ঢাকা ০২:০৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ৫ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব শেখ হাসিনার বিচার করা: শফিকুল আলম পুতুলকে ডব্লিউএইচও থেকে অপসারণে অনলাইনে স্বাক্ষর জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে জনসাধারণের অভিমত চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা শাপলা চত্বরে হেফাজত দমন : অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট বেগম জিয়াকে হিংসা করতেন হাসিনা ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন শেখ হাসিনা? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাত্রদের ঘোষণাপত্র দিতে বারণের কারণ জানালেন ড. ইউনূস  ঐক্যবদ্ধভাবে দিতে না পারলে জুলাই ঘোষণাপত্রের দরকারই নাই রেস্তোরাঁ, ওষুধ ও মোবাইল রিচার্জে বাড়ছে না ভ্যাট ধর্মনিরপেক্ষতাসহ রাষ্ট্র পরিচালনার ৩ মূলনীতি বাদ পদত্যাগপত্রে যা বললেন টিউলিপ সিদ্দিক পদত্যাগ করলেন টিউলিপ সিদ্দিক আমার মেয়ের খুনি কে, আমি কি বিচার পাব না: প্রশ্ন তিন্নির বাবার জয়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ৩ বছর আগে, জানালেন নিজেই গণহত্যায় জড়িতদের গুরুত্বপূর্ণ কল রেকর্ড হাতে পেয়েছে প্রসিকিউশন ৫ আগস্ট: বাংলাদেশ ও ভারতের সেনাপ্রধানের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল ক্রসফায়ারে নিহতদের ৪ জন ছিলেন ডিবি হেফাজতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অদৃশ্য নিয়ন্ত্রক ছিলেন শেখ রেহানা শনিবার স্কুল খোলা নাকি বন্ধ? ‘জমজমের’ নামে ট্যাপের পানি বিক্রি, আয় ৩০ কোটি টাকা!

সিরাজ সিকদার: এক অপূর্ণ বিপ্লবীর জীবনগাঁথা

বিডি সারাদিন২৪ নিউজ
  • আপডেট সময় : ১০:৪৫:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ জানুয়ারী ২০২৪
  • / 14
আজকের সারাদিনের সর্বশেষ নিউজ পেতে ক্লিক করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও প্রস্তুতি: সিরাজ সিকদারের রাজনৈতিক জীবনের শুরু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এবং ১৯৬৬ সালে বুয়েটে শেরে বাংলা হলের নির্বাচিত সহ-সভাপতি হিসেবে। প্রথম জীবনে তিনি তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির (হক-তোয়াহা) সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্ত হক-তোয়াহার রাজনৈতিক লাইনকে ভুল আখ্যায়িত করে তিনি সে পার্টি ত্যাগ করে, ১৯৬৭ সালে ঢাকার মালিবাগে “মাওসেতুং চিন্তাধারার গবেষনা কেন্দ্র” স্থাপন করে মাওসেতুং তথা মার্কসীয় দর্শন অধ্যয়নের একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সে সময়ে দেশের অন্য কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা এ ধরনের গবেষনা কে টেস্টটিউব গবেষনা বলে বিদ্রুপ করতেন এবং সিরাজ সিকদারের দানা বেধে উঠা পার্টি প্রক্রিয়াকে টিটি (টেস্ট টিউব) বলে অভিহিত করতেন। মজার তথ্য হলো, সে কেন্দ্রটি তৎকালীন তথাকথিত জামাতদের চাপে পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করে দেয়। তথাকথিত জামাতিরা তাদের শত্রু চিনতে ভুল করেনি। (সুত্র: বাংলাপেডিয়া: সিরাজ সিকদার)। সৈয়দ আবুল মকসুদকেও সিরাজ সিকদার একথা বলেছিলেন বলে মকসুদ একটি নিয়মিত কলামে উল্লেখ করেছিলেন।

রাজনৈতিক কার্যকলাপ: কিন্তু সিরাজ সিকদার সে সময়ে সঠিকভাবে মার্কসীয় আলোকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে প্রথম দলিল প্রকাশ করে বামপন্থী মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। আগ্রহী ও অগ্রসর পাঠকেরা ইংরেজীতে অনুদিত তার দলিলটি পড়তে পারেন।

১৯৬৮’র ৮ই জানুয়ারী সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির মূল প্রস্তুতি সংগঠন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৮ সালেই সিরাজ সিকদার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের উপনিবেশ এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে জাতীয় গনতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে একটি স্বাধীন, প্রগতিশীল এবং সমাজতান্ত্রিক পুর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। (সিরাজ সিকদারের দলিল)। এই সালেই তাঁর পার্টির গেরিলারা ঢাকাতে জাতীয় পূনর্গঠন কেন্দ্রে (NBR), পাকিস্তান কাউন্সিলে এবং আমেরিকান তথ্যকেন্রে বোমা আক্রমন চালিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। ১৯৬৯ সালে পুর্ব বাংলার ছাত্র-গন আন্দোলনে শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীদের সাহসী ভুমিকা বামপন্থী মহলে প্রশংসা অর্জন করে।

১৯৭০ সালের ৩রা ডিসেম্বর পল্টনে মওলানা ভাসানীর জনসভায় পুর্ব বাংলার জাতীয় গনতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার আহ্বান সংবলিত লিফলেট এবং ভবিষ্যতে স্বাধীন পুর্ব বাংলার পতাকা বিতরন করে। সে পতাকাটি, সিরাজ সিকদারের অনুসারীদের ভাষায়, এখনকার বাংলাদেশের পতাকা যার ডিজাইন করেছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী অবাঙ্গালী আজমী (সুত্র: ব্লগে)। [আমিও সে লিফলেট ও পতাকা দেখেছি, তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছিনা।]

