ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির শীর্ষ নেতাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম

- আপডেট সময় : ০২:৫৭:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
- / 27
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির শীর্ষ ১০ নেতার নাম জানা গেছে। তাদের অধিকাংশের রাজনৈতিক আন্দোলনের শুরু হয় ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে এবং পরবর্তীতে ছাত্র অধিকার পরিষদের ব্যানারে ২০১৯ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন থেকে।
নাহিদ ইসলাম, আহ্বায়ক
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ১ দফার ঘোষক নাহিদ ইসলাম ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাজনীতি শুরু করেন। পরে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচনে নুরুল-রাশেদ-ফারুক প্যানেল থেকে নাহিদ নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি সংস্কৃতি সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন। তবে তিনি জয়ী হননি। পরে মতবিরোধের কারণে ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসেন নাহিদ ইসলাম।
পরবর্তীতে ২০২৩ সালের অক্টোবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নির্দলীয় ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি আত্মপ্রকাশ করে। এর কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব ছিলেন নাহিদ ইসলাম।
২০২৪ সালের ৫ জুন সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের পরিপত্র হাইকোর্টে খারিজ হলে আন্দোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন নাহিদ ইসলাম। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সংঘটিত এই আন্দোলনের ১ নম্বর সমন্বয়ক ছিলেন তিনি।
কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে তাকে দুবার আটক করা হয়। প্রথমবার ১৯ জুলাই সাদা পোশাকধারী বেশ কয়েকজন লোক তার এক বন্ধুর বাড়ি থেকে তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। চোখে কাপড় বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে তাকে মারধর করা হয়। দুদিন পর পূর্বাচলে একটি ব্রিজের তলায় নিজেকে আবিষ্কার করেন নাহিদ। এরপর নিজেই কোনোরকমে একটি রিক্সায় উঠে বাড়িতে ফেরেন।
দ্বিতীয়বার ২৬ জুলাই ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে নাহিদকে অপহরণ করা হয়। পরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন জানান, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ নাহিদকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
পরে ২ আগস্ট ডিবি কার্যালয় থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেখ হাসিনা পতনের ১ দফা ঘোষণা করেন নাহিদ।
শেখ হাসিনার পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন নাহিদ। পরে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি নতুন দলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য পদত্যাগ করেন তিনি।
নাহিদের জন্ম ১৯৯৮ সালে ঢাকার অদূরে ফকিরখালীতে। ২০১৪ সালে ঢাকার দক্ষিণ বনশ্রী মডেল হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন তিনি। সরকারি বিজ্ঞান কলেজ থেকে ২০১৬ সালে এইচএসি পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। ২০২২ সালে অনার্স পাশ করেন তিনি। বর্তমানে তিনি একই বিভাগে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।
আখতার হোসেন, সদস্য সচিব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫-১৬ সেশনে ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১৪তম হয়েছিলেন আইন বিভাগের ছাত্র আখতার হোসেন। সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠলে তার প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন আখতার। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলনে অংশ নেন এবং ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র অধিকার পরিষদের নুরু-রাশেদ প্যানেল থেকে সমাজসেবা পদে নির্বাচন করে জয়লাভ করেন।
পরবর্তীতে ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে বেরিয়ে এসে আখতারের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের অক্টোবরে নতুন ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি আত্মপ্রকাশ করে। এই সংগঠনের আহবায়ক ছিলেন আখতার হোসেন। সংগঠনটি পরবর্তীতে বিলুপ্ত করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি আত্মপ্রকাশের দিনেও ছাত্রলীগের হাতে মারধরের শিকার হয়ে গুরুতর আহত হন আখতার।
২০২৪ সালের আন্দোলনে ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কফিন মিছিল কর্মসূচির আগে আখতার হোসেনকে আটক করে পুলিশ। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর রাতে তাকে মুক্তি দেওয় হয়।
২০২৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠিত হলে সেখানে সদস্য সচিব হিসেবে মনোনীত হন আখতার হোসেন।
নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী, প্রধান সমন্বয়কারী
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন তিনি। ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট নাহিদ ইসলামের ১ দফা ঘোষণার সময় তার পাশে ছিলেন পাটোয়ারী। আন্দোলনকে পেছন থেকে সংঘটিত করতে ভূমিকা রাখেন তিনি।
পরে জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠিত হলে সেখানে আহবায়ক হিসেবে মনোনীত হন নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী।
হাসনাত আব্দুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল)
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ পরবর্তীতে সংগঠনটির আহ্বায়ক মনোনীত হন। ২০২৪ সালে আন্দোলনের শুরু থেকেই সরব ছিলেন হাসনাত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের এই ছাত্র ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে প্রশাসনিক দুর্নীতি, কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য ও দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধের দাবিতে অনশন করে আলোচনায় এসেছিলেন। হাসনাত আব্দুল্লাহ বিভিন্ন ভর্তি কোচিং সেন্টারে ইংরেজি বিষয়ক ক্লাস নিতেন।
কোটা আন্দোলনের সময় ২৬ জুলাই অন্যান্য সমন্বয়কদের সঙ্গে হাসনাত আব্দুল্লাহকেও ডিবি কার্যালেয়ে আটকে রাখা হয়।
হাসনাত কুমিল্লার দেবীদ্বার সরকারি রেয়াজ উদ্দিন পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২০১৪ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন এবং পারুয়ারা আবদুল মতিন খসরু কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।
সারজিস আলম, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল)
পঞ্চগড়ের ছেলে সারজিস আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার সীমান্তবর্তী বামনকুমার গ্রামে তার বাড়ি। আলোয়াখোয়া তফশিলী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেন তিনি।
২০১৯ সালে অমর একুশে হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে সদস্য নির্বাচিত হন সারজিস। ২০২২ সালে ছাত্রলীগের রাজেনীতি থেকে সরে আসেন তিনি।
অমর একুশে হল থেকে ২০২৩ সালে টেবিল টেনিসেও পেয়েছেন পুরস্কার। বিতার্কিক হিসেবেও সারজিস আলম বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। ২০২২ সালে জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রোকেয়া বিতর্ক অঙ্গন, বিজয় ৭১ ডিবেটিং ক্লাব, সমাজ কল্যাণ ডিবেটিং ক্লাব, কবি জসিমউদ্দিন হল ডিবেটিং ক্লাব প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম অন্যান্য সমন্বয়কদের সঙ্গে ২৬ জুলাই ডিবি কার্যালয়ে আটক হন।
সারজিস আলম ২০২৪ সালের ২১ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ২২ জানুয়ারি পদত্যাগ করার আগপর্যন্ত জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের মহাসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ের মধ্যে ৯ ডিসেম্বর জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক হিসেবেও দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।