।
তৃণার সহকারী হিসেবে আকাশ চরিত্রটা মানানসই হলেও বন্যা চরিত্রে এলিনা শাম্মীকে ঠিক যাচ্ছিল না। যদিও এলিনা ভালো অভিনয় করেছেন। কিন্তু পুলিশ হিসেবে তাঁকে কিছুটা সহজ-সরল বলে মনে হচ্ছিল! এছাড়া বাকি সব চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ খুব কম।
সিনেমার গানগুলো নিয়ে চাইলেই অভিযোগ তোলা যায়। ‘লুট করেছ’ কিংবা ‘এই ভাসাও’ গানের সঙ্গে লিপসিং মিলেনি। দুটি গানের দৃশ্যায়ন হয়েছে হিন্দি ডাবিংয়ে! তবে শেষদিকে মন খারাপের দৃশ্যে ইমরান মাহমুদুলের কণ্ঠে ‘এক প্রেম’ গানটি শ্রুতিমধুর ছিল। এছাড়া সিনেমার পোস্ট ক্রেডিট দৃশ্যে নোবেলের ‘ওরে পাগল মন’ গানটাও ছিল এনার্জেটিক।
গানসহ পুরো সিনেমার অধিকাংশ দৃশ্যের শুটিং ভারতের বেনারসের আশে-পাশেই হয়েছে। ব্যাক-গ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যবহার ছিল চমকপ্রদ। এজন্য প্রশংসা পেতেই পারেন অনন্য মামুন।
কিন্তু প্রসঙ্গ যখন পুরো সিনেমা, তখন কিছুটা দ্বিধায় পড়তে হয়। এমনিতেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার সিনেমার ধারা কিছুটা নতুন। তাছাড়া শাকিব খানের বিশাল ভক্তকুলের বড় অংশই এ জনরার সঙ্গে পরিচিত নয়। তাই এ ধরনের গল্পের চিত্রায়ণে একটু এদিক-সেদিক হলেই দর্শকের তালগোল পাকিয়ে ফেলার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
আর সিনেমার প্রথমভাগে তেমনটাই দেখা গেছে অন্তত দুবার। সিনেমার গল্প কখন অতীতে যাচ্ছে, আবার কখন বর্তমানে আসছে, সেটি বুঝতে বেগ পেতে হয়েছে বেশ। বিরতির আগ পর্যন্ত গল্প এগিয়েছে ধীর-লয়ে। জোর করে দর্শক হাসানোর চেষ্টাও করেছেন পরিচালক। এছাড়া তেমন কোনো টুইস্টও ছিল না এ অর্ধে। তবে দ্বিতীয়ার্ধে সিনেমা গতি পায়। রহস্য উন্মোচনের সঙ্গে দর্শকের মনোযোগও আটকে যায় পর্দায়। এরপরও যে গল্প পরিচালক দেখাতে চেয়েছেন, তাতে নির্মাণ দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। কয়েকটি দৃশ্যে পরিচালক যা বোঝাতে চেয়েছেন, দর্শক তা বুঝতে পারলেন কিনা, এ নিয়ে শঙ্কা থাকে।
প্রথমার্ধের মন্থর গল্প, অনুমেয় টুইস্ট, দুর্বল নির্মাণ, চিত্রনাট্যে কিছু জায়গায় অসংগতি থাকা সত্ত্বেও পুরো সিনেমা একাই টেনে নিয়ে গেছেন শাকিব খান। তাঁকে ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’ বললেও ভুল হবে না। সিনেমা টানার পাশাপাশি ‘সাইকো’ চরিত্রের দুলু মিয়া পরিকল্পনামাফিক নিজের কাজ করে গেছেন। চরিত্রে রহস্য ধরে রেখেছেন সিনেমার শেষ দৃশ্যেও। আর তা বলে দেয়, দরদের সিক্যুয়েল আসছে!