স্বাধীনতা যুদ্ধ ও সিরাজ সিকদার: ১৯৭০ সালের শেষের দিকে সিরাজ সিকদার তাঁর কেন্দ্রীয় কার্যালয় বরিশালের পেয়ারা বাগানে স্থানান্তর করেন এবং একটি বাহিনী গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭১ সালের ৩রা জুন সিরাজ সিকদার আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ, একটি পূর্নাঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টি, পুর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। অতিদ্রুত সেই বাহিনী বরিশাল, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ সহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিকাশিত হয়ে পাকিস্তানীদের দুঃশ্চিন্তার কারন হয়ে দা্ঁড়ায়। পাকিস্তানি সেনা বাহিনী গান বোট এবং হেলিকপ্টার ব্যবহার করেও সিরাজ সিকদারের মূল ঘাটি ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয়ে, হাজার হাজার বাঙ্গালীকে বন্দুকের মুখে পেয়ারা বাগান কাটাতে বাধ্য করে। এই সময়েই সিরাজ সিকদার তাঁর অত্যন্ত বিখ্যাত দলিল, “ছয় পাহাড়ের দালালদের নির্মূল করুন” শীর্ষক দলিল ও প্রচারনাপত্র রচনা করেন। সে দলিলে তিনি সঠিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিনতি নিয়ে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎবানী করেন। যা সত্য বলে প্রমানিত হয়েছিলো। ১৯৭১ এর আগস্ট মাসে সিরাজ সিকদারের নেতৃস্থানীয় সহযোগী আজমীকে আলোচনার কথা বলে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। আজমীর স্মরণে সিরাজ সিকদার একটি কবিতায় বলেছেন, “উত্তর প্রদেশ থেকে এসে তুমি হলে বাংলার বেথুন”!! এরপরেই মুজিব বাহিনীর প্রতিআক্রমনে সর্বহারা পার্টি যুগপৎ পাকিস্তানি বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়।

সিরাজ সিকদারের স্বাধীনতা পরবর্তী ভুমিকা: স্বাধীনতার পরে পরে সিরাজ সিকদার ১৮টি দাবী সংবলিত একটি লিফলেট শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশ ও প্রচার করেন। সেখানে দেশপ্রেমের প্রমান দিতে সেই ১৮টি দাবী (যার মূল সুর ছিলো ভারতীয় সম্প্রসারনবাদের কবল থেকে মুক্তি) পূরনের আহ্বান জানান। অতি স্বাভাবিকভাবেই শেখ মুজিব বা সরকার এ লিফলেটের কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি। এরপরেই সিরাজ সিকদার শেখ মুজিবকে ভারতের দালাল ও বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশ বলে রাজনৈতিক প্রচারনা শুরু করে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর প্রধান দাবীগুলোর মধ্যে যা জনপ্রিয়তা অর্জন করে তা হলো, ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক নিয়ে যাওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অস্ত্র ফেরত আনার দাবী, আওয়ামী লীগের একাংশের নির্বিচার লুন্ঠন এবং সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসননীতির বিরুদ্ধে। একই সাথে সর্বহারা পার্টির গেরিলারা ৭৩-৭৪ সালে ১৪টি থানা এবং ৭৯টি পুলিশ ফাঁড়ি লুট করে অত্যন্ত শক্তিশালী সশস্ত্র কমিউনিস্ট পার্টিতে পরিনত হয়। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে সর্বহারা পার্টি ১৬ই ডিসেম্বরকে কালো দিবস আখ্যা দিয়ে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে এবং গ্রামাঞ্চলে ও অনেক ছোট শহরে সে হরতাল পালিত হয়। (সিরাজ সিকদার তাঁর “ছয় পাহাড়ের দালালদের নির্মূল করুন” শীর্ষক প্রচারপত্রে পাকিস্তানীদের পরাজয় এবং ভারতের সহযোগিতায় অর্জিত জয়কে বাংলাদেশের জনগনের উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পতনের তুল্য হবে বলে ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেন সে সীমান্ত লোপ পাবে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ভারত কর্তৃক বাধাগ্রস্থ হবে এবং বাংলাদেশের সরকার ভারতের অনুগত হবে )। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে কমরেড মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার সহযোগিতায় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে পদচ্যুত লে. কর্ণেল জিয়াউদ্দিনের পরিচালনায় একটি কোম্পানী সৃস্টি করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান কালে সিরাজ সিকদার তাঁর আশাবাদী মনের পরিচয় রেখে একটি কবিতায় লিখেছেন, “…পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যায় মুরং তরুনী। অঙ্গে তার ছোট্ট আবরনী, কী নিটোল স্বাস্থ্যবতী। কবে তার কাঁধে শোভা পাবে রাইফেল একখানি?”

