‘শেখ বশিরের’ বিরুদ্ধে হত্যামামলা: বাদী বললেন জানেন না
- আপডেট সময় : ০৬:৩৫:৪৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪ ৬৬ বার পড়া হয়েছে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সোহান শাহ নামের (৩০) এক যুবককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় আসামির তালিকায় নাম রয়েছে ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’ নামের এক ব্যক্তির।
নামটি আংশিকভাবে মিলে যায় গতকাল রোববার অর্ন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়া ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিনের সঙ্গে। এমনকি সেখ বশিরের বাবার নামের সঙ্গে আসামি তালিকায় থাকা ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’র বাবার নামের আংশিক মিল রয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে, ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’ নাম দিয়ে সেখ বশির উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে কি না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। তিনি বলেছেন, নামের আংশিক সংগতি ও অসংগতি থাকলেও তিনি নিশ্চিত নন, মামলাটি তাঁর নামে হয়েছে কি না।
অন্যদিকে পুলিশ বলছে, শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া ও সেখ বশির উদ্দিন একই ব্যক্তি কি না, তারা খতিয়ে দেখছে।
মামলার বাদী নিহত সোহান শাহর মা সুফিয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেছেন, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ তাঁর ছেলে হত্যার জন্য দায়ী। আসামি কারা করেছে, তা তিনি বলতে পারবেন না। কারা নাম দিয়েছে, তা–ও তিনি বলতে পারবেন না। তিনি তাঁর ছেলে হত্যার ন্যায়বিচার চান।
সোহান হত্যা মামলাটি গত ১৮ অক্টোবর রাজধানীর রামপুরা থানায় রেকর্ড হয়। মামলার নথিপত্র বলছে, এতে মোট ৫৭ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ২০০ থেকে ৩০০ জনকে।
মামলার ৫৭ জন আসামির মধ্যে ৪৯ নম্বর তালিকায় নাম রয়েছে শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়ার। পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি আওয়ামী লীগ নেতা। বাবার নাম শেখ আকিজ উদ্দিন ভূঁইয়া।
মামলার ৪৮ নম্বরে আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে শেখ আফিল উদ্দিন ভূঁইয়া। পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি সাবেক সংসদ সদস্য, যশোর-১। বাবার নাম শেখ আকিজ উদ্দিন ভূঁইয়া।
প্রয়াত সেখ আকিজ উদ্দিন আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি আকিজ। সেখ আকিজের ছেলেদের মধ্যে সেখ আফিল উদ্দিন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।
সেখ আকিজের সন্তানেরা আলাদাভাবে ব্যবসা করেন। সেখ বশির উদ্দিন আকিজ–বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে গতকাল শপথ নেন সেখ বশির উদ্দিন। তার পর থেকে মামলার বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে।
মামলার বিষয়টি নিয়ে আজ সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিলেন সেখ বশিরের কাছে। তিনি বলেন, ‘আমি খুব ভালো জানি না। আমাদের লিগ্যাল টিম বিষয়টি দেখছে। ওখানে (মামলার এজাহার) আমার নামের, আবার বাবার নামের কিছু সংগতি আছে, কিছু অসংগতি আছে। এটা আসলেই আমি কি না, আমি নিশ্চিত নই। নিশ্চিত হলে লিগ্যালি ফেস (আইনিভাবে মোকাবিলা) করা হবে।’
উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে বিভিন্নজনের মন্তব্যের বিষয়ে সেখ বশির বলেন, ‘যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁদের আবেগের সঙ্গে আমার দ্বিমত নেই। তবে আমার ধারণা, ওনারা মিস ইনফরমড (ভুল তথ্য পাওয়া)। ওনাদের তথ্যের ভিত্তি সঠিক নয়।’
যা বলছে থানা–পুলিশ
মামলার এজাহারের তথ্য অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন সোহান শাহ। তাঁর গ্রামের বাড়ি মাগুরা জেলায়। তিনি ভারগো গার্মেন্টস কারখানায় মেকানিক্যাল বিভাগের প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করতেন। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরা সিএনজি স্টেশনের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন সোহান শাহ।
মামলায় বলা হয়, সেদিন সন্ধ্যা ছয়টার দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগসহ অন্যরা ছাত্র–জনতার আন্দোলনে নির্বিচার গুলি চালায়। তখন সোহান শাহ বেশ কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হন। পরে সোহান শাহকে স্থানীয় ফারাজী হাসপাতালে নেওয়া হয়। তখন ওই হাসপাতালের মালিক ইমন ফারাজীর নির্দেশে (মামলার ১৯ নম্বর আসামি) তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। পরে সোহান শাহকে জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এরপর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত ২৩ আগস্ট ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। সেখানেই গত ২৪ আগস্ট তিনি মারা যান।
মামলার তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ সেপ্টেম্বর সোহান শাহর মা সুফিয়া বেগম ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে একটি নালিশি মামলা করেন। আদালতের নির্দেশে সেই মামলা থানায় রেকর্ড করা হয়।
মামলায় হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারী হিসেবে মাগুরা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। সাইফুজ্জামান শিখর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব ছিলেন। তাঁর বাবা মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান সংসদ সদস্য ছিলেন।
সোহান শাহ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন ও সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম।
মামলায় নাম থাকা শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া ও সেখ বশির উদ্দিন একই ব্যক্তি কি না, তা প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল পুলিশের কাছে। রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান আকন্দ প্রথম আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ছেলেকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সুফিয়া বেগম নামের এক নারী ঢাকার আদালতে একটি নালিশি মামলা করেন। আদালত মামলাটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য নির্দেশ দেন। সেই মামলায় শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছে।
ওসি বলেন, ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া বর্তমান মাননীয় উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন কি না, সেটি তাঁরা খতিয়ে দেখছেন।’ তিনি আরও বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে এনে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যা বললেন বাদী
মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলা সদরের আলতাফ হোসেন মহিলা কলেজ রোডের বাড়িতে গিয়ে আজ সুফিয়া বেগমকে পাওয়া যায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মামলা করেছেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ তাঁর ছেলেকে মেরেছে।
সুফিয়া বেগমের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, মামলার আসামির তালিকা কে ঠিক করেছেন? জবাবে তিনি বলেন, আসামি কারা হয়েছে, কে করেছে, তা তিনি বলতে পারবেন না।
মামলা করার সময় তাঁর সঙ্গে কে কে ছিলেন, তা জানতে চাইলে সুফিয়া বেগম বলেন, তা তিনি জানেন না।
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, মাগুরা)