গ্রেফতার ও হত্যা: ১৯৭৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামে গ্রেফতার হয়ে সিরাজ সিকদার ঢাকায় আনীত হন এবং ২রা জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে রক্ষীবাহিনীর কেন্দ্রীয় দপ্তর সাভারে সাজানো বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

ভুল-ত্রুটি নিয়েও একটি কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সাফল্যের সাথে সিরাজ সিকদার এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কমরেড সিরাজ সিকদার জিন্দাবাদ।

 

লেনিন সম্পর্কে মাক্সিম গোর্কি বিখ্যাত স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, ‘ভ্লাদিমির ইলিচ তাড়াতাড়ি করে বক্তৃতামঞ্চে উঠলেন। মনে হয় বক্তা হিসেবে তেমন সুবিধের নন, কিন্তু এক মিনিটের মধ্যেই আমি আর সবারই মতো নিমগ্ন হয়ে গেলাম।’ তার এই নিমগ্নতার কারণ, গোর্কির ভাষায়, ‘অতি জটিল সব রাজনীতিক প্রশ্ন নিয়ে এত সহজ-সরলভাবে কেউ বলতে পারে তা আমি কখনও শুনিনি।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এই বক্তা [লেনিন] সুন্দর সুন্দর কথা তৈরি করেন না, কিন্তু প্রত্যেকটি শব্দকে যেন নিজের হাতের তালুতে রেখে আশ্চর্য অনায়াসে তার সঠিক অর্থটিকে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি যে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করলেন তার বর্ণনা দেওয়া কঠিন।’

গোর্কির এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, লেনিনের মতো নেতা, শুধু রাশিয়ায় নয়, সারা দুনিয়ায় দুর্লভ। এই সত্যটি মেনে নিয়েও বলতে পারি যে আজকের বাংলাদেশে এমন একজন নেতা জন্মেছিলেন যিনি কিনা চিন্তায়, মতাদর্শের সক্রিয়তায় ছিলেন অনেক বেশি অগ্রসর। শুধু তা-ই নয়, যার মধ্যে একটি কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত করবার সামর্থ্য ছিল। সেই নেতা হলেন কমরেড সিরাজ সিকদার, যিনি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী শিক্ষা ও অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।

সময়টা ছিল ১৯৬৮, সিরাজ সিকদারের বয়স তখন মাত্র ২৪ বছর! ভারতবর্ষে মাও সে-তুঙের বিপ্লবী চিন্তাধারার প্রথম সৃজনশীল প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন কমরেড চারু মজুমদার। আর তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সেই তত্ত্বেরই আরেকটি সৃজনশীল প্রয়োগ ঘটেছিল সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে‘পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন’ গঠনের মধ্যে দিয়ে।

২.

বিপ্লবের প্রশ্নে কমরেড লেনিন মনে করতেন, ‘প্রত্যেকটি বিপ্লবেরই মূল প্রশ্ন হল রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্ন।’ তার মতে, ‘এই প্রশ্নটি উপলব্ধ না হলে বিপ্লবে সজ্ঞান অংশগ্রহণ সম্ভবপর হতে পারে না, বিপ্লব পরিচালনার তো কথাই ওঠে না।’ এর পাশাপাশি লেনিন সূত্রাকারে বিবরণ দিয়ে বলেছিলেন যে, বিপ্লবী অভ্যুত্থান সার্থক করতে হলে চক্রান্তের কিংবা কোনো পার্টির ওপর নয়, আমাদের নির্ভর করতে হবে সমাজের অগ্রণী শ্রেণিটির ওপর। এর পাশাপাশি তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে জনগণের বৈপ্লবিক ও ঐক্যবদ্ধ জোয়ারকে, যাকে আমরা ‘গণজোয়ার’ বলে থাকি। এখানে ‘জনগণে’র প্রতিপক্ষ হচ্ছে সমাজের ‘ধনিক শ্রেণি’।

লেনিনের ভাষায়, শ্রমজীবীর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ওই পরজীবী শ্রেণিকে পরাজিত করা জরুরি। সেক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের নীতিকেও লেনিন সমর্থন করতেন। লেনিনের বিপ্লবী তত্ত্বকে সামনে এনে কমরেড মাও-সে তুঙ বলেছিলেন, ‘বিপ্লব কোনো ভোজ-সভা নয় বা প্রবন্ধ রচনা বা চিত্র অঙ্কন কিংবা সূচিকর্ম নয়; এটা এত সুমার্জিত, এত ধীর-স্থির ও সুশীল, এত নম্র, দয়ালু, বিনীত, সংযত ও উদার হতে পারে না।’ কেন পারে না? তার উত্তর দিতে গিয়ে মাও জানিয়েছিলেন, ‘বিপ্লব হচ্ছে বিদ্রোহ―উগ্র বলপ্রয়োগের কাজ, যার দ্বারা এক শ্রেণি অন্য শ্রেণিকে পাল্টে দেয়।’

অনেকেরই মনে হতে পারে যে, অস্ত্রই বোধহয় এই বিপ্লবের প্রধান শক্তি। না, মোটেই তা নয়। কমরেড চারু মজুমদার খুব স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন, ‘বিপ্লবী যুদ্ধের মাল-মসলা আমাদের তৈরি করতে হবে।’ সেই মাল-মসলা আদতে কী?―এর উত্তরে চারু মজুমদার বলেছিলেন, ‘এ মাল-মসলা ডিনামাইট নয়, বিস্ফোরক পদার্থ নয়, আগ্নেয় অস্ত্র নয়। বিপ্লবী যুদ্ধের প্রধান মাল-মসলাই হচ্ছে মানুষ।’ মানুষকে গুরুত্ব দিয়ে বিপ্লবকে এইভাবে বুঝতে পারাটা খুব সহজ নয়।

৩.

বিপ্লবের তাৎপর্য উপলব্ধি করা কঠিন, আর সেই কঠিন কাজটি করতে সমর্থ হয়েছিলেন সিরাজ সিকদার। তিনি তার ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিসে’ (৮ জানুয়ারি, ১৯৬৮) বলেছেন, ‘পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা নিজেদের বিকাশের জন্য পাকিস্তানে যোগ দেয়। কিন্তু পাকিস্তানী উপনিবেশিক শ্রেণি পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া বিকাশের জন্য যে সুবিধা প্রয়োজন তা নিজেদের বিকাশে ব্যবহার করে। ফলে এ-দেশে বুর্জোয়া বিকাশ ব্যাহত হয়। তাই বুর্জোয়া বিকাশের প্রয়োজনীয় অবস্থার সৃষ্টি অর্থাৎ সামন্তবাদ ও উপনিবেশবাদের অবসান প্রয়োজন।’

কীভাবে এর অবসান ঘটানো হবে, সে-সম্পর্কে বলতে গিয়ে সিরাজ সিকদার জানিয়েছিলেন, ‘সামন্তবাদের অবসান সম্ভব গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে এবং উপনিবেশিক শাসনের অবসান সম্ভব জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে। কাজেই পূর্ব বাংলার বিপ্লব হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব।’ অগ্রসর সর্বহারার নেতৃত্বে পরিচালিত এই বিপ্লবকে ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ বা ‘নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করে সিরাজ সিকদার বলেছিলেন যে, এই বিপ্লব হবে সমগ্র ‘বিশ্ব বিপ্লবেরই একটি অংশ’।

সেইসঙ্গে তিনি মাওবাদী আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এ বিপ্লবের একটি চরিত্র হলো সশস্ত্র বিপ্লব।’ যা সম্পন্ন করতে হলে ‘সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে হবে।’

সিরাজ সিকদারের এই চিন্তার অগ্রসরতার প্রমাণ আমরা পেয়েছি একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের মধ্যে, যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাকামী অংশটি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে, ঠিক তখন সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী গেরিলারা পেয়ারাবাগান অঞ্চলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করতে এতটুকুও দ্বিধা করেননি।

সিরাজ সিকদার চেয়েছিলেন, ‘শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে, সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ-বিরোধী সকল দেশপ্রেমিক শ্রেণির’ একটি ঐক্যফ্রন্ট। কিন্তু তার সে-স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যায়নি প্রধানত শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নতজানু নীতির কারণে। সে-কারণেই আমরা দেখতে পাই, ওই দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশের অভ্যন্তরে জনগণকে একত্রিত করে প্রতিরোধ যুদ্ধের বদলে, ভারত সরকারের নিরাপদ আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে অবস্থান করে, যুদ্ধটাকে অন্যদিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

৪.

এসবের পরিণতি আমাদের কারওর জন্যই, গোটা জাতির জন্যও, সুখকর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন অচিরেই ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। এমনটা যে ঘটবে, সেটি শুধু সিরাজ সিকদার ও তার দলের নেতাকর্মীরাই শুধু নন, যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত আরও অনেকেই সেই সময় অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। প্রয়াত বামপন্থী নেতা হায়দার আনোয়ার খান জুনো ও তাদের সংগঠন একাত্তরে দেশের অভ্যন্তরেই পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

তার সেই সময়ের স্মৃতিকথা ‘একাত্তরের রণাঙ্গন : শিবপুর’ গ্রন্থে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমরা যখন নরসিংদী মুক্ত করি, ভারতীয় বাহিনী তখন নরসিংদী থেকে অনেক দূরে।…টি. এন্ড. টি. ক্যাম্প দখল করে সেখানে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি।’ তিনি আরও লিখেছিলেন যে, ‘ক্যাম্প দখলের পর ভিতরে ঢুকে অস্ত্রের সম্ভার দেখে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। ঘর বোঝাই হাল্কা ও ভারি মেশিনগান। থরে থরে সাজানো রকেট লাঞ্চার আর দুই ইঞ্চি মর্টার। অফুরন্ত গোলাগুলি আর গ্রেনেড। এত অস্ত্র আমাদের হস্তগত।’

এরপরই জুনো বলেছেন, ‘এই অস্ত্র আমরা দখলে রাখতে পারলাম না। কারণ অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা হেলিকপ্টার নামলো। তাতে ভারতীয় বাহিনীর কয়েকজন অফিসার ও সৈনিক। তারা আমাদের নরসিংদী মুক্ত করার জন্য ধন্যবাদ জানালেন এবং ঐ ক্যাম্পের দায়িত্ব তাদের হাতে ছেড়ে দিতে বললেন।’ এইভাবে শুধু একটি ক্যাম্পের দায়িত্বই নয়, গোটা দেশের দায়িত্ব সেদিন ভারতের হাতে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। যার মাশুল আমাদের গত চুয়ান্ন বছর ধরে দিয়ে যেতে হচ্ছে। অথচ এসবের বিপরীতে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে সিরাজ সিকদার বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী, আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম কিছুতেই দাবিয়ে রাখতে পারবে না (শেখ মুজিব এই “দাবিয়ে” শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭১ সালের মার্চে)। ১৯৭০-এ পূর্ব বাংলার জনগণের যে গণযুদ্ধ শুরু হয়েছে তা দাবানলের রূপ নেবে ১৯৭১-এ। পূর্ব বাংলার গ্রামে-গ্রামে দাউ-দাউ করে জ্বলবে গণযুদ্ধের দাবাগ্নি। আর তাতে পুড়ে মরবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার শত্রুরা, তাদের দালাল, বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীরা।’

৫.

ইতিহাস সাক্ষী, কমরেড সিরাজ সিকদারের সেই ভবিষ্যদ্বাণীই পরবর্তী সময়ে সত্যি হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ের জাতীয়তাবাদী শক্তির আপস-নীতির কারণে গণযুদ্ধের সেই ফসল আমরা নিজেদের ঘরে তুলতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায়ভার স্বীকার করতেই হবে। মাও সে-তুঙ বলেছিলেন, ‘জনসাধারণের মধ্যে নিহিত রয়েছে বিরাট সমাজতান্ত্রিক সক্রিয়তা।’ আর সেই সক্রিয়তাকেই সিরাজ সিকদার একাত্তরে যুদ্ধে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। এ-রকম সজীব, অগ্রসর ও প্রাণবান কমিউনিস্ট নেতা বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে আর কখনও দেখা যায়নি।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

সিরাজ সিকদার: এক অপূর্ণ বিপ্লবীর জীবনগাঁথা

আপডেট সময় : ১০:৪৫:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৭ জানুয়ারী ২০২৪

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও প্রস্তুতি: সিরাজ সিকদারের রাজনৈতিক জীবনের শুরু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এবং ১৯৬৬ সালে বুয়েটে শেরে বাংলা হলের নির্বাচিত সহ-সভাপতি হিসেবে। প্রথম জীবনে তিনি তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির (হক-তোয়াহা) সাথে যুক্ত ছিলেন। কিন্ত হক-তোয়াহার রাজনৈতিক লাইনকে ভুল আখ্যায়িত করে তিনি সে পার্টি ত্যাগ করে, ১৯৬৭ সালে ঢাকার মালিবাগে “মাওসেতুং চিন্তাধারার গবেষনা কেন্দ্র” স্থাপন করে মাওসেতুং তথা মার্কসীয় দর্শন অধ্যয়নের একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। সে সময়ে দেশের অন্য কমিউনিস্ট ও বামপন্থীরা এ ধরনের গবেষনা কে টেস্টটিউব গবেষনা বলে বিদ্রুপ করতেন এবং সিরাজ সিকদারের দানা বেধে উঠা পার্টি প্রক্রিয়াকে টিটি (টেস্ট টিউব) বলে অভিহিত করতেন। মজার তথ্য হলো, সে কেন্দ্রটি তৎকালীন তথাকথিত জামাতদের চাপে পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ করে দেয়। তথাকথিত জামাতিরা তাদের শত্রু চিনতে ভুল করেনি। (সুত্র: বাংলাপেডিয়া: সিরাজ সিকদার)। সৈয়দ আবুল মকসুদকেও সিরাজ সিকদার একথা বলেছিলেন বলে মকসুদ একটি নিয়মিত কলামে উল্লেখ করেছিলেন।

রাজনৈতিক কার্যকলাপ: কিন্তু সিরাজ সিকদার সে সময়ে সঠিকভাবে মার্কসীয় আলোকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে প্রথম দলিল প্রকাশ করে বামপন্থী মহলের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। আগ্রহী ও অগ্রসর পাঠকেরা ইংরেজীতে অনুদিত তার দলিলটি পড়তে পারেন।

১৯৬৮’র ৮ই জানুয়ারী সিরাজ সিকদার পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির মূল প্রস্তুতি সংগঠন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৮ সালেই সিরাজ সিকদার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানের উপনিবেশ এবং সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে জাতীয় গনতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে একটি স্বাধীন, প্রগতিশীল এবং সমাজতান্ত্রিক পুর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। (সিরাজ সিকদারের দলিল)। এই সালেই তাঁর পার্টির গেরিলারা ঢাকাতে জাতীয় পূনর্গঠন কেন্দ্রে (NBR), পাকিস্তান কাউন্সিলে এবং আমেরিকান তথ্যকেন্রে বোমা আক্রমন চালিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। ১৯৬৯ সালে পুর্ব বাংলার ছাত্র-গন আন্দোলনে শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীদের সাহসী ভুমিকা বামপন্থী মহলে প্রশংসা অর্জন করে।

১৯৭০ সালের ৩রা ডিসেম্বর পল্টনে মওলানা ভাসানীর জনসভায় পুর্ব বাংলার জাতীয় গনতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার আহ্বান সংবলিত লিফলেট এবং ভবিষ্যতে স্বাধীন পুর্ব বাংলার পতাকা বিতরন করে। সে পতাকাটি, সিরাজ সিকদারের অনুসারীদের ভাষায়, এখনকার বাংলাদেশের পতাকা যার ডিজাইন করেছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃস্থানীয় কর্মী অবাঙ্গালী আজমী (সুত্র: ব্লগে)। [আমিও সে লিফলেট ও পতাকা দেখেছি, তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করছিনা।]

স্বাধীনতা যুদ্ধ ও সিরাজ সিকদার: ১৯৭০ সালের শেষের দিকে সিরাজ সিকদার তাঁর কেন্দ্রীয় কার্যালয় বরিশালের পেয়ারা বাগানে স্থানান্তর করেন এবং একটি বাহিনী গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭১ সালের ৩রা জুন সিরাজ সিকদার আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ, একটি পূর্নাঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টি, পুর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। অতিদ্রুত সেই বাহিনী বরিশাল, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ সহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিকাশিত হয়ে পাকিস্তানীদের দুঃশ্চিন্তার কারন হয়ে দা্ঁড়ায়। পাকিস্তানি সেনা বাহিনী গান বোট এবং হেলিকপ্টার ব্যবহার করেও সিরাজ সিকদারের মূল ঘাটি ভাঙ্গতে ব্যর্থ হয়ে, হাজার হাজার বাঙ্গালীকে বন্দুকের মুখে পেয়ারা বাগান কাটাতে বাধ্য করে। এই সময়েই সিরাজ সিকদার তাঁর অত্যন্ত বিখ্যাত দলিল, “ছয় পাহাড়ের দালালদের নির্মূল করুন” শীর্ষক দলিল ও প্রচারনাপত্র রচনা করেন। সে দলিলে তিনি সঠিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরিনতি নিয়ে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎবানী করেন। যা সত্য বলে প্রমানিত হয়েছিলো। ১৯৭১ এর আগস্ট মাসে সিরাজ সিকদারের নেতৃস্থানীয় সহযোগী আজমীকে আলোচনার কথা বলে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। আজমীর স্মরণে সিরাজ সিকদার একটি কবিতায় বলেছেন, “উত্তর প্রদেশ থেকে এসে তুমি হলে বাংলার বেথুন”!! এরপরেই মুজিব বাহিনীর প্রতিআক্রমনে সর্বহারা পার্টি যুগপৎ পাকিস্তানি বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়।

সিরাজ সিকদারের স্বাধীনতা পরবর্তী ভুমিকা: স্বাধীনতার পরে পরে সিরাজ সিকদার ১৮টি দাবী সংবলিত একটি লিফলেট শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশ ও প্রচার করেন। সেখানে দেশপ্রেমের প্রমান দিতে সেই ১৮টি দাবী (যার মূল সুর ছিলো ভারতীয় সম্প্রসারনবাদের কবল থেকে মুক্তি) পূরনের আহ্বান জানান। অতি স্বাভাবিকভাবেই শেখ মুজিব বা সরকার এ লিফলেটের কোন প্রতিক্রিয়া দেখাননি। এরপরেই সিরাজ সিকদার শেখ মুজিবকে ভারতের দালাল ও বাংলাদেশকে ভারতের উপনিবেশ বলে রাজনৈতিক প্রচারনা শুরু করে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর প্রধান দাবীগুলোর মধ্যে যা জনপ্রিয়তা অর্জন করে তা হলো, ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক নিয়ে যাওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অস্ত্র ফেরত আনার দাবী, আওয়ামী লীগের একাংশের নির্বিচার লুন্ঠন এবং সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসননীতির বিরুদ্ধে। একই সাথে সর্বহারা পার্টির গেরিলারা ৭৩-৭৪ সালে ১৪টি থানা এবং ৭৯টি পুলিশ ফাঁড়ি লুট করে অত্যন্ত শক্তিশালী সশস্ত্র কমিউনিস্ট পার্টিতে পরিনত হয়। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে সর্বহারা পার্টি ১৬ই ডিসেম্বরকে কালো দিবস আখ্যা দিয়ে দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে এবং গ্রামাঞ্চলে ও অনেক ছোট শহরে সে হরতাল পালিত হয়। (সিরাজ সিকদার তাঁর “ছয় পাহাড়ের দালালদের নির্মূল করুন” শীর্ষক প্রচারপত্রে পাকিস্তানীদের পরাজয় এবং ভারতের সহযোগিতায় অর্জিত জয়কে বাংলাদেশের জনগনের উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পতনের তুল্য হবে বলে ভবিষ্যৎবানী করেছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছিলেন সে সীমান্ত লোপ পাবে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ভারত কর্তৃক বাধাগ্রস্থ হবে এবং বাংলাদেশের সরকার ভারতের অনুগত হবে )। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে কমরেড মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার সহযোগিতায় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে পদচ্যুত লে. কর্ণেল জিয়াউদ্দিনের পরিচালনায় একটি কোম্পানী সৃস্টি করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থান কালে সিরাজ সিকদার তাঁর আশাবাদী মনের পরিচয় রেখে একটি কবিতায় লিখেছেন, “…পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যায় মুরং তরুনী। অঙ্গে তার ছোট্ট আবরনী, কী নিটোল স্বাস্থ্যবতী। কবে তার কাঁধে শোভা পাবে রাইফেল একখানি?”

গ্রেফতার ও হত্যা: ১৯৭৪ সালের ৩০শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামে গ্রেফতার হয়ে সিরাজ সিকদার ঢাকায় আনীত হন এবং ২রা জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে রক্ষীবাহিনীর কেন্দ্রীয় দপ্তর সাভারে সাজানো বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।

ভুল-ত্রুটি নিয়েও একটি কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সাফল্যের সাথে সিরাজ সিকদার এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কমরেড সিরাজ সিকদার জিন্দাবাদ।

 

লেনিন সম্পর্কে মাক্সিম গোর্কি বিখ্যাত স্মৃতিকথায় বলেছিলেন, ‘ভ্লাদিমির ইলিচ তাড়াতাড়ি করে বক্তৃতামঞ্চে উঠলেন। মনে হয় বক্তা হিসেবে তেমন সুবিধের নন, কিন্তু এক মিনিটের মধ্যেই আমি আর সবারই মতো নিমগ্ন হয়ে গেলাম।’ তার এই নিমগ্নতার কারণ, গোর্কির ভাষায়, ‘অতি জটিল সব রাজনীতিক প্রশ্ন নিয়ে এত সহজ-সরলভাবে কেউ বলতে পারে তা আমি কখনও শুনিনি।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এই বক্তা [লেনিন] সুন্দর সুন্দর কথা তৈরি করেন না, কিন্তু প্রত্যেকটি শব্দকে যেন নিজের হাতের তালুতে রেখে আশ্চর্য অনায়াসে তার সঠিক অর্থটিকে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি যে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করলেন তার বর্ণনা দেওয়া কঠিন।’

গোর্কির এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, লেনিনের মতো নেতা, শুধু রাশিয়ায় নয়, সারা দুনিয়ায় দুর্লভ। এই সত্যটি মেনে নিয়েও বলতে পারি যে আজকের বাংলাদেশে এমন একজন নেতা জন্মেছিলেন যিনি কিনা চিন্তায়, মতাদর্শের সক্রিয়তায় ছিলেন অনেক বেশি অগ্রসর। শুধু তা-ই নয়, যার মধ্যে একটি কমিউনিস্ট বিপ্লব সংঘটিত করবার সামর্থ্য ছিল। সেই নেতা হলেন কমরেড সিরাজ সিকদার, যিনি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী শিক্ষা ও অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে একটি বিপ্লবী রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।

সময়টা ছিল ১৯৬৮, সিরাজ সিকদারের বয়স তখন মাত্র ২৪ বছর! ভারতবর্ষে মাও সে-তুঙের বিপ্লবী চিন্তাধারার প্রথম সৃজনশীল প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন কমরেড চারু মজুমদার। আর তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সেই তত্ত্বেরই আরেকটি সৃজনশীল প্রয়োগ ঘটেছিল সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে‘পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন’ গঠনের মধ্যে দিয়ে।

২.

বিপ্লবের প্রশ্নে কমরেড লেনিন মনে করতেন, ‘প্রত্যেকটি বিপ্লবেরই মূল প্রশ্ন হল রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্ন।’ তার মতে, ‘এই প্রশ্নটি উপলব্ধ না হলে বিপ্লবে সজ্ঞান অংশগ্রহণ সম্ভবপর হতে পারে না, বিপ্লব পরিচালনার তো কথাই ওঠে না।’ এর পাশাপাশি লেনিন সূত্রাকারে বিবরণ দিয়ে বলেছিলেন যে, বিপ্লবী অভ্যুত্থান সার্থক করতে হলে চক্রান্তের কিংবা কোনো পার্টির ওপর নয়, আমাদের নির্ভর করতে হবে সমাজের অগ্রণী শ্রেণিটির ওপর। এর পাশাপাশি তার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে জনগণের বৈপ্লবিক ও ঐক্যবদ্ধ জোয়ারকে, যাকে আমরা ‘গণজোয়ার’ বলে থাকি। এখানে ‘জনগণে’র প্রতিপক্ষ হচ্ছে সমাজের ‘ধনিক শ্রেণি’।

লেনিনের ভাষায়, শ্রমজীবীর গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ওই পরজীবী শ্রেণিকে পরাজিত করা জরুরি। সেক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের নীতিকেও লেনিন সমর্থন করতেন। লেনিনের বিপ্লবী তত্ত্বকে সামনে এনে কমরেড মাও-সে তুঙ বলেছিলেন, ‘বিপ্লব কোনো ভোজ-সভা নয় বা প্রবন্ধ রচনা বা চিত্র অঙ্কন কিংবা সূচিকর্ম নয়; এটা এত সুমার্জিত, এত ধীর-স্থির ও সুশীল, এত নম্র, দয়ালু, বিনীত, সংযত ও উদার হতে পারে না।’ কেন পারে না? তার উত্তর দিতে গিয়ে মাও জানিয়েছিলেন, ‘বিপ্লব হচ্ছে বিদ্রোহ―উগ্র বলপ্রয়োগের কাজ, যার দ্বারা এক শ্রেণি অন্য শ্রেণিকে পাল্টে দেয়।’

অনেকেরই মনে হতে পারে যে, অস্ত্রই বোধহয় এই বিপ্লবের প্রধান শক্তি। না, মোটেই তা নয়। কমরেড চারু মজুমদার খুব স্পষ্ট করেই জানিয়েছিলেন, ‘বিপ্লবী যুদ্ধের মাল-মসলা আমাদের তৈরি করতে হবে।’ সেই মাল-মসলা আদতে কী?―এর উত্তরে চারু মজুমদার বলেছিলেন, ‘এ মাল-মসলা ডিনামাইট নয়, বিস্ফোরক পদার্থ নয়, আগ্নেয় অস্ত্র নয়। বিপ্লবী যুদ্ধের প্রধান মাল-মসলাই হচ্ছে মানুষ।’ মানুষকে গুরুত্ব দিয়ে বিপ্লবকে এইভাবে বুঝতে পারাটা খুব সহজ নয়।

৩.

বিপ্লবের তাৎপর্য উপলব্ধি করা কঠিন, আর সেই কঠিন কাজটি করতে সমর্থ হয়েছিলেন সিরাজ সিকদার। তিনি তার ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলনের থিসিসে’ (৮ জানুয়ারি, ১৯৬৮) বলেছেন, ‘পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া ও সামন্তবাদীরা নিজেদের বিকাশের জন্য পাকিস্তানে যোগ দেয়। কিন্তু পাকিস্তানী উপনিবেশিক শ্রেণি পূর্ব বাংলার বুর্জোয়া বিকাশের জন্য যে সুবিধা প্রয়োজন তা নিজেদের বিকাশে ব্যবহার করে। ফলে এ-দেশে বুর্জোয়া বিকাশ ব্যাহত হয়। তাই বুর্জোয়া বিকাশের প্রয়োজনীয় অবস্থার সৃষ্টি অর্থাৎ সামন্তবাদ ও উপনিবেশবাদের অবসান প্রয়োজন।’

কীভাবে এর অবসান ঘটানো হবে, সে-সম্পর্কে বলতে গিয়ে সিরাজ সিকদার জানিয়েছিলেন, ‘সামন্তবাদের অবসান সম্ভব গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে এবং উপনিবেশিক শাসনের অবসান সম্ভব জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে। কাজেই পূর্ব বাংলার বিপ্লব হবে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব।’ অগ্রসর সর্বহারার নেতৃত্বে পরিচালিত এই বিপ্লবকে ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লব’ বা ‘নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করে সিরাজ সিকদার বলেছিলেন যে, এই বিপ্লব হবে সমগ্র ‘বিশ্ব বিপ্লবেরই একটি অংশ’।

সেইসঙ্গে তিনি মাওবাদী আদর্শকে এগিয়ে নিয়ে বলেছিলেন, ‘এ বিপ্লবের একটি চরিত্র হলো সশস্ত্র বিপ্লব।’ যা সম্পন্ন করতে হলে ‘সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করতে হবে।’

সিরাজ সিকদারের এই চিন্তার অগ্রসরতার প্রমাণ আমরা পেয়েছি একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের মধ্যে, যখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাকামী অংশটি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে, ঠিক তখন সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী গেরিলারা পেয়ারাবাগান অঞ্চলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করতে এতটুকুও দ্বিধা করেননি।

সিরাজ সিকদার চেয়েছিলেন, ‘শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে, সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে পাকিস্তানী উপনিবেশবাদ-বিরোধী সকল দেশপ্রেমিক শ্রেণির’ একটি ঐক্যফ্রন্ট। কিন্তু তার সে-স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যায়নি প্রধানত শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নতজানু নীতির কারণে। সে-কারণেই আমরা দেখতে পাই, ওই দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশের অভ্যন্তরে জনগণকে একত্রিত করে প্রতিরোধ যুদ্ধের বদলে, ভারত সরকারের নিরাপদ আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে অবস্থান করে, যুদ্ধটাকে অন্যদিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

৪.

এসবের পরিণতি আমাদের কারওর জন্যই, গোটা জাতির জন্যও, সুখকর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন অচিরেই ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। এমনটা যে ঘটবে, সেটি শুধু সিরাজ সিকদার ও তার দলের নেতাকর্মীরাই শুধু নন, যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত আরও অনেকেই সেই সময় অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। প্রয়াত বামপন্থী নেতা হায়দার আনোয়ার খান জুনো ও তাদের সংগঠন একাত্তরে দেশের অভ্যন্তরেই পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

তার সেই সময়ের স্মৃতিকথা ‘একাত্তরের রণাঙ্গন : শিবপুর’ গ্রন্থে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমরা যখন নরসিংদী মুক্ত করি, ভারতীয় বাহিনী তখন নরসিংদী থেকে অনেক দূরে।…টি. এন্ড. টি. ক্যাম্প দখল করে সেখানে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি।’ তিনি আরও লিখেছিলেন যে, ‘ক্যাম্প দখলের পর ভিতরে ঢুকে অস্ত্রের সম্ভার দেখে আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। ঘর বোঝাই হাল্কা ও ভারি মেশিনগান। থরে থরে সাজানো রকেট লাঞ্চার আর দুই ইঞ্চি মর্টার। অফুরন্ত গোলাগুলি আর গ্রেনেড। এত অস্ত্র আমাদের হস্তগত।’

এরপরই জুনো বলেছেন, ‘এই অস্ত্র আমরা দখলে রাখতে পারলাম না। কারণ অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা হেলিকপ্টার নামলো। তাতে ভারতীয় বাহিনীর কয়েকজন অফিসার ও সৈনিক। তারা আমাদের নরসিংদী মুক্ত করার জন্য ধন্যবাদ জানালেন এবং ঐ ক্যাম্পের দায়িত্ব তাদের হাতে ছেড়ে দিতে বললেন।’ এইভাবে শুধু একটি ক্যাম্পের দায়িত্বই নয়, গোটা দেশের দায়িত্ব সেদিন ভারতের হাতে ছেড়ে দিতে হয়েছিল। যার মাশুল আমাদের গত চুয়ান্ন বছর ধরে দিয়ে যেতে হচ্ছে। অথচ এসবের বিপরীতে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে সিরাজ সিকদার বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী, আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম কিছুতেই দাবিয়ে রাখতে পারবে না (শেখ মুজিব এই “দাবিয়ে” শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন ১৯৭১ সালের মার্চে)। ১৯৭০-এ পূর্ব বাংলার জনগণের যে গণযুদ্ধ শুরু হয়েছে তা দাবানলের রূপ নেবে ১৯৭১-এ। পূর্ব বাংলার গ্রামে-গ্রামে দাউ-দাউ করে জ্বলবে গণযুদ্ধের দাবাগ্নি। আর তাতে পুড়ে মরবে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার শত্রুরা, তাদের দালাল, বিভিন্ন আকৃতির সংশোধনবাদীরা।’

৫.

ইতিহাস সাক্ষী, কমরেড সিরাজ সিকদারের সেই ভবিষ্যদ্বাণীই পরবর্তী সময়ে সত্যি হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ের জাতীয়তাবাদী শক্তির আপস-নীতির কারণে গণযুদ্ধের সেই ফসল আমরা নিজেদের ঘরে তুলতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায়ভার স্বীকার করতেই হবে। মাও সে-তুঙ বলেছিলেন, ‘জনসাধারণের মধ্যে নিহিত রয়েছে বিরাট সমাজতান্ত্রিক সক্রিয়তা।’ আর সেই সক্রিয়তাকেই সিরাজ সিকদার একাত্তরে যুদ্ধে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। এ-রকম সজীব, অগ্রসর ও প্রাণবান কমিউনিস্ট নেতা বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে আর কখনও দেখা যায়নি।